শেষ পর্ব: আমার আকাশে পাখি হয়ে উড়বেন?
শাহাজাদী বেগম পেশাগত জীবনে একজন উন্নয়নকর্মী, ১৮ বছর ধরে প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর জীবনমান উন্নয়নে নিরলস কাজ করে যাচ্ছেন। উনি বাংলাদেশে যৌনকর্মী ও শিশুদের মানবাধিকার রক্ষা, এইচআইভি ও এইডসসহ অন্যান্য স্বাস্থ্যসেবা প্রদান, পাচারসহ বিভিন্ন ইস্যুতে গবেষনার কাজ করছেন। এই কাজগুলোর জন্য তাকে দেশের যৌনপল্লীগুলোতে অসংখ্যবার যেতে হয়েছে। সেই অভিজ্ঞতাগুলোকেই গল্পে রূপান্তর করে লেখা হয়েছে “গুহান্তরাল”, ফেমিনিস্ট ফ্যাক্টরে ধারাবাহিক আকারে প্রকাশ হচ্ছে। আজ পড়ুন এর শেষ পর্ব।।
প্রচন্ড যানজটে নয়া পল্টনে থেমে আছে গাড়ি। সুরমা যাচ্ছে পুরান ঢাকার ইংলিশ রোডে। সেখান থেকে যাবে দয়াগঞ্জে। গুলশান থেকে ইংলিশ রোড হয়ে দয়াগঞ্জ যাওয়া বিরাট ঝক্কি। সুরমা ফোনে ফেসবুক খোলে। ঘুরতে ঘুরতে থেমে যায় পৌষালি ব্যানার্জীর গানের ভিডিওতে। মেয়েটা যেমন সুন্দর বাউল গান করে, তেমন দেখতে সুন্দর, তেমনই গ্ল্যামারাস। পেশাগত উৎকর্ষতা আর গ্ল্যামার একসাথে কীভাবে মেইন্টেইন করে, সুরমা ভেবে পায় না। মাঝে মাঝে আশংকা হয় বাহ্যিক সৌন্দর্যের কাছে প্রতিভা না জানি পিছনে পড়ে যায়। নারীর ক্ষেত্রে এই এক সমস্যা। “আগে দর্শনধারী, তারপরে গুনবিচারী” সেই ধারনা থেকে এখনো সমাজ বের হরে পারেনি। পুরুষের ক্ষেত্রে সেসব সমস্যা নেই। প্রায়ই মনে হয়, মানুষের শিক্ষা যতই বাড়ছে ততই নারীকে ভোগ্যপন্য হিসাবে ভাবার মানুষও বাড়ছে। নারী-পুরুষের অর্জিত জ্ঞান নারীকেই নতুন নতুন পন্থায় ভোগের পন্য করে তুলছে।
মাঝে মাঝে নিজের মনেই যুদ্ধ করে সে; সমতা, স্বাধীনতা আর অধিকারের সঠিক প্রয়োগ হচ্ছে কিনা ভেবে। নাকি এইসবের আড়ালে নারীকে আরো বেশি পুরুষের ভোগের পণ্য করছে কিংবা নারী নিজের স্বাধীনতা ও অধিকার প্রতিষ্ঠা করতে গিয়ে অন্য নারীর অধিকার খর্ব, অন্য নারীর সন্মানহানী, বঞ্চনা, প্রতারনার কারণ হচ্ছে এবং দিনশেষে সেই পুরুষগুলোর কাছেই নিজেকে ভোগের বস্তু বানাচ্ছে কিংবা হতে হচ্ছে। হয়তো একটা অংশ পুরুষ সবকিছু দিয়েই নারীকে অধস্তন প্রমাণ করবে, নারীকে ব্যবহার করবে। সুরমা নিজের উপর খুব বিরক্ত হয়। নারী-পুরুষ নিয়ে কাজ করতে করতে মনটা খুব জটিল হয়ে গেছে, কোন কিছুই সাদা চোখে দেখতে পারে না। মনে মনে বলে, “যাকগে, আগে গানটা তো শুনি।”
“সে আবার কেমন পাগল
সে আবার কেমন পাগল বাধালে গোল
সে আবার কেমন পাগল বাধালে গোল নদে এসে
সে আবার কেমন পাগল
একে তো সে গৌড় বরণ রমণীর মন করে হরণ
একে তো সে গৌড় বরণ রমণীর মন করে হরণ
তাই আবার তিলক ধারণ
তাই আবার তিলক ধারণ করেছে নবীন বয়সে
তাই আবার তিলক ধারণ করেছে নবীন বয়সে
সে আবার কেমন পাগল
বেলারে করোনা হেলা
বয়ে যায় তোর ভবের খেলা
বেলারে করোনা হেলা
বয়ে যায় তোর ভবের খেলা
ভূষণ বলে গেলে বেলা
আবার ভূষণ বলে গেলে বেলা বারবেলা পড়িবে শেষে
ভূষণ বলে গেলে বেলা বারবেলা পড়িবে শেষে
সে আবার কেমন পাগল।”
সুরমার সাধারণ ভাবনায় মনে হলো এটি নারী-পুরুষের প্রেমের গান। কিন্তু ভিডিওর নিচে গানের কথার সাথে ভাবার্থ দেওয়া আছে, “চৈতন্য অঙ্গে একাধারে শ্যাম ও রাইয়ের বাস। সেই সোনার গৌরের কৃষ্ণপ্রেম দিনে দিনে ঝুলনের ষোলকলা চাঁদের মত দীপ্তি পায়। আর চৈতন্যের আপাত উম্মাদনা কৃষ্ণের পরশে হয়ে ওঠে এক পরম, দেহাতীত ঈশ্বরচেতনা।”
সুরমা বাউল গান শুনতে পছন্দ করে কিন্তু এই তাত্ত্বিক কথাবার্তা সে বোঝে না। দেহের মধ্যে দেহাতীত ঈশ্বর চেতনা- বড্ড কঠিন আর গোলমেলে লাগে। ভিতরে ভিতরে আরেক ধরণের দ্বন্দ্ব কাজ করে, কখনো অস্থির লাগে, কখনো বিষন্ন লাগে। অস্থিরতা কিংবা বিষন্নতার সময়ে সে কোনকিছু না ভেবে হিন্দি সিনেমার নাচের গান ছাড়ে। বিশেষ করে ঐশ্বরিয়ার নাচের গানগুলো- বার্ষো রে মেঘা মেঘা, তাল সে তাল মিলা, ডোলা রে ডোলা রে, মেরা মাহি বড়া সোরা হে, নিম্বুড়া নিম্বুড়া …। ঘরে থাকলে এই গানগুলোতে সে আপন মনে নাচতে থাকে। ঐশরিয়ার নাচের মধ্যে এক ধরনের কোমলতা ও শক্তি আছে, টের পায় সুরমা। কেন যেন এই মুদ্রাগুলোকে সে সহজেই নিজের মধ্যে আয়ত্ত্ব করতে পারে। কখনো কখনো রাংগিলো মারো ঢোলনা, ছাইয়া ছাইয়া, ছাম্মা ছাম্মা এমনকি মুকাবিকা মুকাবিলা’র সাথে সেমি ক্ল্যাসিক্যাল করতেও বেশ লাগে।
পুরো দুইঘন্টা লাগলো ইংলিশ রোডে পৌঁছতে। সুরমা নামলো ঠিক যেই জায়গাটিতে কান্দুপট্টি যৌনপল্লী ছিল। এখন সেখানে দোকানপাট উঠেছে, ঢাকার একেবারে কেন্দ্রবিন্দু। সুরমা আশেপাশের লোকজনের সাথে টুকটাক কথা বললো। ১৯৯৭ সালে কান্দুপট্টি যৌনপল্লী উচ্ছেদ হয়। জায়গাটার প্রতি মানুষের লোভ ছিল। ধর্মের পবিত্রতা রক্ষার দোহাই দিয়ে স্বার্থান্বেষী মহল উচ্ছেদ করে। উচ্ছেদ হওয়া শত শত নারী রাস্তায়, সন্তান নিয়ে দিন কাটায়। তাদের মধ্যে অনেকেই রাস্তার/ভাসমান যৌনকর্মী (স্ট্রিট বেইজড/ফ্লোটিং) হিসাবে জীবন যাপন শুরু করে। সেই মেয়েদের নিয়ে উল্কা নারী সংঘ নামে একটি সংস্থা গঠন করা হয়েছে। সুরমা দয়াগঞ্জে উল্কা নারী সংঘে যায়। সংগঠনের এক্সিকিউটিভ কমিটির সাথে এবং কিছু মেয়েদের সাথে কথা বললো কান্দুপট্টি যৌনপল্লী উচ্ছেদ ও তাদের অভিজ্ঞতা নিয়ে।
উচ্ছেদের কথা যখন থেকে শোনা যাচ্ছিলো, নারী অধিকার সংগঠন নারীপক্ষের কয়েকজন প্রতিষ্ঠাতা সদস্য ব্রোথেলে যায় সেখানকার মেয়েদের পরিস্থিতি বোঝার জন্যে। ওখানকার একজন নেত্রী মমতাজ আপার সাথে তাদের পরিচয় হয়, মমতাজ আপাই তাদেরকে ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে ব্রোথেলের মেয়েদের সাথে কথা বলিয়ে দেয়, পরিস্থিতি ব্যাখ্যা করে। নারীপক্ষের প্রতিনিধিরা অফিসের ঠিকানাসহ স্লিপ দিয়ে আসে যে কোন দরকারে যোগাযোগ করার জন্য।
উচ্ছেদ প্রতরোধের জন্য নারীপক্ষ বেশ কিছু কর্মসূচি যেমন মানব বন্ধন, সংবাদ সম্মেলন করলো। বাংলাদেশ উইমেন হেলথ কোয়ালিশন (বি ডব্লিউ এইচ সি), নারী মৈত্রী ও কেয়ার বাংলাদেশ সেগুলোতে যোগ দিল। উচ্ছেদের প্রথম হুমকি যখন আসে মমতাজ আপা আরো কয়েকজন যৌনকর্মীকে সাথে নিয়ে নারীপক্ষে গিয়ে উঠলো। নারীপক্ষ সদস্যদের চাঁদা থেকে মমতাজ আপাকে এক বছরের ইন্টার্নশিপের ব্যাবস্থা করল। সেখানে মমতাজ আপাসহ অন্যান্য নেত্রীদের দস্তখত শেখানো, প্রেস রিলিজ লেখা, সংগঠন তৈরি এইসব হাতে কলমে শেখানো হয়। একসময় সমতাজ আপাকে সভানেত্রী করে “উল্কা নারী সংঘ” গঠন করা হয়। সেই সাথে ৮৬টা এনজিও মিলে “সংহতি” নামে একটি নেটওউয়ার্ক গঠন করে নারীপক্ষের সহযোগিতায়। সংহতি যৌনকর্মীদের অধিকার আন্দোলনে কাজ করতো, মমতাজ আপার সাথে বিভিন্ন সরকারি ও বেসরকারি অফিসে যেত, সংবাদ সম্মেলনে সাথে থাকতো। এই আন্দোলনে হিজড়া যৌনকর্মীরাও সামিল হল।
সুরমা পরের দিন নারায়নগঞ্জে গেলো অক্ষয় নারী সংঘে, টানবাজার- নিমতলী যৌনপল্লীর উচ্ছেদকৃত যৌনকর্মীদের সংগঠন। সুরমা সেখানে নেত্রীদের সাথে বসলো উচ্ছেদের ঘটনা জানার জন্য।
সুন্দরীর বয়স ৮ বছর। বাবা মারা গেলে মায়ের সাথে নানার বাড়িতে গিয়ে উঠলো সুনামগঞ্জে। কিছুদিন পরে মায়েরও বিয়ে হয়ে গেল নরসিংদীতে। মাঝে মাঝে সে মায়ের নতুন সংসারে গিয়ে কয়েকদিন করে থেকে আসতো। কিন্তু তার সব সময় মায়ের কাছে থাকতে ইচ্ছে করে। মায়ের কাছে যাবে বলে একদিন সে একা একা বাস স্ট্যান্ডে যায়। সেখানে একজন লোক তাকে মায়ের কাছে পৌঁছে দেবার কথা বলে বাসে তোলে। সারাদিন শেষে তারা এক শহরে নামে, হোটেলে ভাত খায়। তারপর আর মনে নেই। যখন ঘুম ভাঙ্গে তখন একটা বাড়িতে বিছানায় শোয়া। সেই লোক বসা, সাথে একজন মহিলা বসা। সুন্দরী মায়ের খোঁজ করে। মহিলা বলে,
– এ তো অনেক ছোড মাইয়া।
– পাইলা পুইষা বড় কইরা নিবেন, লোকটা বলে। একটু থেমে সুন্দরীর দিকে তাকিয়ে বলে, এই খালা তোমারে মায়ের কাছে নিয়া যাবে।
লোকটা চলে যায়। মহিলা সুন্দরীকে নিয়ে তার বাড়িতে যায়। সুন্দরী বিক্রি হয়ে গেল নারায়নগঞ্জের বিখ্যাত টানটাবাজার যৌনপল্লীর সর্দারনী জমিলার কাছে। জমিলা সুন্দরীকে ২ বছর নিজের কাছে রেখে বড় করে। তারপর একদিন টানবাজার যৌনপল্লীতে নিয়ে যায়। জমিলা দেখতে কালো, সুন্দরীর গায়ের রঙও চাপা। পল্লীতে অন্যরা ভাবলো সুন্দরী জমিলার নিজের মেয়ে। সেই সময়ে অর্থাৎ আজ থেকে প্রায় ২৮ বছর আগে, যৌনকর্মীদের কন্যা সন্তান হলে তারা খুশি হতো কারন সেই মেয়েকে দিয়েও “দেহ ব্যবসা” করাতে পারবে, তাতে রোজগার বাড়বে। পৃথিবীতে একমাত্র যৌনকাজেই নারীর গুরুত্ব কিংবা মূল্য সবচেয়ে বেশি- হোক সেটি (পেইড অর আনপেইড) অর্থের বিনিময়ে, ভালোবাসার বিনিময়ে, বৈবাহিক সম্পর্কের বিনিময়ে কিংবা পেশীশক্তির বিনিময়ে জোর করে। সুরমার বুকের ভিতরে ভাঙ্গচুর হতে থাকে। এক জীবনে নারীকে কত কাজ করতে হয়, কত ভূমিকা পালন করতে হয়। অথচ সবকিছু ছাপিয়ে শধু যৌনকাজে অংশগ্রহণ সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ এই পুরুষতান্ত্রিক সমাজের কাছে।
তবুও যৌনপল্লীর আরেক সর্দারনী জিজ্ঞেস করলো
– নিজের মাইয়াডারে কামে নামাইতেছ?
– হ, লেখাপড়া করে না, ঘরের কামে কাজে মন নাই, দেখতেও কালা। বিয়া দিতে অনেক ট্যাকা লাগবো। তার চাইতে অরে দিয়াই ট্যাকা কামাই।
– মাইয়া তো অনেক ছোড। মনে হয় অহনও মাসিক হয় নাই, সর্দারনী নিজের মনে বলে।
জমিলা একজন খদ্দেরকে নিয়ে একটা ঘর দেখিয়ে সুন্দরীকে বলল, “যা কাস্টমার বসা।”
সুন্দরী লোকটাকে নিয়ে ঘরে ঢুকে বিছানায় বসতে দিয়ে নিজে টুলের উপরে বসে থাকে। ব্রোথেলে কাস্টমার বসানো মানে তার সাথে যৌনকাজ করা। কিন্তু সুন্দরী সেটা জানে না। কিছু না করেই বেরিয়ে এলো তারা। জমিলা সুন্দরীকে মারতে মারতে বাড়িতে নিয়ে গেল। মাসখানেক পরে আবার টানবাজারে নিয়ে গেল। এবার তাকে বুঝিয়ে দিলো কীভাবে কি করতে হবে। সেদিন যা হয়েছিলো সেটা ভাবলে এতবছর পর আজো সুন্দরীর গা শিউরে ওঠে। “একজন কাস্টমাররে নিয়া আইসা দুইজন সর্দারনী সাথে ধইরা আমারে রেপ করাইলো গো আপা! যন্ত্রনায় যখন চিক্কুর পারি, এক সর্দার্নী তখন আমার মুখ চাইপা ধইরা থাকে।”
সুন্দরীর শুরু হল টানবাজার ব্রোথেলে আরেক জীবন। কিন্তু তার ভালো লাগতো না। মাস ছয়েক পরে সে একদিন পালালো। কাছাকাছি এক বাড়িতে আশ্রয় পেল, কাজকর্ম করে থাকে, খায়। বছর দুই পরে সে নিজে স্বাধীন যৌনকর্মী হিসাবে টানবাজারে ঢুকলো। বছর তিনেক ওখানে থাকলো। কিন্তু তার ওখানে মন টিকে না। বাংলাদেশ উইমেন হেলথ কোয়ালিশন (বি ডব্লিউ এইচ সি) নামে একটি এনজিওতে সে চাকরি পায় টানবাজার-নিমতলী যৌনকর্মীদের স্বাস্থ্যসেবা দেবার জন্য। কিছুদিন পরে সে ব্রোথেলের বাইরে চলে আসে। কিন্তু এনজিওর কর্মী হিসাবে সেখানে প্রতিদিন কাজের জন্য যায়।
সুন্দরীর মতে প্রায় হাজার সাতেক মেয়েদের বাস ছিল সেখানে। বেশির ভাগ বাড়িগুলোই ৪-৫ তলা বিল্ডিং। মাত্র দুটো টিন শেডের বাড়ি ছিল। টানবাজার যৌনপ্ললীর সামনে একটা চিকন খাল। তার ওপাশের নিমতলী যৌনপল্লী। টানবাজার-নিমতলী একসাথেই বলে ও চলে। ১৯৯৯ সালের দিকে টানবাজার যৌনপল্লীর ভিতরে “………খাঁ”র বাড়িতে একজন যৌনকর্মী খুন হয়। সেই খুনকে কেন্দ্র করে অনেক হাঙ্গামা হয় দুই বড় রাজনৈতিক দলের নেতাদের মধ্যে। এক দলের নেতা এসে মেয়েদেরকে বললো তাদেরকে পূনর্বাসন করবে, যারা যারা চায় তাদেরকে হজে পাঠাবে কিন্তু যৌনপল্লী থাকবে না। কিছু কিছু মেয়ে অন্য জায়গায় চলে গেলো। কিন্তু বেশির ভাগ মেয়েই কী করবে বুঝতে পারছিলো না। সবার আগে মমতাজ আপাই সোচ্চার হল। সাথে নারী সংগঠন নারীপক্ষ, বি ডব্লিউ এইচ সি অনেক পদক্ষেপ নিলো কিন্তু পারলো না উচ্ছেদ ঠেকাতে। একদিন গভীর রাতে পুলিশ ও কয়েকজন কর্মকর্তা এসে কয়েকটা বাস ভর্তি করে টানবাজার-নিমতলীর সব মেয়ে ও শিশুদের নিয়ে গেল। কিছু কিছু মেয়ে রাতের অন্ধকারে পালাতে পেরেছিল। বাকিদেরকে নিয়ে গেল। নেবার সময় জানিয়েছিল তাদেরকে ভবঘুরে কেন্দ্রে (সরকারি আশ্রয় কেন্দ্র) নিয়ে যাচ্ছে। যৌনকর্মী নেত্রীরা বলল কিছু মেয়েদেরকে কোন একটা চরে নিয়ে ছেড়ে দিয়েছে। সারারাতে স্থানীয় মাস্তানেরা হরিলুট করলো ব্রোথেলের ভিতরে মেয়েদের ঘরে থাকা সব জিনিসপত্র। কিছু মেয়ে আশ্রয় পেল নারীপক্ষের প্রতিষ্ঠাতা সদস্য, একশন এইড বাংলাদেশের সাবেক কান্ট্রি ডিরেক্টর নাসরিন হক আপার বাসায়। নাসরিন আপা মেয়েদেরকে ওনার বাসায় অনেকদিন রেখেছিলেন। যে মেয়েগুলো পালাতে পেরেছিল তারা রাস্তার পাশে আশ্রয় নিলো। নারীপক্ষ এবং বি ডব্লিউ এইচ সি’র সহযোগিতায় টানবাজার-নিমতলী থেকে উচ্ছেদকৃত যৌনকর্মীদের নিয়ে অক্ষয় নারী সংঘ গঠন করলো সুন্দরী। সুন্দরী (ছদ্ম নাম) সেই সংস্থার সভানেত্রী। নারীপক্ষ আরো কিছু সংস্থাকে সাথে নিয়ে হাইকোর্টে রিট পিটিশন করলো ব্রোথেল উচ্ছেদের বিরুদ্ধে। এক যুগান্তকারী রায় হলে। রায়ে টানবাজার-নিমতলী যৌনপল্লী উচ্ছেদকে বেআইনী এবং যৌনকর্মকে একটি পেশা হিসাবে স্বীকৃতি দিল। কিন্তু রায়ে যেটা বলা হল না, মেয়েগুলোকে আবার তাদের জায়গায় ফিরিয়ে দেওয়া হোক, বলা হল না শত শত নারী ও শিশুর কী হবে, বলা হল না যারা উচ্ছেদের সাথে জড়িত ছিল তাদের কোন শাস্তি হবে কিনা। কাজেই এই রায় ওখানকার মেয়েদের কোন কাজে এলো না। তবে অন্য ব্রোথেল উচ্ছেদের বিরুদ্ধে আন্দোলনে হাতিয়ার হিসাবে ব্যবহার করা হল।
ঢাকায় ফেরার পথে সুরমা ভাবছিলো এই দুই দিনে কান্দুপট্টি, টানবাজার-নিমতলী উচ্ছেদের বিষয়গুলো দেখতে গিয়ে একটি বিষয় স্পষ্ট হয়েছে তার কাছে। নারীপক্ষ হলো যৌনকর্মীদের অধিকার রক্ষার আন্দোলনের সূতিকাগার, এবং নারীপক্ষই যৌনকর্মীদের অধিকার আন্দোলনকে নারী অধিকার আন্দোলনের সাথে সংযুক্ত করেছে বিভিন্নভাবে। এদেশে যৌনকর্মী অধিকার আন্দোলনে বেশ কিছু দেশি বিদেশি উন্নয়ন সংস্থাও নেটওয়ার্ক জড়িয়েছিল নারীপক্ষকে ঘিরে। উল্লেখযোগ্য নাম হল বাংলাদেশ উইমেন হেলথ কোয়ালিশন (বি ডব্লিউ এইচ সি), নারীমৈত্রী, দুর্বার নেটওয়ার্ক, সংহতি, কেয়ার বাংলাদেশ, কনসার্ন ওয়ার্ল্ড ওয়াইড এবং অক্সফাম, একশন এইড । সেটি আরেক ইতিহাস। নারীপক্ষের মাহবুবা মাহমুদ লীনা আপা, সামিয়া আফরিন আপা, জাহানারা আপা, বি ডব্লিউ এইচ সির রেবেকা সানিয়াত আপার দুর্দান্ত সাহসী ভূ্মিকা আজও যৌনকর্মীদের মুখে মুখে।
বাসায় পৌঁছতে সন্ধ্যা হয়ে গেলো। বসার ঘরে ঢুকতেই মায়ের ডাক
– সুমু
– হ্যাঁ মা
– তোর বাবা একটা স্পেশাল গ্রিন টি এনেছে। এখন নিজে বানিয়ে আনছে। তুই এক ঝটকায় ফ্রেশ হয়ে আয়। তিনজনে একসাথে চা খাবো।
বাবাটা এমনই। বাবা মা’র ৪০ বছরের সংসার। হঠাৎ হঠাৎ বাবার এমন চা বানানোর শখ হয়। সুরমা এখন বোঝে মা বাবার প্রেমে তখন অলৌকিকতা ভর করে।
সুরমা হেসে ঘরে যায়। দ্রুত চেঞ্জ করে হাত মুখ ধুয়ে বারান্দায় এসে দেখে মা-বাবা আগেই বসে আছে। চায়ের সাথে কুকিজ আছে। মা-ই কথা তুললেন , ‘‘হ্যাঁ রে সুমু, বিয়ের কথা কিছু ভাবছিস?”
– ও মা।। এত তাড়াহুড়ো কেন? তাছাড়া ওসব ভাবার জন্য তো তোমরাই আছো।
– মাঝে মাঝে ভয় হয়। এই বয়সেই নারী-পুরুষ সম্পর্কের অনেক অপ্রিয় সত্য তুই জেনে গেছিস, তিক্ত নোংরা দিকগুলোও তুই জানিস। যদি এসব কারনে তোর মধ্যে পুরুষ কিংবা বিয়েভীতি তৈরি হয়!
– তোর কি কোন পছন্দ আছে? তোকে কিছুটা বোঝে, তুই কি নিয়ে কাজ করিস সেসব জানে, কিছুটা একই ধরনের মানসিকতার?
বাবা হেসে জিজ্ঞেস করেন।
– না বাবা।
– অনেকে কথা বলতে চায়, আমরা কি কথা বলবো?
– তোমরা প্রাথমিকভাবে কথা বল বাবা। কিন্তু আমাকে কথা বলতে দিও। মা, আমি কিন্তু কাল অফিসে যাবো না।
– কেন ? শরীর খারাপ?
– না। আমার অনেক ছুটি পাওনা হয়ে গেছে। আগামী দু’দিন ছুটি নিয়েছি। শুধু ঘুমাবো মা।
রাতে সুরমা আর ওর বাবা মিলে স্পেশাল ডিশ রান্না করলো। রাতের খাবার শেষে তিনজন মিলে “শকুন্তলা দেবী” সিনেমা দেখে অনেক রাতে ঘুমাতে গেল।
পরদিন সকাল সাড়ে দশটায় সুরমার ঘুম ভাঙলো মায়ের ডাকাডাকিতে।
– সুমু তোর একটা পার্সেল আছে।
বলেই মা একটা প্যাকেট সাইড টেবিলে রেখে গেল। আলসেমিতে ভর করে শুয়ে থেকেই হাত বাড়িয়ে নিলো। পাতলা চারকোনা বড় প্যাকেট। বাম পাশে লেখা আশিক পারভেজ, ফরিদপুর। সেই সাংবাদিক! সুরমা বেশ অবাক হয়। প্যাকেটটি খুলে আরো অবাক হয় বাউল সম্রাট শাহ আব্দুল করিমের গানের গ্রামোফোন রেকর্ড। বাউল গানের গ্রামোফোন রেকর্ড! বিস্ময় যেন ছাড়ছেই না, স্বপ্ন দেখছে নাতো। রেকর্ডের প্যাকেটের গায়ে লেখা দেখে বুঝলো বাউল সম্রাটের নিজের গাওয়া বাছাই করা গানগুলি নিয়ে একটি কোম্পানী উদ্যোগী হয়ে করেছে। সুরমা আধশোয়া হয়ে রেকর্ডটি উলটে পালটে দেখতেই প্যাকেটের ভিতর থেকে এক টুকরা কাগজ পরলো তার কোলের উপর।
ভাঁজ করা একটুকরা কাগজ। খুলতেই বাম পাশে গোটা গোটা অক্ষরে লেখা,
“আমি দুবছরের জন্য বিবিসি লন্ডনে অফার পেয়েছি। জয়েন করবো আগামী মাসে।”
আর ডান দিকে লেখা-‘‘তোমার কুঞ্জ সাজাও গো, আজ আমার প্রাণনাথ আসিতে পারে।
আমার ভীষন ভীষন পছন্দের একটি পদ। আমি ফানাফিল্লাহ হয়ে যাই। তাই এই ধরনের পদ আমি ইচ্ছে করেই কম শুনি। ছোটবেলায়, নিজ ঘর থেকে পাটালি গুড় চুরি করে রাতে লেপের নিচে শুয়ে শুয়ে অল্প অল্প করে খেতাম। পাটালি গুড়ের সৌরভে মন উতলা হয়ে থাকতো। সারারাত ঘুমাতাম না। আর পুরোটা খেয়েও ফেলতাম না। মনে হতো, খেলেই শেষ হয়ে যাবে। মনে হতো, এটা পাটালি গুড় নয়-এটা অলৌকিক কিছু। পদকর্তা শাহ আব্দুল করিম যখন বলেন, ‘আসিলেও আসতে পারে, ভরসা অন্তরে। করিমে কয়, পাইলে কি আর ছাইড়া দিমু তারে…’ তখন আর এটা কিছুতেই জাগতিক থাকে না, তখন অলৌকিকতা এসে ভর করে।”
সুরমার বিস্ময় এবার সীমা ছাড়িয়ে যায়। মনে মনে ভাবে, “এভাবে কেউ কাউকে……” মোবাইলের রিংয়ের শব্দে ভাবনায় ছেদ পরে। আশিকের ফোন। রিসিভ করতেই অপাশ থেকে,
– আপনাদের ঢাকার আকাশ এত ছোট!
– মানে কী?
– কাল ঢাকায় এসেছি, বোনের বাসায় উঠেছি। আজ এমবেসিতে যাচ্ছি। এখন নয়া পল্টনে জ্যামে বসে আছি। জানালা দিয়ে আকাশ দেখার চেষ্টা করলাম, দুই পাশে গাড়ি আর উঁচু উঁচু দালানকোঠায় আমার ছোট্ট গাড়িতে বসে এক চিলতে আকাশ কোনোভাবে নজরে এলো।
আমার মনের আকাশটা কিন্তু অনেক বড়! সেই আকাশে পাখি হয়ে উড়বেন?
[গুহান্তরাল সমাপ্ত]
[চলবে]
পড়ুন দ্বিতীয় পর্ব- পর্ব-২: খানকিগো আবার দাফন কীসের?
পর্ব-৩: টাঙ্গাইলের পুণ্যভূমিতে পাপীষ্ঠাদের আর জায়গা হবে না
পর্ব-৪: ‘ভালো হইতে চাইছিলাম, দিলেন কই?’
পর্ব-৫: ‘আমরা তো খারাপ কাজ করি, তাই দোয়া চাই আল্লাহর কাছে’
পর্ব-৬: ‘পিন্দনের কাপড় খুইলা টাকা কামাই, পিন্দনেরই কাপড় কেনার লাইগা’
পর্ব-৭: ‘সমাজে যেমুন ব্যাডারা বউরে পিডায়, আমাগোও বাবুরা মারে’
পর্ব-৮: ‘সারাদিন ভালবাসলো, সন্ধ্যায় যৌনপল্লীতে নিয়া বেইচা দিয়া গেল’
পর্ব-৯: ‘‘এই যৌনপল্লীর মাইয়াগো উন্নতি করতে চাই”
পর্ব-১০: “একজন খদ্দের না পাইলে ভাত পাবো কোম্মে”
পর্ব-১১: ‘আমি ভালোবাসি মাইয়াগো, ব্যাডাগো সাথে শুইলে আমার গা গোলায়!’
পর্ব-১২: “এসএসসি’র নিবন্ধনের সময় মাইয়ারে নিজের বইলা স্বীকৃতি দিলো”
পর্ব-১৩: “যৌনপল্লী না থাকলে সমাজে কোন পরকীয়া, সুইসাইড থাকবে না”
পর্ব-১৪: টিকে থাকাই জীবন, বেঁচে থাকাই জীবন
পর্ব-১৫: যুদ্ধ, দুর্ভিক্ষ, বঙ্গবন্ধুরে মারল; এইসবের মইধ্যেও ওগো মাইয়া মাইনষের শরিল লাগে