করোনার গরিমায়…
সেঁজুতি জাহান জিনাত।। একটা অদ্ভুত পক্ষপাতদুষ্ট পৃথিবীর কথা নিজের ভেতর বাড়তে থাকা অপ্রত্যাশিত ভ্রুণকে জানিয়ে একজন পেশাদার মা যে চমৎকার চিঠি লিখেছেন, তা ইতালিয়ান সাংবাদিক এবং ঔপন্যাসিক ওরিয়ানা ফাল্লাচির ‘লেটার টু আ চাইল্ড নেভার বর্ন’ উপন্যাসের শুরু থেকে শেষ অবধি যে কোন নারী জন্মকে নাড়িয়ে দিয়েছে। বাংলায় অনুবাদ করে আনু মুহাম্মদ নাম দিয়েছেন ‘হাত বাড়িয়ে দাও’।
‘হাত বাড়িয়ে দাও’ একটি স্বর্গীয় কথা। প্রচণ্ড মানবিক এবং আস্থাপূর্ণ বাক্য। মানুষের জন্য মানুষের ‘হাত বাড়িয়ে’ দেওয়ার রেওয়াজ যেমন ধর্মীয় কানুনে আছে, তেমন সকল সভ্যতার মৌলিক আচারেও আছে। হাত বাড়িয়ে দেওয়া মানেই একটি প্রাণের স্পর্শে আসা আরেকটি প্রাণ। হাতটা গরম না ঠান্ডা তার অনুভূতি আবিষ্কার করা। হাতটা শক্ত না নরম তাও বুঝতে পারা। শুকনো না ভেজা তাও টের পাওয়া।
এই বাড়িয়ে দেওয়া বায়োলজিক্যাল হাতটাকে এখন আর বাড়িয়ে দেওয়া যাবে না। করোনা ছড়াবে। মানুষের স্পর্শ নেওয়া যাবে না। প্রাণের অনুভূতিও টের পাওয়া যাবে না। নিজেকে সুরক্ষিত রাখতে হবে। হাত ভিজিয়ে ফেনা তুলতে হবে সাবানের, এবং সেটা ঘরে থেকে থেকেই।
‘ট্রেন টু বুসান’ সিনেমায় জম্বির কামড় থেকে যেভাবে নিজেকে বাঁচাতে চেষ্টা করেছিল সবাই, বন্ধুর জন্য মমতা, স্বামীর প্রতি ভালোবাসা, বোনের জন্য মহব্বত, একজন অপর অপ্রকৃতিস্থ পাগলের জন্য মানবতা, পিতার জন্য শিশুর মায়া বিসর্জন দিয়ে যেভাবে বেঁচে থাকার জন্য অদম্য যাত্রা শুরু করেছিল তিনটি প্রাণ- একটি শিশু, একটি অনাগত শিশু এবং তার মা, ঠিক সেভাবে দৌড়াতে হবে করোনাকে পিছে ফেলে। এবং অবশ্যই সেটা রাস্তায় নয়, ঘরে।
ঘরে থাকছে মানুষ। কিন্তু এ কেমন ঘরে থাকা? মানুষের সংশ্রব ছাড়া বাড়িয়ে দেওয়া হাতের স্পর্শ ছাড়া, প্রাণের অনুভূতি ছাড়া কিভাবে বেঁচে থাকে মানুষ? একই রকম চিন্তা করতে করতে, একই অভ্যাসে যাপন করতে করতে মানুষের মাঝে কী কী পরিবর্তন দেখা যাচ্ছে?
বলা হচ্ছে করোনা মানুষকে প্রকৃতির কাছে পৌঁছে দিচ্ছে ধীরে ধীরে। মানুষ ঘরে থাকছে আর প্রকৃতি অপরূপ সাজে সাজছে। প্রকৃতিস্থ হচ্ছে সবকিছু। মানুষের তৈরি করা ঐতিহাসিক ‘ভাষা’, যা যুগ যুগ ধরে নিজেদের প্রয়োজনে বিবর্তন পরিবর্তনের মধ্যে দিয়ে মানুষ প্রতিমুহূর্তে যে জীবন যাপন করে যাচ্ছে, যা কিনা একরৈখিকভাবে অপ্রকৃতিস্থ বা কৃত্রিম, সেই সামাজিক কৃত্রিম ‘ভাষা’টা ভেঙ্গে যাচ্ছে ধীরে ধীরে। মানুষের নিজের সুরক্ষার জন্য নিজের ঘরে, নিজের ঠিক করা যাপন পদ্ধতিতে যখন মানুষকে বিচরণ করতে হচ্ছে, তখন সে কেনই বা সমাজারোপিত ‘ভাষা’য় চলবে? যার যার নিজের ‘ভাষা’য়ই মানুষ এখন তার জীবন যাপন করছে।
হ্যাঁ, এটা মানুষের যার যার নিজের ‘ভাষা’। প্রকৃতিস্থ ‘ভাষা’, যা সামাজিকভাবে কৃত্রিম নয়, সমাজের ‘ভাষা’য় উন্মাদের ‘ভাষা’।
কৌশক গাঙ্গুলী পরিচালিত ‘শব্দ’ সিনেমায় তারক চরিত্রটি সিনেমার ডাবিং এ বিকল্প শব্দ উৎপাদন করত। এবং এই কাজকে সে তার প্রফেশনাল কাজের জায়গা থেকে এক পর্যায়ে প্যাশনের জায়গায় নিয়ে গেল।
শব্দ সিনেমার তারককে এক পর্যায়ে ‘অসুস্থ’ বলা হচ্ছে। অথচ, সসুস্থতার সংজ্ঞা আর কেউ দিতে পারছে না। না পরিবার, না পরিজন, না কোন মনোবিজ্ঞানী। অভ্যস্ত নিয়মের বাইরে যেন আর কোন শব্দ থাকতে নেই! এই চাপিয়ে দেওয়া সমাজের শব্দসম্ভার, যা আদৌ কারো পক্ষে বহন করা সম্ভব কি না তার দায় সমাজ না নিয়ে উলটো মানুষটাকেই সমাজচ্যুত করে ফেলে দিচ্ছে।
একজন মানুষ তার সারা জীবনে ঠিক কোন জাতীয় শব্দজগৎ দিয়ে কাজ চালাবে তা যেন নিয়তির মতো বা পূর্বনির্ধারিত ধর্মের মতো হয়ে যায়। কিন্তু মানুষ কি আদতে তাই? মানুষের মন কি সমাজের আরোপিত সবগুলো শব্দকে গ্রহণ করে? বা করতে পারে?
না।
কখনোই না।
পারে না।
চেষ্টা করে মাত্র।
চেষ্টা আর অবলীলা এক জিনিস না। ভবলীলার এই ব্যারিকেডের ভেতর মানুষ প্রতিনিয়ত মৃত্যুবরণ করে। আবার বেঁচে ওঠে নতুন শব্দের খোঁজে। শরীরী মৃত্যু হয় যখন, তখনো মানুষ কথা বলে। কিন্তু আধিপত্যবাদী সমাজ সে ‘ভাষা’ বোঝার জ্ঞান রাখে না। সেক্ষেত্রে মর্মেন্দ্রীয়ের ‘ভাষা’ খুব যৌক্তিক হয়ে হঠে। মানুষ ধ্যান ক’রেও সে ‘ভাষা’র শব্দগুলো আয়ত্ত করতে চায়।
কেউ কেউ পারে, অধিকাংশই পারে না।
করোনার কোয়ারেন্টাইনের এই আমলে অনেকেরই সেই মর্মচক্ষু খুলে যাচ্ছে। বেঁচে থাকার দৌঁড়ে মানুষ সমাজ, রাষ্ট্র, প্রতিষ্ঠানকে পেছনে ফেলে পারিবারিক এবং ব্যক্তিগত ‘ভাষা’কে বেছে নিয়েছে। প্রখর অনুভূতিসম্পন্ন যারা, তারা তারকের মতো আত্মমগ্ন হয়ে প্রকৃতিকে আবিষ্কার করছে, আর যারা জীবনাগ্রহ ব্যতীত কেবল অভ্যাসগত যাপনের ‘ভাষা’কে নিয়েছে, তারা আলফ্রেড হিচককের ‘সাইকো’ সিনেমার নরম্যানের যাপনের ‘ভাষা’কে নিয়েছে।
দীর্ঘদিন পরিজনহীন একলা বাড়িতে থাকতে থাকতে নরম্যানের মধ্যে স্প্লিট পারসোনালিটির বৈশিষ্ট্য তৈরি হয়ে গিয়েছিল। যার ফলে সে নিজের নিষ্পাপ সত্তার সঙ্গে তার নিজের হাতেই খুন হওয়া মায়ের কণ্ঠ এবং পোশাক নিয়ে আর একটা খুনী সত্তার ধারক হয়ে উঠেছিল। নরম্যান ভদ্র পোশাকে মোটেল চালাত আর মায়ের পোশাক পরে খুন করত। ম্যারিয়ন নামের এক স্মার্ট নারী অফিস থেকে ৪০ হাজার ডলার চুরি করে পালিয়ে গিয়ে নরম্যানের মোটেলে গিয়ে ওঠে এবং খুব অদ্ভুত তরিকায় নরম্যানের হাতে নৃশংসভাবে খুন হয়। মোটেলে রুম ভাড়া দেবার সময় নরম্যানের অদ্ভুত নরমাল এবং নিষ্পাপ আচরণে অর্থ চুরি করা ম্যারিয়নের অস্থির ভীত মন একটু স্বস্তি পায়। নরম্যান যখন ম্যারিয়নকে আতিথেয়তা করছিল, স্যান্ডউইচ নিয়ে আসার সময় অদ্ভুত রকমের যৌন ইঙ্গিতে নরম্যান মায়ের কণ্ঠে চিৎকার করছিল, তখন ম্যারিয়ন ভেবেছিল তার মা খুবই সমর্থ নারী। কিন্তু নরম্যান ম্যারিয়নকে যখন বলল যে তার মা খুবই রুগ্ন এবং অসুস্থ- দর্শক একবিন্দুও বিস্মিত হয়নি, বিস্মিত হয়েছিল ম্যারিয়ন। কোন রুগ্ন নারীর এমন বলিষ্ঠ কণ্ঠ হতেই পারে না। সে বিস্ময় প্রকাশ করতে করতে স্যান্ডউইচে কামড় দেয় এবং তার সবটা গোগ্রাসে সাবাড় করে শাওয়ার নিতে ঢুকে যায় ওয়াশরুমে এবং মিসেস বেটসের সত্তায় নরম্যান বেটসের হাতে খুন হয়। ম্যারিয়নের মতো দর্শকও কিছুতেই ভাবতে পারত না যে এই খুন নরম্যানের পক্ষে করা সম্ভব, যদি না সিনেমার শেষে হিচকক ম্যারিয়নের বয়ফ্রেন্ড এবং বোনের সাথে সাথে দর্শকের সামনে পুরো ঘটনা পরিচ্ছন্ন না করতেন। ম্যারিয়নের খুনীর তালাশে আসা গোয়েন্দা অফিসারকেও নরম্যান তার মায়ের সত্তা এবং সজ্জা নিয়ে খুন করে। অথচ নরম্যান নরমাল দশায় সবার সাথে কথা বলে খুবই ডিসেন্ট এবং ইনোসেন্টলি, খুনের জন্য গোয়েন্দার সামনে হালকা একটু তোতলামি থাকলেও ইনোসেন্ট লুক সব মাফ করে দেয়। এটা সম্ভব হয়েছে দীর্ঘদিন নিজের মতো করে থাকতে পারার সুবাদে, নিজের ‘ভাষা’তে যাপন করার সুবাদে।
হিচকক চোখে আঙুল এবং মস্তিষ্কে শূল ফুটিয়ে এটা বোঝাতে পেরেছেন যে, তিনি জোসেফ স্টিফেনের তৈরি করা একটি প্রকৃতিস্থ (সামাজিক ভাষায় অবশ্য অপ্রকৃতিস্থ) অসাধারণ চরিত্রের একটি রক্ত মাংসের প্রকৃতি আমাদের সামনে তুলে ধরতে পেরেছেন।
করোনার জন্য আর কিছুদিন ঘরে থাকতে থাকলে প্রকৃতি যে আমাদেরকে উপর্যুক্ত ‘তারক’ এবং ‘নরম্যান’ হিসাবে উন্মুক্ত আকাশ পানে হাজির করবে তা এখন বোঝা যাচ্ছে। মৃত্যু দেখে দেখে, স্পর্শহীন আটকা জীবনে গুঁজে থাকতে থাকতে মানুষের অর্থনৈতিক অস্তিত্বের সাথে মনোজাগতিক অস্তিত্বের যে ধ্বস নামছে তা চিন্তা করে দেখবার মতো কোন ভবিষ্যৎ আদৌ থাকবে কিনা সন্দেহ। ফলে, তোমার ‘হাত বাড়িয়ে দাও’ কোন বহুকোষী প্রাণির দিকে নয়, বেসিনে রাখা ক্ষার-চর্বির দিকে।আর বায়োলজিক্যাল সুরক্ষার ভার সময়ের কাঁধে ছেড়ে দিয়ে নির্ভার থাকো।
নিজের ‘ভাষা’র পরিচর্যা করো, সেই ‘ভাষা’টা টিকে গেলে, টিকে যাবে তুমি।
[ফেমিনিস্ট ফ্যাক্টরে প্রকাশিত কলাম লেখকের নিজস্ব বক্তব্য]