November 1, 2024
কলামফিচার ২

নয় দফা দাবি এবং বৃহত্তর নারীমুক্তি আন্দোলনের প্রাথমিক ঐক্য

ইমতিয়াজ মাহমুদ।। আইনের সংশোধন করতে চাচ্ছেন, করেন। আইন তো সংশোধন করতেই হবে- যে হারে ধর্ষণসহ নারী ও শিশু নির্যাতনের বিরুদ্ধে জনমত উত্তপ্ত হচ্ছে, একটা কিছু তো আপনাদের করতেই হবে। যাবজ্জীবন সাজার বিধান ছিল সেটা বাড়িয়ে মৃত্যুদণ্ড করছেন, তাতে হয়তো জনমনে উত্তাপ কিছুটা কমবে। কিন্তু তাতে কি কাজের কাজ কিছু হবে? উল্লেখযোগ্য কোন পরিবর্তন কি হবে চলমান এই ধর্ষণ ও নারী নির্যাতনের প্রবণতার?

তারচেয়ে আপনারা আপনারা ছাত্রদের নয় দফা দাবিগুলি কেন বিবেচনা করে দেখছেন না? যুগে যুগে আমাদের ছাত্ররাই আমাদেরকে পথ দেখিয়েছে। ইতিহাস সাক্ষী, ছাত্র ছাত্রীরাই এরশাদকে ক্ষমতা থেকে হঠিয়েছি। শাহবাগের গণজাগরণে ছাত্রদের ভূমিকার কথা আপনারা জানেন- ছাত্র ও যুবকদের নেতৃত্বে মানুষের জাগরণ ছিল এটা। আজকে এই দুই হাজার বিশ সনে এসেও আবার আমাদের ছাত্ররাই আমাদেরকে পথ দেখাচ্ছে- দেশজুড়ে ধর্ষণের যে নোংরা ও অশ্লীল উল্লাস চলছে তার বিরুদ্ধে দেশব্যাপী আন্দোলনের অগ্রভাগে আছে আমাদের ছাত্ররা। ছাত্রদের এই আন্দোলনটি একটি পরিপক্ক আন্দোলন এবং এটি যে একটি পরিপক্ক আন্দোলন সেটা ওদের দাবিনামার নয়টি দফা দেখলেই স্পষ্টত প্রতীয়মান হয়।

 নয় অক্টোবর তারিখে শাহবাগের মহাসমাবেশে ছাত্ররা যে নয় দফা দাবি পেশ করেছে সেগুলি হচ্ছে:

১. সারাদেশে অব্যাহত ধর্ষণ-নারীর প্রতি সহিংসতার সাথে জড়িতদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি নিশ্চিত করতে হবে। ধর্ষণ, নিপীড়ন বন্ধ ও বিচারে ‘ব্যর্থ’ স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীকে অবিলম্বে অপসারণ করতে হবে।

২. পাহাড়-সমতলে আদিবাসী নারীদের ওপর সামরিক-বেসামরিক সব ধরনের যৌন ও সামাজিক নিপীড়ন বন্ধ করতে হবে।

৩. হাইকোর্টের নির্দেশনা অনুযায়ী শিক্ষা প্রতিষ্ঠানসহ সরকারি-বেসরকারি সব প্রতিষ্ঠানে নারী নির্যাতন বিরোধী সেল কার্যকর করতে হবে। সিডো সনদে স্বাক্ষর ও তার পূর্ণ বাস্তবায়ন করতে হবে। নারীর প্রতি বৈষম্যমূলক সব আইন ও প্রথা বিলোপ করতে হবে।

৪. ধর্মীয়সহ সব ধরনের সভা-সমাবেশে নারীবিরোধী বক্তব্য শাস্তিযোগ্য অপরাধ হিসেবে গণ্য করতে হবে। সাহিত্য, নাটক, সিনেমা, বিজ্ঞাপনে নারীকে পণ্য হিসেবে উপস্থাপন বন্ধ করতে হবে। পর্নোগ্রাফি নিয়ন্ত্রণে বিটিসিএলের কার্যকর ভূমিকা নিতে হবে। সুস্থ ধারার সাংস্কৃতিক চর্চায় সরকারিভাবে পৃষ্ঠপোষকতা করতে হবে।

৫. তদন্তকালীন সময়ে ভিকটিমকে মানসিক নিপীড়ন-হয়রানি বন্ধ করতে হবে। ভিকটিমের আইনগত ও সামাজিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে।

৬. অপরাধ বিজ্ঞান ও জেন্ডার বিশেষজ্ঞদের নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনালে অন্তর্ভুক্ত করতে হবে। ট্রাইব্যুনালের সংখ্যা বাড়িয়ে অনিষ্পন্ন সব মামলা দ্রুত নিষ্পন্ন করতে হবে।

৭. ধর্ষণ মামলার ক্ষেত্রে সাক্ষ্য আইন ১৮৭২-১৫৫ (৪) ধারা বিলোপ করতে হবে এবং মামলার ডিএনএ আইনকে সাক্ষ্য প্রমাণের ক্ষেত্রে কার্যকর করতে হবে।

৮. পাঠ্যপুস্তকে নারীর প্রতি অবমাননা ও বৈষম্যমূলক যে কোনো প্রবন্ধ, নিবন্ধ, পরিচ্ছেদ, ছবি, নির্দেশনা ও শব্দ চয়ন পরিহার করতে হবে।

এবং

৯. গ্রামীণ সালিশের মাধ্যমে ধর্ষণের অভিযোগ ধামাচাপা দেওয়ার চেষ্টাকে শাস্তিযোগ্য অপরাধ হিসেবে গণ্য করতে হবে।

লক্ষ্য করবেন যে ধর্ষণের সাজা বৃদ্ধি করে মৃত্যুদণ্ড নির্ধারণ করার দাবিটি লোকমুখে বেশ জনপ্রিয় হলেও ছাত্ররা এই দাবিটি ওদের নয় দফাতে অন্তর্ভুক্ত করেনি। এইটা আমার কাছে বেশ পরিপক্ক এবং সুবিবেচনাপ্রসুত একটা সিদ্ধান্ত মনে হয়েছে। কারণ সর্বোচ্চ শাস্তি যাবজ্জীবন কারাদণ্ডের পরিবর্তে মৃত্যুদণ্ড নির্ধারণ করলেই কি লাভ হবে যদি বিচারে বিচারে অপরাধীর অপরাধ প্রমাণই না হয়? আমাদের দেশে এখন যে অবস্থা আছে সেখানে ধর্ষণের অভিযোগে একশটা মামলায় দেখা যায় যে, দুইটা কি তিনটা মামলায় মাত্র অভিযুক্তের বিরুদ্ধে অপরাধ প্রমাণিত হয়; বাকি সাতানব্বই কি আটানব্বইটি মামলায় অভিযুক্তরা বেমালুম ছাড়া পেয়ে যায়। ধর্ষণ সংক্রান্ত মামলার বেশিরভাগই তো আর মিথ্যা মামলা হতে পারে না। চট করে একজন নারী তো কারো বিরুদ্ধে ধর্ষণের মামলা করবে না আরকি। মিথ্যা মামলা হয়তো একশতে দুই চারটা হতে পারে- বা ধরে নিলাম একশতে দশটাই হলো, কিন্তু ধর্ষণের মামলায় তো দেখা যাচ্ছে যে একশতে পঁচানব্বইটার চেয়ে বেশি মামলাতেই আসামীরা খালাস পেয়ে যাচ্ছে। এর মানে কী? এর মানে হচ্ছে যে ধর্ষণের মামলা যারা তদন্ত করছেন, যারা এইসব মামলায় সরকারের পক্ষে উকিল হিসাবে প্রসিকিউটর হিসাবে কাজ করছেন, এরা ঠিকমত কাজ করছেন না। আইনে হয়তো কিছু ত্রুটি বিচ্যুতি আছে বা ধর্ষণের বিচার সংক্রান্ত আইনগুলি হয়তো আরও যুগোপযোগী করা যায়, সেগুলি তো ঠিক আছে, ধর্ষণ মামলায় এই হারে আসামীরা ছাড়া পেয়ে যাবে এর দায় তো আপনি সম্পূর্ণ আইনের সীমাবদ্ধতার উপর চাপাতে পারেন না।

শাস্তির প্রশ্নটা তো আসে অভিযুক্তরা দোষী প্রমাণিত হবার পর। প্রসিকিউটররা যদি মামলাই প্রমাণ করতে না পারেন, বেশিরভাগ মামলাতেই অভিযুক্তরা যদি হাসতে হাসতে খালাস পেয়ে যায় তাইলে আইনের বইতে সর্বোচ্চ সাজার পরিমাণ মৃত্যুদণ্ড করলেন নাকি কি করলেন তাতে কিইবা যায় আসে? আর মামলার বিচারে যে পরিমাণ সময় যায় সেটাও একটা গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। আজ একজন নারী ধর্ষণের শিকার হলেন, পুলিশের কাছে গেলেন, মামলা করলেন- এর বিচার হতে হতে যদি সাত আট বা দশ বছর পার হয়ে যায় তাহলে সেই মামলায় অভিযুক্তদের সাজা হলেও সমাজে তো এর ইতিবাচক কোন প্রভাব পড়ে না। অপরাধীকে সাজা দেওয়ার একটা উদ্দেশ্য তো হচ্ছে যে একজনকে সাজা দিলে সেটা দেখে যেন অন্যেরা শিক্ষা নেয় বা ভয় পায় যে না, এইরকম অপরাধ করে পার পাওয়া যাবে না। বিচারে বিলম্ব হলে যেটা হয় যে সময়ের সাথে সাথে ঘটনাটির গুরুত্ব কমে যায়, অন্যান্য সব গুরুত্বপূর্ণ খবর চলে আসে, এইভাবে মানুষ একসময় ঘটনাটি ভুলে যায়। অথচ বিচারটি যদি মানুষের স্মৃতিতে থাকতে থাকতে শেষ করা যায়, আর প্রকৃত অপরাধীদের যদি শাস্তি নিশ্চিত করা যায় তাইলেই না বিচার ও শাস্তির উদ্দেশ্য পূরণ হবে। শাস্তি হিসাবে মৃত্যুদণ্ডই দিতে হবে সে তো জরুরী নয়। ঘটনা ঘটার এক বছরের মধ্যেই যদি সাজা নিশ্চিত হয় আর সেই শাস্তিটা যদি যাবজ্জীবন কারাদণ্ডও হয়, তাতেও তো কাজ হয়।

জরুরি কোনটা? জরুরি হচ্ছে যথাযথ বিচার হওয়া, প্রকৃত অপরাধীর অপরাধ প্রমাণ করা এবং বিচারটা সময়মত হওয়া। আন্দোলন শুরু হওয়ার পরপরই দেখা গেল সরকারের ধর্ষণের সাজা বৃদ্ধি করে মৃত্যুদণ্ড করার উদ্যোগ নিয়েছে, আজ সেটা ক্যাবিনেটে পাশও হয়ে গেছে। সরকার উদ্যোগ নিয়েছে এইসব সংশোধন অধ্যাদেশ আকারে জারি করার। কিন্তু সাজা বাড়িয়ে মৃত্যুদণ্ড করে কি লাভ যদি বিচারই যথাযথ না হয় আর ঠিক সময়ে না হয়? একশটা মামলার মধ্যে পঁচানব্বই জন আসামীই যদি খালাস পেয়ে যায় তাইলে আইনের বইতে মৃত্যুদণ্ডের বিধান রেখে কী লাভ? এইখানে আন্দোলনকারী ছাত্ররা, বলতেই হয়, সরকারের চেয়ে বুদ্ধিমান বিবেচক এবং পরিপক্ক হিসেবে নিজেদেরকে প্রমাণ করেছে। ওদের প্রথম দাবিই হচ্ছে, শাস্তি নিশ্চিত করতে হবে- দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি। শাস্তি মৃত্যুদণ্ডই হোক বা যাবজ্জীবন, দৃষ্টান্তমূলক হতে হলে সঠিক বিচার হতে হবে আর ঠিক সময়ের মধ্যেই হতে হবে।

শাস্তি নিশ্চিত করার জন্যে কি করতে হবে? ছাত্রদের ৫, ৬, ৭ ও ৯ নম্বর দফার দাবিগুলি দেখুন।

আগে ৭ নম্বর দফাটার কথা বলি। আপনারা এর মধ্যে সাক্ষ্য আইনের ১৫৫(৪) ধারার কথা অনেক শুনেছেন। কী আছে এই ধারায়? ১৫৫ ধারা কয়েকটা পরিস্থিতির কথা বলা আছে সেরম পরস্থিতিতে একজন সাক্ষীর কথার বিশ্বাসযোগ্যতা নির্ভর করতে পারে। এই সবের মধ্যে, ৪নং উপধারায় বলা হয়েছে যে, ধর্ষণ বা ধর্ষণ চেষ্টার মামলা যখন কাউকে অভিযুক্ত করা হয় তখন অভিযুক্ত ব্যক্তি চাইলে দেখাতে পারে যে মামলার বাদী সাধারণভাবে অনৈতিক চরিত্রের অধিকারী (of generally immoral character)। অর্থাৎ মামালার আসামী যদি দেখাতে পারে যে মামলার বাদী অনৈতিক চরিত্রের অধিকারী তাইলে তার কথা জজ সাহেব বিশ্বাস নাও করতে পারে। এর মানে কী দাঁড়ায়?

ধর্ষণের মামলায় তো মূল দুইটা জিনিস দেখাতে হয়- এক হচ্ছে যে শারীরিক সম্পর্ক স্থাপিত হয়েছিল, দ্বিতীয়ত, ঐ শারীরিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে নারীটির সম্মতি ছিল না। মামলার শুনানির সময় প্রায়শই দেখা যায় যে আসামী পক্ষ থেকে নারীটির চরিত্রের প্রশ্নটি নিয়ে আসে। ওরা দেখাতে চেষ্টা করে যে নারীটির চরিত্র ভাল ছিলনা ফলে তাকে বিশ্বাস করা যাবে না, সুতরাং এখন যে সে বলছে যে তার সম্মতি ছিল না এই কথাটা বিশ্বাস করা যাবে না। আপনারা নাটকে সিনেমায় গল্প উপন্যাসে দেখেছেন সাক্ষীর কাঠগড়ায় ধর্ষণের শিকার নারীটিকে হয়রানী করা উদ্দেশ্যে কত রকম বাজে বাজে প্রশ্ন করা হয়, এগুলি খুব একটা বানানো নয়। বিশেষ করে ওর চরিত্র খারাপ সেটা প্রমাণ করার জন্যে আসামী পক্ষের উকিলরা ধর্ষণের শিকার নারিটিকে অপমানের চূড়ান্ত করে ছাড়ে। এইগুলি হচ্ছে এই ১৫৫(৪) ধারার মাহাত্ম্য।

এই ১৫৫(৪) ধারার কারণেই দেখা যায় যে ধর্ষণ মামলায় নারীরা সাক্ষীর কাঠগড়ায় চূড়ান্ত অপমানের শিকার হয়। সব নারী এইটা সহ্য করে টিকে থাকতে পারে না, অনেকেই ভেঙে পড়েন, দৃঢ়তার সাথে ঠিক ঠিক কথা বলে শেষ করতে পারেন না। এইটার সুবিধা পায় আসামী- খালাস পেয়ে যায়। সুতরাং ছাত্ররা যে এই ধারাটির বিলোপ চেয়েছে সেটা খুবই যুক্তিযুক্ত- এটা সরিয়ে দিলে বিচারে প্রকৃত দোষীদের অপরাধ প্রমাণ সহজ হয়ে যায়।

কিন্তু শুধুমাত্র ১৫৫(৪) ধারা বিলোপ করে দিলেই এই সমস্যাটার পুরো সমাধান হবে না। ভারতে ইতিমধ্যে এইটা নিয়ে অভিজ্ঞতা হয়ে গেছে। ভারতে প্রথম সাক্ষ্য আইন থেকে ১৫৫(৪) ধারা বিলোপ করে দেওয়া হলো, কিন্তু তারপরেও দেখা গেল যে জেরার সময় চরিত্র নিয়ে প্রশ্ন করা বন্ধ হলো না। পরে বিশেষভাবে আলাদা একটা বিধান যুক্ত করা হলো, যে বাদীর সাক্ষ্যের বিশ্বাসযোগ্যতার প্রশ্নে তার চরিত্র নিয়ে জেরা বা ক্রস একজামিনেশনের সময় কোন প্রশ্ন করা যাবে না। কিন্তু তারপরেও শুনানিকালে আসামিপক্ষের আইনজীবীরা চরিত্র নিয়ে আক্রমনাত্মক প্রশ্ন করা চালিয়েই যেতে থাকলেন। কীভাবে? সাক্ষ্য আইনেরই অন্যত্র চরিত্র সংক্রান্ত সাক্ষ্য প্রমাণকে প্রাসঙ্গিক বলা হয়েছে, সেইটাকে উছিলা করে এইসব প্রশ্ন করা হতো। আসল মতলব হচ্ছে বাদী যেহেতু নারী, তাকে যতটুকু পারা যায় হেনস্থা করে, অপমান করে হতভম্ব করে ফেলা। পরে ২০১২ সনে ভারতে আরেকটি সাক্ষ্য আইনে আরেকটি সংশোধনী এনে ধর্ষণ মামলায় চরিত্র সংক্রান্ত প্রশ্ন সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ করা হয়।

ছাত্ররা শুধু ১৫৫(৪) ধারা বাতিলের কথা বলেছে, সরকার চাইলেই সাক্ষ্য আইনের এই বিশেষ ধারাসহ আরও প্রয়োজনীয় সব সংশোধন করতে পারে। তাইলে কী হবে? দুটো কাজ হবে। প্রথমত নারীদেরকে কাঠগড়ায় হয়রানী করা বা অপমান করার প্রবণতা বন্ধ হয়ে আসবে। লোকে জানবে যে ধর্ষণের সাথে নারীর চরিত্রের কোন সম্পর্ক নেই। এমনকি নারীটি যদি পেশাদার যৌনকর্মীও হয় তার সম্মতি ছাড়া তার সাথে শারীরিক সম্পর্ক স্থাপন করলে সেটাও ধর্ষণ। দ্বিতীয়ত এই যে নারীকে বিব্রত করে, তার চরিত্র হনন করে যে অনেক ধর্ষক আইনের ফাঁক গলে বেরিয়ে যায় সেটাও অনেকাংশে কমে আসবে।

এর সাথে ছাত্ররা ওদের দাবীর ৫ ও ৬ নম্বর দফায় দুইটা গুরুত্বপূর্ণ দাবি করেছে। একটা হচ্ছে তদন্তকালীন সময়ে ভিকটিমকে মানসিক নিপীড়ন-হয়রানি বন্ধ করার দাবি এবং ভিকটিমের আইনগত ও সামাজিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করার দাবি। আরেকটা হচ্ছে ট্রাইব্যুনাল বাড়ানোর দাবি ও বিচার প্রক্রিয়ার সাথে বিশেষজ্ঞদের যুক্ত করার দাবি। এই দুইটা দাবি মেনে নিলে ফলাফল কী হবে? ভিকটিম তো হচ্ছে প্রথম সাক্ষী ও সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সাক্ষী। ওকে যদি অভিযুক্ত ব্যক্তিরা ভয় দেখিয়ে বা সামাজিক চাপ দিয়ে দুর্বল করে ফেলতে পারে তাইলে কী হবে? তাইলে ওরা আদালতের বিচার থেকে খালাস পেয়ে বেরিয়ে যাবে। সরকার যদি বিচার চলাকালীন সময়ে ভিকটিমের সুরক্ষা নিরাপত্তার ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে পারে তাইলে তো আসামীরা আর সেই সুযোগটা পায় না। আপনি চিন্তা করতে পারেন, একজন নারী যখন ধর্ষণের শিকার হয় তারপর যদি তাকে ক্রমাগত সামাজিক গঞ্জনা সহ্য করতে হয় এবং সবশেষে বিচার না পেয়ে মাথা নিচু করে নিজের ঘরে ফিরতে হয় এরচেয়ে গ্লানির আর কী হতে পারে?

সমাজ কী করে? সমাজ তো পুরুষতান্ত্রিক সমাজ। একটা নারী যখন ধর্ষণ বা যৌন নির্যাতনের শিকার হয় তখন ওরা মেয়েটাকে দোষ দেয়, ধর্ষক পুরুষদের দোষটা ছোট করে দেখানোর চেষ্টা করে। এই তো সেদিনও আপনারা দেখেছেন আমাদের সিনেমার এক হিরো নির্লজ্জের মত ধর্ষণের দায় নারীর উপর চাপিয়ে ভিডিও তৈরি করেছে। আমাদের সমাজে ঐ হিরোর মত লোকদের সংখ্যাই তো বেশি। একটা ধর্ষণ হলে এরা বলবে মেয়েটা নষ্ট হয়ে গেল। এরা সালিশ ফালিশ করে কিছু টাকা পয়সা দিয়ে আর ধর্ষকদেরকে দুই একটা চড় চাপড় মেরে ব্যাপারটা সেইখানেই সেরে ফেলতে চাইবে। এইটা যদি বন্ধ করতে না পারেন তাইলে তো ধর্ষণের বিচার হবে না। ধর্ষণের শিকার একজন নারী তো বেশীরভাগ ক্ষেত্রেই গোটা সমাজের সাথে লড়তে পারে না। রাষ্ট্র ও সরকারের উচিত ওর পাশে দাঁড়ানো। এইজন্যে ছাত্ররা ৯ নম্বর দফায় এই দাবিটা করেছে- এইসব সালিশের নামে ধর্ষণের অপরাধ ধামাচাপা দেওয়া চলবে না।

এইগুলি যদি বাস্তবায়ন করা যায়, তাইলে তো ধর্ষণের বিচার দ্রুত করা যাবে, চট করে আসামীরা খালাস পাবে না। আর সেই সাথে যদি তদন্ত ও বিচারের সময়সীমা কড়াকড়িভাবে নির্ধারণ করে দেওয়া হয়, তাইলে দেখবেন যে ধর্ষণ করে অপরাধীরা আর পার পাবে না।

এইগুলি তো গেল বিচার ও সাজার ব্যাপার। ছাত্রদের এই নয় দফার মধ্যে ধর্ষণের বিরুদ্ধে চেতনার বিকাশ নিয়েও দাবি রয়েছে। ৩, ৪ ও ৮ নং দাবিগুলি দেখেন। নারী অধিকারের সনদ CIDAW গ্রহণ করতে হবে কোনরকম শর্ত ছাড়া। ধর্মীয়সহ সকল সভা সমাবেশে নারীবিদ্বেষী বক্তব্য বন্ধ করতে হবে। এইটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। কেননা এইসব স্বভাব সমাবেশে, বিশেষ করে ওয়াজ মাহফিলগুলিতে যে মাত্রায় নারীবিদ্বেষী ও নারীর প্রতি অবমাননাকর কথাবার্তা প্রচার করা হয় সেগুলি তো নারীর প্রতি সহিংসতা উৎসাহিত হয়। এইগুলি তো বন্ধ করতে হবে। সেই সাথে স্কুল কলেজের পাঠ্যপুস্তকেও একইরকম নীতির প্রতিফলন থাকতে হবে।

এই ৯ দফা দাবি পালন হলেই যে দেশ থেকে ধর্ষণ সম্পূর্ণ দূর হয়ে যাবে সেকথা কেউ বলছে না। কিন্তু এইসব দাবি হচ্ছে ধর্ষণ ও যৌন নির্যাতনের বিরুদ্ধে একটি রাষ্ট্র ন্যুনতম যেসব ব্যবস্থা গ্রহণ করতে পারে সেইসব ব্যবস্থারই একটি দলিল। এই সমস্ত ব্যবস্থা যদি একটি রাষ্ট্র গ্রহণ করতে না পারে বা না চায় তাইলে তো বলতেই হবে যে রাষ্ট্রটি ধর্ষণের বিরুদ্ধে ন্যুনতম ব্যবস্থাও গ্রহণ করেনি।

লক্ষ্য করেছেন নিশ্চয়ই, ছাত্ররা ওদের এই নয় দফার মধ্যে দ্বিতীয় দফাতেই রয়েছে একটি দাবি যেটা অত্যন্ত জরুরি একটা প্রসঙ্গ অথচ যেই দাবিটা আমরা আমাদের মূলধারার রাজনৈতিক বা সামাজিক সংগঠনগুলির কেউই খুব একটা কিছু স্পষ্ট করে বলে না- ‘পাহাড়-সমতলে আদিবাসী নারীদের ওপর সামরিক-বেসামরিক সব ধরনের যৌন ও সামাজিক নিপীড়ন বন্ধ করতে হবে।’

এই দাবিগুলির পক্ষে চলুন সকলেই আওয়াজ তুলি- এই দাবির ভিত্তিতেই গড়ে উঠতে পারে বৃহত্তর নারী মুক্তির আন্দোলনের লক্ষ্যে একটি প্রাথমিক ঐক্য।

 

[ফেমিনিস্ট ফ্যাক্টরে প্রকাশিত কলাম লেখকের নিজস্ব বক্তব্য]