November 2, 2024
সাহিত্যফিচার ২প্রবন্ধ

নারী নেতৃত্বের গোপন অস্ত্র: আইকিউ না ইকিউ? [পর্ব – ০১]

ক্যামেলিয়া আলম।। ছেঁড়া টুকরো কাপড় কারো নাম হয়? অবাঞ্চিত মনে করা মেয়েটির নাম তার পরিবার দিলো ‌ছিন্ধি (ছেঁড়া টুকরো কাপড়)। ভারতের মহারাষ্ট্রের মেয়ে। মাত্র দশ বছর বয়সে বিয়ে হয় ৩০ বছর বয়সী এক গোচারকের সাথে। ছিন্ধির পুরো নাম ছিল সিন্ধুতাই সাপকাল। ২০ বছর বয়সে তিন ছেলে জন্ম দেবার পর আবারও সন্তানসম্ভবা। এই সময়ে এক ঘটনার সাথে জড়িয়ে যান। স্থানীয় এক প্রতাপশালী গ্রামবাসীদের ঠকিয়ে পারিশ্রমিক ছাড়া শুকনো গোবর সংগ্রহ করে বনদপ্তরের সাথে যোগসাজশ করে বিক্রি করছিলেন। সিন্ধুতাই তার বিরুদ্ধে এমন আন্দোলন করেন যে জেলা শাসক এসে তদন্ত করতে বাধ্য হন। আর আদেশ জারি করেন দরিদ্র গ্রামবাসীদের পক্ষে। এতে ক্ষুব্ধ হয়ে সেই লোক তার স্বামীকে প্ররোচিত করলে স্বামী ৯ মাসের গর্ভকালীন সময়ে এমন বিভৎস মার মারেন যে সে জ্ঞান হারালে মৃত ভেবে গোয়ালঘরে ফেলে আসেন পরে মাটি চাপা দেবে ভেবে। সেই রাতেই জন্ম নেয় এক মেয়ে।

‌“গোয়ালে সন্তান জন্ম দিলাম। মেয়ের নাড়ি পড়ে আছে দেখে নিজেই পাথর দিয়ে তা কাটলাম। তারপর আত্মীয় স্বজনের দুয়ারে দুয়ারে গেলাম, মায়ের কাছেও গেলাম। কেউ আশ্রয় দিল না। সবাই তাড়িয়ে দিয়েছিল আমাকে।”

নামই টুকরো কাপড়, সমাজের চোখে সে ফেলে দেয়া কীট ছাড়া আর কী? ভিক্ষে করে মেয়ে আর তার পেট চলতো। রাতে ঘুমাতো গোরস্তানের ভেতর। আর মৃতদের পাশে দিব্যি ঘুমকে কেন্দ্র করে তাকে সবাই ভয় পেত বলে কেউ তার ছায়াও মাড়াতো না। সেই কঠিন সময়ে চারপাশে তাকিয়ে দেখেন তার মতো অসংখ্য অনাথ।পাশের জনকে না দিয়ে খেতেও পারেন না। বাড়তে থাকে আশ্রয়হীন অনাথের সংখ্যা। এত মুখ আর সে খেতে দিতে পারে না, নিজে খেতে পারে না, মেয়েও মরোমরো না খেতে পেয়ে। ধৈর্য্য হারিয়ে একদিন মেয়েকে নিয়ে ট্রেনের নিচে পড়বে বলে সিদ্ধান্ত নেয়। সেই সময়ে সে রেললাইনের পাশে কাতর কান্না শুনতে পেয়ে গিয়ে দেখে এক ভিক্ষুক জ্বরে পুড়ে যাচ্ছে । মরার চিন্তা বাদ দিয়ে লেগে পড়েন সুস্থ করতে। মানুষটির প্রাণ বাঁচান। তখন তার মনে হয়, পরের জন্য করতে পারাটাই জীবনের আসল কাজ।

মন শান্ত করে মেয়েকে দিয়ে দেন পুনের এক ট্রাস্ট ফাউন্ডেশনে। এরপর শুরু হয় অনাথদের জন্য লড়াই। ভিক্ষে করে, গান গেয়ে, বক্তৃতা করে ঘুরতে থাকেন গ্রামে গ্রামে। মোটিভেট করে করে পয়সা সংগ্রহ করে গড়ে তোলেন একে একে ৬টি আশ্রম। তিনটি ছেলেদের, তিনটি মেয়েদের। রেল স্টেশন, পরিত্যক্ত আস্তাকুঁড়, আবর্জনার স্তুপ, এমনকি রাস্তার কুকুরের মুখ থেকেও শিশুদের উদ্ধার করে নিয়ে আসেন আশ্রমে। এভাবে প্রায় ১৫’শ বাচ্চার মা এই ছিন্ধি কখন যে হয়ে যান সিন্ধু। শুধু আশ্রয় দিয়েই থামে না তার পথ, তাদের মানুষ করার দায়িত্ব নেন। কেউ যেন খারাপ পথে পা না দেয়, নষ্ট না হয়ে যায়, সেদিকেই বরং তাঁর মনোযোগ বেশি। ১৮ বছরের বেশি অধিকাংশ এতিমখানায় আশ্রয় দেয়া হয় না। তাঁর মতে, তখনই আসলে ছেলে-মেয়েদের পারিবারিক আশ্রয় বেশি দরকার। ওই সময়ই মানুষ বেশি দ্বিধাগ্রস্ত থাকে, হতাশায় বেশি আক্রান্ত হয়। তাই সত্যিকারের পরিবারের মতো প্রতিষ্ঠিত হয়ে নিজের পায়ে না দাঁড়ানো পর্যন্ত কেউ তাঁর আশ্রম ছেড়ে যায় না। বাচ্চাদের লালন পালন, পড়ানো, বিয়ে দেয়ার কাজও সিন্ধু করে গেছেন। তাদের অনেকেই আজ সমাজে প্রতিষ্ঠিত। হয়েছেন ডাক্তার, অধ্যাপক, আইনজীবী। সিন্ধুতাইয়ের নিজের মেয়ে মনোবিজ্ঞান থেকে অনার্স, সমাজকর্ম থেকে মাস্টার্স পাস করে এখন মায়ের পাশে এসে দাঁড়িয়েছেন অনাথের সেবায়।

বাস্তবের এই কাহিনী মহানুভবতার ঘটনা হলেও তা বলার উদ্দেশ্য ভিন্ন। সাইকোলজির একটা টার্ম আছে, ইমোশনাল ইন্টেলিজেন্স। নিজের আবেগ বা মনোভাবের পাশাপাশি অন্যেরটা বুঝতে পারার ক্ষমতা হল ইমোশনাল ইন্টেলিজেন্স। তিনটি দক্ষতা দিয়ে একে বোঝা যায়:

১. আবেগজনিত সচেতনতা

২. আবেগ ব্যবহার করে বিভিন্ন ধরনের সমস্যা সমাধান

৩. আবেগ নিয়ন্ত্রণ করে নিজেকে ও অন্যকে উৎসাহিত করা

আরও সহজ করে বলা যায়, ব্যাক্তির সেই মানসিক সামর্থ্য, যার মাধ্যমে ব্যাক্তি নিজেকে সুন্দরভাবে ম্যানেজ করতে পারে, আশেপাশের অন্যান্যদের সাথে সফলতার সাথে আচরণ করতে পারে, অন্যকে মোটিভেট করতে পারে আর প্রতিদিনের পরিবেশ ও পরিস্থিতিতে যথার্থভাবে সাড়া দিতে সমর্থ হয়। এই বিশেষ গুণগুলো তাদের থাকে যারা ইমোশনাল ইন্টেলিজেন্ট। গবেষণায় দেখা গেছে, পুরুষের চেয়ে নারীদের ইমোশনাল ইন্টেলিজেন্স অপেক্ষাকৃত বেশি। পরিবার বলি আর সংগঠনই বলি, তা শুধু টিকে থাকাই না, উন্নত থাকে টেকসই পদক্ষেপের কারণে।

এ কথা অস্বীকার করার উপায় নাই আজ, যুগ যুগ ধরে পরিবার নামক সংগঠন টিকে থাকছে নারীদের চেষ্টা ও সামর্থ্যের উপরে। স্বাভাবিক সময়ই না, নানা দুর্যোগেও নারী একজন পুরুষের চেয়ে অনেক বেশি শ্রম দিয়ে, পুরুষের চেয়ে অনেক বেশি বাধা পেরিয়ে পরিবারকে রক্ষা করে। পরিবারের সদস্যদের যে কোন বিপর্যয়ে পাশে থেকে সংকট দূর করায় তাদের জুড়ি নেই। বাংলাদেশের মেয়েদের সংসারে কাজের সময়ের এক হিসাব দেবার ইচ্ছে সামলাতে পারছি না। এই হিসাব আমার বা কোন নারীর মনগড়া না, সিপিডি বলে যে গবেষণা প্রতিষ্ঠান আছে তাদের ২০১৩-১৪ অর্থবছরের এক হিসাব। গৃহস্থালী কাজে এ দেশের নারীর বছরে ব্যয় হয় ১৬ হাজার ৬৪১ কোটি ঘন্টা, যার আর্থিক মূল্য ২ লাখ ৪৯ হাজার ৬১৫ কোটি টাকা। আমাদের জাতীয় আয়ে এই কাজের মূল্য ধরা হলে তার বার্ষিক মূল্য হতো জিডিপি’র ৭৬.৮ শতাংশ। যদিও নারী পুরুষের তুলনামূলক আলোচনা আমার লেখার লক্ষ্য না, নারীদের কেবল জানাতে চাই যে, কোনো পরিবার রক্ষা আর গঠনে তারা কতটা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখার পরেও পরিবারেই নারীর অবস্থানকে গুরুত্বহীন করে রাখার প্রবণতা চলে।

এবার আসি পাবলিক সেক্টরে। করোনাকালীন দূর্যোগ মোকাবেলায় সফল দেশগুলোর শীর্ষে তাকালে কী দেখি? নিউজিল্যান্ড, তাইওয়ান, নরওয়ে, জার্মানি, ফিনল্যান্ড, আইসল্যান্ড, ডেনমার্ক, সিঙ্গাপুর, হংকং- দেশগুলোর প্রতিটিতে নারী নের্তৃত্ব। এমনকি বিশ্বে নারী নির্যাতনে ২য় স্থান অধিকারী এই বাংলাদেশও করোনা মোকাবেলায় যথার্থ ভূমিকা রেখে যাচ্ছে নের্তৃত্বের গুণে, যা আমার কোন কল্পনাপ্রসূত ধারণা না, ফোর্বস ম্যাগাজিনের তথ্যমতে। হ্যা সত্যি যে, এদেশের স্বাস্থ্য খাত বিপর্যস্ত, আক্রান্ত যা হচ্ছে তার সরকারি হিসাব যথার্থ নয়। এরপরেও এই শংকর জাতিভুক্ত দেশে সংকট মোকাবেলায় একজন সরকার যতটা উপযোগী ও কার্যকর নীতি নির্ধারণ করে এমন এক মহামারী মোকাবেলা করছে তা অবশ্যই প্রশংসার দাবি রাখে।

পাবলিক সেক্টরের কাজ নারীর জন্য বহুদিন নিষিদ্ধ করা ছিল। নারী একসময় তা মেনে নিতে অস্বীকার করে। কিন্তু যখন বিপ্লব, অর্থনৈতিক ও সংগঠন পরিচালনার কাজে জনসংখ্যার অর্ধেক অংশ এই নারীকে পাশে নেবার প্রয়োজনীয়তা অনুভূত হয়, তখন থেকে নারীরা আবার সক্রিয় হয় বাইরের কাজগুলোয়। আর সেখানে তারা দক্ষতাই শুধু অর্জন করে না, সফলতা দেখাতে শুরু করে প্রতি ক্ষেত্রে। কৃষি, শিল্পের ক্ষুদ্র শ্রমিক হিসেবে নিজেদের অবস্থান তৈরি করার অল্প সময়ের ব্যবধানে নীতি নির্ধারণ ও পরিচালনায় বিস্ময়কর সফলতা দেখাতে শুরু করে। দেখা গেছে, যে সংগঠন পরিচালনায় নারী কোন নির্বাহী থাকে, সেই সংগঠনে কর্ম পরিবেশ থাকে পুরুষ পরিচালিত সংগঠনের চাইতে অনেক বেশি কো অপারেটিভ। আর নিজ উদ্যোগে যখন কোন প্রতিষ্ঠান পরিচালিত হয়, সেই প্রতিষ্ঠানটিতে যদি নারীকে সহায়ক শক্তি হিসেবে পা‌ওয়া যায় সেই প্রতিষ্ঠানের আর্থিক ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ খুবই কম। ফলে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে যেমন, তেমন উদ্যোক্তা হিসেবে নারী বর্তমান পৃথিবীতে আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে আসছে। দ্য পাইপলাইনের প্রতিবেদনে, লন্ডনের তালিকাভুক্ত যেসব কোম্পানির নির্বাহী কমিটিতে নারী নেই সেসব কোম্পানির নেট প্রফিট মার্জিন ১.৫ শতাংশ। অথচ যেসব প্রতিষ্ঠানের নির্বাহী কমিটিতে কমপক্ষে তিন ভাগের এক ভাগ নারী সেসব প্রতিষ্ঠানের নেট প্রফিট ১৫.২ শতাংশ। (সূত্র; ফেমিনিস্ট ফ্যাক্টর; খবর বিবিসির)। ফোর্বসের এক তথ্যমতে, এফবিআই’য়ের সাম্প্রতিক রিপোর্টে এজেন্ট হিসেবে, পরিচালক হিসেবে নারীদের কর্মকুশলতায় পুরুষের চাইতে এগিয়ে যাওয়ার বিষয়টি রীতিমতো আলোচনায় আসছে।

এবার যাই সেই রহস্য উন্মোচনে, দক্ষতা, অভিজ্ঞতায় প্রায় হাজার বছর পিছে থাকা নারীরা কী গুণ দিয়ে তার অবস্থানের ইতিবাচক পরিবর্তন আনছে। এখানে আরেকটি বিষয় বলে নেয়া ভালো- দক্ষতায় আর কাজে সব পুরুষই যে পেছানো আর সব নারীই যে সফল হচ্ছে তা কিন্তু না। আবার পুরুষেরা এখনও রাজনৈতিক, সামাজিক, অর্থনৈতিক প্রতিষ্ঠানে নারীদের চাইতে সংখ্যায় অনেক বেশি। ফলে নারীর কাংখিত সাফল্য অর্জনের পথ এখনও মসৃণ না। এবার যাবো পরের আলোচনায়।

(চলবে)