লিঙ্গের বিলোপ এবং কমিউনাইজেশন
Maya Andrea Gonzalez এর লেখা প্রবন্ধ Communization and the abolition of gender প্রকাশিত হয় ২০১১ সালে। ফেমিনিস্ট ফ্যাক্টরের পাঠকদের জন্য প্রবন্ধটির অনুবাদ করেছেন ফাতিন ইশরাক।।
‘‘বর্তমান সভ্যতা পরিষ্কারভাবেই চায় যৌন সম্পর্ক কেবল একগামিতার ভিত্তিতে এক পুরুষ এবং এক নারীর মধ্যে হবে। এটি যৌনতাকে আনন্দের উৎস হিসেবে দেখার অধিকার দেয় না এবং এটি যৌনতার কেবল একটি রূপই সমর্থন করে কেননা এখন পর্যন্ত বংশ বিস্তারের অন্য কোন বিকল্প পাওয়া যায় নি।”- সিগমণ্ড ফ্রয়েড, Civilization and its Discontents.
কমিউনাইজেশন বিপ্লবী কোন অবস্থান না। এটি বিপ্লব পরবর্তী সমাজ ব্যবস্থাও না। এটি কোন চাল বা কৌশলগত দৃষ্টিভঙ্গি বা সংগঠন বা পরিকল্পনা কিছুই না। যদি কোন বিপ্লব হতেই হয়, তবে শ্রেনি সংগ্রাম এর দিকে লক্ষ্য রেখে যে ব্যবস্থাগুলো নিতে হবে, তার কাঠামো দেয় কমিউনাইজেশন। মজুরি, বিনিময়, মূল্যরূপ, রাষ্ট্র, শ্রম এবং ব্যক্তিগত সম্পত্তির বণ্টন থেকে শুরু করে উৎপাদনের পুঁজিবাদী ব্যবস্থা বিলোপ করে কমিউনাইজেশন। বিপ্লবের এরকম রূপ নেওয়া আজকের শ্রেণি সংগ্রামের অত্যাবশ্যকীয় বৈশিষ্ট্য। যেহেতু পুঁজিবাদের অভ্যন্তরীণ বিরোধ বিপ্লবের যাবতীয় কাঠামোগুলো ধ্বংস করেছে, আমাদের সংগ্রামের চক্রের যেন কোন শেষ নেই। বিপ্লবের পরবর্তীতে সামাজিক বিভাজন বিলোপ করা যাবে এমন কোন পরিস্থিতি কল্পনাও করা সম্ভব নয়।
লিঙ্গ অসুবিধাজনক বা প্রশ্নবিদ্ধ বলে নয় বরং এটি পুঁজিবাদী ব্যবস্থার সাথে জড়িত সম্পর্কগুলোর সমষ্টিগত অংশ বলে কমিউনাইজেশনের বিপ্লবে সকল সামাজিক বিভাজনের পাশাপাশি বিদ্যমান লৈঙ্গিক সম্পর্কও বিলোপ করতে হবে। পুঁজির মৌলিক অসঙ্গতি হল লিঙ্গ এবং তাই বিপ্লবপরবর্তী সময় পর্যন্ত অপেক্ষা না করে বিপ্লবের অংশ হিসেবেই এটি বিলোপ করতে হবে। পরিকল্পিত বিলোপ বা সক্রিয় বিনির্মাণ বা লৈঙ্গিক পরিচয়ের সমতা বা ব্যাপক বৈচিত্র্য সাধনের মধ্যে দিয়ে হোক- আমাদের অস্তিত্বের সাথে এর প্রাসঙ্গিকতা ধীরে ধীরে বদলাবে না। বরং, কমিউনাইজেশনের বিপ্লব হতে হলে লিঙ্গের প্রতিটি অংশকে বিলোপ করতে হবে এবং প্রত্যেককে তাদের ঐক্যের ভিত্তিতে ব্যক্তি পর্যায়ের সম্পর্কগুলোর সূচনা করতে হবে।
বিপ্লব যে কমিউনাইজেশনের রূপ নেয়, এটি পূর্বের পরাজয়ের শিক্ষা বা লিঙ্গ প্রশ্নের সমাধানে পূর্বের আন্দোলনের ব্যর্থতা না। আমরা উপলব্ধি করি বা না করি অতীতের আন্দোলনের কৌশল বর্তমান সম্পর্কে কিছুই বলে না। পুঁজি প্রলেতারিয়েতদের সাধারণ পরিচয়ের ভিত্তিতে ঐক্যবদ্ধ করে না। পুঁজি-শ্রম সম্পর্ক শ্রমিকদের নিজেদের শ্রমিক হিসেবে পরিচয় শক্তিশালী করে না এবং এর উপর ভিত্তি করে গঠিত শ্রমিক সংগঠন কর্তৃক রাষ্ট্র ব্যবস্থার অভ্যন্তরে ক্ষমতা গ্রহণের সক্ষমতাও দেয় না। যেসব আন্দোলন শ্রমিকদের পুঁজিবাদী চরিত্রে নিয়ে গিয়েছিল, সেগুলো কমিউনিস্ট ছিল, কিন্তু যে ধাঁচের কমিউনিস্ট ছিল, সেটা বর্তমানে হতে পারে না। না শ্রমিক, না প্রিক্যারিয়েট- কমিউনাইজেশনের বিপ্লবে কোন বিপ্লবী চরিত্র নেই, কোন আনুষ্ঠানিক পরিচয় নেই। এরকম কোন বিপ্লবী চরিত্রের ভিত্তি হারিয়ে গেছে।
নিঃসন্দেহে শ্রমিকরা এখনও একটি শ্রেণি হিসেবে বিরাজ করে। Wage-Labor অন্য পূর্বের যেকোনো সময়ের চেয়ে এখন জীবনের অধিক প্রয়োজনীয় শর্তে পরিণত হয়েছে। প্রলেতারিয়েতরা এখন পঙ্গু ও বিকীর্ণ। পুঁজির সাথে এর সম্পর্ক বিপজ্জনক। শ্রমের কাঠামো বদ্ধ অতিরিক্ত সরবরাহ ব্যাপক হারে বিস্তৃত। সুযোগ সুবিধাপ্রাপ্ত শ্রমিকদের অংশ বাদে এক বিলিয়নের ওপরে অতিরিক্ত জনসংখ্যা, যারা বৈশ্বিক কাঁচামালের চেইনে একটি জায়গা চায় কিন্তু যাদেরকে বের করে দেয়া হয়েছে, তারা শ্রম সরবরাহে সক্ষম বৃহৎ সংগঠন কাঠামো বদ্ধ করা অসম্ভব করে দেয়। পুঁজি এখন বিভাজন ঘটায় এবং শ্রমিকদের মধ্যকার বিভাজনের ওপরই দাঁড়িয়ে থাকে। যেই মাত্র ঐতিহাসিকভাবে বিপ্লবের সৌন্দর্য বহনকারী প্রলেতারিয়েত শ্রেণি পুঁজিবাদের অভ্যন্তরে একটি শ্রেণি হিসেবে স্বাতন্ত্র্য লাভ করে, তারা আর পুঁজির বিরুদ্ধে একটি শক্তি হিসেবে নিজেদের দাঁড়া করাতে পারে না। এখন প্রলেতারিয়েতদের অনৈক্য দূর করার একমাত্র উপায় হিসেবে এই অনৈক্য হতেই বিপ্লব শুরু করতে হবে। বিপ্লব যদি প্রলেতারিয়েতদের বিভাজন দূর না করে, তবে সেটা বিপ্লবই না; সেটা কমিউনাইজেশন না।
বর্তমান সময়ে সংগ্রামের মৌলিক সীমাবদ্ধতা হল শ্রমিকদের পরিচয়ের ভিত্তিতে এক হওয়ার অক্ষমতা। এই সীমাবদ্ধতার মধ্যে একই সাথে লৈঙ্গিক সম্পর্কের বিলোপও অন্তর্নিহিত। পূর্বের সংগ্রামের চক্র শেষ হতেই শ্রমিকদের বিরুদ্ধে যে নতুন বিদ্রোহ হয়েছে এবং যাতে নারীবাদ ভূমিকা রেখেছে- এটা কোন ঐতিহাসিক দুর্ঘটনা না। নারী, কৃষ্ণাঙ্গ এবং সমকামীদের অধীনস্থ করবে না এমন কোন শ্রমিক আন্দোলনের চিন্তা করা হল এমন একটি আন্দোলন চিন্তা করা যা একতাবদ্ধ করার ক্ষমতা রাখে না। প্রলেতারিয়েতরা সমাজের সংখ্যাগুরু হলে শ্রমিক আন্দোলন যে সংখ্যাগরিষ্ঠতা পাবে না, এটা স্পষ্ট। কমিউনাইজেশন এই সমস্যার সমাধান করে না কিন্তু একে নতুন জায়গায় নিয়ে যায়। আন্দোলনের বর্তমান অবস্থা পর্যালোচনায় আমাদের উচিত লৈঙ্গিক সম্পর্কের দিকে আন্দোলন নিয়ে যাওয়া।
কিছুদিন আগে পর্যন্তও কমিউনাইজেশনের তত্ত্ব কেবল কিছু পত্রিকায়ই সীমাবদ্ধ ছিল। শ্রেণি বিভাজনের মূল ভিত্তি নিয়ে পর্যালোচনায় তারা বিফল হয়ে লিঙ্গের তাত্ত্বিক আলোচনা হাতে নিয়েছে। এর বিপরীতে, তারা এমন বিপ্লবী অনুসন্ধানে ব্যস্ত, যার দ্বারা পূর্বের সংগ্রামের ভালো মন্দ অনুসন্ধান করা যাবে। কমিউনাইজেশনের বেশিরভাগ তাত্ত্বিকরাই বিপ্লবকে সকল বিভাজনের শেষ হিসেবে দেখে এই সিদ্ধান্তে এসেছে যে, কমিউনাইজেশনকে বর্তমানের ঐতিহাসিক স্বাতন্ত্র্যের চেয়ে পূর্বের আন্দোলনের ব্যর্থতাকে ছাপিয়ে যেতে হবে।
এ কারণে Theorie Communiste (TC) কে ঘিরে প্রবণতাগুলো অন্যরকম এবং আমরা আমাদের ব্যাখ্যায় সেগুলো অনুসরণ করি। TC এর মতে, যখন সংগ্রামগুলো গতিপথ পরিবর্তন করতে শুরু করে তখনই বিপ্লব বাস্তব হয়, কেননা সংগ্রাম প্রলেতারিয়েতকে নিজেদের শ্রেণি হিসেবে বংশবিস্তারের পথে বাধা দেয়। সংগ্রামে দূরত্ব শুরু হয় এবং এই দূরত্বের বৃদ্ধিই হল আমাদের সময়ে কমিউনিজম প্রতিষ্ঠার বাস্তবিক সম্ভাবনা। শ্রমিকেরা নিজেদের চাকরি টিকিয়ে রাখার পরিবর্তে তাদের ফ্যাক্টরি পুড়িয়ে দেয় ন্যায্য মজুরির আশায়। শিক্ষার্থীরা বিশ্ববিদ্যালয় দখল করে কিন্তু যে দাবিতে লড়াই করার কথা, সে উদ্দেশ্যে না। যেসব আন্দোলনে নারীরা সংখ্যাগরিষ্ঠতা পায়, সেগুলো তারা করে না কেননা সেগুলো তাদের প্রতিনিধিত্ব করে না। বেকার, যুবক এবং অলিখিত অনেকে যোগ দেয় এবং সুযোগ সুবিধাপ্রাপ্ত সংখ্যালঘু শ্রমিকদের সংগ্রামকে অতিরঞ্জিত করে। এর মাধ্যমে সমসাময়িক দাবি অর্জনে সীমাবদ্ধতাগুলো বড় হয়।
সংগ্রামের মাঝের ব্যবধানগুলোর জন্য একটি উক্তি:
“প্রলেতারিয়েতদের একটি অংশ নিজেদের সংগ্রামের জন্য দাবির ঊর্ধ্বে গিয়ে কমিউনাইজিংয়ের উদ্যোগ নেবে এবং এভাবে প্রলেতারিয়েতদের এক করতে শুরু করবে, যা মানব সমাজকে এক করার মত একটি প্রক্রিয়া; প্রত্যেকে নিজেদের একতায় নিজেদের মধ্যে যে সামাজিক সম্পর্কের প্রতিষ্ঠা করে।”
TC এর হিসেবে, বিপ্লবে প্রলেতারিয়েতদের বিভাজনের পাশাপাশি এর উৎসও দূর করতে হবে। এ কারণে কমিউনাইজেশনের তাত্ত্বিকদের মধ্যে TC লৈঙ্গিক পার্থক্যের পর্যালোচনা করে, যা প্রলেতারিয়েতদের মধ্যকার সবচেয়ে মৌলিক বিভাজন। লিঙ্গের উপর TC এর কাজ আপেক্ষিকভাবে নতুন। লিঙ্গের উপর তাদের মূল লেখা ২০০৮ এ লিখিত, ২০১০ এ প্রকাশিত হয় তাদের জার্নালের ইস্যু ২৩ এ “Distinction de Genres, Programmatisme et Communisation” হিসেবে। TC দাবি করে কমিউনাইজেশনে পুঁজিবাদী সামাজিক সম্পর্কের বিলোপের পাশাপাশি লিঙ্গের বিলোপ বিদ্যমান। পুঁজিবাদই লৈঙ্গিক বিভাজন বজায় রাখে এবং এই বিভাজন অন্য সকল বিভাজনকে। TC লিঙ্গের ঐতিহাসিক বস্তুবাদী তত্ত্ব নির্মাণ করতে গিয়ে উৎপাদনের পুঁজিবাদী ব্যবস্থার তত্ত্বের চেয়েও বেশি কিছু করে। এর কারণ তারা ফরাসি নারীবাদী ক্রিসটাইন ডেলফির কাজের ওপর নির্ভর করে।
প্রেক্ষাপটের জন্য, TC এর কমিউনাইজেশন তত্ত্ব শ্রেণি সংগ্রামের কালানুক্রমিক পর্যালোচনা, যা পুঁজি-শ্রম সম্পর্কের ইতিহাসের কালানুক্রমিক বিশ্লেষণ। এটি TC কে কমিউনাইজেশনের বর্তমান দিকগুলো সম্পর্কে ঐতিহাসিক বিশ্লেষণ দেয়। TC মূল্যের পুনরুৎপাদনের চেয়ে পুঁজি-শ্রম সম্পর্কের পুনরুৎপাদনে অধিক আলোকপাত করে। এই পরিবর্তন তাদেরকে ফ্যাক্টরি বা অফিসের দেয়ালের ঊর্ধ্বে গিয়ে পুঁজিবাদী সমাজ জীবনের সম্পর্কগুলো বিশ্লেষণে সুযোগ দেয়। লৈঙ্গিক সম্পর্ক সবসময়ই মূল্য উৎপাদনের গণ্ডির বাইরে অবস্থান করেছে।
১. “নারী” শ্রেণির বিনির্মাণ:
নারী একটি সামাজিক নির্মাণ। নারী শ্রেণি কয়েকটি সামাজিক সম্পর্কের ভিত্তিতে সজ্জিত, যা থেকে মানব সমাজকে দুই ভাগে ভাগ করা হয়- নারী ও পুরুষ- এবং কেবল স্ত্রী ও পুরুষ না- অবিভেদ্য। এভাবে যৌন পার্থক্যকে একটি নির্দিষ্ট সামাজিক কাঠামো দেয়া যায়, যা অন্যথায় থাকত না। যখন নারী জাতিকে বেশিরভাগ স্ত্রীর বংশবিস্তারের প্রক্রিয়ার দ্বারা সংজ্ঞায়িত করা হয়, শ্রেণি সমাজ ব্যবস্থায় যৌন পার্থক্য বিশেষত্ব পায়। কিছু নারী সন্তান নেয় বলে শ্রেণি সমাজ শরীরকে সামাজিক উদ্দেশ্য দেয়। যেসকল শরীর সন্তান উৎপাদনে সক্ষম, তাদেরকে সামাজিক শৃঙ্খলার অধীনস্থ করা হয়। নারী তাদের জন্মগত জৈবিক বৈশিষ্ট্যের দাস হয়ে যায়। শ্রেণি সমাজের দীর্ঘ ইতিহাসে দেখা যায়, নারীরা এমন পৃথিবীতে জন্মেছিল, যা সমাজের প্রাথমিক কর্তা এবং সম্পত্তির একচ্ছত্র মালিক পুরুষের জন্য সংগঠিত। এভাবে নারীরা সমাজের সম্পত্তিতে পরিণত হয়।
যেহেতু সংজ্ঞানুযায়ী নারীরা অপুরুষ, তারা প্রকাশ্য সামাজিক জীবন থেকে বঞ্চিত। TC এর হিসেবে, নারীর এই বাস্তবতার অর্থ হল তাদের শরীরের পাশাপাশি তাদের কার্যকলাপের পুরোটাই পুরুষের দ্বারা অধিকারভুক্ত। তাদের কার্যকলাপ হতে হবে একান্ত। এভাবে, নারী গার্হস্থ্য শ্রমের দায়িত্ব পায়। এই শ্রমকে বাসার কাজ হিসেবে সংজ্ঞায়িত করা হয় না, বরং নারীর কাজ হিসেবে সংজ্ঞায়িত করা হয়। বাজারে কাপড় বেচলে নারী তাঁতি হয় কিন্তু বাসায় কাপড় বানালে সে কেবল স্ত্রী। এভাবে নারীর কাজ কে কেবল তার কাজ হিসেবে দেখা হয়। অন্য কারো দ্বারা এটি করা হলে তা সম্মানজনক সামাজিক পরিচয় লাভ করত। নারী পুরুষের লৈঙ্গিক বিভাজন এভাবে প্রকাশ্য/একান্ত এবং সামাজিক/ গার্হস্থ্য হিসেবে বিশেষত্ব পায়।
সন্তান উৎপাদনসহ পুরুষের প্রতি নারীর অবৈতনিক শ্রম কি শ্রেণি সম্পর্ক, না উৎপাদনের মাধ্যম (ডেলফি একে উৎপাদনের গার্হস্থ্য মাধ্যম বলেন)? TC শ্রেণি সম্পর্ককে উদ্বৃত্ত উৎপাদক এবং শোষকের সম্পর্ক হিসেবে সংজ্ঞায়িত করে। এই গ্রুপ গুলোর মধ্যকার সামাজিক বিভাজন উৎপাদনের সম্পর্কগুলোর জন্য অত্যাবশ্যক, যা উদ্বৃত্ত উৎপাদন এবং শোষণের চালিকা শক্তি নিয়ন্ত্রণ করে। এভাবে এই সম্পর্কগুলো হয়ে ওঠে শ্রেণি সম্পর্কের পুনরুৎপাদনের মাধ্যমে উৎপন্ন একটি পণ্য। TC এর সাথে আমরা একমত পোষণ করি যে, উৎপাদনের প্রত্যেকটি মাধ্যম স্বতন্ত্র এবং এমন কি যৌন প্রজননে নারীর ভূমিকার সামাজিক গুরুত্ব উৎপাদনের মাধ্যমের সাথে বদলায়। এর মানে এই না যে নারী পুরুষ সম্পর্ক শ্রেণি সম্পর্ক থেকে উৎপন্ন। এর মানে হল, নারী পুরুষের সম্পর্ক শ্রেণি সম্পর্কের গুরুত্বপূর্ণ একটি উপাদান এবং একে আলাদা সিস্টেম ভাবা যাবে না।
অবশ্যই এই আলোচনাটি দুর্বোধ্য থেকে গেল। এখন প্রশ্ন দাঁড়ায়, আমরা কীভাবে উৎপাদনের মাধ্যমের ধারাবাহিকতার গল্পের সাথে নারীর গল্প সংযোগ করি? TC এর মতে, যেহেতু জনসংখ্যা বৃদ্ধির ফলে শ্রেণি সম্পর্কের পুনরুৎপাদন সম্ভব হয়, শ্রেণি সমাজগুলোতে নারী প্রধান চালিকা শক্তি। এভাবে শ্রেণি সমাজের ইতিহাসে প্রাথমিক চালিকা শক্তি হিসেবে জনসংখ্যা বৃদ্ধি নারীর উপর বোঝা। এভাবে বিষমকামী ম্যাট্রিক্স কিছু বস্তুবাদী সামাজিক সম্পর্কের উপর প্রতিষ্ঠিত।
আমাদের মনে রাখা দরকার যে- সন্তান প্রসবের বিশেষ বোঝা শ্রেণি সমাজের আবির্ভাব ঘটায়। ঐতিহাসিকভাবে প্রত্যেক নারীকে গড়ে ৬ জন সন্তান জন্ম দিতে হত, যাতে অন্তত ২ জন বংশবিস্তারের জন্য বেঁচে থাকে। সন্তান প্রসবের সময় নারী মৃত্যুর ঘটনা দশটায় একটা ঘটে। এজন্য TC শ্রেণি সমাজের আবির্ভাবের পর্যালোচনায় দেখে যে, মানব সমাজে জনসংখ্যা বৃদ্ধির সাথে এই বিষয়গুলোর সামাজিক সঙ্গতি মজবুত হয়। শ্রেণি সমাজের আবির্ভাবের আগে, মানব যৌন প্রজননের কোনো প্রাকৃতিক রাজত্ব ছিল না। বিয়ের সময় বয়স, সন্তান প্রতিপালনের সময়কাল, সন্তান সংখ্যা, শিশুহত্যার সামাজিক গ্রহণযোগ্যতা বিভিন্ন সমাজে বিভিন্ন রকম ছিল। এই ভিন্নতা মানুষ প্রজাতির গ্রহণযোগ্যতার বিশেষ চিহ্ন।
কিন্তু আমরা পুঁজিবাদী উৎপাদন ব্যবস্থার চেয়ে মানব প্রজাতির দীর্ঘ ইতিহাসে কম আগ্রহী। শ্রম মজুরি মৌলিকভাবে আদি দাস প্রথা এবং সামন্ততান্ত্রিক সমাজব্যবস্থা থেকে আলাদা। দাসপ্রথায় উদ্বৃত্ত উৎপাদকের উৎপাদনের পুঁজির সাথে কোন সম্পর্ক নেই। কারণ দাসরা উৎপাদনের পুঁজির অংশ। মালিকের দায়িত্ব দাসদের বংশবৃদ্ধি নিশ্চিত করা ও বাঁচিয়ে রাখা। যেহেতু দাসরা পুরোপুরি একান্ত জগতে থাকে, নারী ও পুরুষ দাসের জন্য প্রকাশ্য ও একান্তের পার্থক্য তাই সমাধান হয়। দাসদের জন্য সম্পত্তির মালিকানা বা কর জাতীয় রাষ্ট্রের সাথে সম্পর্কের প্রশ্ন নেই। এমন কিছু প্রমাণ পাওয়া যায় যে, এই কারণে আমেরিকার দক্ষিণে দাস পরিবারদের মধ্যে পুরুষতন্ত্র দুর্বল ছিল। সামন্ততন্ত্রে উদ্বৃত্ত উৎপাদকদের উৎপাদনের পুঁজিতে সরাসরি প্রবেশাধিকার ছিল। উদ্বৃত্ত বল প্রয়োগের মাধ্যমে শোষিত হয়। কৃষক পরিবারের জনপ্রতিনিধি হিসেবে কৃষক এই বাহ্যিক বলের সাথে সম্পর্কিত। নারী ও শিশু গ্রামের একান্ত জগতে সীমাবদ্ধ, যা উৎপাদন ও পুনরুৎপাদনের স্থান। কৃষক পরিবারকে নিজের চাহিদা উৎপাদনে তাদের একান্ত জগত ছাড়তে হয় না বরং উৎপাদিত পণ্যের একটি অংশ মালিককে দিয়ে দিতে হয়। এ কারণে বাজারে কৃষক পরিবার আপেক্ষিকভাবে স্বাধীন থাকে।
পুঁজিবাদে উদ্বৃত্ত উৎপাদকের জীবন প্রকাশ্য উদ্বৃত্ত উৎপাদন এবং উৎপাদকের একান্ত বংশবিস্তারে বিভক্ত। শ্রমিকরা তাদের নিজস্ব সম্পত্তি, দাসরা যেমনটা না। নিজেদের রক্ষণাবেক্ষণ করতে পারলেই কেবল তারা বেঁচে থাকবে। মজুরি অনেক কম হলে বা তাদের শ্রম আর প্রয়োজন না হলে, শ্রমিকরা অন্য উপায়ে বেঁচে থাকতে স্বাধীন (যতক্ষণ পর্যন্ত উপায়গুলো বৈধ)! শ্রমিকদের পুনরুৎপাদন এজন্য পুঁজিপতির দায়িত্ব না। শ্রমিকরা নিজেদের টিকিয়ে রাখতে পারবে কেবল যদি তারা শ্রম বাজারে বারবার কাজ খুঁজতে ফিরে যায়। এখানে পুঁজি-শ্রম সম্পর্কের বিশেষত্ব। শ্রমিকরা সামাজিকভাবে উৎপাদন করে যা উপার্জন করে, তা খরচ করে তাদের নিজেদের বংশবিস্তার করে টিকিয়ে রাখতে হবে। প্রকাশ্য/ একান্ত এবং সামাজিক/ গার্হস্থ্য সম্পর্কের বাইনারিগুলো এভাবে মজুরি সম্পর্কেই অন্তর্নিহিত।
পুঁজিপতিরা যদি শ্রমিকদের বেঁচে থাকার জন্য সরাসরি দায়বদ্ধ হত এবং শ্রমিকদের পুনরুৎপাদন ও টিকে থাকা যদি একান্ত জগত থেকে সরিয়ে দেয়া হত, শ্রমিকেরা আর তাদের শ্রমশক্তি বেচতে বাধ্য হত না। বিচ্ছিন্ন গার্হস্থ্য পরিবেশে পুনরুৎপাদনের অস্তিত্ব পুঁজিবাদী সামাজিক সম্পর্কের জন্য অত্যাবশ্যক (যেখানে বাজারে কেনা পুঁজির সাহায্য ছাড়াই স্বল্প উৎপাদন হয়)। যেহেতু বাজার ঘরের বাইরের সামাজিক শ্রমের চালিকা শক্তি হিসেবে কাজ করে, সামাজিক কাজকর্ম গার্হস্থ্য কাজকর্ম থেকে আলাদা হয়। বিনিময়ের জন্য উৎপাদন আগে ঘরের ভেতরে করা হয়, তা এখন ঘরের বাইরে অন্য কোথাও করা হয়। এরকম অবস্থায় প্রকাশ্য/ একান্ত পার্থক্য একটি ভিন্ন মাত্রা গ্রহণ করে। যেই মুহূর্তে ফ্যাক্টরি পুরুষের কাজের সামাজিকভাবে উৎপাদনশীল চরিত্রের জন্য জনসাধারণের থেকে চাঁদা নেয়, সেই একই মুহূর্তে ঘর নারীর গার্হস্থ্য শ্রম এবং পুরুষের অবসরের জায়গা হয়ে যায়।
যতটা সময় ধরে পুঁজিবাদ আছে, নারীদের অবশ্যই পুরুষের পাশাপাশি শ্রমিক হিসেবে দেখা গেছে। TC এর মতে, নারীর গার্হস্থ্য শ্রমের লৈঙ্গিক প্রকৃতি তাদের কাজ নির্ধারণ করে দেয়। এমনকি যখন ঘরের বাইরে কাজ করে, তা নারীর কাজই রয়ে যায়। এটাকে বলা হয় অনুৎপাদনশীল অথবা কম মূল্যের শ্রম। নারীরা এজন্য পার্ট টাইম কাজ করে, স্বল্প মজুরির চাকরি করে (যদিও বর্তমানে অর্থনীতির সকল ক্ষেত্রে অন্তত কিছু নারী কাজ করে।) নারীরা প্রায়ই গার্হস্থ্য কাজ করে অন্যের বাসায় বা উড়োজাহাজে। যখন নারীরা ফ্যাক্টরি তে কাজ করে, তাদেরকে অত্যধিক শ্রম বা সুন্দর হাতের কাজের প্রয়োজন এমন চাকরিতে আলাদা করে রাখা যায়; বিশেষত টেক্সটাইল, পোশাক এবং ইলেক্ট্রনিক্স সংক্রান্ত। এদিকে গার্হস্থ্যের কাজ নারীর কাজই থেকে যায়, যদিও তা পুরুষও করে অল্প কিছু ক্ষেত্রে।
এই অর্থে, লিঙ্গের প্রকাশ্য/ একান্ত বাইনারি সম্পর্ক হিসেবে মজুরি সম্পর্কের অংশ হয়ে যাওয়া TC নারীর যৌন প্রজননের ভূমিকার সাথে তাত্ত্বিকভাবে সামঞ্জস্য দেখায়। ঘরের বাইরে নারীদের কাজের যে নির্দিষ্ট চরিত্র আছে, তা তাদের ঘরের কাজের চরিত্রের সাপেক্ষে অসামঞ্জস্যপূর্ণ। যৌন প্রজননে নারীর ভূমিকার বস্তুবাদী প্রেক্ষাপটের সাথে এর কোন সম্পর্ক নেই এবং এর অর্থে এটা কম বেশি আদর্শিক। একইভাবে, TC এর মতে, উৎপাদন ক্ষেত্রের বাইরে নারীরা ঘরে যে পুনরুৎপাদনশীল শ্রম দেয়, তা স্বীকৃত হলেও সন্তান প্রসবে নারীর অত্যাবশ্যক ভূমিকা সামাজিকভাবে স্বীকৃত না। যদি পুঁজিবাদী উৎপাদন ব্যবস্থায় নারীরা সর্বদাই শ্রমিক এবং ঘরে গার্হস্থ্য শ্রমিক হয়ে আসছে, তারা কেন কেবল নারী থেকে যায়? TC যখন পুঁজিবাদ আলোচনা করতে শুরু করে, তারা তাদের লক্ষ্য যৌন প্রজননের ওপর দেয়, যা গার্হস্থ্যে শ্রমের বস্তুবাদী অনানুষ্ঠানিক ধারণার নিচে চাপা পড়ে যায়।
এই ভ্রম একটি বড় ভুল। পুঁজিবাদী উৎপাদন ব্যবস্থায় শ্রমের যৌন বিভাজন সরাসরি নারীর জীবনের অস্থায়ীত্বের সাথে জড়িত। সন্তানের প্রতিপালনের মূল উৎস নারী। পুঁজিবাদের দীর্ঘ ইতিহাসে শ্রম বাজারে নারীর অংশ গ্রহণ একটি M কার্ভ মেনে চলে। নারীরা যৌবনে প্রবেশ করতেই অংশগ্রহণ বাড়ে, তারপর বিশে’র শেষে এবং ত্রিশে’র শুরুর ঘরে তা কমে যায়। চল্লিশের শেষে তাদের অংশগ্রহণ আবার বাড়ে, এবং তা অবসর গ্রহণ পর্যন্ত চলতে থাকে। এই প্যাটার্নের কারণ সবার কাছে পরিচিত। তরুণীরা ফুল টাইম কাজ খোঁজে কিন্তু তারা জানে সন্তান নেয়া মাত্র তারা হয় কাজ বন্ধ করবে না হয় পার্ট টাইম কাজ করবে। সন্তান প্রসবের বছরগুলোতে প্রবেশের পর শ্রম বাজারে তাদের অংশগ্রহণ কমে যায়। যেসব নারী তাদের সন্তানের বাল্য বয়সেও কাজ করে, তারা অধিকতর গরিব প্রলেতারিয়েত এবং অত্যধিক শোষিত, অবিবাহিত মা, বিধবা অথবা তালাকপ্রাপ্ত বা সেসব নারী যাদের স্বামীর উপার্জন যথেষ্ট না। সন্তানের বয়স বাড়ার সাথে অধিক সংখ্যক নারী শ্রম বাজারে ফিরে যায় কিন্তু দক্ষতা ও নিয়োগের সময়ের ক্ষেত্রে তারা তাদের প্রতিযোগী পুরুষের তুলনায় পিছিয়ে থাকে।
এসব কারণে পুঁজিবাদী অর্থনীতিতে সবসময়ই নারীদের জন্য বিশেষ জায়গা ছিল। শ্রমিকরা হয় লম্বা সময় চাকরিতে থাকত না অথবা বয়স্ক হিসেবে নতুন রা পুনরায় প্রবেশ করত শ্রম বাজারে। এসবের ঊর্ধ্বে, নারীরা একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ তৈরি করে, মার্ক্স যাকে বলে শ্রমের “সুপ্ত” সংরক্ষিত সৈন্যদল, যারা পুঁজিপতি এন্টারপ্রাইজের চাক্রিক প্রয়োজন অনুসারে শ্রমশক্তিতে প্রবেশ করে এবং বের হয়। শ্রমশক্তিতে নারীদের আলাদা জায়গার অস্তিত্ব সমাজব্যাপী প্রতিশ্রুতি এবং নারীদের প্রাকৃতিক জায়গা সম্পর্কে মতাদর্শটি ঘরে এবং কর্মক্ষেত্রে জোরদার করে। এমনকি যখন নারী পুরুষ উভয় কাজ করে, পুরুষ সচরাচর অধিক সময় কাজ করে এবং ঘরের বাইরে অধিক সময় কাজ করে। যেহেতু নারীরা পার্থিবভাবে তাদের স্বামীর উপর নির্ভরশীল, তাদের অধীনস্থতা মেনে নিতে এবং ঘরের ভেতর শ্রমের যৌন বিভাজনে প্রশ্ন না করতে বাধ্য, তাদের উপর শক্ত বোঝা থেকে যায়। ঐতিহাসিকভাবে, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরবর্তী সময় পর্যন্ত নারীকে বিভিন্ন রকম সম্পত্তির মালিকানা থেকে বঞ্চিত করা হত, তাদের পুরুষের ওপর নির্ভরশীল রাখা হত তাদের পুঁজির সাথে সম্পর্কের সমন্বয়কারী হিসেবে- এভাবে এই বোঝা নারীর উপর চাপানো হয়েছে। পুরুষ প্রলেতারিয়েতদের মত নারীদের আইনগত স্বাধীনতাও ছিল না। নারীরা পুরুষদের মত বাজার এবং রাষ্ট্রের কাছে সত্যিকার অর্থে “স্বাধীন” শ্রমের সম্পর্কে ছিল না।
২. “নারী” শ্রেণির বিলোপ:
যদিও TC পুঁজিবাদে নারীর বিনির্মাণের ক্ষেত্র ব্যাখ্যা করতে ব্যর্থ হয়, নারীর পরিস্থিতি পুঁজিবাদে উৎপাদনের মাধ্যমের সাথে পরিবর্তনের বিষয়ে অসাধারণ একটি তত্ত্ব দেয়। ‘নারীর সাথে পুঁজিবাদের সমস্যা আছে’ কারণ বর্তমানে পুঁজি-শ্রম সম্পর্ক শ্রমশক্তির বৃদ্ধির সাথে খাপ খাওয়াতে পারে না। আমরা যেমনটা ইতোমধ্যে বলেছি, পুঁজি প্রতিনিয়ত ক্রমবর্ধমান উদ্বৃত্ত জনসংখ্যার মুখোমুখি হয়, যা এর শ্রমের চাহিদার তুলনায় অত্যধিক। এই উদ্বৃত্ত জনসংখ্যার সাথে মিলিত হয়েছে পুঁজিবাদী রাষ্ট্র, শ্রমিক আন্দোলন এবং নারীবাদীদের চোখে নারীদের “অত্যাবশ্যক চালিকাশক্তি” হওয়া। পূর্ববর্তী ইউরোপ এবং ইউরোপীয় উপনিবেশে জন্মহার হ্রাস পেয়েছিল। এর প্রতিক্রিয়া ছিল প্রো ন্যাটালিজম। সভ্যতা অনিবার্য পতনের মুখোমুখি হতে গিয়েছিল কেননা নারীরা জাতির প্রতি তাদের দায়িত্ব আর পালন করছিল না; তাদেরকে ফিরে আসতে উৎসাহিত করতে হত। ১৯২০ এর মধ্যে নারীবাদীরাও মাতৃত্বকে পুরুষের সাপেক্ষে নারীর ‘সমান কিন্তু আলাদা’ মর্যাদা হিসেবে ব্যাখ্যা করে প্রো ন্যাটালিস্ট হতে শুরু করছিল। ১৯৭০ এর মধ্যে গরিব দেশগুলোতে পুঁজিবাদী অর্থনীতি দীর্ঘকালীন সংকটে প্রবেশের সাথে অধিক জনসংখ্যার বিস্ফোরণ হয় যখন, তখন মাতৃত্ব প্রায় মৃত হয়ে গিয়েছিল। শ্রমের চাহিদার তুলনায় পৃথিবীর জনসংখ্যা অধিক ছিল। নারীদের আর নারীর ভূমিকায় প্রয়োজন ছিল না। তাদের অধীনস্থ ভূমিকার ‘বিশেষ মর্যাদা’ আর মর্যাদা ছিল না।
এটা কেবল অর্ধেক গল্প। বাকি অর্ধেকটা জনতাত্ত্বিক পরিবর্তনের ইতিহাসে পাওয়া যায়, যা TC বিবেচনা করতে ব্যর্থ। শুরুর দিকে, পুঁজিবাদ শ্রমিকদের ব্যয় বাড়ায় এবং শিশু মৃত্যুহার হ্রাস করার পাশাপাশি তাদের স্বাস্থ্যের উন্নতি ঘটায়। শিশু মৃত্যুহার হ্রাস নারীদের জন্য বংশ বিস্তারে প্রয়োজনীয় সন্তান সংখ্যা কমায়। প্রথমে এই পরিবর্তন নারী প্রতি জীবিত সন্তান সংখ্যা বৃদ্ধি এবং জনসংখ্যা বৃদ্ধির মাধ্যমে দৃশ্যমান হয়। এভাবে পুঁজিবাদী সমাজের বিস্তারের সাথে নারীর যৌন প্রজননের বোঝা বাড়ে। সময়ের সাথে পৃথিবীর সব জায়গায় নারী প্রতি সন্তান সংখ্যা এবং জীবিত সন্তান সংখ্যা হ্রাস পায়। যেহেতু নারী এবং পুরুষ দীর্ঘ সময় বাঁচে, নারীর জীবনকালের কম সময় সন্তান প্রতিপালনে ব্যয় হয়। এগুলো ব্যাখ্যা করে কেন বর্তমান সময়ে নারী পুরুষ উভয়ের জন্য বিষমকামিতা কমতে শুরু করেছে। এমনকি, যারা লৈঙ্গিক বিভাজনের কোনটিতেই পড়ে না- তাদের জন্যও।
পুঁজিবাদের সবকিছুর সাথে নারীরা তাদের পুনরুৎপাদনশীলতার ভাগ্যের কারণে যে স্বাধীনতা পেয়েছে তা অবসর দিয়ে প্রতিস্থাপন হয়নি, অন্যান্য কাজ দিয়ে হয়েছে। শ্রমশক্তিতে নারী প্রবেশ এবং শ্রমে নারীর অংশগ্রহণের সময়কাল সর্বদাই বৃদ্ধির দিকে ছিল। কিন্তু এখন যেহেতু নারীরা সন্তান জন্মদান ও প্রতিপালনে কম সময় দিচ্ছে, শ্রম বাজারে তাদের অংশ গ্রহণের M আকৃতির প্রকৃতিতে হ্রাস দেখা দিয়েছে। নারীর পরিস্থিতি এজন্য ভঙ্গুর হচ্ছে, একদিকে সন্তান পালন ও গার্হস্থ্য কাজের ভারি বোঝা আছে, অন্যদিকে শ্রম বাজারে তারা সুযোগ সুবিধা হতে বঞ্চিত। যেমনটা নারীরা জানে, এই পরিস্থিতি পুরুষের সমান কর্মজীবন এবং সন্তান নেয়ার ইচ্ছার পাশাপাশি একটি জোরপূর্বক সিদ্ধান্ত। কিছু নারী যে সন্তান না নিয়ে এই দোটানা নিজেদের জন্য সমাধান করে, এটি নিচের জন্মহার হ্রাসের একমাত্র ব্যাখ্যা, যা জনতাত্ত্বিক পরিবর্তন তত্ত্ব দ্বারা অনুমিত। বর্তমানে ইতালি ও জাপানে উর্বরতার হার হল নারী প্রতি ১.২ জন সন্তান; পাশ্চাত্যের সব জায়গায় যেটি ২ এর নিচে। সমগ্র পৃথিবীতে উর্বরতা ১৯৫০ এ নারী প্রতি ৬ জন সন্তান হতে বর্তমানে প্রায় ২.৫ জন এ নেমে এসেছে।
এই পরিস্থিতিতে এটি স্পষ্ট হয়ে যায় যে বাজার নারীর সাথে অসঙ্গতিপূর্ণ। এই অসঙ্গতি পুঁজিবাদী উৎপাদনের মাধ্যমে দুটি বিষয়ে নেমে আসে। প্রথমত, পুঁজির পুঁজি হিসেবে থাকতে হলে প্রলেতারিয়েতের পুনরুৎপাদনের দায়িত্ব নিতে পারে না। এর কারণ হল শ্রমিকরা নিজেদের রক্ষণাবেক্ষণের জন্য দায়ী এবং শ্রম বাজারে বারবার ফিরে আসতে বাধ্য। একইসাথে শ্রম বাজারকে শ্রম বাজার থাকতে হলে ‘লিঙ্গঅন্ধ’ হতে হবে। বাজারকে শ্রমিকদের বাজারের বাইরের বৈশিষ্ট্যের বাইরে শ্রমিকদের মধ্যকার প্রতিযোগিতা মূল্যায়ন করতে হবে। মানুষের অর্ধেক যে নারী- এ বিষয়টি এ সকল বৈশিষ্ট্যের অন্তর্ভুক্ত। কিছু নিয়োগকারীর জন্য যৌনপার্থক্য একটি বাড়তি খরচ হিসেবে আবির্ভূত হয়। নারী শ্রমিকেরা সন্তান নিতে পারে এবং এজন্য সন্তান না নেয়ার ব্যাপারে নির্ভর করা যায় না। অন্য নিয়োগকারীদের জন্য যৌনপার্থক্য একটু সুবিধা হিসেবে আবির্ভূত হয় একই কারণে- নারীরা সহজবশ্য, সস্তা শ্রম দেয়। এভাবে নারীরা পুঁজিবাদী সম্পর্কে নির্বাসিত- কেননা বাজার নারীর শ্রমের ব্যাপারে লিঙ্গঅন্ধ।
নারী এবং বাজারের এই অসঙ্গতি নারী আন্দোলনকে বাধা দিয়েছে। নারীবাদ ঐতিহাসিকভাবে সামাজিক জীবনের লৈঙ্গিক প্রকৃতি মেনে নিয়েছে, কেননা কেবল লিঙ্গের মাধ্যমে নারীরা নারী হিসেবে তাদের পরিচয় নিশ্চিত করতে পারে। এই নিশ্চায়ন আন্দোলনটির জন্য ঐতিহাসিকভাবে সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে, কেননা প্রলেতারিয়েত এবং পুঁজির অস্তিত্বের সাথে নারী পুরুষের অস্তিত্বের ভিত্তি তথা লিঙ্গের সামঞ্জস্য বিধান করা পুরোপুরি সম্ভব নয়। ফলশ্রুতিতে নারীর আন্দোলন দুটি অবস্থানের মাঝে আটকে আছে। এক দিকে, নারীরা পুরুষের সাথে মৌলিক অভিন্নতার ভিত্তিতে সমতার জন্য লড়াই করেছে। কিন্তু তাদের স্বাভাবিক ক্ষমতার যা-ই মিল থাকুক না কেন, পুঁজির জন্য নারী ও পুরুষ কখনোই এক হতে পারবে না। অপরদিকে নারীরা পুরুষের সাপেক্ষে ভিন্ন কিন্তু সমান মর্যাদার ভিত্তিতে লড়াই করেছে। কিন্তু নারীদের অধীনস্থতার জন্য মাতৃত্ব একটি বড় কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে।
শ্রমিক আন্দোলন নারী এবং শ্রমিকদের মধ্যে সঙ্গতি আনতে চেয়েছিল। জার্মান সোশ্যাল ডেমোক্রেসির শুরুর দিকের মার্ক্সের ক্যাপিটাল, এঙ্গেলস এর অরিজিন্স অফ দ্য ফ্যামিলি, প্রাইভেট প্রোপার্টি অ্যান্ড দা ষ্টেট এবং বেবেল এর উইমেন অ্যান্ড সোশ্যালিজম এর মত লেখাগুলো ছিল। শ্রমিক আন্দোলন নারীদের ঘরের বাইরে কর্মক্ষেত্রে এনে পুরুষের সমান অধিকার দিতে চেয়েছিল। সত্যিকার সমতা অর্জনে বিপ্লবের পরবর্তীতে তারা নারীদের যৌন প্রজননের সামাজিক মর্যাদা দিতে চেয়েছিল। গার্হস্থ্যের কাজ এবং সন্তান প্রতিপালন নারী পুরুষের উভয়ের দ্বারা সম্পাদন হওয়ার কথা ছিল। ১৯৭০ এর র্যাডিক্যাল নারীবাদী আন্দোলনের কাছে স্পষ্ট হয়ে গিয়েছিল যে এগুলো নারী এবং পুরুষ শ্রমিকদের মধ্যে সত্যিকার সমতা আনতে পারবে না। শ্রমিকদের সমতা অর্জনের একমাত্র উপায় ছিল লিঙ্গ এবং শ্রমের সীমাবদ্ধতাগুলো বিভক্ত করা; শিশুরা যদি টেস্ট টিউবে হত, তাহলে জন্মদানের সাথে নারীদের করার কিছু ছিল না।
এমনকি শ্রমিক আন্দোলন সুযোগ পাওয়া মাত্র নারীদের ধোঁকা দেয়। ক্ষমতা পেলেই পুরুষরা অর্থনীতি নিয়ন্ত্রণ করত এবং নারীকে নারীর জায়গায় রাখত। ব্রিটিশ কমিউনিস্ট পার্টিতে পুরুষকে গার্হস্থ্যের কাজ থেকে মুক্ত করাই ছিল নারীর ‘পার্টি দায়িত্ব’ এর অংশ। যে পৃথিবী কাজ তথা উৎপাদনশীল শ্রমের দ্বারা চালিত হয়, নারীরা সর্বদাই পুরুষের চেয়ে কম থাকবে। নারী দের পুরুষের সমতায় আনার উদ্যোগ গুলো সর্বদাই ছিল শ্রমিক আন্দোলনের মাধ্যমে নারী দের চাহিদা গুলো শুধু মাত্র মেটানো। এরকম উদ্যোগ পুঁজিবাদের অভ্যন্তরেও নেয়া হয়েছিল, যেগুলোতে বাজারে নারী দের অসুবিধা থেকে রক্ষা করতে কিছু আইন ছিল (যেমন, মাতৃত্ব কালীন ছুটি), চাইল্ড কেয়ার এর জন্য অল্প কিছু সামাজিক কাঠামো ছিল। শ্রমিক আন্দোলন এই রাস্তা ধরে আরও এগুতে পারত। কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে তারা আগায়নি।
শ্রমিক আন্দোলনের মৃত্যু নিয়ে অন্যান্য লেখায় আলোচনা করা হয়েছে। এই মৃত্যু একইসাথে ঐতিহাসিকভাবে এক আন্দোলন থেকে অন্য আন্দোলনে পরিবর্তনের সাক্ষী। বর্তমানে শ্রেণি সংগ্রামে নারীর অবস্থান কেবল চিড় হিসেবে কাজ করে, শ্রেণি সংঘাতের মধ্যকার বিচ্যুতি হিসেবে কাজ করে, যা একে অস্থিতিশীল করে দেয়। তারা সংখ্যাগরিষ্ঠ হলেও এই সংগ্রাম নারীদের সংগ্রাম হবে না। যতদিন প্রলেতারিয়েতরা একটি শ্রেণি হিসেবে থাকবে, নারীরা হারতে বাধ্য। ফলশ্রুতিতে নারী পুরুষে সংঘাত হবে। নারীর আন্দোলন পথচ্যুত করার জন্য সমালোচনার শিকার হতে হবে। কিন্তু সংগ্রামের উদ্দেশ্য অন্য জায়গায়। প্রলেতারিয়েতকে পুঁজির সাথে নিজেদের সম্পর্কের ঊর্ধ্বে গিয়ে নিজেদের শ্রেণি বাধা উপেক্ষা করতে হবে। এর মাধ্যমেই কমিউনাইজেশনের বিপ্লব সম্ভব, যা লিঙ্গ এবং বিভাজন সৃষ্টিকারী সবকিছুর বিলোপ করতে পারে।