September 20, 2024
ফিচার ৩মুক্তমত

অহল্যা’র শরীর অহল্যা’র মন

ক্যামেলিয়া আলম।। অহল্যা’কে চেনেন? এক হিন্দু পৌরাণিক চরিত্র। রামায়নে আছে, ব্রহ্মা যতগুলি মানসকন্যা সৃষ্টি করেছিলেন তার মাঝে সবচেয়ে সুন্দর, যাকে সোজা কথায় বলা যায় তিলোত্তমা ছিলেন এই অহল্যা। বলা হয়, স্বর্গের নর্তকী ঊর্বশীর রূপের দেমাগ খর্ব করতে ব্রহ্মার এই সৃষ্টি। এর অর্থ কী এমন দাঁড়াচ্ছে না যে, দেবতারও থাকে প্রতিশোধের ইচ্ছা! শুধু তাই ই না, তারা প্রতিহিংসা চরিতার্থ করতে এক নারীর বিকল্প আরেক নারী তৈরি করে ফেলেন। অনেকেই হয়তো ভাবছেন, চাঁদে মানুষের পা দেওয়ার কালে কী ভুজুং ভাজুং বকে যাচ্ছি। এইজন্যই বকছি যে, আমাদের মনস্তাত্ত্বিক বা ভাবজগৎ, তাতে আদ্যিকালের ব্লুপ্রিন্ট ছায়া হয়ে থাকে, তা বিজ্ঞান আমাদের বলছে।

যাক, যা বলছিলাম, অহল্যাকে বানিয়েই ব্রহ্মার ভয় শুরু ইন্দ্রকে নিয়ে। কাম আর প্রেমে কাতর এক দেবতা। তার হাত থেকে বাঁচাতে ব্রহ্মা বিশ্বাসী গৌতমমুণির কাছে পাহারায় রাখলেন। যৌবনবতী হলে গৌতমের কামনা জাগলেও ব্রহ্মাকে করা প্রতিজ্ঞায় অহল্যাকে সম্মানের সাথে ফিরিয়ে দেন। ব্রহ্মা এবার ঘোষণা দেন, সারা পৃথিবী পরিক্রমা করে যে সবার আগে আসবে তার সাথেই হবে এ বিয়ে। ইন্দ্র জিতে গেলেও বৃদ্ধ গৌতমের জ্ঞান, ধ্যান আর চরিত্রের সততায় তাঁর সাথেই দেন বিয়ে। দেবরাজ ইন্দ্রের খুব রাগ হল। আটঁলেন ফন্দি।

বৃদ্ধ গৌতম খুব ভোরে ধ্যানে যেতেন নিয়ম করে। সেই সুযোগে ইন্দ্র প্রেমে কামে ভরিয়ে তুললো অহল্যার জীবন। প্রেমের মাধুকরী স্পর্শে অহল্যার রূপ বেড়ে গেলে চোখে পড়লো গৌতমের। একদিন ধ্যানে যাবার নাম করে রইলো লুকিয়ে। ইন্দ্রের সাথে প্রেমরত অবস্থায় দরজায় এসে দাঁড়ালো মুণি। এরপর কী হল? উত্তাল এই প্রেমিকপ্রবর ভালোবাসার প্রেমিকাকে স্বামীর রোষানলে একা ফেলে পগার পাড়। পুরাণে আছে, সৎ চরিত্রবান স্বামীর অভিশাপে পাথর হয়ে কাটাতে হয়েছিলো অহল্যাকে বহুকাল।

এবার অহল্যাকে নিয়ে একটু বিশ্লেষণে যাই।

১. তাঁর রূপ (ব্রহ্মার ইচ্ছায়)

২. অহল্যার শরীর-মনের নিয়ন্ত্রকও ব্রহ্মা আর এরপর বৃদ্ধ স্বামী

৩. শরীরকে উপেক্ষা করতে না পেরে ইন্দ্রের সাথে জড়িয়ে পড়া। যদিও ধরা পড়ার পর সমাজের ভয়ে সেই সত্য প্রকাশ করতে সাহস না পেয়ে ইন্দ্রের প্রতারণার ফাঁদে পড়া অসহায় নারী সাজার ছলনা।

৪. অহল্যার শরীর আর মনের উপর স্বামীর একচ্ছত্র অধিকারের আধিপত্যে অহল্যার সাময়িক পাথর জীবন।

কাহিনী পৌরাণিক যুগের, কিন্তু আজও কাল্পনিক অংশটুকু বাদ দিলে সমাজে এমন উদাহরণ ভুরি ভুরি। একজন স্বামী ইমপোটেন্ট কিংবা সমকামী থাকলেও নারীর শরীরের উপর তার থাকে একক অধিকার। ধরে নিলাম, বিবাহ একটা চুক্তি। ফলে বৈবাহিক সম্পর্ক থেকে সরে এসেই তার অন্যের সাথে জড়ানো উচিত। তবে বাস্তবতা হল, যখন মেয়েরা এ কারণে সংসার ভাঙ্গতে যায়, সমাজে মেয়েটিকে নিয়ে চলে চাপা হাসাহাসি। আর সবচেয়ে বড় বাধা হয় তার সন্তানেরা।

আবার উল্টোটাও ঘটে। কোন নারীর ইচ্ছে ছাড়াই স্বামী শুধুমাত্র নিজের ইচ্ছেতে তাকে ব্যবহার করতে থাকে। বৈবাহিক ধর্ষণ নিয়ে মাত্র আমরা মুখ খুলতে শুরু করেছি। আমাদের এই সমাজে একজন নারীর শরীর আর মনের চাহিদাকে এতোটাই হালকাভাবে দেখা হয় যে, আশি বছরের কোন পুরুষের পাশে দিব্যি সংসার করতে পাঠিয়ে দেয় কিশোরীকে। বাল্যবিয়ে আর ধর্ষকের সাথে বিয়েকে স্বাভাবিক মনে করা হচ্ছে এই শতকে এসেও। আর তাইতো নারীর শরীরকে ঘিরে থাকে মতাদর্শ। সম্মান, লজ্জা, ধর্ষণের আদর্শিক বেড়াজালে নারীকে আটকে রাখা হয়। কোন নারী যদি একবার সেই বেড়াজাল ছিঁড়ে সামনে এগিয়ে আসে, তাকে ডাকা হয় বেশ্যা খানকি, যাদের তৈরি করাই হয়েছে পুরুষের শরীরের কথা ভেবে। অসুস্থ বা শারীরিকভাবে অক্ষম স্ত্রী ঘরে থাকলে কী করবে বেচারা স্বামী?

অথচ একজন নারীরও সুস্থ স্বাভাবিকভাবে বেঁচে থাকার অধিকার থাকা উচিৎ। অন্তত এই শতকে এসে। বায়োলজিক্যাল ট্রুথকে ইগনোর যত করা হবে ততই পারভার্শন বাড়তে থাকবে। অহল্যা’র জীবন আর কতদিন? সাহস আর সিদ্ধান্তই নতুন পথ দেখায়।

 

[ফেমিনিস্ট ফ্যাক্টরে প্রকাশিত মুক্তমত লেখকের নিজস্ব বক্তব্য]