November 24, 2024
ফিচার ২মুক্তমত

কুলসুমের লাশ এবং ‘রেমিটেন্স খাবো নিরাপত্তা দেবো না’ নীতি

প্রিথুলা মারজান।। লাশের কোনো ধর্ম থাকে না। যেমন থাকে না গোলাপের কোনো বন্ধু-শত্রুর বোধ। মধ্যপ্রাচ্য আমাদের মহান ধর্মীয় রাষ্ট্র। মহান মানবতার রাষ্ট্র, যে ধর্ম নারী অধিকারের কথা বলে, নারীর সম্মানের কথা বলে। সেই রাষ্ট্রগুলার নারী নিগ্রহের পরিসংখ্যান চরমতম নাস্তিক্যবাদী রাষ্ট্রকেও হার মানাবে।

সৌদি আরবে গিয়ে কুলসুম ফিরেছে লাশ হয়ে। কুলসুম, ব্রাহ্মণবাড়িয়ার মেয়ে, যে কি না পরিবারকে একটু আর্থিক স্বস্তি দিতে চাকরির প্রত্যাশায় সৌদি আরবে গিয়েছিলেন। কিন্তু চাকরি করে বাবা-মায়ের স্বপ্ন পূরণ দূরে থাক নির্মম নির্যাতনের শিকার হয়ে সৌদি আরবের একটি হাসপাতালেই শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেছে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার এই কিশোরী। স্বপ্নযাত্রা ধূলিস্মাৎ হওয়া এই কিশোরী অবশেষে দেশের মাটিতে ফিরেছে লাশ হয়ে।

মৃত্যুর আগে তার কি ইচ্ছা জাগছিল? তার কি বাবা-মা’র কথা মনে পড়েছিল? তার প্রতি অন্যায় অবিচারের বিরুদ্ধে কী করতে ইচ্ছা জেগেছিল? সে কি সৌদিতে মরার কারণে সৌদি থেকেই জান্নাতি সার্টিফিকেট পেয়ে এসেছিল?

নিশ্চিতভাবেই তাকে যারা হত্যা করেছে তারা জান্নাতি কারণ তারা মহান সৌদির মানুষ। কুলসুম, সে হলো থার্ড ওয়ার্ল্ড এর কীট। তার জন্য এত মাথা ব্যাথা থার্ড ওয়ার্ল্ডের লোকজনেরও নাই।

পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এই পর্যন্ত কয়টা প্রবাসী নারী কর্মীর নিগৃহীত হবার ঘটনা সমাধানের জন্য এগিয়ে এসেছে। কয়টার সমাধান করেছে? কয়টার বিচার করেছে?

আসলে বিদেশে নারী কর্মী পাঠানোর জন্য সুনির্দিষ্ট কোনো নীতি আছে কি সরকারের? সরকার সুরক্ষা দিতে পারবে না যেহেতু সেহেতু নারী কর্মী পাঠানোর মানে কী?

ফি বছর সংখ্যা বাড়ছেই কিন্তু সমস্যার সমাধানের কোনো খোঁজ নাই। রেমিটেন্স খাবো নিরাপত্তা দেবো না- এটা সম্ভবত আমাদের বৈদেশিক নারী কর্মীদের জন্য নীতি।

এরকম মৃত্যু অহরহ ঘটছে। যার অধিকাংশই অপ্রকাশিত থাকছে। সাথে ধর্ষণ তো উপর্যুপরি চলতেই থাকে। ছেলেও ধর্ষণ করে,বাবাও ধর্ষণ করে।

এক পরিসংখ্যান অনুযায়ী মধ্যপ্রাচ্যে কর্মরত নারীর সংখ্যা প্রায় ৮ লাখ ৬৬ হাজার। এর মধ্যে শুধু সৌদি আরবেই রয়েছেন ৪ লাখের উপর। নির্যাতিত হয়ে ৮ মাসে সৌদিতে থেকে ফিরেছেন ৯ শতাধিক নারী (বিশ এর প্রথম ও ঊনিশ এর শেষ দিক)।

পরিসংখ্যান দেখাইলে শুধু লিস্ট বাড়তেই থাকবে। মধ্যপ্রাচ্যের সবগুলা রাষ্ট্রে প্রবাসী বাংলাদেশি নারী কর্মীদের মৃত্যুর মোট সংখ্যা আর সৌদিতে মৃতের সংখ্যা সমান।এক সৌদিতেই ১১২ জনের মৃত্যু।

সৌদি পাঠায়ছে মানে নিরাপদ। কেউ এটা ভেবে বসে থাকবেন না। সৌদির প্রতি যে অবনসেশন তা বাদ দিয়ে বাস্তবতায় ফিরে আসুন।

এ তো গ্যালো বিদেশী নিগ্রহ। এরপর আবার যদি কেউ বেঁচে ফিরেও তাহলে তার জন্য রয়েছে দেশিয় সামাজিক কটাক্ষ। ফ্যামিলি ভায়োলেন্স। দেশে ফিরলে বলবে ‘‘মেয়েটা ভালো না। টাকার লোভে বিদেশ গেছে স্বামী সন্তান ছেড়ে। আমরা বুঝি না ওসব কোন ধান্দায় বিদেশ যায়…” ইত্যাদি ইত্যাদি।

একটা ইতিহাস বলি। একটা মশাকে তার ডানা ছিঁড়ে ফেলে শুধু তার চোষক রেখে দিলেও সে রক্ত চুষতে ভুলে যাবে না। তেমনি ধর্মের দোহাই দিয়ে ধর্ষণ, নারী নির্যাতনকে এড়ানো যায় না। সর্বস্ব দিয়ে দেশের সেবা করবে, রেমিটেন্স পাঠাবে, সমাজ এর যূপকাষ্ঠে বলি হবে এই শ্রমিক নারীরা, আর কিছু হইলেই নিপীড়ন, ধর্ষণ এবং সবশেষ হত্যা।

এটা হতে পারবে না। এটা থেকে মুক্তি চাই। নারীর জন্য সুন্দর বাসস্থান চাই। দেশ ও সুন্দর পৃথিবীর জন্য নারীর মুক্তি চাই।

 

[ফেমিনিস্ট ফ্যাক্টরে প্রকাশিত মুক্তমত লেখকের নিজস্ব বক্তব্য]