September 20, 2024
ফিচার ২মুক্তমত

শালীনতার নামে যারা মেয়েদের শোষণ করে…

শামস্ আবীরুজ্জামান সিয়াম।। সেবার আমি এসএসসি পরীক্ষা দিচ্ছি। সবার মতোই আমার মনে অনেক আশা এবং উত্তেজনা, জীবনের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ পরীক্ষা। কিন্তু সেবার আমার জীবনের সেই গুরুত্বপূর্ণ পরীক্ষা দিতে গিয়ে আমি চমকে উঠলাম এবং যন্ত্রণার চোটে হাসতে শুরু করলাম।

জানেন কেন?

বিশেষ কিছুনা, একটা প্রশ্ন দেখে।

একটা প্রশ্ন…

ধর্ম পরীক্ষার দিন একটা প্রশ্ন দেখে। উদ্দীপকটা এমন ছিল- ডেইজি রাস্তা দিয়ে হেঁটে যাওয়ার সময় একদল বখাটে ছেলে তাকে টিজ করে, উত্যক্ত করে। তার বোন তাকে বলে তোমার নিজের ড্রেস পরিবর্তন করা উচিত।

আমি এটা দেখে ধাক্কা খাই, পরে প্রশ্নে দেখি জিজ্ঞেস করা, ডেইজির মধ্যে উত্তম চরিত্রের কোন গুণের অভাব রয়েছে? দেখার পর আমি আরও বড় ধাক্কা খাই, আমার চোখ এক মুহূর্তের জন্য অন্ধকার হয়ে যায়!

সারাটা প্রশ্নে বখাটেদের করা নোংরামোর কোন আলোচনা আমি পাইনা। ব্যাপারটা এমন দাঁড়ায় যে, বখাটেরা ঠিক কাজ করেছে, তারা নির্দোষ। আমাদের সমাজে ধর্ষিত হলে, টিজ হলে যেমনে আমরা বলে উঠি মেয়েটার চরিত্রে সমস্যা, তেমনি যেন ডেইজির চরিত্রে সমস্যা, তার পোশাকের কারণে সে টিজ হয়েছে!

ছোটবেলা থেকে টিভির চ্যানেল বদলালেই দেখে অবাক হতাম প্রত্যেক সপ্তাহে অন্তত একটা ধর্ষণের খবর। ছোট্ট কোলের বাচ্চা থেকে একদম বয়স্ক বৃদ্ধা, কাউকে রেহাই পেতে দেখিনি। অনলাইনে পোর্টালে গিয়ে কমেন্টবাক্সে যখন চোখ রাখতাম, তখন ভারি ঘেন্না হতো।কারণ ধর্ষণের কারণ হিসেবে পোশাককে দায়ী করা, টিজিংয়ের কারণ হিসেবে কাপড়কে দায়ী করা এবং ধর্ষিতার চারিত্রিক সার্টিফিকেট উদ্ধার করতে ব্যস্ত এক প্রচণ্ড নোংরা মানসিকতা দেখতাম, যাদের চোখে অপরাধী বেমালুম খালাস পেয়ে যেত। মানুষ যেখানে বলত, মেয়েটারই দোষ, তারই আরো শালীন হয়ে কাপড় পরে চলা উচিত ছিল, তার উচিত তার পোশাক পরিবর্তন করা। নাহলে তার সাথে তো অমন হবেই!

আমি ভাবতাম,না, একজন মেয়ে রেপ হলে, টিজ হলে সম্পূর্ণ অপরাধ সেই বখাটেদের, শুধু তাদের।

যখন প্রতিদিন এ ধরণের অপরাধ বাড়তো, আমি অবাক হতাম। ভাবতাম এর কারণ কী হতে পারে? ক্রমেই কমেন্টবাক্স পড়তে পড়তে বুঝতে বেগ পেতে হলোনা যে, অপরাধীদের কাজকে যৌক্তিকতা প্রদানকারী বড় অংশের গৌষ্ঠী এদেশে আছে, যারা ধর্ষণ, টিজ হলে বলে মেয়েটারই সমস্যা ছিল চরিত্রে, এমন কাপড় পরলে তো হবেই। এটা সেই মানসিকতা যার শিকড় ধরে রেপিস্টরা রেপ করে, টিজাররা টিজ করে। তাদের এক মানসিকতা, যারা বলে অমন ড্রেস পরেছে, তাহলে রেপতো আমি করবই। তখন আমি আবিষ্কার করলাম, শালীনতা আর শোষণের সংজ্ঞায়ন এখন এক।

শালীনতা নিজের কাছে, শালীনতা বলে না আমার কাপড় তোমার মন মতো না হলে আমাকে রেপ কর, টিজ কর। প্রত্যেকটা মানুষের রুচি যেমন ভিন্ন, ঠিক তেমনি তাদের শালীন থাকার মডেস্ট থাকার সংজ্ঞাটা, ধরণটাও ভিন্ন এবং আমি তা সম্মান করি। কিন্তু যখন শালীনতার নাম ধরে মানুষকে রেপ করা হয়, টিজ করা হয় আর বলা হয় সে কাপড় ঠিক করুক, এমন কাপড় পরলো কেন, ওরই চরিত্রে সমস্যা, তাহলে এমন তো হবেই, তখন তা শালীনতা থাকেনা, তখন তা হয়ে শোষণ, শালীনতার নামে শোষণ। তাই আমি আবিষ্কার করলাম, রেপের জন্য টিজের জন্য যে পরিমাণে রেপিস্ট, টিজাররা দায়ী ঠিক তেমনি এই মানসিকতাধারী মানুষ একই পরিমাণে দায়ী, এরা সবাই নিজে একেকটা পটেনশিয়াল টিজার, রেপিস্ট।

এবং সেই তখন থেকে এই মানসিকতাধারী মানুষদের প্রচণ্ড ঘৃণা করতাম। এই  মানসিকতার তীব্র বিরোধিতা করতাম। কিন্তু যখন দেখলাম, শুধুমাত্র পরীক্ষায় গুটিকতক নাম্বার পেতে গিয়ে আমাকে আমার সেই ঘৃণা করা নোংরা মানসিকতার পক্ষে লিখতে হবে, টিজিংকে জাস্টিফাই করতে হবে তখন শুধু একটা প্রশ্ন মাথায় আসল, এটা করার পর আর কোনোদিন আয়নায় নিজেকে মুখ দেখাতে পারবো তো?

নিজের মা বা বোনের সামনে ঘাড় উচু করে চলতে পারবো তো?

আমার পক্ষে এরকম নোংরা কাজ করা সম্ভব হলো না। আমি তাই আমার মনমতো লিখলাম। আমি লিখলাম, উদ্দীপকে প্রশ্নকর্তার নোংরা বিদ্বেষী কুমানসিকতার বহিঃপ্রকাশ ঘটেছে যেখানে উল্লিখিত বখাটেরা তারই প্রতিনিধিত্বকারী। সেখানে ডেইজির এবং তার বোনের উচিত ছিল এ ছেলেগুলোর গালে কষিয়ে চড় মারা, নিজের জন্য প্রতিবাদ করা। কারণ সেটাই সঠিক আর নিজের অধিকার আর নিজের অধিকার ক্ষুন্ন হলে তার প্রতিবাদ করটাই সর্বোৎকৃষ্ট গুণ। এই বখাটেদের উচিত ছিলো তাদের কুপ্রবৃত্তির সাথে লড়াই করা, নিজেকে বিরত রাখা, নিজের ভেতরের জানোয়ার সত্তার সাথে লড়াই করা, এটাই প্রকৃত শালীনতা।

আমি চাইলে প্রশ্নটা সহজে স্কিপ করতে পারতাম, কিন্তু আমি করিনি, কারণ আমি ছোটবেলা থেকে এরকম অন্যায় হলে মানুষকে শুধু স্কিপই করতে দেখেছি, শুধু পালাতেই দেখেছি। এবং এই পালিয়ে যাওয়ায় এই নোংরাদের নোংরামো বাড়তে দেখেছি, বখাটেদের ডেইজিকে প্রত্যেকদিন টিজ করতে দেখেছি, তাই এ পালানো আমার পক্ষে সম্ভব না। যদি আমি স্কিপ করে না পালাই, তাহলে কাল যদি আমার মা বা বোন বিপদে পড়েন, অন্য কেউও স্কিপ করে হয়তো পালাবে না, আমার মতো কেউ থাকতে পারে যে পাশে দাঁড়িয়ে থাকবে। অন্তত আমি নিজেকে এই বিশ্বাসটা দিতে পারব এবং এটা নিয়া আমি দিব্যি স্বস্তির নিঃশ্বাসে ঘাড় উচু করে বাঁচতে পারব। তাছাড়া একটা বার্তা যাবে, যা দেওয়াটা গুরুত্বপূর্ণ, তা হল এই নোংরা শোষণকারী মানসিকতার বিরুদ্ধে দাঁড়ানোর মতো একটা পক্ষ এখনো এক্সিস্ট করে।

পরীক্ষার রেজাল্ট বের হল,ধর্ম পরীক্ষায় প্রশ্নকর্তাকে উত্তম মধ্যম দেয়ায় এবং নৈর্ব্যক্তিকে কম পাওয়ায় সেবারের জন্য আমার ধর্মে এ+ পাওয়া হলো না।

কিন্তু আমি দিব্যি আছি, স্বস্তিতে বাঁচতে পারি, আয়নায় নিজের মুখখানা দেখতে পারি, বিশ্বাস করি কালকে আমার মা বা বোনকে কেউ টিজ করলে একজন হয়তো তাদের কাপড়ের দোহাই দিয়ে টিজিংকে মৌন সমর্থন করবে না এবং বিশ্বাস করি হয়তো একটু হলেও মানুষ হতে পেরেছি।

মনে আছে,  ক’দিন আগে হীরামনি ধর্ষণের কথা। তার মায়ের বুক ফাটা হাহাকার এখনো আমার কানে এসে বাজে। এবং এর জন্য আপনি, যারা এভাবে টিজ হলে চারিত্রিক সার্টিফিকেট, জামাকাপড় খোঁজেন, তারাই দায়ী। এ অপরাধের জন্য দায়ী আপনাদের এই প্রশ্রয়কারী মানসিকতা আর সেই মানসিকতার শিকড় ধরে বেড়ে ওঠা লোকেরা। আপনাদের বন্ধুবান্ধব, মা বোন কেউ যে আপনাদের হতে সুরক্ষিত না, তা কি আপনারা জানেন? আপনারা এবং সেই রেপিস্ট, টিজারদের মধ্যে কোনো পার্থক্য আদতে আছে কি?

না, একটুও নেই। আদতে এটা কখনো কি ভেবে দেখেছেন?

তাই দয়া করে যারা এ রকম মানসিকতা নিয়ে থাকেন, টিজ হলে ড্রেস কোড খোঁজেন, শালীনতার নামে শোষণ করেন, আপনাদের মানসিকতা বদলান। তাহলে হয়তো সমাজে একজন রেপিস্ট কম জন্মাবে, ভিড়ের মধ্যে আপনার মা বোনের গায়ে হাত দেয়ার মানসিকতার একজন কম থাকবে। তাহলে হয়তো… হয়তো সেই পাঁচ বছরের ধর্ষিত বাচ্চাটা, ধর্ষিত হওয়া সে বৃদ্ধা মহিলাটা, হীরামনিরা আপনাদের অন্তত একবারের জন্য ক্ষমা করতে পারবে…

 

[ফেমিনিস্ট ফ্যাক্টরে প্রকাশিত মুক্তমত লেখকের নিজস্ব বক্তব্য]