September 20, 2024
ফিচার ৩মুক্তমত

এই সমাজে নারী যখন প্রতিবাদী…

তৌকির ইসলাম।। দুইজন টগবগে যুবক রিকশা দিয়ে যাচ্ছিলেন। রিকশাওয়ালা মামা অন্যায়ভাবে ৫০ টাকার ভাড়া ৮০ টাকা দাবি করলেন। ফলশ্রুতিতে কথা কাটাকাটি এবং যুবকদের একজন মামাকে ধাম করে মেরে বসলেন। পাশে থাকা সাধারণ জনগণ যুবকদের বীরত্বে বাহ বাহ করছে আর রিকশাওয়ালা মামার যে অন্যায় হয়েছে তা বারংবার উচ্চারণ করছে। সমাজের খুব কমন চিত্র এটি। হয়তো বাহবা দেওয়া জনগণের ভিড়ে আমি আপনিও আছি। কিন্তু ঘটনাটি যদি এমন হতো রিকশাওয়ালা মামার যাত্রী দুইজন তরুণী। মামার অশালীন কোন আচরণে (পড়ুন যৌন বিকারগ্রস্ত মন্তব্য অথবা অশ্লীল অঙ্গভঙ্গি) তরুণীদের একজন মামাকে মেরে বসলেন এক চড়। এবার জনগণের কাতারে তাকাই। বর্তমান আধুনিক যুগের মেয়েদের খারাপ বলার জন্য কী কী যুক্তি আছে আর পৃথিবী যে কেন দিন দিন ধ্বংসের দিকে যাচ্ছে তার হাজারো ব্যাখ্যা আপনি শুনতে পাবেন। কিন্তু বিচারিক দৃষ্টিতে মামার পরের অপরাধটি বেশি ঘৃণিত এবং শাস্তিযোগ্য বেশি।

জন্মের পর থেকে সমাজ নারীকে নম্র, শান্ত, অবলা, নরম হিসেবে বিবেচনা করতে বেশি অভ্যস্ত। কিন্তু বাস্তবিক অর্থে একজন পুরুষ স্বভাবে নরম এবং শান্ত প্রকৃতির হতে পারে এবং একজন নারী হতে পারে কঠোর প্রকৃতির। তার মানে আমি এটা বলছি না যে নারী নরম, শান্ত প্রকৃতির হতেই পারবে না। আমাদের এই সমাজ নারীর প্রতিবাদকে মেনে নিতেই পারে নি। আপনি যদি একটু খেয়াল করেন দেখতে পাবেন প্রতিবাদ করার ক্ষেত্রে সমাজে পরোক্ষ লিঙ্গ বৈষম্য রয়েছে। লিঙ্গ বৈষম্য দেখাতেই আমি উপরের উদাহরণটি টেনে এনেছি। একজন পুরুষের প্রতিবাদকে সমাজ যেভাবে বীরত্বের ব্যাপার মনে করে ঠিক তেমনই একজন মেয়ের প্রতিবাদকে সমাজ বীরত্ব ভাবে না। আর সমাজের এই দ্বিচারিতাই সমাজে নারীর প্রতি সহিংসতার অনেকগুলো কারণের একটি। নারীর প্রতি অন্যায় আচরণকে পরিবার তথা সমাজ মুখ বুজে সহ্য করতে অভ্যস্ত করে। নারী যদি অন্যায়ের প্রতিবাদ করে তবে সর্বপ্রথম নারীর চরিত্রের উপর দোষারোপ করা হয়। কিন্তু প্রতিবাদ করা যে পুরুষের মত নারীরও অধিকার তা আমরা এক রকম ভুলেই গেছি। কিছু কিছু পরিবার নারীর প্রতিবাদকে স্বাগত জানালেও সমাজ সেইসব পরিবারকে আরও বেশি দূরে ঠেলে দেয়।

একজন প্রতিবাদী নারীকে সমাজ না মেনে নেওয়ার কারণ হলো বিচার ব্যবস্থায় নজিরবিহীন লিঙ্গ বৈষম্য। একটা বাস্তব উদাহরণ দেই। আমাদের দেশের গ্রামাঞ্চলে যতগুলো সালিশজনিত বিচার ব্যবস্থা দেখবেন সেখানে আপনি পুরুষের কোন শাস্তি দেখতে পাবেন না। হয় দেখবেন নারীকে গাছে বেধে রাখা হয়েছে, নারীর পুরো পরিবারকে একঘরে করা হয়েছে। অভিযোগ ছিল নারীপুরুষ দুইজনের বিরুদ্ধেই কিন্তু শাস্তি পাচ্ছে নারী। এমন কি একজন নারী বিচারকের রায় মেনে নিতেও নারাজ থাকেন কোন কোন পুরুষ অপরাধী। আর তার একটা বড় প্রমান হলো এসব গ্রাম্য সালিশে আপনি সচারাচর কোন মহিলা ইউপি সদস্যের উপস্থিতি দেখতে পাবেন না, আর যদি দেখে থাকেনও দেখবেন তিনি নির্বিকার। আমাদের এই সমাজে একজন নারীকে চরিত্রের দোষ দিয়ে পার পেয়ে যাওয়া যায়।

স্বামীর নির্যাতনের প্রতিবাদ করলে নারী সাংসারিক না; শ্বশুরবাড়ির নির্যাতনের প্রতিবাদ করলে নারী বেয়াদব; সমাজের অসঙ্গতির বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করলে নারী উচ্ছৃঙ্খল; যৌন নির্যাতন তথা ধর্ষণের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করলে নারী অশালীন ইত্যাদি। সমাজের লালিতপালিত এসব ট্যাগ লাইনের বাইরে আমাদের পরিবারগুলো নয়। পরিবারও নারীকে প্রতিবাদ করতে বাধা দেয়। এমনকি প্রতিবাদস্বরূপ নারীর উচ্চস্বরে কথা বলাও বারণ। আর এভাবেই নারীর ভেতরকার সাহসকে ধ্বংস করা হয়। নারীর ভেতরের মানুষ সত্তাকে হত্যা করা হয়। কিন্তু একজন প্রতিবাদী নারী আমার দৃষ্টিতে বর্তমান সামাজিক প্রেক্ষাপটে বেশি জরুরি। একজন হোমমেকার  হোক কিংবা একজন কর্মজীবী নারী, নারীর উপর দায়িত্ব তুলনামূলকভাবে বেশি। যার উপর দায়িত্ব বেশি তার জন্য সমাজের চলার পথটা সহজ হওয়া প্রয়োজন আর সহজ চলার পথ তৈরি হবে নারীর প্রতিবাদের যথাযথ মূল্যায়নের মাধ্যমে। নারীর প্রতিবাদের যথাযথ মূল্যায়নই পারে নারীর প্রতি সহিংসতা, যৌন নির্যাতন, শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন রোধ করতে।

[ফেমিনিস্ট ফ্যাক্টরে প্রকাশিত মুক্তমত লেখকের নিজস্ব বক্তব্য]