November 25, 2024
কলামফিচার ২

বাংলাদেশে ইন্ডিজেনাস ফেমিনিজম বা আদিবাসী নারীবাদের প্রাসঙ্গিকতা

ইমতিয়াজ মাহমুদ।। নারীবাদ বা ফেমিনিজম কথাটা যখন থেকে শুরু হয়েছে, বিশ শতকের শুরুতে বা তারও আগে উনিশ শতকের শেষ দিকে, তখন থেকেই নারী অধিকার নিয়ে যারা সংগ্রাম করেন তাদের মধ্যে মতাদর্শগত বিভক্তি ছিল। মোটা দাগে সবচেয়ে বড় বিভক্তি যেটা, সেটা ছিল কমিউনিস্ট ও সমাজতন্ত্রীদের সাথে সেসময় ইউরোপে নারীদের ভোটাধিকার ও অন্যান্য রাজনৈতিক ও সামাজিক অধিকার নিয়ে আন্দোলন করছিলেন তাদের মধ্যে। কেননা কমিউনিস্ট ও সমাজতন্ত্রী নারীনেত্রীরা নারীর জন্যে আলাদা করে বিচ্ছিন্নভাবে এইসব দাবী দাওয়া উত্থাপনের মধ্যে নারীর সমস্যার কোন সমাধান দেখতেন না। ওদের বক্তব্য ছিল যে শ্রেণি শোষণের বিলোপ করে নতুন সমাজ গঠন করতে না পারলে বিচ্ছিন্নভাবে ঐসব দাবিদাওয়াতে নারীর মুক্তি হবে না। ভোটাধিকার ইত্যাদি জরুরি বটে, কিন্তু তাতেই নারীর মুক্তি হবে না। বিশেষ করে শ্রমজীবী নারীর ক্ষেত্রে- ভোটাধিকার বা সেরকম কিছু কিছু বিশেষ সুযোগ ও অধিকার মধ্যবিত্ত স্বচ্ছল নারীদের জীবনে কিছু ইতিবাচক পরিবর্তন হয়তো নিয়ে আসবে, কিন্তু শ্রমজীবী নারীর মুক্তি আসবে না। কমিউনিস্টদের সাথে নারীবাদের এই বিভক্তি খুবই স্পষ্ট বলে কমিউনিস্টরা বা কমিউনিস্ট নারী নেত্রীরা নিজেদেরকে নারীবাদী বলতেও পছন্দ করেন না- কেননা তাদের কাছে নারীবাদী আন্দোলন তো সমাজ বদলের লড়াইয়ের পরিবর্তে এক ধরনের সমাজ সংস্কারের আন্দোলন। যদিও নারীর অধিকার প্রশ্নে নানান ইস্যুতে আজকাল দেখা যায় যে নারীবাদী ও কমিউনিস্টরা একসাথে হয়েই কাজ করে।

কমিউনিস্ট ও সমাজতন্ত্রীদের সাথে এই বিভক্তি তো আছেই। কিন্তু পশ্চিমা ধারার যে নারীবাদী আন্দোলন বা অ-কমিউনিস্ট নারীবাদী আন্দোলন এদের মধ্যেও আবার নানারকম ভাগ যে আছে সেটাও তো আমরা দেখতে পাই। এইটাকে সবসময় বিভক্তি হয়তো বলা যায় না, কিন্তু এই একেকটা ভাগ যে চিন্তার একেকটা স্বতন্ত্র ধারা সেকথা তো নিশ্চয় করেই বলা যায়। নারীবাদের এইসব নানাপ্রকার ধারার মধ্যে পারস্পরিক কিছু কিছু বিরোধ আছে, বিতর্ক ও ভিন্নমত তো আছেই, কিন্তু মুল লক্ষ্য মোটামুটি সকলেরই একটাই- বৈষম্য ও শোষণ থেকে নারীরই মুক্তি ও সমাজে নারীরই সমান অধিকার বাস্তবায়ন। কৌতূহল জাগানিয়া ব্যাপার হচ্ছে, নারীবাদীদের এইসব নানা ধারার মধ্যে সোশ্যালিস্ট ফেমিনিজম বা সমাজতন্ত্রী নারীবাদ বলেও একটা ধারা আছে। এই লেখাটা সমাজতন্ত্রী নারীবাদ নিয়ে নয়। এই লেখাটা হচ্ছে ইন্ডিজেনাস ফেমিনিজম বা আদিবাসী নারীবাদ ও বাংলাদেশে এর প্রাসঙ্গিকতা নিয়ে। নারীবাদ চর্চায় আদিবাসী নারীবাদ নামে এই শাখাটি অপেক্ষাকৃত নতুন হলেও দুনিয়াজুড়ে আদিবাসী নারীদের অধিকার আদায়ের সংগ্রামে এই চিন্তাটি ইতিমধ্যেই একটা গুরুত্বপূর্ণ জায়গা দখল করে নিয়েছে, কিন্তু আমাদের এখানে, বিশেষ করে আমাদের আদিবাসী নারীদের মধ্যে, এইটা নিয়ে সেরকম কোন আলোচনা লক্ষ্য করা যায়নি। এইজন্যেই আলোচনাটা।

আগে বুঝে নিই আদিবাসী এবং আদিবাসীদের প্রতি ক্রমাগত চলে আসা শোষণ ও বঞ্চনার ধরন এবং তাদের দাবিদাওয়া ও অধিকারের রূপ। ইংরেজি ইন্ডিজেনাস শব্দটাকে বাংলায় আদিবাসী করা হয়েছে বটে, কিন্তু আন্তর্জাতিকভাবে আইন রাজনীতি কূটনীতি ইত্যাদির ক্ষেত্রে ইংরেজি ইন্ডিজেনাস কথাটা এবং সেইসাথে বাংলা আদিবাসী কথাটা এখন একটা আলাদা অর্থ ধারণ করেছে। এইটা হয়েছে ২০০৭ সনে আদিবাসী অধিকার সংক্রান্ত জাতিসংঘের ঘোষণা বা United Nation’s Declaration on the Rights of Indigenous People গৃহীত হওয়ার পর থেকে। কেননা এই ঘোষণাটায় পৃথিবীর প্রায় সব দেশই মেনে নিয়েছে যে আদিবাসী জনগণের ভূমির অধিকার, আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকার ও নিজের সংস্কৃতি ও পরিবেশ রক্ষার অধিকারকে যেমন স্বীকার করতে হবে, সেই সাথে ওদের সেইসব অধিকার ওদের জন্যে নিশ্চিত করতে হবে। দায়িত্বটা হচ্ছে যে রাষ্ট্রে আদিবাসীরা বাস করে, সেই রাষ্ট্রের উপর।

আর আদিবাসী কারা? ২০০৭ সনের ঘোষণায় আলাদা করে সেটার সংজ্ঞা দেওয়া হয়নি কারণ সংজ্ঞা বেঁধে দিলে কথাটার অর্থ সীমিত হয়ে যায়। তাছাড়া আদিবাসী কথাটার পরিধি বা আদিবাসী বলতে কোন ধরনের জনগোষ্ঠীকে বুঝানো হচ্ছে সেটা কিন্তু ঘোষণাটা পাঠ করলে এমনিই বোঝা যায়। এছাড়া আইএলও’র আরেকটা কনভেনশনে আদিবাসী বা ইন্ডিজেনাস কথাটা এর আগে একবার ডিফাইন করা হয়েছে, সেটাও আছে। এইসব থেকে আপনি আদিবাসী বলতে মোটামুটিভাবে তাদেরকেই বুঝবেন যেসব জনগোষ্ঠী বা গোত্র কোন একটা সার্বভৌম রাষ্ট্রের সংখ্যাগুরু জনগণের চেয়ে সাংস্কৃতিক ও নৃতাত্বিকভাবে ভিন্ন, যাদের অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডের ধরণ আলাদা, জীবনযাপনের ধরণ আলাদা এবং সেটা ওরা ধরে রাখতে চায়। খুবই সোজা, সেইসব জনগোষ্ঠী গোত্র কওম বা ট্রাইব যারা রাষ্ট্রের সংখ্যাগুরু জনগণের চেয়ে সাংস্কৃতিকভাবে, নৃতাত্বিকভাবে, অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডের ধরণ বিচার ইত্যাদিতে ভিন্ন ও স্বতন্ত্র এবং সেইটা ওরা রক্ষা করতে চায়। সংখ্যাগুরু কখনো আদিবাসী হয় না, কেননা আপনি যদি একটি দেশের সংখ্যাগুরুই হয়ে থাকেন তাইলে তো ল্যাঠাই চুকে গেল, আপনার অধিকার তো আর কেউ খর্ব করতে পারবে না আরকি। আদিবাসী অধিকারের প্রশ্নটা আসে কেবল ওদের জন্যে যারা জাতিগতভাবে সংখ্যালঘু। আর একটা ভূখণ্ডে হিস্টোরিক্যালি কে আগে আগে এসে বসবাস গেড়েছে বা কোন জনগোষ্ঠী পরে এসে বসবাস শুরু করেছে বা কোন জনগোষ্ঠী আদিমতম বাসিন্দা সেটা বিবেচ্য নয়।

আদিবাসীদের সমস্যাগুলি কী? প্রতিটা দেশের বিশেষ কিছু আলাদা সমস্যা তো আছেই, সেগুলির কথা বাদ দিলাম। বিশ্বজুড়েই প্রায় সকল আদিবাসীই কিছু সাধারণ সমস্যার শিকার- এর অন্যতম হচ্ছে ভূমি বা জমি। পৃথিবীর প্রায় সর্বত্রই দেখা গেছে যে আদিবাসীদের ভূমি দখল করে নেয় সংখ্যাগুরুরা। আরেকটা বড় সমস্যা হচ্ছে সংখ্যাগুরুর হাতে আদিবাসী নারী নির্যাতন। কানাডায় দেখা গেছে এইরকম নারী নির্যাতনের চূড়ান্ত অবস্থা। কানাডায় ও আমেরিকায় আদিবাসী নারী অপহরণ, ওদেরকে বিক্রি করে দেওয়া, হত্যা করা এগুলি তো অনেকটা মহামারির মত রূপ ধারণ করেছিল। এখনো সেই সমস্যা থেকে ওরা বের হয়ে আসতে পারেনি। আরেকটা বড় সমস্যা হচ্ছে আদিবাসীদের অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড ও জীবনধারণের রীতিনীতিতে হস্তক্ষেপ। সংখ্যাগুরুরা সাধারণত যেটা করে, ওরা আদিবাসীদেরকে বন্য অসভ্য হিসাবে চিত্রিত করে আর সভ্য করার নামে ওদেরকে কখনো জোর করে বা কখনো নানান কায়দায় ওদের নিজস্ব জীবনযাপনের কায়দা, চাষবাসের কায়দা এগুলি ভেঙে দেয়। এর ফলে অনিবার্যভাবে দেখা যায় যে আদিবাসীরা বেকারত্ব ও দারিদ্র্যের জালে আটকা পড়ে, ওদের পরিবার প্রথা প্রতিষ্ঠান এইসব ভেঙে গিয়ে একটা করুণ অবস্থা হয়।

আদিবাসী নারীদের অবস্থা তাইলে কি হয়? একটা তো আছে যে নারীরা সরাসরি নির্যাতনের শিকার হয়- কানাডা ও আমেরিকার আদিবাসী নারীদের অপহরণ হত্যা আর জোর করে যৌনকর্মী হিসাবে ব্যাবহার করা সেগুলি নিয়ে তো প্রচুর আন্দোলন সংগ্রাম আলোচনা রাজনীতি মামলা মোকদ্দমা এইসব হয়েছে। আমাদের দেশেও কিন্তু এইটা যে নেহায়েত কম হয় তা কিন্তু নয়। পাহাড়ে সেটেলার বাঙালি ও অন্যান্য বাঙালিদের হাতে আদিবাসী নারী ধর্ষণ ও যৌন নির্যাতনের খবর তো আমরা কিছু কিছু পাই। কোন কোন সময় অভিযোগ ওঠে ইউনিফরম পরা লোকজনের বিরুদ্ধেও। যেসব ঘটনার খবর আমরা পাই, সেইসব ঘটনা ছাড়াও নিয়মিত অনেক ঘটনা ঘটে যেগুলির কোন খবর হয় না, ঢাকায় বসে আমরা জানতেও পারি না। পাহাড়ের বাইরেও সমতলের আদিবাসীদের উপরও একই ধরনের নির্যাতন চলে। সাঁওতাল নারী বা গারো নারী নির্যাতনের খবর কি আমরা মাঝে মাঝে পাই না? পাই তো।

সরাসরি নারী নির্যাতনের ঘটনা ছাড়াও আদিবাসী নারীরা আরও কিছু সমস্যার মুখোমুখি হয় প্রতিনিয়ত যেগুলি সংখ্যাগুরু বাঙালিরা বা বা বাঙালি নারীরা কখনো মোকাবেলা করে না। গারো সমাজের উদাহরণ দিই। আপনারা জানেন যে গারোদের সমাজ প্রথাগতভাবে মাতৃতান্ত্রিক। সম্পত্তির মালিক হয় নারীরা, উত্তরাধিকার হয় মা থেকে মেয়ে এইভাবে আর বিবাহের পর ছেলে যায় মেয়ের বাড়ীতে। গারোদের এই প্রথাগত বা ঐতিহ্যগত ব্যবস্থা এখন ভেঙে পড়ার মুখোমুখি। কেননা ওদের নিজেদের যে অর্থনৈতিক ব্যবস্থা ছিল সেখানে এইটাই যুৎসই ছিল বটে, কিন্তু এখন যেহেতু সেই ঐতিহ্যগত অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডের ধরন বদলে যাচ্ছে, পুরুষদের অনেকেই এখন আর এই ব্যবস্থা মানতে চান না। সাথে যুক্ত হয়েছে সংখ্যাগুরুর সাংস্কৃতিক প্রভাব। ফলে গারো সমাজে ক্রমাগত পুরুষদের মধ্যে একটা প্রবণতা বাড়ছে যে বিয়ের পর ওরা আর স্ত্রীর বাড়ীতে গিয়ে থাকতে চান না। এমনকি সম্পত্তির মালিকানা ও উত্তরাধিকারের প্রথাটাও পাল্টে দেওয়ার পক্ষে কেউ কেউ কথা বলছেন আজকাল।

না, কোন প্রথাই চিরকাল থাকে না। প্রথা ভাঙা সেটাও তো প্রগতির লক্ষণই আরকি। কিন্তু প্রথা ভেঙে আপনি যদি পেছনের দিকে যেতে চান তাইলে সেটা তো আর প্রগতি হলো না। কোনপ্রকার কার্যকারণ ছাড়া নিতান্ত সংখ্যাগুরুর প্রভাবে এইরকম পরিবর্তন সেটাকে তো সবসময় প্রগতি বলা যায় না। কিন্তু সমস্যা যেটা হয়েছে, ঐতিহ্যগতভাবে মাতৃতান্ত্রিক হলেও বাস্তবে গারো পরিবারগুলিতে একরকম পিতৃতান্ত্রিকটা চলে আসছে ধীরে ধীরে, আর মাতৃতান্ত্রিক সমাজের উপযোগী বিধানগুলি তো পিতৃতান্ত্রিকতার সাথে মিলছে না। ফলে নয়া প্রজন্ম আর পুরনো বিধান মানতেও চাইছে না।

আমাদের দেশে নারীবাদী আন্দোলন যেটুকুই বিকশিত হয়েছে সেটা তো শহুরে মধ্যবিত্ত নারীদের মধ্যে। যারা নারীবাদের কথা বলেন, এরা বেশিরভাগই ইংরেজি শিক্ষায় শিক্ষিত, পশ্চিমের সংস্কৃতির সাথে পরিচিত এবং এদের বেশিরভাগই অর্থনৈতিকভাবে আত্মনির্ভরশীল। শিক্ষা ওদেরকে দৃষ্টি দিয়েছে দেখার আর অর্থনৈতিক স্বাধীনতা দিয়েছে সাহস করে কথা বলার। ফলে আমাদের নারীবাদীরা সমাজে বিদ্যমান বৈষম্য ও নির্যাতনটা ঠিকই চিহ্নিত করতে পারেন- সেটা অনেক ক্ষেত্রেই নিজেদের জীবনের অভিজ্ঞতা থেকেই ওরা দেখেন। এই দেখা এবং চিহ্নিত করাটা প্রায় সকলেই একইভাবে করতে পারেন, হয়তো সমাধানের পথ চিহ্নিত করতে গিয়ে ভিন্নমত করেন নিজেদের মধ্যে বা কৌশল নির্ধারণের প্রশ্নে। নিজেদের সমাজ অর্থাৎ সংখ্যাগুরু বাঙালি সমাজে নারীর সমস্যা আলোচনা ও সেই ভিত্তিতে দাবিদাওয়া ও প্রশ্ন বা ইস্যু নির্ধারণ যে ওরা করতে পারেন সেকথা অস্বীকার করা যাবে না। সমস্যা হয় আদিবাসী নারীর সমস্যার ক্ষেত্রে। ঢাকায় বসবাসকারী একজন বাঙালি মধ্যবিত্ত নারীর পক্ষে একজন আদিবাসী নারীর সমস্যা পুরোপুরি অনুধাবন করা কঠিন। আর যদি সমস্যাটা দেখেনও, এইটা যে আদিবাসী নারীর আদিবাসী সত্তার সাথে সংযুক্ত সেটা পুরোপুরি অনুভব করা তার পক্ষে কঠিন হয়ে যায়।

বাংলাদেশের আদিবাসী নারীদের যে সমস্যা, হোক সে পাহাড়ের আদিবাসী কি সমতলের, এটার দুইটা উৎস। প্রথমত নারী বলে একজন আদিবাসী নারী পৃথিবীর সকল নারীর মতোই বৈষম্যের শিকার হন। এইখানে একজন ইংরেজ নারী একজন  বাঙালি মধ্যবিত্ত নারী আর একজন পাহাড়ি নারীর মধ্যে খুব বেশি পার্থক্য নাই। কিন্তু দ্বিতীয় আরেকটা উৎস থেকেও আদিবাসী নারীর প্রতি বৈষম্য ও শোষণ আসে, সেটা হচ্ছে তার আদিবাসী পরিচয়। অর্থাৎ নিতান্ত আদিবাসী বলেই একজন নারী কিছু কিছু বাড়তি বৈষম্য ও বঞ্চনার শিকার হন, সেটা একজন সংখ্যাগুরু বাঙালি নারীকে মোকাবেলা করতে হয় না। ধর্ষণের উদাহরণই ধরেন। আমাদের সমাজে সকল নারীই সম্ভাব্য ধর্ষণের আশঙ্কার মধ্যে বাস করেন- তিনি যে বয়সেরই হন। কিন্তু আপনি কি জানেন কী পরিমাণ বাঙালি পুরুষ ‘পাহাড়ি মাল’ চেখে দেখার আকাঙ্ক্ষা বুকে লালন করে এবং সেটা আবার প্রকাশ্যে বলেও। আমাদের সংখ্যাগুরু বাঙালির মনের জগতে এমনিতেই তো নারী মানেই মাল, পাহাড়ি নারীরা যেন ওদের কাছে একটু ভিন্ন রকমের মাল- আর পাহাড়ি নারীদেরকে ধর্ষণ করা সেটা যেন আমাদের লোকদের মনে বড় কোন অপরাধের বিষয়ও না।

ধর্ষণ বা যৌন নির্যাতন এটা তো শুধু একটা সমস্যা, এইটাই সব না। আদিবাসী নারীকে মোকাবেলা করতে হয় সকল সমস্যা যেগুলি সকল আদিবাসী মানুষকেই মোকাবেলা করতে হয়। একটা জিনিস কখনো ভুলবেন না, এই যে আমাদের রাষ্ট্র ব্যবস্থা, আমাদের সংবিধান, আমাদের আইন আমাদের কানুন আমাদের আদালত- এই সবকিছুই আমরা আদিবাসীদের উপর চাপিয়ে দিয়েছি। এর কোনটাই ওদের সমাজে স্বতঃসিদ্ধভাবে বা স্বাভাবিক প্রক্রিয়ায় বিকশিত হয়নি বা এইসব বিকাশে আদিবাসী মানুষের চিন্তা, প্রয়োজন, মতামত বা সুবিধা অসুবিধা কিছুই বিবেচনায় নেওয়া হয়নি। এ যেন একটা সম্পূর্ণ বহিরাগত হেজিমনি আমরা চাপিয়ে দিচ্ছি একটা অনিচ্ছুক জনগোষ্ঠীর উপর আর ধ্বংস করছি ওদের জীবন ওদের সংস্কৃতি প্রথা প্রতিষ্ঠান অর্থনীতি সবকিছু। তার মানে একজন আদিবাসী নারীকে প্রতিদিনই সংগ্রাম করতে হয় একটা হেজিমনির মধ্যে নিজেকে মানিয়ে নেওয়ার জন্যে যেটা কিনা তার নিজের নয়। এই অনুভূতি তো একজন বাঙালি মধ্যবিত্ত নারীবাদী কখনোই অনুভব করতে পারবেন না- কেননা তিনি তো সেই অবস্থায় নাই-ই।

এইখানেই আদিবাসী নারীবাদের জায়গা, এইখানেই বাংলাদেশে আদিবাসী নারীবাদের প্রাসঙ্গিকতা।

আমাদের দেশে নারীবাদীদের মধ্যে আদিবাসী নারীরা যে নেই সেটা কিন্তু নয়। বেশ কয়েকজন আদিবাসী নারীকে আমরা দেখেছি, যারা উচ্চশিক্ষিত, বাংলা ও ইংরেজি দুই ভাষায়ই ভাল বলেন, ভাল লেখেন এবং নারী অধিকার নিয়ে কথা বলেন। কিন্তু আমার মনে হয়েছে এরাও যেন বেশিরভাগই নারীর ইস্যুগুলিকে সংখ্যাগুরু বাঙালির দৃষ্টিতেই দেখেন- অর্থাৎ আদিবাসী দৃষ্টিভঙ্গিটা বা আদিবাসীর জায়গায় দাঁড়িয়ে পৃথিবীকে দেখার দৃষ্টিটা যেন ওরা হারিয়ে ফেলেছেন। প্রয়োজনটা হচ্ছে আদিবাসী নারী তার আদিবাসী অবস্থান থেকেই আদিবাসী নারী হিসাবেই নারীর সমস্যা ও ইস্যুগুলিকে বিচার করবেন এবং আদিবাসী দৃষ্টি থেকেই এর সমাধান বের করবেন। তার মানে এই না যে তাঁকে মূলধারার নারীবাদের সাথে ঝগড়া করতে হবে- বরং উল্টা আদিবাসী নারীবাদীদের দৃষ্টি থেকে দেখা সমস্যা সামগ্রিকভাবে সকল নারীবাদীকেই উপকৃত করবে, সাহায্য করবে নারীর সমস্যার আরেকটা বাড়তি দিক সম্পর্কে জানার। একজন নারীবাদী তো উগ্র জাতীয়তাবাদীও হওয়ার কথা না বা সাম্প্রদায়িকও হওয়ার কথা না। সুতরাং আদিবাসী নারীবাদের বিকাশ আদিবাসী ও অ-আদিবাসী নারীবাদীদের মধ্যে কোন বিভেদ বা মারামারি সৃষ্টি করার কথা না- বরং নারীবাদী দৃষ্টিটিকে আরও ব্যাপ্তি এবং পূর্নতা দেবে। এইজন্যে আদিবাসী নারীবাদী চিন্তাগুলি বাংলাদেশে বিকাশ করা জরুরি এবং এই কাজটার সূচনা আদিবাসী নারীদেরকেই করতে হবে।

 

 

[ফেমিনিস্ট ফ্যাক্টরে প্রকাশিত কলাম লেখকের নিজস্ব বক্তব্য]