November 22, 2024
নারীবাদ আলোচনাফিচার ৩

নৈরাজ্যবাদী নারীবাদ, ‘ভয়ংকর এমা’ ও অন্যান্য

নারীবাদ বোঝা ও বোঝাপড়া: পর্ব-১৬

 

শারমিন শামস্।। নৈরাজ্যবাদী রাজনৈতিক আন্দোলনের ভেতর থেকে যখন নারীপ্রশ্ন উত্থাপিত হতে বাধ্য হলো, তখনই নৈরাজবাদী নারীবাদের জন্ম হলো। এমনকি নৈরাজ্যবাদী আন্দোলনের ভেতরেও পুরুষের কর্তৃত্ববাদীতা চোখে পড়ার মতো হয়ে উঠেছিল। ঠিক যেরকম সমাজতান্ত্রিক বা মার্ক্সবাদী আন্দোলনে ঘটেছে। তখন নারী আন্দোলনকারীরাই নারী নেতৃত্ব ও নারীকে সমান গুরুত্ব দেবার বিষয়টি সামনে এনেছেন। কেউ কেউ পুরুষের সাথে যে আন্দোলন করছিলেন, তা থেকে বেরিয়ে এসেছেন। র‌্যাডিকেল হয়েছেন। এক্ষেত্রেও নৈরাজ্যবাদ আন্দোলন নারীবাদের নতুন ধারার উদ্ভবকে তরান্বিত করেছে।

নৈরাজ্যবাদ এবং নারীবাদের একটি মিশ্রনই নৈরাজ্যবাদী নারীবাদ বা অ্যানার্কা ফেমিনিজম। নৈরাজ্যবাদী নারীবাদীদের লড়াই পুঁজিবাদী পিতৃতন্ত্রের বিরুদ্ধে। তারা মনে করেন, শ্রেণি বৈষম্যের বিরুদ্ধে যে লড়াই তার একটি অপরিহার্য অংশ পিতৃতন্ত্রের বিরুদ্ধে করতে হয়। নৈরাজ্যবাদীরা সব ধরণের ক্ষমতার আধিপত্যকে অস্বীকার করেন, যা মূলত নারীবাদী চিন্তা থেকে আসা। নৈরাজ্যবাদী নারীবাদ ক্ষমতার বিপক্ষে, কর্তৃত্বের বিপক্ষে, পুঁজিবাদের বিপক্ষে এবং সব ধরণের বৈষম্য ও বঞ্চনার বিরুদ্ধে অবস্থান ঘোষণা করেন এবং এসবের মূল লক্ষ্য শেষ অব্দি একটি লিঙ্গবৈষম্যবিহীন সমাজ প্রতিষ্ঠা করা। কিন্তু সেটির জন্য রাষ্ট্র কাঠামো ও পুঁজিবাদের শেকড় উপড়ে নেয়া ছাড়া আর কোনো বিকল্প রয়েছে বলে তারা মনে করেন না।

নৈরাজ্যবাদী নারীবাদী এমা গোল্ডম্যান (১৮৬৯-১৯৪০) নারীর স্বাধীনতা ও সমতা, এবং যা কিছু নারীর নেই তার জন্য লড়াই জরুরি বলে মনে করতেন। তিনি বলতেন, শুধু মালিক ও শ্রমিক নয়, সরকার ও সাধারণ মানুষ নয়, লড়াই হতে হবে সেই সমাজ ব্যবস্থার বিরুদ্ধে যে সমাজের পুঁজিবাদী পিতৃতন্ত্র নারীকে শত শত বছর ধরে দমন পীড়ন করে চলেছে।

এমা’কে  এফবিআই ডাকতো `One of the most dangerous women in America’ বলে। লিথুনিয়ায় জন্ম নেয়া এমা নৈরাজ্যবাদী ছিলেন। দারুন বক্তা ছিলেন। সেসময় নিষিদ্ধ গর্ভনিরোধক নিয়ে তথ্যপ্রচারের দায়ে গ্রেফতার হয়েছিলেন। এক শিল্পউদ্যোক্তাকে হত্যার ষড়যন্ত্র করার দায় চাপানো হয়েছিল তার কাঁধে। নৈরাজ্যবাদীরা মনে করতেন বিপ্লব সফল করতে অ্যাকশন দরকার। রেজল্যুশন চাই। এমার কর্মকাণ্ড আগুনের মতো ছড়িয়ে যেত বিপ্লবের দিকে। এমা ছিলেন আমেরিকার চোখে ভয়ংকর। অথচ এখন বলা হয়, এমা অন্যায় কিছু করেননি বা বলেননি। বরং বলা যায়, তিনি ছিলেন তার সময়ের চেয়ে আটশ বছর এগিয়ে থাকা একজন মানুষ। এমা সমকামী সম্পর্ককে সমর্থণ দিয়েছিলেন। নাস্তিক ছিলেন। শ্রমিকদের অধিকার আদায়ে সবকিছুর আমূল পরিবর্তন দাবি করেছিলেন এমা। ভোটাধিকার আন্দোলনে থাকা নারী আন্দোলনকে বাতিল করে দিয়েছিলেন এমা। কারণ এমা মনে করতেন, নারীর প্রতি বঞ্চনার সাথে রাষ্ট্র ও অর্থনৈতিক ক্ষমতার যে সম্পর্ক আছে সেটিকে চ্যালেঞ্জ করতে পারেননি আন্দোলনকারীরা। এমা নারীর জন্য মুক্ত জীবনের কথা বলতেন। বিবাহ রীতির ঘোরবিরোধী ছিলেন তিনি। স্বপ্ন দেখতেন, একদিন নারী নিজের ইচ্ছেতে নিজের জীবন যাপন করতে পারবে আর এজন্য পুঁজিবাদী রাষ্ট্রের পিতৃতান্ত্রিক কাঠামো ভাঙার কথাই বারবার বলে গেছেন তিনি।

স্পেনে ১৯৩৬ সালে গড়ে ওঠে নৈরাজ্যবাদী নারীবাদী দল Mujeres Libres (Free Women)। তখন গৃহযুদ্ধ চলছে। এর প্রতিষ্ঠাকালীন সদস্যদের একজন লুসিয়া স্যানচেয সাওর্নিল। অন্য সদস্যরা হলেন মার্সেডিস ক্যাম্পোসাডা এবং অ্যাম্পারো  গ্যাসকন।

লুসিয়া স্যানচেয সাওর্নিল ছিলেন র‌্যাডিকেল অ্যানার্কিস্ট। সমাজ বিপ্লবের জন্য নিজের জীবন উৎসর্গ করেছিলেন। অ্যান্টি ফ্যাসিস্ট গ্রুপের সদস্য হয়ে কাজ করতেন। একসময় অনুভব করলেন পুরুষের করা নৈরাজ্যবাদ আন্দোলন নারীর ইস্যুগুলোকে যথেষ্ট গুরুত্ব দেয় না। ঘরের ভেতরে নারী কতটা নির্যাতিত হচ্ছে কিংবা ধর্ম নারীর উপর কীভাবে নানাকিছু চাপিয়ে দিচ্ছে, এ সবই উপেক্ষিত। এই অনুভব থেকেই Mujeres Libres গঠন করলেন। লিখতে পড়তে না জানা কর্মজীবী নারীদের জন্য কাজ করতেন তারা। একটা পত্রিকা বের করতেন, শিশু দিবাযত্ন কেন্দ্র চালু করলেন এবং শুধুমাত্র নারীদের নিয়ে রাজনৈতিক আলাপ ও ভাবনা বিনিময়ের পরিসর তৈরি করলেন। দুই বছরের ভেতরে সংগঠনটির প্রায় ৩০ হাজার সদস্য হয়ে যায়।

১৯৩৯ এ গৃহযুদ্ধে জাতীয়তাবাদীদের জয়ের পর চার্চের ক্ষমতায় অধিষ্ঠান ও রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের কারণে নৈরাজ্যবাদী রাজনৈতিক দর্শন, বিশেষ করে নৈরাজ্যবাদী নারীবাদকে দমন করা হলো কঠোর হাতে। লুসিয়া তার সঙ্গীসহ পালিয়ে গেলেন স্পেন থেকে। পরে ১৯৪১ এ মাদ্রিদে ফিরেছিলেন। কবিতা লিখতেন। সম্পাদক হিসেবে কাজ করেছেন ১৯৭০ সালে ক্যান্সারে মৃত্যু হওয়া পর্যন্ত।

Mujeres Libres এর দর্শন ও চিন্তা ৬০ ও ৭০ এর দশকে দ্বিতীয় তরঙ্গের নারীবাদ আন্দোলনকে উজ্জীবিত করেছে। নৈরাজ্যবাদী নারীবাদ পুঁজিবাদ, পিতৃতন্ত্র, সেনাশাসনের বিরুদ্ধে তাদের যুদ্ধ জারি রেখেছিলেন। কারণ এ সমস্তই নারীর প্রতি সমাজ ও রাষ্ট্রের বঞ্চনা ও নির্যাতনের মূল কারণ।

[চলবে]