September 20, 2024
কলামফিচার ৩

সমাজ কি নারীর খোলা পোশাক আর ধূমপানে ভেসে যায়?

ক্যামেলিয়া আলম।। তিক্ত মন নিয়ে কয়েকদিন ধরে ঘুরপাক খাচ্ছি। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের কল্যাণে চোখে পড়লো এক নারীর ছবি যিনি সিগারেট টানছেন। দৃশ্য হিসেবে খুবই সাধারণ এক দৃশ্য। তবে পাবলিক প্লেসে সিগারেট খাওয়ার উপর এক ধরনের নিষেধাজ্ঞা আছে। কিন্তু এদেশে দেদারসে খোলা জায়গায় সিগারেট বেচা কেনা চলে আর রাস্তাঘাটে ধূমপায়ীদের সংখ্যাও কম দেখি না! তবু সিগারেট ক্ষতিকর হিসেবে তা খাওয়াকে সমর্থণ করছি না।

কিন্তু এই মেয়েটির ছবি দিয়ে যা বলতে চাইছে সমাজের বহু মানুষ। সেই কথাগুলো আমার মাথায় আগুন ধরিয়ে দিলো। এই সামান্য সাধারণ এক বিষয়কে তারা সমাজের বিপর্যয় হিসেবে দেখাতে চাইলো। বলতে চাইলো, ছবিটি অভব্যতার, সমাজ নষ্ট করবার, উচ্ছন্ন সমাজের প্রতীক! এছাড়া আরও নানা বিষাক্ত কথা দিয়ে ভরিয়ে দিল নারীটির ছবি সামনে রেখে। অথচ একজনকে না বলে তার ছবি তোলা, তার ফেইসবুক থেকে ছবি নেয়া, প্রচার করা যে ঘোরতর অন্যায়, অসভ্যতা এই কথাটা কারও মাথায় ঢুকছে না। আর আইটি ৫৭ ধারা অনুযায়ী কারও পারমিশন ছাড়া এভাবে কারও ছবি প্রচার করাও দণ্ডনীয় অপরাধ।

‘‘ডিজিটাল মাধ্যম ব্যবহার করে আক্রমণাত্মক, মিথ্যা, ভীতি প্রদর্শক তথ্য উপাত্ত প্রকাশ, মানহানিকর তথ্য প্রকাশ, ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত, আইনশৃঙ্খলার অবনতি ঘটানো, ঘৃণা প্রকাশ, অনুমতি ছাড়া ব্যক্তিগত তথ্য সংগ্রহ, প্রকাশ বা ব্যবহার করলে জেল জরিমানার বিধান রয়েছে। এসব ক্ষেত্রে তিন থেকে সাত বছরের কারাদণ্ড, জরিমানা বা উভয় দণ্ড হতে পারে। দ্বিতীয়বার এরকম অপরাধ করলে ১০ বছরের কারাদণ্ড হতে পারে।”

কতটা হাস্যকর এই সমাজ বর্তমানে তৈরি হচ্ছে। এক সিগারেটের ধোঁয়ায় যদি সমাজ ভেসে যায়, তো যাক না ভেসে সেই সমাজ। লণ্ডভণ্ড হয়ে যাক পুরুষের নিগড়ে বাধা সোসাইটাল ভ্যালুজ, কাঠামো।

মজার ব্যাপার, এই সব হুক্কা হুয়ার দল এক সময় পর্যন্ত ছিলো শিক্ষাহীন ও ধর্মান্ধ মানুষ। আর তা একক কোন ধর্মাবলম্বীর না, সব ধর্মেই ধর্মান্ধরা একই চেহারার। কিন্তু এখন দেখি, নারী প্রশ্নে তাদের পাশে এসে দাঁড়িয়েছে সমাজের প্রগতিশীল চেহারাধারী বহু নারী পুরুষ। যারা দুই রকম নারীর সংজ্ঞায়ন বের করে। এক ধরনের নারী যারা সাত সকাল থেকে রাত পর্যন্ত দৌড়াদৌড়ি করে রাধে, কাপড় ধোয়, বাচ্চা স্কুলে নেয়, বাচ্চা পড়ায়, ঘর মোছে, স্বামীরে সুখি রাখতে যতটুকু কাজ করা দরকার তা করে, স্বামীর অত্যাচারের পর আত্মীয় স্বজন পাড়া প্রতিবেশির কাছে সেই স্বামীর সুনাম করে বেড়ায়, পুরুষ থেকে দূরত্ব নিয়ে চলে, চুলোচুলি করে স্বামীর পরকীয়ারে তাড়ায়ে স্বামীর বুকে মাথা রাখে ইত্যাদি ইত্যাদি; তারা  নারী জাতের মধ্যে জিপিএ ফাইভ পাওয়া। আর আরেক শ্রেণির নারী, যারা দুই পাশে দুই পুরুষ বন্ধু নিয়ে ঘোরে, সিগারেট খেয়ে আকাশের দিকে ধোঁয়া ছাড়ে, শিল্পকলা বিজ্ঞান নিয়ে যারা কথা বলতে ভালোবাসে, কবিতা বা সাহিত্য নিয়ে পড়ে থেকে রান্না জ্বালায়ে ফেলে, নিজের চাহিদার কথা মুখ ফুটে বলে, নিজের অধিকার আদায় না হলে লাত্থি মেরে সেই সংসার ভাঙে, যে কারও বিপদে ঝাঁপ দিয়ে বিপদ থেকে উদ্ধার করে, রাস্তাঘাটে কারও অপরাধ দেখলে থাপড়ায়ে ঠিক করে- তারা সমাজের মাপকাঠিতে টেনেটুনে জিপিএ টু পাওয়া নারী। শুধু তা-ই না, এই সমস্ত নারীদের সরাসরি কেউ কিছু বলে না, বলে আড়াল থেকে, দূরত্ব থেকে। সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমগুলোতে এই সমস্ত নারীর ছবি দিয়ে বের করে অশ্লীল ট্রল, তাদের কমেন্ট সেকশন আর মেসেঞ্জার ভেসে যায় ‘খানকী মাগী’ আর ‘তোরে চু*’ দিয়ে। তাদের শায়েস্তা করার, ভালো নারী করার, নিদেনপক্ষে গায়ের জ্বালা মেটানোর জন্য সমাজের এক শ্রেণির নারী ও পুরুষ এতোই নগ্নভাবে ঝাপিয়ে পড়ে যে তাদের খেয়ালই থাকে না, তারা নিজেরাই সমাজকে ভাসিয়ে কোথায় নিয়ে যাচ্ছে।

সোস্যাল মিডিয়ায় বিভিন্ন আইডি খোলা হচ্ছে, নারী অবমাননার নানা বিষয়গুলোকে প্রাধান্য দিয়ে। আবার কোনটাতে নারী কী করে ভালো নারী হতে পারে তা নিয়ে থাকে উপদেশমূলক ট্রল। এইমাত্র দেখতে পেলাম সোস্যাল হাউজ বলে এক আইডি থেকে নারীদের জন্য তেমন কিছু উপদেশমালা দিয়েছে।

দুই একটা ধারণা দেই-

‘‘কখনোই স্বামীর আগে খাবার খাবেন না। আগে স্বামীকে খেতে দিন অথবা স্বামীর সাথে খান এতে স্বামী খুশি হবে।

স্বামী ঘরে ফেরার আগে ঘুমিয়ে যাবেন না। স্বামী যত রাতেই ফিরুক সে যেন এসে দেখে আপনি অধীর উৎকন্ঠা নিয়ে তার অপেক্ষায় আছেন।

স্ত্রীদের আলাদা ফেসবুক আইডি থাকার কোনো দরকার নাই। স্বামী যখন ফেসবুক চালাবে তখন সে অনুমতি দিলে তার পাশে বসে ফেসবুক চালানো দেখুন।’’

কী একটা অবস্থা! ইদানীং এইসব দেখলে আর শুনলেই আমার মাথা কেমন ভো ভো করতে থাকে। ভালো নারী আর খারাপ নারীর বিকৃত মাপকাঠিতে সকল নারীই হয় বৈষম্যের শিকার। মাঝ থেকে সুবিধা ভোগ করে বিপরীত লিঙ্গ।

আমরা নুড আন্দোলনের কথা এর মাঝে সবাই জানি। নগ্নতা সমাজে একসেপটেবল না। তাই আমরা পোশাক ব্যবহার করি। সমাজের অবক্ষয় রোধের প্রতিবাদে যখন সেই পোশাক খুলে নারীরা একযোগে দাঁড়িয়ে পড়ে তাকে আমাদের শ্রদ্ধা করতেই হয়। গত ১৯শে জুন রেহানা ফাতিমা নামক এক ভারতীয় নারী সোশ্যাল মিডিয়ায় এক ভিডিও পোস্ট করেন। ভিডিও-তে দেখা যায়  তার উর্ধাঙ্গে কোনও আবরণ না রেখেই বিছানায় শুয়ে আছেন তিনি। পরণে শুধু একটা লাল রঙের শর্টস। এই অবস্থায় রেহানার নগ্ন বুকে তাঁর শিশু পুত্র ও কন্যা একটি ফিনিক্স পাখি আকঁছে। তিনি পোস্ট এ লিখেন, ‘‘নৈতিক ফ্যাসিবাদী সমাজে নারী দেহকে নিছক মায়া হিসেবে দেখানো হয়। এই সমাজে তারা যা গোপন করতে চায় তা প্রকাশ করাও একটি রাজনৈতিক কাজ। আজকের সমাজ নারীদের মুখে লাগাম লাগানোর জন্য উঠেপড়ে লেগেছে। ঠিক যেমনভাবে নগ্নতা বা যৌনতার উল্লেখ পর্যন্ত সেন্সর করা হয়। তাই একটা সাহসী রাজনৈতিক কাজ যা এই সময় দাবি করে।’’

এই নারীকে নিয়ে তর্ক বিতর্কের ঝড় বয়ে যাচ্ছে সমাজে। যাবার মতোই কাজ। কিন্তু কাজটা কেন করতে হয় বা হল? কারণ আমাদের সমস্যার পেছনের রিজনটা এই সমাজের কর্তৃত্ববাদীরা বুঝতে চাইছে না, মানতে চেষ্টা করছে না। স্বেচ্ছাচারীতা আর স্বাধীনতার পার্থক্য নিশ্চয়ই আছে। একজন পুরুষ যখন প্রকাশ্যে ধূমপান করতে পারে, নারীর করতে বাঁধা তো থাকার কথা না। কিন্তু কেন একটা সমাজ মনে করে, নারীরা ধূমপায়ী হওয়া মানেই সমাজ রসাতলে যাওয়া, নারীরা পোশাক খুলে বা খোলামেলা পোশাকে চলা মানেই সমাজ ভেসে যাওয়া? সমাজ কি নারীর খোলা পোশাকে আর ধূমপানে ভেসে যায়? নাকি ১১ মাসের বাচ্চার যৌনাঙ্গ দিয়ে, পায়ূপথ দিয়ে ধর্ষণের মধ্য দিয়ে যায়? এই ফারাকটুকু কী আসলেই বুঝতে পারছে না কেউ? কেন বুঝে না?

ক্ষতিকর কোন পন্থা কখনও কাম্য না। কিন্তু সমাজ যদি ভয়ংকর হয়ে উঠতেই থাকে, শ্বাস আটকে আসার পর্যায়ে চলে যায়, তখন ঠিক এমন ঝাকুনিই দিতে হয়। ধোঁয়ায় আর নগ্নতায় ভাসিয়ে নিয়ে এইসব নরপশুর দলকে ফেলতে হয় ভূমধ্যসাগরে। সেই দিনগুলোর জন্য অপেক্ষায় আছি। যেদিন মানুষ মানুষের ভাষায় তাদের ভাব প্রকাশ করবে। যতদিন অমানুষের রাজত্ব চলবে; ততদিন আন্দোলন চলুক নানা বেশে, নানা ছন্দে।

 

[ফেমিনিস্ট ফ্যাক্টরে প্রকাশিত কলাম লেখকের নিজস্ব বক্তব্য]