September 20, 2024
ফিচার ৩মুক্তমত

আমার মতো ভয়ানক জীবন কারো না হোক

প্রিয়া দেব।। নারী জীবনটা অদ্ভুত এক শব্দ। এখানে নারী হাসে অন্যের কারণে, কাঁদে অন্যের কারণে, নারীর ব্যক্তিগত সুখ কিংবা দুঃখ বিষয়টা বড় বেশি ডুমুরের ফুল এদেশে। আমার এখনো ডুমুরের ফুল দেখা হয়নি, সেজন্যই এ উপমা।

ছোট্টবেলা থেকে দেখে আসছি, আমরা নারীরা পিতা, স্বামী কিংবা পুত্রের জন্য বরাদ্দ বস্তু, নারী জীবন মানেই সংসারের জন্য তৈরি করা নিখুঁত কোনো পুতুল। যাকে শেখানো হয় লজ্জা তার ভূষন,কান্না তার অস্ত্র, অন্য মহিলাদের সাথে কূটনামী না করলে সে সাংসারিক জীবনে দক্ষ হতে পারবে না, পড়াশুনা যদি করেও তবে সেটা শেষপর্যন্ত হেঁশেল ঠেলবার জন্যেই। কারণ ভালো ডিগ্রিধারী মেয়ের হাতের রান্নার কদর দূর্দান্ত। কি সুন্দর সমাজ…….!

নাহ, এসব এখনো বদলায়নি, বদলালে কি সিলেটের ডাক্তার মেয়েকে অবলীলায় শ্বশুর শাশুড়ি আর স্বামী মিলে খুন করে ফেলেন? মেয়েটি শুধু চাকরি ছাড়তে চায়নি, সেটা ছিল তার দোষ।

কি অদ্ভুত তাই না?

আর হ্যাঁ, এখানে যে মেয়ে গলা উঁচু করে কথা বলে না, যে মেয়ে কোনোদিন চন্দ্র সূর্য দেখেনি, যে মেয়ে কোনোদিন তসলিমা নাসরিনকে পড়েনি, যে মেয়ে প্রেম করে না, যে মেয়ের কাছে পুরুষ প্রভু, সে মেয়ের বিশাল সম্মান। সে নারী জাতির আইকন।

এমন সমাজে কোনো মেয়ের জীবনে একটা কষ্টের ঘটনা থাকেনা, থাকতে পারে না।

এখানে পবিত্রতা, শুচি সব নারীর শরীরে থাকে- সে শিক্ষা নারীকে ছোটোবেলা থেকে গেলানো হয়, কিন্তু যখন বড়ো হওয়ার সাথে সাথে কোনো পুরুষের খারাপ স্পর্শ তার জীবন ওলোটপালোট করে দেয়, তখন তাকে চুপ থাকতে বলা হয়।

ঘটনার প্রভাবে মেয়ে তখন ক্ষুব্ধ  হয়, ঘৃনা করে সমস্ত পুরুষ কিংবা নারী জাতটাকে। কিন্তু বলে উঠতে পারেনা, যে শুচিতাকে নিয়ে এতো বড় বড় ভাষণ, সে শুচিতা যখন সংজ্ঞার ভেতরে পড়েই নষ্ট হয়, তখন সেই দুষ্কৃতকে কেন শাস্তি দেওয়া হয় না? তখন কেন দায়টা নারীর কাঁধে পড়ে? প্রশ্নটা তারা করে না, আর না করার জন্য দিন দিন এ বিচিত্র নিয়ম বেড়েই যায়।

বাদ দিন ওসব, নিজের কথা বলি…

আমার জীবন থেকে উনিশ বছর চলে গেছে, সেটা নেহাৎ ক্ষুদ্র নয়। প্রচুর ধাক্কা শুধু নারী হিসেবে এ জীবনে আমি পেয়েছি, প্রচুর কান্নার জলকে অবলীলায় খরচ হতে দিয়েছি, আমার বাথরুম আর পানির কল ছাড়া তার কোনো সাক্ষী নেই।

তবে আমার জীবনকে অদ্ভুত বিশ্রী করার জন্য একটা ঘটনাই যথেষ্ট ছিল। তখন আমি সদ্য তিন বছরের বাচ্চা। তিন বছরের বাচ্চারা কি করে জানেন তো? ছোট্ট পায়ে দৌড়ায়, এ ঘর ওঘর করে, মিষ্টি গলায় গান গায়-

“আচ্ছা মাগো বলতে পারো সূর্য কেনো ওঠে/ ভোরবেলাতে কোন সে গানে ফুলকুমারী ফোটে”?

সে বাচ্চা বয়সটা সেরকমই ছিলো। আমার ঘরভর্তি ডিজনির কার্টুনের ছড়াছড়ি, ডিজনির প্রিন্সেসরা সেখানে কি সুন্দর এক পৃথিবীতে ঘুরে বেড়ায়! সব কি চমৎকার।

আমার কাছের এক আত্মীয়, বাড়িতে ভীষন যাওয়া আসা তার। নিজের গাড়ি করে আসতেন। তার গাড়িতে নিয়ে ঘুরতে যাওয়ার লোভ দেখাতেন। তিন বছরটা কি সে লোভকে অগ্রাহ্যে করার জন্য যথেষ্ট ছিল?

মনে তো হয় না।

আমি প্রথম মলেস্টের শিকার হই উনার হাতে।

আমি মলেস্টের ব্যাপারটা পুরোপুরি মনে করতে পারিনা, আমার অবচেতন মন পুরোটা জানে খুঁটিনাটিসহ। কিন্তু কেন জানি আমাকে জানাতে চায় না। আমিও তাকে আমার অবচেতন মন থেকে বার করতে চাই না।

কারণ আমি ভীষন ভীতু, এ যন্ত্রনার মুখোমুখি হওয়ার মতো সাহস আমার নেই।

আমি আমার সাড়ে আট বছর বয়সে বুঝতে পারি আমার সাথে ভীষন অন্যায় কিছু হয়েছে। আমার মাকে বলেছি, আমার মা হয়তো বিষয়টা হজম করতে পারেননি। কিন্তু এককালের তুমুল সাহসী সাংবাদিক হিসেবে পরিচিত আমার মা ওই ব্যক্তিকে কোনোরকম প্রশ্ন এ ব্যাপারে করেননি, এড়িয়ে গেছেন। ওই ভদ্রলোক অনেক বয়সে এক ১৪ বছরের মেয়েকে বিয়ে করেন। আমার মা হাসিমুখে সে বিয়ে অ্যাটেন্ড করেছেন। আমাকে করাতে বাধ্য করেছেন।

কি সুন্দর তাই না?

নারীদের জীবনের গল্প এমনই হয়।

এখন প্রশ্ন আসতে পারে তিন বছরের ওই ঘটনাতে কি আর এমন গেল আসলো?

নাহ্ তেমন কিছু হয়নি, শুধু আমি এখন আর কাউকে বিশ্বাস করতে পারিনা, নিজের বাবাকেও না। আমি প্রতিরাতে ঘুমোবার আগে একবার এ বিষয় নিয়ে ভাবি, আমি রোজ ভালো করে সাবান দিয়ে স্নান করি, ডিসেম্বরের কনকনে শীতেও করি, ভাবি কোনোভাবে যদি সেসব স্পর্শ তুলে ফেলা যায়!

সেসব স্পর্শ তাও ওঠেনা। আমি মাথাভর্তি ঘেন্না নিয়ে ঘুরি, মানুষ খুনের অদ্ভুত অদ্ভুত টেকনিক নিয়ে ঘুরি, মাঝে মাঝে মনে হয় আমার ভেতরের ভীষণ তোলপাড় কিছু নির্দিষ্ট মানুষের গরম রক্তের স্রোতের ধারা দেখে কমে যাবে। আমি মানুষের কাছে কোনো আশা রাখিনা, রাস্তাঘাটে কিংবা ঘরে অপরিচিত পরিচিত প্রত্যেকের চোখে ঈগলের দৃষ্টিতে তাকাই, অপেক্ষা করি কখন চরিত্র বদলে যাবে। আমার প্রেম ভালোবাসাকে ঘেন্না লাগে,মনে হয় সব নাটক,আমি কাউকে বিশ্বাস করতে পারিনা, নিউজফিডে কারো প্রেমময় পোস্ট দেখলে আমার গা গুলিয়ে ঘেন্নায় বমি আসে। আমি প্রেমের উপন্যাস ছুঁয়ে দেখি না, প্রেমের সিনেমা দেখে প্রচন্ড বিরক্তি লাগে। আমার প্লে লিস্ট ভর্তি হয় “I saw the devil”, “I spit on your grave”, “Saw”,”Wrong turn” এর মতো কালেকশনে। আমার The fault in our stars দেখে ন্যাকা ন্যাকা প্রেমে বিরক্ত লাগে, আমি অপেক্ষা করি রিডলারের কণ্ঠে ন্যায়নীতির বারোটা বাজানো উক্তি শোনার।

আমি ছোটোবেলায় কাউন্সিলিং যখন করাতাম তখন অনেক বাচ্চা ছেলেও সেখানে ছিল, যারা আমার মতোই ছিল, তাদের জীবনটা অদ্ভুতভাবে বদলে গেছে।

আমি এ বিশাল পৃথিবীর প্রতিটা মানুষের জন্য ঘেন্না নিয়ে বসে থাকি।

মানুষ যখন পিশাচে বদলায় তখন আমার অদ্ভুত হাসি পায়, কারণ আমার প্রেডিকশন তারা প্রমান করে।

কি অদ্ভুত সবকিছু। এমন অদ্ভুত জীবন আমি চাইনি, আমি স্বাভাবিক এক সুন্দর জীবন চেয়েছিলাম, একটা হাসি কান্নার গল্পে মাখানো জীবন, বাকিদের মতো নিশ্চিন্তে রাতে ঘুমিয়ে যাবার জীবন।

আমার কিচ্ছু হয়নি।

আমি এ জীবন নিয়ে পার করবো বাকি সব আগত যুগ।

আমি আমার মলেস্ট হবার গল্প এখন গলা উঁচিয়ে বলি, ডিবেটের প্ল্যাটফর্মে হাজার হাজার মানুষের সামনে বলি, পোস্ট দিয়ে বলি। বেশিরভাগ নাক কুঁচকান, আমাকে নির্লজ্জ বলেন, অনেক মেয়ে আমাকে ঘেন্না করেন, পুরুষেরা সহমর্মী হয়ে জানতে চান আমি কি রেইপ হয়েছিলাম?

আমি পাল্টা প্রশ্ন করি?

সাড়ে তিন বছরের বাচ্চার শরীরকে রেইপ ছাড়া কি অন্যভাবে মলেস্ট করলে মলেস্ট্রেশনের গুরুত্ব কমে যায় আপনাদের কাছে?

উনারা আমতা আমতা করেন।

আমার মা বিব্রত হোন,আত্মীয় স্বজন যাদের সন্তান বহুগামী হওয়াকে আধুনিকতা মনে করেন, তারা আমার মাকে ফোন দিয়ে প্রতিনিয়ত বোঝান আমি যাতে এসব প্রকাশ না করি, ভালো মেয়েরা এসব প্রকাশ করেনা। এসব করলে আমার বিয়ে হতে সমস্যা হবে, সমাজে টিকতে সমস্যা হবে।

আমার মা মাঝে মাঝে এদের রাগ আমার উপর ঝাড়েন, প্রচুর নোংরা কথা বলেন। আমি মাকে সহানুভূতির চোখে দেখি, তাকে বলি তুমি আসলেই পরাজিত ভীতু একজন মানুষ। আমার মা নিজেও তা জানেন সেজন্য তার গলার আওয়াজে তেমন কনফিডেন্স থাকে না। আমি নিজের মতো বলে যাই। এদের কিচ্ছুকে আমি দাম দেইনা।

শুধু নিজের কথা বলার পর কিছু ছোট্ট বাচ্চা যখন চোখের ভাষায় বোঝায় আমায় যে সে দুঃখ তাদেরও, ইনবক্সে বলে দেয় নিজেদের সব যন্ত্রনা, কেউ কেউ যখন টেলিফোনে সব বলতে গিয়ে টানা ছ’মিনিট চিৎকার করে কাঁদে; তখন মনে হয় আমার বলা উচিত।

এ মেয়েগুলো বুঝুক তারা একা না, সমাজের নোংরা সংজ্ঞায়নকে এরা পা দিয়ে মাড়িয়ে দিক। এরা বুঝুক এদের সাথে যে অন্যায় হয়েছিলো, তার দায় এ বাচ্চাগুলোর কোনোভাবেই না।

আমার দিন এভাবেই রাগে ঘেন্নায় কাটে, আমি স্বাভাবিক হতে পারিনা। সমাজের হাজারটা জাজমেন্টের ভেতর আমি ঘাড় বাঁকা করেই বেঁচে থাকি। নিজেকে শক্ত করে বেঁচে থাকি, কোনোভাবেই নরম হতে চাইনা কারণ সেই একটা ঘটনা আমার জীবনকে দূর্বিষহ করে দিয়েছে।

আমি স্বপ্ন দেখি, একদিন আমি অনেক সাহসী হবো, একদিন আমি সবার সামনে ওই অত্যাচারের খুঁটিনাটি বর্ণনা করবো, সেদিন আমি একদম কাঁদবো না। ঠান্ডা গলায় বোঝাবো কেন আমি স্পর্শ তুলতে যুগ যুগ গোসল করে গেছি।

আমি স্বপ্ন দেখি একদিন সেসব স্পর্শ উঠে যাবে, প্রকৃতির স্নিগ্ধতা আমাকে আলিঙ্গন করবে। আমি আবার নিষ্পাপ আনন্দময় মন নিয়ে মায়ের গলা ধরে কবিতা বলব।

আমি এই বয়সের তুলনায় বড় হয়ে যাওয়াটা কখনো চাইনি, আমাকে হতে হয়েছে। আমি সত্যি স্বপ্ন দেখি এ সমাজের কোনো মেয়েকে আর বয়সের তুলনায় বড় হতে হবে না। তারা ভালো থাকবে, আনন্দে থাকবে। প্রকৃতির অপার স্নেহময় দানে সবচেয়ে সুন্দর সাহসী ফুল হয়ে তারা উঠবে। আমার মতো ভয়ানক জীবন তাদের কারো হবে না।

আমি স্বপ্ন দেখি একদিন এ পৃথিবীতে নারী পুরুষ সবাই মানুষ হয়ে রাস্তায় হাঁটবে, নারীকে কেউ ব্যক্তিগত সম্পত্তি ভাববে না, নারী নিজেকে মানুষ ভাববে। নারী মানুষের সম্মানে জীবন পার করবে- এর থেকে সুন্দর কিচ্ছু হয় না।

আমি স্বপ্নপূরনের অপেক্ষায় ভালো থাকি।

[ফেমিনিস্ট ফ্যাক্টরে প্রকাশিত মুক্তমত লেখকের নিজস্ব বক্তব্য]