September 20, 2024
ফিচার ৩মুক্তমত

কার শরীর? কার সিদ্ধান্ত? 

সাদিয়া আফরিন।। আমার শরীর আমার সিদ্ধান্ত দুর্দান্ত এই নারীবাদী স্লোগানটি নিয়ে লেখার শুরুতেই দুজন নারীর কথা মনে পড়ছে, একজন ঢাকার শরীফা (ছদ্মনাম) ও অন্যজন ময়মনসিংহের নাজমা (ছদ্মনাম)। শরীফা ও নাজমার মত যত নারীর সাথে সন্তান, গর্ভধারণ ও পরিবার পরিকল্পনা বিষয়ক কথাবার্তা হয়েছে, শরীর ও সিদ্ধান্ত এই দুটো ইস্যুতে বৈচিত্রময় অভিজ্ঞতার সম্মুখীন হতে হয়েছে এবং একজন প্রজনন স্বাস্থ্য গবেষক হিসাবে এই টুকরো টুকরো অভিজ্ঞতাগুলো সবসময় আমার ভাবনাগুলোকে সমৃদ্ধ করেছে।

এক সকালে শরীফা দেখা করতে এলো। বয়স আনুমানিক ৩০ হবে। বেশ ইতস্তত শরীফা আস্তে আস্তে যা বললো তার সারমর্ম করলে দাঁড়ায়- সে গর্ভবতী এবং সে গর্ভপাত করতে চায়। কারণ হিসাবে জানালো তার চারটি সন্তান বর্তমান, তাদের ভরণপোষন করা স্বামীর জন্য বেশ কষ্টকর। এর আগে সে আরও তিনটি গর্ভপাত করিয়েছে। দরিদ্র সংসারে পর্যাপ্ত খাওয়াদাওয়া, যত্নের অভাব এবং বারবার গর্ভধারণের ফলে তার শরীর ভেঙ্গে পড়েছে। এরমধ্যে আরেকটি সন্তান সে নিতে চায়না। এতগুলো গর্ভধারণের কারণ হিসাবে সে জানায় তারা স্বামী-স্ত্রী কোনরকম জন্মনিয়ন্ত্রণ পদ্ধতি ব্যবহার করেনা। তার স্বামী তাকে কোন পদ্ধতি ব্যবহার করতে দেয়না এবং নিজেও কোন পদ্ধতি ব্যবহার করে না কারণ সে বিশ্বাস করে জন্মনিয়ন্ত্রণ পদ্ধতি ব্যবহার করা গুণাহের কাজ। একটি সন্তান আল্লাহর নেয়ামত, তাকে পৃথিবীতে আসতে বাধা দেয়া মানে পাপের ভাগী হওয়া। সে এও বিশ্বাস করে আল্লাহ সন্তান দান করেন, আল্লাহই তার দেখশোনার দায়িত্ব নেন এবং রিজিকের ব্যাবস্থা করেন। যদিও শরীফার স্বামীর চারটি সন্তান ভালভাবে প্রতিপালনের সামর্থ্য নেই, এই গর্ভের কথা জানলে সে শরীফাকে গর্ভপাত করতে বাধা দেবে, তাই সে স্বামীকে না জানিয়ে গর্ভপাত করতে চায়। এর আগেও সে স্বামীকে না জানিয়েই গর্ভপাত করিয়েছে, কিন্তু গর্ভপাত করার জন্য যে পরিমাণ অর্থ প্রয়োজন তা এই মূহুর্তে তার হাতে নেই। শরীফার অর্থ সহায়তা দরকার।

বিয়ের অল্প কিছুদিন পরই নাজমার মা এবং শ্বাশুড়ি বাচ্চা নেয়ার জন্য চাপ দিতে থাকে। তাদের যুক্তি- প্রথম বাচ্চা খুব তাড়াতাড়ি নিয়ে নিতে হয়, দেরি করে বাচ্চা নেয়ার জন্য খাবার বড়ি খেলে ‘বাচ্চাদানী’ জ্বলে যায় পরে বাচ্চা হতে সমস্যা হয়, এমনকি বন্ধ্যাত্বও দেখা দেয়। বিষয়টি নিয়ে স্বামীর সাথে আলাপ করে সে। স্বামী বললো একটা সন্তান হয়ে যাক, কয়েক বছর পর আরেকটি সন্তান গ্রহন করবে তারা। ষোড়শী নাজমা স্বামীর কথা মেনে নেয় কারণ স্বামী খাওয়াবে পড়াবে তার কথার উপর কি কথা বলা যায়! আমার সাথে যখন কথা হয় তখন নাজমা দুই কন্যা সন্তানের মা। উনিশ বছর বয়সী উচ্ছল নাজমার কাছে জানতে চাইলাম প্রথম সন্তান গ্রহণের পর পদ্ধতি ব্যবহার করনি কেন? সে বললো, “আপা, বয়স কম ছিলো কেউ আমাকে বলে নাই, আমিও বুঝি নাই। আর এখন তো পোলার লাইগা আরেকটা বাচ্চার নেয়ার জন্য চাপাচাপি শুরু করছে আমার স্বামী।”

আমার শরীর আমার সিদ্ধান্ত স্লোগানটিকে যদি এভাবে পড়ি ‘নারীর শরীর নারীর সিদ্ধান্ত’ তাহলে ভাবনা আসে এই স্লোগানের যে মর্মার্থ তা শরীফা ও নাজমার মতো নারীদের জীবনে কতটুকু কার্যকর? পাশ্চাত্যের এই নারীবাদী স্লোগানটি ব্যাখ্যা করে প্রতিটি নারীর তার শরীর নিয়ে সিদ্ধান্ত নেবার এবং সেই অধিকার অর্জনের জন্য সব ধরণের সেবা পাবার অধিকার রয়েছে, সে সন্তান জন্মদানের ক্ষেত্রেই হোক আর গর্ভপাত করার ক্ষেত্রেই হোক। মূল প্রশ্ন হলো এই বিষয়টি বাংলাদেশের কতজন নারীর উপলব্ধির আওতায় রয়েছে এবং কতজন নারীর এই অধিকার আদায় করার সামর্থ্য রয়েছে যখন দেশের ৫০ শতাংশ বিয়ের কনের বয়স ১৮ বছরের নীচে এবং বাংলাদেশের মোট মাতৃত্বের ২৮ ভাগ দখল করে আছে কিশোরী মেয়েরা। এই বিবাহিত কিশোরীরাসহ ঠিক কতজন নারী যৌন ও প্রজনন স্বাস্থ্য এবং অধিকার সম্পর্কে জেনে দাম্পত্য সম্পর্কে প্রবেশ করে যেখানে দারিদ্র্য, শিক্ষার অভাব, শ্রেণি ও লিঙ্গীয় বৈষম্যের মত সামাজিক উপাদানগুলো ভিন্ন ভিন্ন প্রেক্ষাপটে নারীর প্রজনন স্বাস্থ্যকেন্দ্রিক অভিজ্ঞতাকে প্রতিনিয়ত প্রভাবিত করে?

নারীর শরীর নারীর সিদ্ধান্ত না হওয়ার একটি সামাজিক প্রেক্ষাপট রয়েছে। যে প্রেক্ষাপটে শুধু যৌন ও প্রজনন স্বাস্থ্যের ক্ষেত্রেই নয়, নারীর শরীরের উপর যে কোন ধরণের আরোপনই সামাজিকভাবেই বৈধ হয় এবং এই বৈধতাদানের প্রক্রিয়া খুবই নিয়মতান্ত্রিক (systematic)। এই প্রক্রিয়ায় প্রতিনিয়ত প্রতিষ্ঠিত হয় নারীর শরীর আসলে তার নয়, সুতরাং সিদ্ধান্তও তার নয়। নারীর শরীর ও এ-সম্পর্কিত দৃষ্টিভঙ্গিকে একটি কাঠামোর প্রতিফলন হিসাবে দেখতে হবে, আর সে কাঠামোটি হচ্ছে পিতৃতান্ত্রিক সমাজ কাঠামো। কাঠামোর অংশ হিসাবে আমরা আমাদের বিহেভিয়ার প্যাটার্নের একটা বড় জায়গা জুড়ে স্থান দিয়েছি নারীর শরীরের উপর নানাবিধ সমাজ-সাংস্কৃতিক অনুশাসন ও মূল্যবোধ আরোপ করা এবং তার অনুমোদন দেয়া। আমরা প্রতিনিয়তই এটি করে থাকি। যেমন, আমরা চেনাজানা কাউকে খুব সহজেই বলি “ইশ বেশ মুটিয়ে গেছো। চেনাই যাচ্ছে না। স্বাস্থ্য কমাও।” আবার স্বাস্থ্য ভালো এমন অপরিচিত কাউকে দেখে ফিসফাস করি “আল্লাহ কি ধুমসী গো!” চিকিৎসকের চেম্বারে বসে থাকতে থাকতে বিরক্ত হয়ে পাশের অচেনা নারীটির কাছে জানতে চাই “বাচ্চা কয়টা আপনার? ওমা এত বছরের বিয়ে এখনও বাচ্চা নেননি কেন? কোন সমস্যা?” আমরা ধরেই নেই নারীর শরীর অবধারিতভাবেই একটি সন্তান উৎপাদন যন্ত্র এবং আমাদের সামাজিক দায়িত্বই হলো নারীকে এ সম্পর্কিত বিষয়ে জ্ঞান দান করা। ফলে কেউ সন্তান গ্রহণ করতে না চাইলে কিংবা একটি সন্তান গ্রহণ করতে চাইলে আমাদের নানা রকম মন্তব্য চলতেই থাকে। এমনকি দুটির বেশি তিনটি সন্তান কারো আছে শুনলেও চোখ আকাশে তুলে আমরা বলে ফেলি “বোকা নাকি মেয়েটা, এই যুগে তিনটা বাচ্চা?” লক্ষ্য করার মত বিষয় হলো শরীর, প্রজনন স্বাস্থ্য ও সন্তান এই সমস্ত আলোচনার মূল কেন্দ্রে সবসময় থাকে নারী এবং সবক্ষেত্রে নারীকেই প্রশ্নের সম্মুখীন হতে হয়, পুরুষকে নয়।

নারীর সন্তান গ্রহণকেন্দ্রিক আলোচনার বাইরে আমাদের আরেকটি নিয়মিত ভাবনার বিষয় হলো নারীর পোশাক। “কেমন মেয়ে গো এমন ছোটখাটো পোশাক পরে বাইরে গেলো, লোকে তো হা করে তাকাবেই!” “ধর্ষণ হবেনা, আজকাল যা পোষাক পরে মেয়েরা!” এভাবে সবক্ষেত্রে নারীর ভাবনাকে উপেক্ষা করে আমরা নারীর শরীরের উপর সামাজিক আরোপনকে পোক্ত করি এবং এর পেছনের পিতৃতান্ত্রিক সমাজ মনস্তত্বকে প্রতিষ্ঠিত করি। এই সমাজ মনস্তত্ব একদিনে তৈরি হয়নি। দীর্ঘদিনের চিন্তা, চর্চা, অভ্যাস সুসংগঠিত হয়ে আজকের পর্যায়ে এসেছে। এই কাঠামো যে শুধু নারীর শরীরের উপর আরোপন করেই খালাস তা কিন্তু নয় পুরুষের শরীর নিয়েও এটি সচেতন এবং এটি নারীর পাশাপাশি পুরুষের শরীর কেমন হবে তাও ঠিক করে দেয়। বিদ্যমান কাঠামোর ব্যবস্থাপত্র নির্ধারন করে নারী ও পুরুষের শরীর দেখতে কেমন হবে। যে কারণে নারীর জিরো ফিগার যেমন এই সমাজের আকাঙ্ক্ষিত শরীর কাঠামো, পুরুষের ক্ষেত্রে তেমনি সিক্সপ্যাক। বলাই বাহুল্য এই ভাবনা অবধারিতভাবেই একটি বৈপরীত্যকে ধারণ করে। যেমন, নারীর শরীর হবে কোমল, হালকা-পাতলা (স্লিম) এবং পুরুষের বলিষ্ঠ, সুঠাম। নারীর শক্ত হাত কেমন “ব্যাটা ব্যাটা”, অগ্রহণযোগ্য, পুরুষের ক্ষেত্রে তেমনি নরম। আবার একই ব্যবস্থায় থেকে প্রেক্ষিতভেদে নারীর শরীরের ধারণা ভিন্নও হয়। যেমন, পল্লীগ্রামে স্বাস্থ্যহীন নারী সংসারের অনুন্নতির পরিমাপক। তাই বলতে শুনি, “কি গো তোমার স্বামী কি ভাত খাইতে দিতে পারেনা? এত শুকনা ক্যান শরীর।”

উপরিউক্ত ভাবনাগুলো যতটা না শারীরবৃত্তীয় তারচেয়ে বেশি এটি একটি ব্যবস্থার নির্মাণ। এটি প্রতিনিয়ত পুননির্মিত হয়, বিস্তৃত হয় আমাদের প্রাত্যহিক চর্চার মাধ্যমে। পুঁজিবাদী বাজার ব্যবস্থা এবং মিডিয়ার পরিবেশনা এর সাথে গুরুত্বপূর্ণভাবে সম্পর্কিত। পুঁজি ও ভোগবাদী সমাজে সকল কিছুই যেহেতু পণ্য, সেহেতু নারীর শরীর এর বাইরে নয়। কী করলে নারী এই ব্যবস্থার কাঙ্ক্ষিত নারী হয়ে উঠবে সে প্রচারণায় পুঁজিবাদী প্রচারমাধ্যম বিশ্বস্ত বন্ধুর ভূমিকা পালন করে চলে।

সুতরাং একটি স্বতন্ত্র নারীবাদী স্লোগান, নির্দিষ্ট করে বলতে গেলে পশ্চিমা পুঁজিবাদী উদার নারীবাদী স্লোগান হিসাবে ‘আমার শরীর আমার সিদ্ধান্ত’ যখন নারীর শরীরের সার্বভৌমত্ব, অধিকার ও পছন্দের কথা বলে তখন একে একটি শ্রেণি নির্দিষ্ট (মধ্য ও উচ্চবিত্তের নারী যাদের নারীবাদ সম্পর্কে জানাশোনা আছে) ভাবনা হিসেবে বুঝতে চাই আমি। কেননা দরিদ্র ও শ্রমজীবী নারীর জন্য শরীরের সার্বোভৌমত্বের চাইতেও বেঁচে থাকার অন্যান্য সংগ্রাম হয়তো জরুরি যা মধ্য ও উচ্চবিত্তের চিন্তার বাইরে। আমি মনে করি, এই স্লোগানটি ঠিক তখনই কার্যকর নারীবাদী আন্দোলনে পরিণত হবে যখন এটি শ্রেণি নির্বিশেষে সকল নারীর স্বতন্ত্র অধিকার ও সার্বভৌমত্বের বিষয়টিকে ধারণ করতে পারবে। সমাজে বিদ্যমান লিঙ্গীয় অসমতা, অমর্যাদা, অর্থনৈতিক শোষণ-বঞ্চনার যে প্রেক্ষাপট জারি আছে তাকে বজায় রেখে, শুধু নারীর শরীরের সার্বভৌমত্ব ও অধিকার অর্জনের আন্দোলন হবে খণ্ডিত কিংবা শ্রেণি নির্দিষ্ট (for privileged groups)। কেননা এমন এক প্রেক্ষাপটের মধ্যে আমরা বসবাস করি যেখানে নারী শ্রেণি নির্বিশেষে শোষণ-বঞ্চনার শিকার তার লিঙ্গীয় পরিচয়ের কারণেই। ফলে আমাদের বিদ্যমান প্রেক্ষাপট বিবেচনায় রাখতে হবে, ভাবতে হবে কোন পন্থায় প্রেক্ষিতভেদে নারীর ভিন্ন ভিন্ন অধিকারের ইস্যুগুলোকে একাত্ম করা যায় যেখানে নারীর শরীর নারীর সিদ্ধান্ত ন্যায্যতার ভিত্তিতে অন্যান্য অধিকারের মতোই সার্বজনীন হিসাবে স্বীকৃতি পাবে। আর তা করা সম্ভব না হলে এই স্লোগানটি হয়তো শ্রেণি নির্দিষ্ট একটি নারীবাদী দৃষ্টিভঙ্গী হিসাবেই বাংলাদেশের নারীবাদী ইতিহাসে টিকে থাকবে।

 

[ফেমিনিস্ট ফ্যাক্টরে প্রকাশিত মুক্তমত/কলাম লেখকের নিজস্ব বক্তব্য]