November 24, 2024
সাহিত্যগল্পফিচার ৩

আরো একটি দিন

ইকবাল বিন শহীদ।।

“প্রান্তিক নারীর উন্নয়নকল্পে আমাদের একযোগে কাজ করতে হবে। অদৃশ্য দাসত্বের যে শিকল আমরা নিজেরাই পরে আছি, তা আইডেন্টিফাই করে সেই শিকল ভাঙতে হবে।” বলতে বলতে চোখ তুলে ঘড়ির দিকে তাকান শ্রাবণী হাসান। রাত এগারটা বেজে গেছে প্রায়! কালকে সকালেই তার একটা সেমিনার আছে, নারীর প্রতি বৈষম্যমূলক আচরণ বিষয়ে।

“সালমা! রাতের খাবার টেবিলে দিস নি এখনো!” গলা উঁচু করে বলেন শ্রাবণী। “জানিস না, আমার কাল সকালেই যেতে হবে! আর সাহেব এসে টেবিলে খাবার না দেখলে রাগ করবে!”

মেজর তারিক হাসান, শ্রাবণীর স্বামী। অত্যন্ত বুদ্ধিদীপ্ত ও পরিশ্রমী মানুষ। শ্রাবণীকে সব স্বাধীনতাই সে দিয়েছে। পড়াশুনা, সমাজসেবা, নারী স্বাধীনতা বিষয়ে সভা সেমিনার- কোন কিছুতেই সে বাধা দেয়নি। তাকে চাকরিও করতে দিয়েছে। এমনকি, শ্রাবণীর শ্বাশুড়ি যখন মাঝে মাঝে বলে, “বিয়ের এত বছর হয়ে গেলো, বাচ্চা নাও না কেন বৌমা?” – তখন তারিক বলে, “মা, এটা ওর ডিসিশন, আপনার না”। শ্রাবণী জানে, তারিক তাকে ভালবাসে, অন্যদের মত করে না, কিন্তু ভালবাসে।
একথাগুলো ভাবতে ভাবতেই আবার সালমাকে ডেকে উঠে শ্রাবণী, “কি রে, হয়েছে?”, মনে মনে ভাবে। নাহ, এই মেয়েটাকে রাখা যাবে না, কাজে খুব স্লো। আর আচরণটাও আজকাল কেমন যেন, বাড়ির মালিকের মতো।
ভাবতে ভাবতেই বেল বেজে ওঠে- শ্রাবণী উঠে দাঁড়ায়, দরজা খুলে দিতে, তারিক চলেই এলো বোধহয়, ভাবে শ্রাবণী।

পরদিন, বিকেল প্রায় তিনটা। সম্মেলন কেন্দ্রের বিশাল হলরুমটা গম গম করছে মানুষে৷ নামকরা ও নাম করতে চায় এরকম সবাই-ই সমবেত সেখানে। একটু পরেই একটি নারী মুক্তি ও অধিকার বিষয়ক সংস্থার পক্ষ হয়ে বক্তব্য দেবে শ্রাবণী। শ্রাবণীর প্রাঞ্জল বক্তব্য ও ঈর্ষণীয় সামাজিক ও সাংসারিক সাফল্যের প্রশংসা সবার মুখে মুখে। চা বিরতির মাঝে শ্রাবণী ঘুরে ঘুরে কয়েকজনের সাথে কথা বলে, অকুন্ঠ প্রশংসা শুনতে ভালই লাগে তার।

“এই! শ্রাবণী! এই”- শুনে ফিরে তাকায় শ্রাবণী। তার কলেজের বান্ধবী রাখী!
“রাখী! কেমন আছিস! কত বছর পরে!” বলে শ্রাবণী।
“কেমন আছিস তুই? কী করছিস এখন? আঙ্কেল আন্টি কেমন আছে?” হড়বড় করে বলে রাখী।
এক লাফে ৮ বছর পিছিয়ে যায় শ্রাবণীর মন। রাখী, তার ইউনিভার্সিটির বন্ধু! কত প্ল্যান, কত প্রতিজ্ঞা এক সাথে করা!
ভাবতে ভাবতেই ডাক চলে আসে-“সবাইকে আসন গ্রহণ করার অনুরোধ জানাচ্ছি। একটু পরে বক্তব্য রাখবেন শ্রাবণী হাসান।” একটু অবাক হয়ে ওর দিকে তাকিয়ে থাকে রাখী।
“প্রোগ্রাম শেষে কথা বলছি, কোথাও যাবি না” বলতে বলতে স্টেজের দিকে আগায় শ্রাবণী।

পাবলিক স্পিকিং এ শ্রাবণী সবসময়েই পারদর্শী৷ সবাইকে সম্মোহিত করে রেখে বলে চলে শ্রাবণী-
“আমাদের নিজস্বতা ও নিজস্ব সত্ত্বা, দুটোই দরকার, আর সেজন্য নিজের আইডেন্টিটিকে নষ্ট করতে দেয়া যাবে না” মনে পড়ে রাখীর সাথে অনেক আগের কথোপকথন ‘‘যে যাই বলুক, আমার নাম নিয়ে আমি খুশি, আমি আমার নাম পাল্টাবো না।’’ – ‘‘ওকে, আকলিমা আক্তার! কিন্তু আমি তোকে একটা ডাক নাম দিলাম- শ্রাবণী’’- রাখীর উত্তর কানে ভাসে।

‘‘এই নাম চলবে না’’ বিয়ের কয়েকদিন পরেই বলেছিল তারিক ‘‘আমাদের সোসাইটিতে এরকম নাম শুনলে হাসবে। আর নামের শেষে হাসান লাগাতে হবে; মিসেস অমুক এরকম নামেই সবাই সবাইকে চেনে এখানে।’’

ঘড়ির দিকে একবার তাকিয়ে স্পষ্ট, আত্মবিশ্বাসী কন্ঠে বক্তব্য দিতে থাকে শ্রাবণী, “পুরুষদের সাথে যুদ্ধ করে না, বরং সমঅধিকার নিশ্চিত করে নিয়ে হাতে হাত রেখে চলতে হবে…।”

হাতের মারের দাগগুলো এখনো যায়নি। কেন যে অসময়ে তারিকের অফিসে হাজির হয়েছিলাম, তা নাহলে ওকে আপত্তিকর অবস্থায় দেখতেও হত না, স্টিলের রুলারের বাড়িও খেতে হত না!
গলার স্বর চড়ে যায় শ্রাবণীর, “আমাদের কথা পরিবার বা সমাজকে শুনতে বাধ্য করতে হবে।”

মা, বাবাকে বলে কোন লাভই হয়নি, উল্টা মা তার সোনার টুকরা জামাইয়ের প্রশংসা করে ভাসিয়ে দিয়েছে। চুপ করে থেকেই ভাল আছি, অন্তত বেঁচে আছি।

“বিয়ে, সন্তান, ক্যারিয়ার- এগুলো আমরা নিজেরাই ঠিক করবো। প্রত্যেক মেয়েকে আগে স্বাবলম্বী হতে হবে, বিয়ে করা বা সন্তান নেয়া এগুলো কোন আবশ্যিকতা না”- দৃপ্ত কন্ঠে বলে শ্রাবণী।

‘‘শুনো শ্রাবণী, তোমার এবারও কোনোভাবেই বাচ্চা রাখা যাবে না, আমার প্রমোশনের বিশাল সমস্যা হবে” বলেছিল তারিক।

‘‘আগেও তো একবার নষ্ট করেছি, তারিক!”

‘‘কিছু করার নেই, পরেরবার”, তারিক ঠান্ডা গলায় উত্তর দিয়েছিল। সেই পরেরবার আর আসলো না জীবনে।
আবারও ঘড়ির দিকে তাকায় শ্রাবণী, বেশি দেরি হয়ে যাবে? রাত হয়ে গেলে?

রাত। সালমার বিছানায় তারিককে পেয়ে চিৎকার দিয়েছিলাম। তারিক গলা চেপে ধরে বলেছিল, একটা শব্দ উচ্চারণ করলেই মেরে ফেলবো।

“প্রান্তিক নারীদের অসহায়ত্বের সুযোগ যাতে কেউ নিতে না পারে, সেই লক্ষ্যে সব নারীকে কাজ করতে হবে- যুদ্ধটা আপনার ঘর থেকেই শুরু হোক,” বলতে থাকে শ্রাবণী।
ভুলেই যায় রাখীর কথা, মাথায় একটা চিন্তাই ঘুরতে থাকে, দ্রুত বাসায় যেতে হবে, নইলে তারিক আজকেও আবার মারতে পারে….