November 24, 2024
সাহিত্যগল্পফিচার ২

মা হওন অতো সোজা না

সেঁজুতি জাহান।।

দারিদ্রের উদাম সত্যের মতো একটা উদাম আকাশের নিচে করোনার ভারি শ্বাসের সঙ্গে জীবন মরণ ফাইট করতে করতে মাঝে মাঝে করোনার দয়ায় একটু হালকা শ্বাস পেতে পেতে লতিফা বানুর শাশুড়ির এই কথা মনে পড়তে থাকে: ‘মা হওন অতো সোজা না’। গত ৩৪ বছরের শেষ ৬ বছর ধরে লতিফা বানুর একটু বেশি বেশিই মনে পড়ে এই কথা। ৩৪ বছরের শেষ ৪ বছর আগে লতিফা বানু বিধবা হন। কৃষি ব্যাংকের পিওনের চাকরি করা এক মাত্র ছেলে ছাত্তারকে তিনি আর তার ছাত্তারের বাপ বিয়ে করান বড়ো সাধ করে। বড়ো সাধের ছেলে এই ছাত্তার। মৃত সন্তানদের ভিড়ে একমাত্র নীলমণি সে। সেই নীলমণির বৌ, লতিফা আর কাশেমের বড়ো সাধের বউমা খুবই বুদ্ধিমতী আর চলতে ফিরতে বেশ মিষ্টি।

নতুন বৌ হয়ে যেদিন লতিফা বানুদের টিনের নতুন ঘরে আসে,  সেদিন তার মনের মধ্যে তার শাশুড়ির বলা ‘মা হওন অতো সোজা না’ বাক্যটা বাড়ি খায়।

একদিন ঠিক এভাবেই একটা লাল লম্বা ঘোমটা দিয়ে লতিফা বানুও এসেছিলেন একটি কুঁড়ে ঘরে। ঘরে উঠতে গিয়ে তার মাথা বাঁশের আড়ায় বেঁধে কেটে গিয়েছিল।  মাথা থেকে রক্তও বের হয়েছিল বেশ। ছয় ননদের মধ্যে বিবাহিত এক জন এবং অবিবাহিত তিন জনের কাউকে দেখা যায়নি এগিয়ে যেতে সেদিন তার মাথার কেটে যাওয়া রক্ত থামানোর জন্য । এমনকি স্বামী কাশেমও মাথার রক্তের চেয়ে নতুন বৌ উপভোগের দিকে শেয়ালের দৃষ্টি দিয়ে অগ্রসর হয়।

যেবার লতিফা বানু প্রথম পোয়াতি হলেন,  সে বছর তিনি কিছু খেতে পারতেন না,  শুধু ভাতের ফ্যান ছিল তার খাবার।

তারপর তিনি কোনো মতে কুকুরের খড়ের মতো একটি অযত্নের খড়ের গাঁদিতে সন্তান জন্ম দিলেন।

ক্ষুধার্ত বাঘিনীর মতো রাজ্যের ক্ষুধা তার পেটে।

শাশুড়ি হলদে বড়ু মেঝো পুত্র কাশেমকে ডেকে বললেন,  ‘শোন, বৌমার তো সুন্তান হইছে,  এখন খিদা বেশি বেশি লাগবো, বাজার থিকা ফলাদি আর ভালা দেইখা গোডা চাইর কইতর লইয়ানিছ, বৌমা আমার কিছুই খাইতে পারে না।’

পূর্ণিমার পূর্ণাঙ্গ চাঁদের মতো দাঁত কেলিয়ে আত্মায় স্নানের প্রশান্তি নিয়ে নিজেদের চষা একটুকরো জমির খাটুনি দূর করে দিয়ে মায়ের হুকুম মতো সব কিনে আনে কাশেম। কিছু দেনাও হয় এ জন্য।

রান্নাঘরের বারান্দা থেকে কাশেমের হাতে সদাই দেখে কাশেমের মায়ের কলিজায় তাজরিন ফ্যাশনের মতো আগুন জ্বলে ওঠে। আগুনের হলকা কিছুটা তার বিবাহিত একজনসহ চার কন্যার কাছেও পাচার হয়ে যায়। পাচার হয়ে যাওয়া বাক্যগুলো অনেকটা এরকম: ‘ দেখছসনি, বৌর কথা কইছি লগে লগেই সব আইনা হাজির,  মায়ের লিগা কইতাম টেহার দোহাই দিয়া থুইয়া দিত। আমিও হলদে বড়ু, ছাড়ুম না আমি।’

লতিফা বানু বাচ্চার মুখে দুধ দিয়ে শুয়ে থাকতে থাকতে সেই হলকার একটু আভাস শোনে। শোনে না কাশেম, কাশেমের বড় ভাই হাশেম এবং তার পরিবার। কাশেমের আগমনী দূরত্বে তার মায়ের এই অগ্নি-বচন পৌঁছে না। বড় ভাই হাশেম স্ত্রৈণ বিধায় জুদা খায়, ফলে তাদের কানেও পৌঁছে না।

দুপুরে ‘কইতর’ রান্না হয়।  কাশেম মাকে জিজ্ঞেস করে লতিফা বানু খেয়েছে কিনা।

মা উত্তরে বলেন,  ‘হ খাইছে। একটা কথা বাবা,সারাদিন তোমার বৌ পোলার মুহে দুধ দিয়া হুইত্যা থাহে ক্যান এট্টু জিগাইও। এইডা তো হউর বাড়ি, হেইডা তো বুঝতে হইব তার।’ শুনে বেশ চটে যায় কাশেম।

ওদিকে ‘কইতর’ এর একটি পালকও পায়নি লতিফা বানু। ছেলের খেতে আসার আগেই বৌমাকে হলদে বড়ু বড় আদর করে ভাতের ফ্যান আর কিছু লবণ দিয়ে পেট ভরিয়ে দিয়েছেন। মুখে বলেছেন, ‘আহারে, বাচ্চা প্যাট থিকা বাইর হইলে ম্যালা খিদা লাগে, তুমি তাড়াতাড়ি খাইয়া নাও বৌমা। আমার পুতারে গিয়া দুধ দ্যাও। পোলাডা সারাডা দিন কান্দে। পোলার কান্দন থামাইতে পারো না?  ক্যামন মা তুমি?’

এ বাড়ি খাবার খাওয়া হয় মাটির মেঝেতে, খেঁজুরের পাটি বিছিয়ে। মাটির মেঝেতে একটু দূরে দূরে যুদ্ধবাজ রাজ্যের দুর্গের মতো ‘কইতর’ এর চিবানো হাড্ডির ভেতরে পিঁপড়ারা তৃপ্তি খুঁজছে। দেখে যে কারো মনে হবে দূর্গের ভেতরের সৈন্যদের শত্রুর টহল।

লতিফা বানু মাংসের ঘ্রাণটাও পেলেন। পরম মমতাময়ী শাশুড়ি মাকে তিনি জিজ্ঞেস করলেন, ‘আম্মা, মাংস রান্না হইছে আজকে?’

হলদে বড়ু বলেন, ‘হ মা, হইছে।  কইতরের গুস্ত রান্না হইছে। ত্যাল মশলা ঝাল দিয়া রান্না হইছে তো তাই তুমারে দেওয়া হয় নাই। শোন মা, মা হওন অতো সোজা না, তুমি এডি খাইলে বাচ্চার প্যাডে যাইবো, বাচ্চায় অসুস্থ হইয়া আরও কানবো।  কয়ডা দিন যাউক, তারপর সবই খাইতে পারবা।’

‘সত্যি তো মা হওন অতো সোজা না’।

দীর্ঘ ক্ষুধার দিন পার করে করেও ছাত্তারের দুইটা ভাই আর একটা বোনকে সে বাঁচাতে পারেনি। কেমন মা সে? সারাদিন লিটমাস পেপারের মতো বাচ্চার মুখের মধ্যে দুধ দিয়ে রেখে রেখেও বাচ্চার কান্নার রঙ পাল্টাতে পারেনি, বাচ্চাগুলোকে বাঁচাতেও পারে না?

কেমন মা সে?  দুই ফোঁটা দুধ বাচ্চার পেটে ঢোকে না অথচ বুক তার লোহার মতো ব্যথা হয়ে থাকে? রাতে স্বামীকে ধরে তার আছাড় মারতে ইচ্ছে করে?

কেমন স্ত্রী সে, যে শুকাতে শুকাতে স্বামীর তার প্রতি অমনোযোগিতার উৎস হিসেবে উপস্থিত হতে থাকে? স্বামীকে নিজের অনাহারে থাকার বিষয়টি কিছুতেই বিশ্বাস করাতে পারে না লতিফা। কারণ লতিফার চেয়ে মাতৃত্বের ব্যাপারে হলদে বড়ু বেশি অভিজ্ঞ। সবকটা ছেলেমেয়ে তার জীবিত।  এতোগুলো সন্তান যার হয়েছে তিনি তো অবশ্যই মা হতে হয় কীভাবে তা খুব ভালো করেই জানবেন। তাই না?

‘কইতর’ খেতে  দেয়নি এই অভিযোগ করলে উলটো কাশেমের হাতে মার খেয়েছে লতিফা বানু। কেমন স্ত্রী সে, নিজের স্বামীকে কোনো কথা বিশ্বাস করাতে পারে না? একজন মুরুব্বি সম্পর্কে এমন নোংরা অভিযোগ কী ক’রে করে,  যিনি কিনা বৌমার জন্যই সব কিছু করতে বলেন ছেলেকে?

কেমন বেটার বৌ সে, এখন পর্যন্ত একটি নাতি পুতির মুখ ঠিক মতো দেখাতে পারল না?

মা হওয়া কিন্তু আবার বেশ সোজাও। সেজন্য কাশেমের সেজো বোনটা এখানে থেকে দুটো বাচ্চা হওয়াতে পেরেছে। লতিফা বানুর জন্য আনা ঝাল ঝাল কইতরের ঝোল খেতে পেরেছে। খেতে পেরেছে ভাতসহ সকল প্রকার মাছ, তরু তরকারি। কিন্তু এর কিছুই কাশেম বা লতিফা বানুর সামনে নয়।

এ বাড়িতে রান্নাঘরটা খাবারের রুম থেকে একটু দূরে।  সেখানে বসেই চার মেয়েকে নিয়ে হলদে বড়ু  খাবারের একটি অংশ চুরি করে খেয়ে নেন। পরে খাবারের ঘরে এনে ছেলের সামনে তিনি প্রায় কিছুই খেতে পারেন না! হাশেম জুদা হওয়াতে অনেক দুর্দশার ভেতরে এইটুকু লাভ হয়েছে ওদের। এবং ছাত্তারের সেজ বোন অছিরনের মা হওয়াও বেশ সহজ হয়েছে।

ছাত্তারের বোন হাওয়াকে বিয়ে দেওয়া হয়েছে অনেক দূরে। ছাত্তারের বুদ্ধিমতী বৌ এই বিয়ে দিয়েছে। দূরত্ব ছেদ করে লতিফা বানুকে হাওয়া দেখতেও আসতে পারে না তেমন। তাই লতিফা বানুর এই করোনার মধ্যে উদাম আকাশ-যাপন।

মা হওয়া যে অতো সোজা নয়, তা লতিফা বানু আজকেও অনুভব করতে পারছেন।

বিগত ৩৪ বছরের শেষ ৬ বছর ধরে লতিফা বানু এই হিসাবই কষছেন অনবরত: ‘মা হওন অতো সোজা না।’

বৌমা তো লতিফা বানুকে খুব আদর যত্ন করে। রোজ অফিসে যাবার আগে ছাত্তার দেখে তার মাকে তার স্ত্রী যত্ন করে প্লাস্টিকের ডাইনিং টেবিলে বসিয়ে নাস্তা তুলে দিচ্ছে। রাতে ঘুমানোর আগে সাত্তার দেখছে তার মায়ের জন্য দুধ দিয়ে আসছে তার স্ত্রী। দুপুরে ছাত্তার দেখছে না তার মাকে দিয়ে মশলা বাটানো, ঘরমোছা, কাপড় ধোয়ার কাজ করিয়ে নিচ্ছে তার বুদ্ধিমতী স্ত্রী।

একদিন লতিফা বানু কোমরের ব্যথার জন্য ঘর মুছতে অস্বীকৃতি জানালে তার বড়ো সাধের বৌমা তার দিকে একটি খুনতি ছুঁড়ে মেরেছিল। লতিফা বানু তার ছেলে ছাত্তারকে তা বিশ্বাস করাতে পারেনি।

বৃদ্ধ বয়সে এই করোনার ভেতরে ঠাণ্ডা পানি ঘেঁটে ঘেঁটে একদিন লতিফা বানুর শ্বাসকষ্ট শুরু হয়। বৌমা খুব কায়দা করে ছাত্তারকে বোঝায়, ‘উনার নিশ্চিত করোনাই হইছে, আর দ্যাশের যে অবস্থা তাতে লোক জানাজানি হইয়া গ্যালে আমগোই বিপদ, কাউরে পাইবা না তুমি, কেউ সাহায্য করতে আইবো না দেখবা। ব্যাকে নিজের জান নিয়া সেভ থাকবো। তার চেয়ে তুমি গোপনে জেলা হাসপাতালের বারান্দায় থুইয়া আসো উনারে। আর প্রচার করো উনার করোনা হইছে, হাসপাতালে ভর্তি করাইছি। ব্যস,কোন লোক দেখবারও যাইবো না, খোঁজও রাখব না।  আর তুমি তো উনারে বাইরে ফালায়া দিতাছ না, হাসপাতালেই তো দিয়া আইতাছ। নাকি?’

যেই বুদ্ধি সেই কাজ।

৬৮ বছরের লতিফা বানু। কোনো কিছুই না হয়ে ওঠা লতিফা বানু আজ ইঞ্জিনের শেষ গন্তব্যে থামবার শব্দের মতো একেবারে শেষ নিঃশ্বাসটুকুতে এসে পৌঁছেছেন।

চোনা পুকুরের মতো সাদাটে ঘোলা চোখে নীলচে সাদা আষাঢ়ের আকাশে এক ফোঁটা বৃষ্টির সম্ভাবনা না দেখে ফুসফুসের ঘন বাতাসের কাছে নিজেকে সঁপে দিয়ে এই কথাই শুধু অভুক্ত ঠোঁট দিয়ে আওড়াতে লাগলেন: ‘মা হওন অতো সোজা না।’

ঠিকঠাক মতো জন্মানোটাও কি অতো সহজ আসলে?