September 20, 2024
ফিচার ২মুক্তমত

বিবাহের প্রলোভনে ধর্ষণ নাকি প্রতারণা?

মাহমুদুল হাসান উৎস।। বাংলাদেশে রেপ, সেক্সুয়াল এক্সপ্লয়টেশন এবং ম্যানিপুলেশন এর সংজ্ঞা নিয়ে বিশাল ঝামেলা আছে। নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন ২০০০, ধারা ৯(১) অনুযায়ী, “যদি কোন পুরুষ বিবাহ বন্ধন ব্যতীত ষোল বৎসরের অধিক বয়সের কোন নারীর সাথে তার সম্মতি ছাড়া বা ভীতি প্রদর্শন বা প্রতারণামূলকভাবে তার সম্মতি আদায় করে, অথবা ষোল বৎসরের কম বয়সের কোন নারীর সাথে তার সম্মতিসহ বা সম্মতি ব্যতিরেকে যৌন সঙ্গম করেন, তাহলে তিনি উক্ত নারীকে ধর্ষণ করেছেন বলে গণ্য হবেন।”

খেয়াল করলে দেখবেন, আইন অনুযায়ী ধর্ষক হিসেবে পুরুষকেই সংজ্ঞায়িত করা হয়েছে।যেহেতু, এই সমাজ নারী অবান্ধব সেহেতু, ধর্ষক হিসেবে পুরুষকেই ধরা হয়েছে। এখন আসা যাক, ভিক্টিমের দিকে। ভিক্টিমকে সংজ্ঞায়িত করতে গিয়ে নারীকেই কেন্দ্রবিন্দু ধরা হয়েছে। এখানে ১৬ বছরের নিচে শুধু মেয়ে শিশুকেই শিশু ধরা হয়েছে। শিশু হিসেবে ছেলে শিশু কিংবা নারী শিশু উভয়েই হতে পারে। আবার শিশুকে সংজ্ঞায়িত করতে গিয়ে বয়স হিসেবে ধরা হয়েছে ১৬।তার মানে ১৬ বয়সের অধিক কোনো ছেলে অথবা, ১৬ বছরের নিচে কোনো ছেলে ধর্ষণ বা বলাৎকার হলে সেটাকে ধর্ষণ হিসেবে সংজ্ঞায়িত করার মতো যথেষ্ট উপাত্ত আইনে নেই। যদিও বলাৎকার শব্দে আমার অ্যালার্জি আছে, তবুও অবস্থা বোঝানোর জন্যে ধর্ষণের সাথে বলাৎকার শব্দটিও সংযুক্ত করা হলো। আদতে, বলাৎকারও একটি ধর্ষণ।

এবার বাংলাদেশের কথা থাকুক। উইকিপিডিয়ার তথ্য মতে, “২০১২ সালের পূর্ব পর্যন্ত যুক্তরাষ্ট্রের ফেডারেল ব্যুরো অফ ইনভেস্টিগেশন (এফবিআই) ধর্ষণকে কেবল নারীদের বিরুদ্ধে পুরুষদের দ্বারা সংঘটিত একটি অপরাধ হিসেবে বিবেচনা করত। ২০১২ সালে তারা ধর্ষণের সংজ্ঞা হিসেবে “কোনো নারীর ইচ্ছার বিরুদ্ধে বলপূর্বক তার সঙ্গে যৌনসঙ্গম”-এর পরিবর্তে “ভুক্তভোগীর অনুমতি ছাড়া যোনি বা পায়ুতে শরীরের কোনো অংশ বা কোনো বস্তু দ্বারা অনুপ্রবেশ কিংবা অন্য কোনো ব্যক্তির যৌনাঙ্গ দ্বারা মুখে অনুপ্রবেশ”-কে গ্রহণ করে। পূর্ববর্তী সংজ্ঞাটি ১৯২৭ সাল থেকে অপরিবর্তিত ছিল এবং এটিকে পুরাতন ও সংকীর্ণ হিসেবে বিবেচনা করা হত। নতুন সংজ্ঞাটি স্বীকার করে নেয় যে, নারী ও পুরুষ উভয়েই ধর্ষক বা ধর্ষিত হতে পারে, এবং কোনো বস্তুর দ্বারা ধর্ষণও ভুক্তভোগীর জন্য যোনিপথ/পায়ুপথে ধর্ষণের মতো কষ্টদায়ক হতে পারে। এফবিআই আরো স্বীকার করে যে, ভুক্তভোগী মানসিক বা শারীরিক অক্ষমতার কারণে অনুমতি প্রদানে অক্ষম হতে পারে, কিংবা ভুক্তভোগীকে মাদকদ্রব্য দ্বারা অচেতনও করা হয়ে থাকতে পারে। এফবিআই কর্তৃক এই সংজ্ঞাটি গ্রহণ যুক্তরাষ্ট্রের ফেডারেল বা রাজ্য ফৌজদারি আইনের কোনো পরিবর্তন ঘটায় নি কিংবা বিচারব্যবস্থায়ও কোনো প্রভাব ফেলে নি, বরং এর উদ্দেশ্য ছিল দেশজুড়ে যেন সঠিকভাবে ধর্ষণের অভিযোগ আসে।

যুক্তরাষ্ট্রের এই তথ্য মতে, একটি বিষয় লক্ষ্যণীয়। বিষয়টা হচ্ছে, “ভুক্তভোগী মানসিক বা শারীরিক অক্ষমতার কারণে অনুমতি প্রদানে অক্ষম হতে পারে।” এই জায়গাতেই ম্যানিপুলেশন এবং সেক্সুয়াল এক্সপ্লয়টেশন গভীরভাবে প্রবাহিত। এখন, বিষয়গুলোকে এভাবে সংজ্ঞায়িত যায়-

প্রথমত, সেক্সের ক্ষেত্রে কনসেন্ট বা সম্মতিই প্রধান বিষয়। কনসেন্ট না থাকলে সেটা নিঃসন্দেহে রেপ বা ধর্ষণ।

দ্বিতীয়ত, কনসেন্ট অথবা সম্মতির প্রকারভেদ নিয়ে কথা বলা যেতে পারে। ভুক্তভোগী মানসিক বা শারীরিকভাবে অক্ষম কি না। শারীরিক অক্ষমতা বলতে বাক প্রতিবন্ধী কিংবা ফিজিক্যালী ডিসকোয়ালিফাইড ব্যক্তি বিশেষ। এক্ষেত্রে, একজন বাক প্রতিবন্ধীও সেক্স করার সময় সম্মতি দিতে পারে। এবং বাক প্রতিবন্ধী বা ফিজিক্যালী ডিসকোয়ালিফাইড ব্যক্তির সাথে সেক্স করা মানেই রেপ- বিষয়টা তেমনও না। এক্ষেত্রে পার্টনার তার পার্টনারের সম্মতি বা অসম্মতি নিজেই বুঝতে পারবে। এখন আসা যাক, মানসিকভাবে অক্ষম ব্যক্তির ক্ষেত্রে। যেহেতু, মানসিক বিকারগ্রস্ত ব্যক্তি তার ব্যক্তি চেতনায় থাকেন না, সেহেতু মানসিক বিকারগ্রস্ত ব্যক্তির সাথে সেক্স করা মানেই রেপ। এ নিয়েও কোনো সন্দেহ থাকবার কথা না। আবার মানসিক বিকারগ্রস্ত মানেই বদ্ধ পাগল বা উন্মাদ নয়। মানসিকভাবে উদ্বিগ্ন, অবসাদে ভোগা ছাড়াও স্ক্রিৎজোফ্রেনিয়াও আছে।এসব ব্যক্তিরা খুব স্বাভাবিকভাবেই কনসেন্ট দিতে পারে।

এবার আসা যাক, বর্তমানের আলোচিত, সমালোচিত টার্ম “বিয়ের প্রলোভনে ধর্ষণ”। প্রলোভন শব্দটার সংজ্ঞা খুঁজতে গিয়ে আমি বেশকিছু ইংরেজি এবং বাংলা প্রতিশব্দ পেলাম। যেমন, temptation, Seduction, Decoy, Inducement।

বাংলা প্রতিশব্দগুলো – ফাঁদ, প্রলুব্ধ করা, লোভ, আকর্ষণের বস্তু, চৌপ, বিনিময়ে আপোষ করা, পরীক্ষা করণসহ ইত্যাদি ইত্যাদি। একজন ব্যক্তি কেন বা কখন প্রলুব্ধ হবেন? যখন সেখানে কোনো অফার থাকবে, লোভ থাকবে, আকর্ষণ থাকবে, পাওনা থাকবে, লাভ থাকবে, এমনকি স্বার্থ থাকবে। মানে হচ্ছে, স্বার্থের জন্যে আমি সেক্স করলাম। আমার ফিজিক্যাল স্যাটিসফিকশনের বাইরেও কোনো একটা উদ্দেশ্য আছে। সেই উদ্দেশ্যকে হাতিয়ার করে আমার স্বার্থ আদায় করা।আমার দেহ বিনিময় করে আকর্ষণের পথের সাথে আপোষ করা। এবং আমার ভবিষ্যৎ নিশ্চিত করা।

আমি আমার পার্টনারকে সেক্স অফার করলাম। পার্টনার সেটি রিজেক্ট করলো। এরপরও, আমি যদি জোরপূর্বক সেক্স করি তাহলে সেটা নিঃসন্দেহে ধর্ষণ। কিন্তু, আমার পার্টনার সেক্সের বিনিময়ে বিয়ের কথা বললো। আমি সেক্স করার জন্যে সেটি মেনে নিলাম। কিন্তু, পরবর্তীতে তাকে বিয়ে করলাম না। সেক্ষেত্রে, এটি হচ্ছে ম্যানিপুলেশন। আমি কারসাজি, প্রতারণা করে তার সম্মতি আদায় করেছি। তাকে বলেছি, তোমার সব দায়িত্ব আমার। এবং সে আমাকে বিশ্বাস করে সেক্স করেছে। মানে হচ্ছে, আমার পার্টনার দুর্বল। তার নিজের দায়িত্ব নিজে নেবার অ্যাবিলিটি নেই। তাই, সেক্সের বিনিময়ে তার ভবিষ্যৎ এবং স্বার্থ উদ্ধার করে আমার দ্বারা। এখানে যেমন কনসেন্ট আছে, তেমন ম্যানিপুলেশনও আছে। এটি হচ্ছে কারসাজি বা প্রতারণা। কারসাজি আমিও করেছি, আমার পার্টনারও করেছে। তাই, এটি কোনোভাবেই ধর্ষণ না। আই রিপিট, এটা ধর্ষণ না। তবে, এই প্রতারণার জন্যে আমার শাস্তি প্রাপ্য। কিন্তু ধর্ষণের শাস্তির মতো লাইফ লেসন কিংবা ডেথ লেসন না।

উপরের বিষয় ছাড়াও আরও একটি পয়েন্ট আছে। ধরা যাক, আমি আমার গার্লফ্রেন্ডের সাথে রিলেশনে আছি। মিউচুয়াল আন্ডারস্ট্যান্ডিং এর মাধ্যমে সেক্স করলাম। পরবর্তীতে, ব্রেকআপের পর যেকোনো শত্রুতা কিংবা ক্ষোভের বশে আমার পার্টনার আমার বিরুদ্ধে বিবাহের প্রলোভনে ধর্ষণ নামক কেস ঠুকে দিলো। যেহেতু এই সমাজ নারী অবান্ধব এবং আইনে নারীই বেশি ফ্যাসিলিটি পাচ্ছে, সেহেতু একটা সামান্য রিলেশনের জন্যে আমাকে ধর্ষক অপবাদ এবং সাজা নিতে হবে। এই বিষয়ে, পুরুষ ব্যক্তিটি সর্বোচ্চ প্রতারিত হবেন।

তাই, “বিবাহের প্রলোভনে ধর্ষণ” টার্ম একটি অযৌক্তিক, স্বার্থবাদী এবং নারী-পুরুষ সমতা বহির্ভূত অবস্থা প্রকাশ করছে। এ বিষয়ে আইন প্রণয়নের আগে সরকারের উচিত সমাজবিজ্ঞানী এবং মনোবিজ্ঞানীদের সাথে আলোচনা করা এবং সমাজের মনস্তাত্ত্বিক চিন্তাধারা বিশ্লেষণ করে সিদ্ধান্ত নেয়া।

 

[ফেমিনিস্ট ফ্যাক্টরে প্রকাশিত মুক্তমত লেখকের নিজস্ব বক্তব্য]