September 20, 2024
ফিচার ৩মুক্তমত

মেয়ে কেন মায়ের পারলৌকিক কাজ করতে পারবে না?

সুদীপ্তা  ভট্টাচার্য্য রুমকি।।  আমার মায়ের মৃত্যুর পর আমাকে তার পারলৌকিক কাজ করতে বাঁধা দেয়া হয়েছে কারন আমি তার বিবাহিতা কন্যা! মায়ের চলে যাওয়া এতটাই বিনা নোটিশে ছিলো যে আমার কোন মানসিক প্রস্তুতি ছিলোনা। আমি প্রকৃতস্থ ছিলাম না কারণ আমার মা সুস্থ অবস্থায় কোন লক্ষণ ছাড়া হঠাৎ ইনস্ট্যান্ট কার্ডিয়াক অ্যারেস্টে এক মিনিটে আমাদের ছেড়ে যায়! ঐসময় ভয়াবহভাবে বিপর্যস্ত ছিলাম। যারা বাঁধা দিচ্ছে তাদের সাথে লড়বার জন্য যে শক্তি প্রয়োজন তাও আমার ছিলো না, কিন্তু ধর্মের নামে তারা আমাকে যে আঘাত করেছে তা আমি আমৃত্যু স্মরণে রাখবো!

শাস্ত্র দিয়ে তারা আমাকে আটকাতে পারতো না, তারা আমাকে আটকে ছিল প্রথা দিয়ে। শাস্ত্রে অবিবাহিতা মেয়ের পরে বাগদত্তা কন্যা, তারপরে বিবাহিতা কন্যার অবস্থান। তবে যদি সেই মেয়ে পুত্র সন্তানের জননী হয় তাহলে সে শ্রাদ্ধাধিকারী, তবে কন্যার জননী হলে নয়। মানে কোন মেয়ে যদি কন্যা সন্তানের জননী হয় এবং সে বাবা মায়ের একমাত্র কন্যাও হয় তবে সে শ্রাদ্ধাধিকারী নয়। কিন্তু আমার পুত্র থাকার পরেও তারা সেটা এড়িয়ে গেলো তাদের প্রথার জোরে।

আমাকে বলা হলো আমি যেহেতু বিবাহিতা তাই আমাকে মায়ের উদ্দেশ্যে দান করতে হবে তিন না চারদিনে ঠিক মনে নেই। আমি বিস্ময় নিয়ে প্রশ্ন করলাম আমার আজকের বেঁচে থাকা যেই বাবা মায়ের দান তার উদ্দেশ্যে দানের সামর্থ্য আমার কই। তিন দিনেরটা আমি মানতে চাইনি, আমি আমার মায়ের হাফ সন্তান নই যে এইটুক করেই ক্ষ্যান্ত দেবো! আমি ১১ দিনের শ্রাদ্ধ পর্যন্ত অশৌচকাল পালন করলাম, নিরামিষ খেলাম। উঠেপড়ে লেগেছিলাম আমি আমার মায়ের পারলৌকিক কাজ করতে চাই, যেভাবে একটা বড় ছেলে করে সেভাবে করার জন্য।

আমি মৃত্যুর পরের বিষয় অতশত বুঝিনা কিন্তু যা একটা ছেলের করনীয় তার মায়ের জন্য তা কেন আমার করণীয় হবেনা?

আমি সিজারিয়ান তার উপর সেভেন মান্থস বেবি ছিলাম মা বাবার। কি কষ্ট তাদের করতে হয়েছে আমাকে বড় করতে। সেভেন মান্থস বেবি খুব সহজ বিষয় না এখনো। সেই মায়ের জন্য আমি  কিছুই করতে পারিনি। মা আমাদের কাউকে কিছুই করার সুযোগ না দিয়েই চলে গেছে। তখন মনে হতো এগুলো করতে পারলেও হয়তো একটু শান্তি পাবো!

আমার মাথা কাজ করছিল না, শুধু মনে হচ্ছিলো আমার মা নিঃসন্তান নয়, তার অনেক ছেলের চেয়েও বেশি উচ্চশিক্ষিতা দুটি মেয়ে আছে। যাদের তিনি মানুষ হিসাবে গড়ে রেখে গেছেন, অশিক্ষিত, অপগণ্ড হিসাবে নয়।

আমার মা নিজেও উচ্চশিক্ষিতা ছিলেন; গোঁড়ামি,কুসংস্কার থেকে যোজন দূরে ছিলো তাঁর অবস্থান। যে নিজেই বলতো পরকাল নিয়ে চিন্তা করিনা তবে যার মেয়ে আছে, ছেলে নেই সেই মেয়েরা কেন বাবা মায়ের পারলৌকিক কাজ করতে পারবে না আমি বুঝিনা। বার বার বিভিন্ন পণ্ডিতের সাথে যোগাযোগ করা হলো, একজন যদি রাজি হয় পাঁচজন গররাজী।রাতে বাসায় যখন স্বনামধন্য আরেকজন আসলেন ইনি জোর গলায় বললেন, বাবাকেই করতে হবে মায়ের সেই কাজ। বাবা তখন এও বললেন, আজ আমাদের দুই পুত্র থাকলে কি আমার স্ত্রীর শ্রাদ্ধের কাজ আমাকে করতে বলতেন, না আমাদের পুত্রকে? বললেন, তখন পুত্রই করতো, যেহেতু আপনার পুত্র নেই তাই আপনাকেই করতে হবে, আর বিবাহিতা মেয়ে কোনভাবেই সেটা করতে পারবে না। সে তো গোত্রান্তরিত হয়ে গেছে। বাবা বললো, আমাদের  মেয়ের বিয়ে হয়েছে কিন্তু আমাদের সন্তান সে সেটা তো বদলে যায়নি! মন্ত্রবলে আমার মেয়ের ব্লাড গ্রুপ তো চেইঞ্জ হয়ে যায়নি! কোনভাবেই এদের বুঝাতে না বাবা পারলো, না আমি পারলাম!

আমার বাবার সেই কাজ করতে হয়েছে শেষ পর্যন্ত। তারা আমাকে বসতে দিলোনা তো দিলোই না, আমার অবিবাহিতা বোনকেও দিলোনা। আমার বোন বললো, দিদিভাই শক্তি নিয়ে তাদের সাথে তর্কে যেতে হবে তোর এখন সেই অবস্থা নেই। তুই যদি জোর করে করতে যাস আর এরা যদি তোকে দিয়ে সেটা না করায়, আরো বিশৃঙ্খলা হবে, তার চেয়ে বাবাই করুক। আমি বললাম এই মূহুর্তে যদি আমি রিট করে দেই হাইকোর্টে, এরা ফেঁসে যাবে, আফসোস আমি সেটাও পারছিনা। অথচ এই মানুষগুলো একবার ভাবলো না মায়ের আকস্মিকভাবে চলে যাওয়ার চাপটা বাবার উপর কতটুকু। আমরা সামবেদী, তাই আমাদের যেকোন কাজ অনেক সময়সাপেক্ষ। সেটা বিয়ে কিংবা শ্রাদ্ধ যেটাই হোক। এতটা সময় তারা বাবাকে মায়ের ছবির সামনে বসিয়ে একের পর এক নিয়ম পালন করিয়ে গেল উপোস রেখে, কিন্তু সন্তান হিসাবে সেটা আমাকে করতে দিলোনা। একটা বার ভাবলো না আমার বাবার মনের উপর দিয়ে কী যাচ্ছে।

আমি এক বছর সেটা নিয়ে ঘাটাঘাটি করলাম। আরো অনেকের সাথে কথা বললাম। মায়ের বাৎসরিকের সময় যিনি মেয়ে করতে পারবে না বলেছিলেন তার বদলে আরেকজনকে সেবার আনলাম, কিন্তু তিনি মেয়ে মেনে নিলেন, তবে অবিবাহিতা। বাৎসরিকেও একই নাটক- আমি করতে পারবোনা কোন কাজ। আমি বললাম দুই বোন বিবাহিতা হলে কে করতো? আমি উপোস করে আছি কিন্তু আমাকে করতে দেবেনা। আমার মেজ মামা এসে বললো তুই খেয়ে নে, তুই করতে পারবি না, নিয়ম নেই। আমি মামাকে চোখে জল নিয়ে  বললাম আমি বিবাহিতা তাই? তিনি বললেন হুম!

আমি মামাকে বললাম যদি শ্বশুরবাড়ি তাদের বাড়ির বউয়ের ভালোমন্দের খবর না রাখে, বউটি যদি তার বাবা মায়ের কারণে বেঁচে থাকে তখন? তিনি বললেন, তখনও মেয়ে করতে পারবেনা।

আমি তাকে বললাম মামা, যদি না মানি সেটা? আমি আমার বাবা মায়ের মেয়ে প্রথমে, তারপর কারো বাড়ির বউ। মেয়ের আগে আমি বউ নই মামা। মেজ মামারও মেজাজ গেল বিগড়ে, তিনিও বললেন, আয় তুই,করবি। আমি পুরোহিতকে বললাম, আপনি আমাকে একটু সাহায্য করুন প্লিজ, আমি কি অনৈতিক কিছু করতে চাইছি? আপনারা কেন আমাকে কিছু করতে দিচ্ছেন না? আমি কি মায়ের সন্তান নই! আমি মেয়ে বলে আমার সাথে আপনারা কেন বৈষম্য করবেন যেটা আমার মা বাবা কোনদিন করেনি! শাস্ত্রে তো নিষেধ নেই।ভদ্রলোক কী বুঝলেন কি জানি। আমরা দুই বোন বসলাম, তিনি আমাকে শুধু বললেন, মায়ের জন্য করবে সে তো ভালো কথা কিন্তু কোন মেয়েকে এমনভাবে করতে চাইতে দেখিনি, ঈশ্বর তোমাদের ভালো রাখুক। তোমাদের মা অবশ্যই ভালো থাকবেন ওপারে, এমনভাবে স্মরণ করার মত যার সন্তান আছে।

বাংলাদেশের হিন্দু মেয়েদের চেয়ে নারী হিসাবে ভারতের হিন্দু মেয়েরা অধিকারের দিক দিয়ে কতটা এগিয়ে আছে তা তাদের অধিকারের দিকে তাকালেই বোঝা যায়। সম্পত্তিতে অধিকার, পারলৌকিক কার্যাদির অধিকার, ভরণপোষনের অধিকার, নোংরা সম্পর্ক থেকে বেরিয়ে আসার অধিকার- সব আছে। কিন্তু আমাদের দেশে সুস্থভাবে বেঁচে থাকারও অধিকার পারিপার্শ্বিক কারণে হিন্দু মেয়েদের নেই। শাস্ত্রে যেগুলোর উল্লেখ আছে সেগুলোরও বাস্তবায়ন নেই এবং মাথামোটাদের এ নিয়ে মাথাব্যাথাও নেই।

 

[ফেমিনিস্ট ফ্যাক্টরে প্রকাশিত মুক্তমত লেখকের নিজস্ব বক্তব্য]