November 25, 2024
কলামফিচার ২

নারী এবং আত্মসম্মান

আঞ্জুমান রোজী।। আত্মসম্মান, আত্মজ্ঞান, আত্মনিয়ন্ত্রন- এই তিনটি বিষয় মানুষকে আত্মপ্রত্যয়ী  করে তুলতে সহায়ক ভূমিকা রাখে; সেইসাথে জীবন যাপনে নিজ ইচ্ছায় এবং নিজ সিদ্ধান্তে সুনির্দিষ্ট পথরেখাও তৈরি করে দেয়। এই তিনটি বিষয় নারী পুরুষ সকলের জন্য প্রযোজ্য। তবে পুরুষ যেভাবে আত্মসম্মান, আত্মজ্ঞান এবং আত্মনিয়ন্ত্রণের মধ্য দিয়ে নিজেকে পরিচালনা করতে পারে বা করার সুযোগ পায়, নারী সেই তুলুনায় কোনো সুযোগ পায় না বলে নিজেকে অনেক সময় পরিচালনাও করতে পারে না। তাছাড়া পুরুষতান্ত্রিক সমাজ নারীকে আত্মবোধসম্পন্ন মানুষ হিসেবে দেখে না, দেখে পরনির্ভর, দুর্বল এবং অবলা রূপে। সেই নারী শিক্ষিত হলেই কি আর অশিক্ষিত হলেই  কি;  সব নারীর প্রতি পুরুষতান্ত্রিক সমাজের দৃষ্টিভঙ্গি একই রকম। যুগের পর যুগ এভাবে চলতে চলতে পুরুষের ভেতর নারীর প্রতি বৈরী ভাব বদ্ধ হয়ে আছে। এমন দ্বান্দ্বিক প্রেক্ষাপটে আত্মসম্মানবোধ সম্পন্ন নারী শত চড়াই-উৎরাইয়ের মধ্যে ঠিকই মাথা উঁচু করে চলে এবং নারী পারে বিদ্যাবুদ্ধিতে আত্মনির্ভরশীল হয়ে উঠতে;  হতে পারে আত্মমর্যাদাপূর্ণ ব্যক্তিত্বসম্পন্ন  সম্পূর্ণ এক মানুষ হতে।

লকডাউন সময়ে ‘থাপ্পড়’ নামে এক হিন্দী মুভি দেখি। যেখানে স্ত্রীকে স্বামী এক থাপ্পড় দেয়ায় দুজনের পুরো জীবনটাই ওলটপালট হয়ে যায়। হ্যাঁ,  পুরুষতান্ত্রিক সমাজ বলবে, একটাই তো থাপ্পর তাতে কী হয়েছে? রাগের মাথায় মানুষ অনেক কিছুই করে। ভুল বুঝতে পারলে ক্ষমা করে দিয়ে স্বাভাবিক জীবনযাপনে ফিরে আসাই হলো বুদ্ধিমানের কাজ- যার জন্য যুগ যুগ ধরে নারীকুল শুধু থাপ্পড়ই নয় এরচেয়ে আরো বেশি অমানবিক, নৃশংস আচরণের মুখোমুখি হয়ে, অপমানে অপদস্ত হয়ে কুলাঙ্গার স্বামীর সঙ্গে সংসার করে যাচ্ছে। কারণ সমাজ বলে কথা। অথচ এমন অনেক নারী আছেন যাদের আত্মসম্মানবোধ টনটনে। রাগে জিদে ক্ষোভে মনের ভেতর অপমানের আগুন পুষে রাখে ঠিকই, তবে সময় ও সুযোগ পেলে এসব নারীও পারে চারদিকে আগুন জ্বালিয়ে, বেড়া ভেঙে বের হয়ে আসতে। এমন নারী তৈরি হয় পারিবারিক পরিবেশ এবং শিক্ষা থেকে; যদি পারিবারিক পরিবেশ নারীটিকে মানুষ হিসেবে গড়ে তোলে, গড়ে তোলে আত্মসম্মান, আত্মজ্ঞান এবং আত্মনিয়ন্ত্রণে পারদর্শী করে। এমন নারী একটা থাপ্পড় কেন পুরুষের গলা চওড়া করে কথা বলাও তো হজম করতে পারে না। ‘থাপ্পড়’ মুভিতে ঠিক এমনই এক নারীর চরিত্র ফুটে উঠেছে, যেখানে স্বামী লোকটি প্রথমে তার ভুলটা কোথায় বুঝতে না পেরে গলাবাজি করে যাচ্ছিলো। তারপর স্ত্রী বিষয়টি সিরিয়াসলি নিয়ে সেপারেশনে চলে যায়, তখন স্বামী ক্ষমা চাইতেও কুণ্ঠাবোধ করেনি। কারণ সে সংসারটা টিকিয়ে রাখতে চায়। অবশেষে ডিভোর্সের দিকে বিষয়টি গড়ালো এবং স্বামী লোকটির পৌরুষত্বও এক ফুৎকারে নিভে গেলো। ভ্যাবাচেকা খেয়ে এক দৃষ্টিতে তাকিয়েই থাকলো সংসার ভাঙ্গার  যবনিকাপাতের দিকে। অনেকেই বলবেন, বাড়াবাড়ি।  আমি বলবো, এটাই ঠিক। পুরুষ বুঝুক নারীর আত্মসম্মানবোধ আছে।

কিছুদিন আগে উপন্যাসিক বাবলী রহমানের ‘অষ্টপ্রহর আনাগোনা’ উপন্যাসটি পড়লাম। উপন্যাসের প্রতিপাদ্য ছিল নারীর আত্মসম্মানবোধ। চিরাচরিত নিয়মে নারী আদিকাল থেকে মনের মতো পুরুষ নিয়ে সংসার করার স্বপ্ন দেখে। সেই স্বপ্ন যখন বাস্তবায়ন হয় তখন নারীটি মনপ্রাণ ঢেলে সংসারধর্মে নিবেদিত হয়। সেইসাথে মনের মতো পুরুষটির প্রতিও অতি যত্নবান হয়ে ওঠে।  যার প্রেক্ষিতে লক্ষ্য করা যায় অধিকাংশ নারী তার শিক্ষা, মেধা, ক্যারিয়ার জলাঞ্জলি দিয়ে সংসার কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়ে। কিন্তু বাস্তবতা এমনই যে কখনোই কোনোকিছু একই স্রোতে বয়ে চলে না। সবকিছু ঠিকঠাক থাকলেও মনের পরিবর্তনটা হয় দিন-রাতের মতো। বিশেষ করে পুরুষটির মধ্যে একধরণের নির্জীবতা এসে ভর করে। তার মধ্যে থাকে না প্রথম পরিচয়ের মতো উত্তেজনা। সবকিছু তার কাছে তখন রুটিনমতো চলতে থাকে। এমনকি সঙ্গী নারীটিকেও তার নিত্যদিনের প্রয়োজনীয় কিছু মনে হয়। যার ফলে, সঙ্গী নারীটিকে অনেক সময় অনেক কিছু জানানোর প্রয়োজন মনে করে না। হুটহাট নিজের মতো সিদ্ধান্ত নিয়ে কাজ করা, রাতে দেরিতে ফেরা, অনেক বিষয়ে নারী সঙ্গীটির সঙ্গে  যোগাযোগ না রাখা; এসব ধীরে ধীরে ঘটতে থাকে। যার ফলশ্রুতিতে দুজনের মধ্যে দূরত্ব বাড়ে। পুরুষ সঙ্গীটি হয়তো অনেকসময় ভুলবশত  কিংবা পাত্তা না দিয়ে কাজগুলো নিজ মনে করে। এতে নারী সঙ্গীটির মনের অবস্থা কেমন হতে পারে? এমতাবস্থায় একাকীত্ব ঘুচানোর জন্য নারীটি মনের আশ্রয় খোঁজে মনুষ্য জগতের বাইরে অন্য এক প্রাণীর কাছে। এখানে সমাজ বলবে, নারীকে সবকিছু মানিয়ে নিতে হয়, নাহলে সংসার করা সম্ভব নয়। কিন্তু একজন শিক্ষিত, বিদূষী, সচেতন, স্মার্ট নারীর পক্ষে এমন অবহেলা, অপমান মেনে নেয়াও সম্ভব নয়। আবার আত্মসম্মানবোধের জন্য অনাহূত বিষয় নিয়ে কথা বলাও যে ঠিক নয়।  এমনই ঘটনার ঘনঘটায় ‘অষ্টপ্রহর আনাগোনা’ উপন্যাসটির আলোকপাত। অবশেষে নারী সঙ্গীটি যখন চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেয় সবকিছু ছেড়েছুড়ে চলে যাবে, তখনই সঙ্গী পুরুষটির মাথায় বজ্রপাত ঘটে। কারণ সে বুঝেই উঠতে পারে না, কেন তার স্ত্রী তাকে ছেড়ে যাবে! যেখানে সংসার পরিচালনায় কোনোকিছুর কমতি নেই, যোগান দিয়ে যাচ্ছে সবকিছু, বলতে গেলে একরকম  বিলাসবহুল জীবনযাপনই তাদের। তাহলে সমস্যা কোথায়? না বোঝারই কথা। সমাজ যে পুরুষের ইচ্ছায় চলে! নারীর মন বোঝার দরকারই মনে করে না!  অবশেষে, স্ত্রী স্বামীকে ডিভোর্সের সব আয়োজন করে চলে যায়। আমি মনে করি, ঠিক করেছে।  উপন্যাসিক শেষে এসে স্ত্রীর  এই সিদ্ধান্তর চূড়ান্ত প্রতিফলন ঘটান।

এতোক্ষণ তো মুভি এবং উপন্যাসের কথা বললাম। এখন কানাডার একটা বাস্তব ঘটনার কথা বলি। আমার সহকর্মীর এক আত্মীয়া, স্বামী ব্যক্তিটি শুধুমাত্র ‘প্লিজ’ শব্দটি উচ্চারণ করেনি বলে সাতবছরের সংসার ভেঙে দেয়। তাদের পাঁচ বছরের একটা পুত্র সন্তানও ছিল। প্রথম প্রথম আমিও শুনে স্তম্ভিত হই। এটা কোনো কারণ হলো? পরে  বিষয়টা ধীরে ধীরে অনুধাবণের চেষ্টা করি। আমাদের আর্থসামাজিক প্রেক্ষাপটে এমনটা  ভাবতেই পারি না। কারণ জন্ম থেকেই বড় হতে হতে জেনেছি পুরুষমাত্রই বিশেষ কিছু, অর্থাৎ ‘সোনার আংটি বাঁকাও ভালো’ এমন মানসিকতা আর কি! সব অবস্থায় পুরুষের অধীন থাকতে হবে। এখন তারা যাই করুক বা বলুক না কেন, তা মাথা নত করে মেনে নিতে হবে। এই অভ্যাস কম বেশি অধিকাংশ নারীর মধ্যে আছে। এমনকি শিক্ষিত অনেক নারীর মধ্যেও এই প্রবণতা লক্ষ্য করা যায়। জন্ম থেকে নারী বড় হতে হতে যদি তাই দেখে তাহলে সেটা মননে মগজে গেঁথে যাবে, এটাই স্বাভাবিক।  কিন্তু তারপরেও কথা আছে। এভাবে মেনে নেয়ার দিন আর কতদিন! মেনে নেয়া মানে নিজের কাছে নিজে হেরে যাওয়া। এই বোধটা যে সমস্ত নারীর মধ্যে আছে তারাই আত্মবিশ্বাসী এবং আত্মপ্রত্যয়ী হয়ে ওঠে। তখন  সমাজের প্রথা ধূলিসাৎ হতে বাধ্য। যেটা হচ্ছে উন্নত দেশে। আমার মেয়ে একদিন একটা কথা বলে আমাকে বিব্রতকর অবস্থায় ফেলে দিয়েছিল। বলেছিল, ‘বাংলাদেশের হাজব্যান্ডরা তাদের ওয়াইফকে প্লিজ, থ্যাংকিউ বলে না। কি মিন তারা!’ কথাটা বলেছিল তাদের বাবার সামনে। খুবই অবাক হয়েছিলাম মেয়ের কথা শুনে।

আত্মসম্মানবোধের জায়গায় বাংলাদেশের নারীদের অবস্থান একেবারে শূন্যের কোঠায়। তারপরও কিছু নারী প্রথার বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াচ্ছে, নিজে সিদ্ধান্ত নিয়ে মাথা উঁচু করে চলছে, তারাই হলো আলোর পথিক, প্রগতির প্রতীক। আত্মসম্মানবোধ,  আত্মনিয়ন্ত্রণ এবং আত্মজ্ঞান নারীকে এখন জাগ্রত করছে।  শিক্ষায়, মেধায়, মননে নারী আত্মপ্রত্যয়ী হয়ে উঠছে এবং উঠছে বলেই মুভিতে, লেখালেখিতে নারীমুক্তির কথা জোরালোভাবে প্রকাশ পাচ্ছে। নারী যতদিন নিজেকে বুঝতে না পারবে ততদিন তাকে পুরুষের অধীনেই থাকতে হবে। নারীকে আত্মপ্রত্যয়ী করে গড়ে তুলতে হলে জন্ম থেকেই তাকে বুঝিয়ে দিতে হবে সে একটি একক সত্তা। তার নিজস্বতা আছে, আছে স্বকীয়তা।  ইচ্ছে করলেই একটা নারী তার ইচ্ছেমতো জীবনধারণ করতে পারে; যদি তার মধ্যে শিক্ষা, মেধা ও সচেতনতা থাকে এবং তা পরিবার থেকেই নারীকে বুঝিয়ে দিতে হবে। নারী দুর্বল নয়। নারী পারে তার আত্মসম্মান নিয়ে মাথা উঁচু করে চলতে। যদি সম্মানবোধটা টনটনে থাকে, তখন পুরুষও শালীনতার মধ্যে থেকে কথা বলবে, সম্মান করবে। অতএব নারীকেই বুঝিয়ে দিতে হবে ‘নারী আসলে কী এবং কেমন?’ এই বিষয়ে নারীর উপরেই তার নিজের দায়িত্বের ভার বেশি। পুরুষতান্ত্রিকতায় কুঠারাঘাত করতে হলে নারীকেই সবচেয়ে বেশি অগ্রণী ভূমিকা রাখতে হবে। পৃথিবীর সকল নারী আত্মসম্মানবোধে বলীয়ান হয়ে নিজ সত্তায় বাঁচুক, সেই প্রত্যাশাই করি।

 

[ফেমিনিস্ট ফ্যাক্টরে প্রকাশিত কলাম লেখকের নিজস্ব বক্তব্য]