মুনিয়ার মৃত্যু: নারী নির্যাতনকারী মুখগুলো এবার উন্মোচিত হোক
ক্যামেলিয়া আলম।। লিও টলস্টয়ের দি ডেভিল উপন্যাসটি একটা অসাধারণ উদাহরণ হিসেবে ব্যবহার করা যায়, যেখানে যৌনতা নিয়ে মানসিক সংকটের মুখোমুখি হয়ে ইউজিনকে এক নিষ্ঠুর পরিণতি বেছে নিতে হয়েছিল। উপন্যাসটায় টলস্টয় দুইটি সমাপ্তি রেখেছেন অথবা দিয়ে। একটিতে রেখেছে তীব্র মানসিক সংকটে পড়ে ইউজিন নিজেই আত্মহত্যা করে. আরেকটিতে আছে সন্তান, মায়াময় স্ত্রী থাকার পরেও আসক্তি হওয়া মেয়েটিকে, তার ভাষায়-মনে ডেভিল, হত্যার মধ্য দিয়ে।
মানুষ নিজেই যখন কোন সম্পর্কে জড়ায়, হয় প্রয়োজনে, নয় অপ্রয়োজনে, এর পরে কোনো কারণে তা ভুল মনে হলে দায়ভার চাপাবার চেষ্টা করে প্রতিপক্ষর প্রতি। প্রতিপক্ষ দুর্বল হলে তাকে পরাজিত করা, তাকে নিয়ে রটনা ছড়ানো আর হত্যা করাটাও সহজ হয়ে যায়। বসুন্ধরা গ্রুপের এমডি আনভিরের সদ্য তারুণ্যে পা দেয়া মেয়েটির সাথে সম্পর্ক ও এর পরে মেয়েটির মৃত্যুর খবরটি দেখে এমনই এক অনুভূতি হল।
এই খবরটি ঘিরে বেশ এক সামাজিক-রাজনৈতিক পাঠ আমার হয়ে গেল। এক সময় এদেশে বর্ণপ্রথা সরাসরি টিকেছিল। উঁচু নীচুরা কখনও একসাথে চলার কথা ভাবতে পারতো না। বুর্জোয়ারা যখন একের পর এক প্রযুক্তি বের করলো, প্রত্যক্ষ ভেদাভেদ থেকে দূরে সরতে বাধ্য হল সমাজ। যে ব্রাহ্মণ নমশুদ্রের ছায়া মাড়াতো না, তারা ট্রেনের কামড়ায় ভাগাভাগি করে চলতে বাধ্য হলো। বংশানুক্রমিক আভিজাত্য ঠুনকো হতে লাগলো অর্থবিত্তের নতুন শ্রেণির হাতে। ফলে সমাজে বর্ণভেদ চলে কিন্তু গেল না, নতুন মাত্রা পেল কেবল। আর এই ভাবধারা আমাদের শেখালো, সমাজে যে দুই শ্রেণি আছে, তারা একে অপরের বন্ধু যদিও বা হয়, আত্মীয় হওয়া সম্ভব না। মুনিয়ার অপরাধ ছিল সে মধ্যবিত্ত পরিবার থেকে এসে এক লক্ষ টাকার ফ্ল্যাটে থাকছে, আনভিরের মতো ধনকুবেরের সাথে প্রেম করে তাকে বিশ্বাস করেছে, ফলে মানুষের মনস্তত্ত্বে প্রথমেই আসে যে, পয়সার জন্যই মোহ থেকে এই প্রেম , আর তা আসল প্রেম হতেই পারে না, লোভ থেকেই মুনিয়ার মতো মেয়েরা আনভিনের শয্যাশায়ী হয়। আর সে যেহেতু লোভী, কাজেই তার শাস্তিটুকু যথাযথ।
হতে পারে, মুনিয়া অর্থের মোহে পড়েই এই ধনকুবেরের সাথে জড়িয়ে যায়। অথচ অর্থের লোভ, ভালো থাকবার লোভ, দামী পোষাকের লোভ কার নাই তা আমার জানতে ইচ্ছে করে। সাংবাদিক, পুলিশ, সরকারি কর্মকর্তাদের বেতন আর তাদের সম্পদ ও ব্যয়ের অবস্থা দেখে কারও কি মনে হয় তারা লোভহীন জীবন যাপনে অভ্যস্ত? আপনি বলবেন, আপনি এর সাথে নেই। ভালো কথা, অবৈধ পয়সা নেই, কিন্তু সম্পত্তিতে প্রত্যেক ভাই বোনের ভাগটুকু সঠিকভাবে দিয়েছেন কি? না দিয়ে থাকলে তা কি লোভ নয়?
আবার দেখেন, আমাদের সমাজে একজন মেয়েকে স্বাবলম্বনের কথা যতটা না বলা হয়, তার চেয়ে বেশি বলা হয়, সুশ্রী থাকার কথা। গায়ে মুখে হলুদ দিয়ে গোসল করানো, ঘন চুল, কোমল হাতটুকু ধরে রাখার চেষ্টা পাল্লা দিয়ে করতে থাকেন মায়েরা। এরপরে লেখাপড়া শেষ করুক না করুক, বড় ঘরে মেয়ে দেয়ার চলে তীব্র প্রতিযোগিতা। সুন্দরী মেয়ের পরিবার দ্রুত সফলতার মুখ দেখে, কালো মেয়েটি প্রতিনিয়ত অপমানিত মুখে ঘষে ঘষে মুখ ধুয়ে কালিমা দূর করতে চেষ্টা করে চোখের পানিতে। এমন এক সামাজিক কাঠামোতে বেড়ে উঠে, একটা মেয়ের প্রথম স্বপ্নই শুরু হয় ঘর, বর, গয়না গাটির। মেয়ে সুন্দরী হলে বেড়ে ওঠার সাথে সাথেই বহুজনের নজর কাড়ে। মেয়ে যদি বড়লোকের সাথে প্রেম করে একবার সফল হতে পারে, তাহলে বাবা মায়ের আনন্দ আর ধরে না! আর যদি আবেগের বশে মিথ্যা মোহে পড়ে ভুল ছেলেকে বেছে নেয়, সেখানে মেয়েটি একই সাথে স্বামী-শ্বশুড়বাড়ি- বাবার বাড়িকে দিয়ে নির্যাতিত হতে থাকে। এমন এক মনোসামাজিক কাঠামোতে বেড়ে উঠে, আমরা ১৮ বছরের এক মেয়েকে আশা করছি সে ৬০ বছর বয়সীর মতো ভালোমন্দ সবই বুঝবে, মহাপুরুষের মতো নির্লোভ থাকবে, সন্ন্যাসীদের মতো জীবনযাপন করবে। হাস্যকর এক ভাবনা।
আনভিরদের মতোন ধনকুবেরদের নিয়ে বলতে চাই, অর্থ বিত্তের সাথে সাথেই মানুষের সম্ভোগের প্রবণতা সৃষ্টি হয়। পার্ল এস বাকের দ্যা গুড আর্থ উপন্যাসটি পড়া থাকলে এই কথার মর্মার্থ বুঝতে পারবেন। একসময় রাজা বা জমিদার মানেই তাদের রাজ্যের সকলের জীবন ও সম্পদের অধিকার তাদেরই। নারীকে তো ভাবা হতো লুট করা সম্পদের একাংশ। বিংশ শতকে এসে নারীর আলাদা ভাবমূর্তি সমাজে তৈরি হলেও অন্যায় বিত্তের কাছে নারীর অবস্থান বিন্দুমাত্র পাল্টায়নি। অথচ দেখেন, নারীর শিক্ষা-ক্ষমতায়ন-মূল্যায়ন বেড়েছে। কিন্তু বিত্তশালীদের কাছে নারী এখনও সেই একই চেহারায় রয়ে গেছে, কেবল যৌনতার প্রতিবিম্ব।
আনভির বসুন্ধরা গ্রুপের কর্ণধার। তার রাজকীয় বাড়িখানা দেখে ঢোক গিললাম কয়েকবার আর ভাবতে লাগলাম, একটা মেয়ে কতটা শিশু মনেবৃত্তির হলেই বিশ্বাস করতে পারে সে এই ধনকুবেরের বউ হবে! কুমিল্লা শহরে জন্ম। বাড়ির সবচেয়ে ছোট আর ফুটফুটে এক মেয়ে। সবার আদর পেতে পেতে, সবার চোখের ভাষা দেখতে দেখতে মেয়েটা এক সময় বুঝে যায়, সে আলাদা রকম সুন্দর এক মানুষ। সুন্দর মেয়েটার তখন সিনেমা দেখে দেখে আগ্রহ জাগে সিনেমা করবে, মডেলিং করবে। এই আগ্রহ তৈরি হওয়া কি দোষের? কিন্তু পরিবার কখনও কি কোনো মেয়ের এই জীবনের প্রতি সামান্য সহানুভূতি দেখায়? দেখায় না। উল্টো পরিবারে তখন বড় ভাইকে নিয়ে নানা অশান্তি, মায়ের ক্যান্সার, হু হু করে খরচ বাড়তে থাকা, দৈনন্দিন জীবনের স্বপ্ন যখন একের পর এক নিরাশা দিয়ে ঢেকে যেতে থাকে, তখন পরিচয় হয় নানা জনের সাথে। আর এই বয়সে এসে যখন কেউ দুইটা ভালো লাগার, ভালোবাসার কথা বলে, তার প্রতি কার দুর্বলতা জন্মাবে না? ফলে জন্মায়। সাংস্কৃতিক জগতে পা রাখার স্বপ্ন আর অন্যদিকে পরিবারের অর্থনৈতিক টানাপোড়েন, মানসিক দ্বন্দ্ব, মায়ের অসুস্থতা, বাবার মারা যাওয়া, মায়ের মারা যাওয়া, ভাইদের সম্পত্তি নিয়ে নেয়া, বড়বোনের সংসারে আশ্রিত হয়ে বাঁচার চাইতে নিজে কিছু করে তাক লাগানোর স্বপ্ন কোনো মেয়ে দেখতে পারে কি না? আমরা বেশ বয়সে এসে অভিজ্ঞতায় বুঝি, কোন লোক কোন কারণে আমায় এ কথা বলছে, এ কাজ করছে- যা কখনও অপরিণত বয়সে বুঝতাম না। হ্যাঁ, এখানে বোনের এক ভূমিকা ছিলো বোনটির প্রতি, যা সে ব্যর্থ হয়েছে। আর এ বিষয়টিও ভুললে চলবে না যে, বয়োসন্ধিকালের বাচ্চার স্বপ্ন এতোটাই জোড়ালো থাকে যে, সেই স্বপ্ন পূরণে সে তখন কারও বারণ শাসন মানতেই পারে না। ফলে শুরু হয় পরিবারের সাথে চোর পুলিশ খেলা। এই খেলার শেষটায় বাচ্চাটি এতোটাই দূরত্বে সরে যায় যে, তাকে নিয়তির হাতে ছেড়ে দেয়া ছাড়া কিছুই করার থাকে না অনেক সময় পরিবারের।
পরিবারের প্রচন্ড খেয়াল থাকার পরেও আমার চেনাজানা বহুজনের স্কুল পড়ুয়া, কলেজ পড়ুয়া মেয়েকে দেখেছি ড্রাগ অ্যাডিকটেড ছেলের সাথে, বিবাহিত লোকের হাত ধরে বেড়িয়ে গিয়ে পড়াশুনার জীবন আর নিজের জীবন ভয়ংকর পরিণতিতে নিয়ে গেছে। এই ঘটনা গুলো নতুন কিছু না। আবার বহু যত্নের পরেও কখনও দেখা যায় ছেলেটি অপরাধ জগতে পা বাড়ায়। এককালের তিন্নী হত্যা মামলার অন্যতম আসামী ছিল অভি বলে এক মেধাবী ছেলে, যার মা ছিলেন রত্নগর্ভা। পরিবার অবশ্যই একটা বড় ভূমিকা নেয়, কিন্তু মধ্যবিত্ত আর নিম্ন মধ্যবিত্তের টানাপোড়েনগুলো এতো বেশি যে সেখানে অনেক সময় কোনো ছেলে বা মেয়ে নিজের অজান্তেই ভুল পথে পা বাড়ায়।
এবার আসি, সমাজের হাতছানির দিকগুলোয়। আমি মনে করি, স্বপ্ন পূরণের প্রতিটা রাস্তাতেই একদল নেকড়ের বাস। চরম মেধাবী হয়ে বিখ্যাত বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে আসবেন, সেখানে পিএইচ ডি ডিগ্রীধারী শিক্ষিত বুদ্ধিবৃত্তিক চৌকষ উদারভাবাপন্ন শিক্ষকের দেখা পাবেন। সদ্য এইচএসসি পাস করা মেয়েটিকে বুদ্ধিবৃত্তিক কৌশল দিয়ে নেশা জাগানো কি খুব অসম্ভব? এই বয়সেই দ্রুত একটা ছেলে বা মেয়ে কারও আদর্শ অনুসরণ করে, শ্রদ্ধা করে, জ্ঞানী মানুষটি মনোযোগী হলে সামান্য ইশারাতেও প্রেমে পড়ে যায়। মেয়েটি বিশ্বাস করে খুব সহজে যে, সে নিশ্চয়ই স্বতন্ত্র। এই ভাবধারায় তার ইতিবাচক নেতিবাচক দুই অবস্থারই সৃষ্টি হয়। এমন এক জ্ঞানী গুণির সাহচর্যে আসার পরে সে সাধারণের চেয়ে জ্ঞানের পাঠগুলোয় বিচরণ করতে অনুপ্রাণিত হয়, তার বিকাশ ঘটতে থাকে, অন্যদিকে তার প্রেম আরও তীব্র হতে থাকে। একটা সময়ে হুট করেই যখন দেখে, নতুন আরেকটা মেয়ে ঠিক তার অবস্থানে তার প্রেমিকের কাছে অথবা তার যখন স্বীকৃতি পাবার এক মানসিক ও সামাজিক অবস্থার সৃষ্টি হয়, ঠিক তখনই হোচট খেয়ে দেখে এক তাসের ঘরের উপর সে রাজপ্রাসাদ গড়ে বসে আছে। আর তা ভেঙে পড়া মাত্রই সমাজের সবচেয়ে ঘৃণ্য বস্তুটি হিসেবে ভয়ংকর নাজেহাল হতে হচ্ছে। অথচ এ ঘটনা নিয়ন্ত্রণে তার বিন্দুমাত্র হাত হয়তো ছিল না। এখন বলবেন, কই আমরা তো পড়িনি, সে কেন প্রেমে পড়তে গেল? সে কেন বিবাহিত জেনে অমুক করলো, তমুক করলো? বক্তব্য একটাই, সংবেদশীলতা সবার এক না, পারিবারিক জীবনের অস্থিরতা সবার এক না অথবা আপনার হয়তো এই পরিস্থিতি কস্মিনকালেও আসেনি, সোজা কথায়, এমন কেউ আপনার চোখে চোখ রেখে বলেনি কখনও ভালোবাসার কথা। ফলে সবক্ষেত্রেই পুলিশী নাক নিয়ে বিচার আচার করাটাও এক ধরণের যুক্তিহীনতা।
এবার আসি, আরেক মোহের কথা। গান, কবিতা, সাহিত্য, নাটক, চলচ্চিত্র, মডেলিং বহু মানুষের কল্পনার জগতের এক স্থান। টিপু সরকার বলে একজন শিশু সাহিত্যিকের খবর পেলাম কিছুদিন আগে। উনি শিশু পর্ণ তৈরির অভিযোগে অভিযুক্ত হয়ে পুলিশের কাছে ধরা পড়েন। ছাড়া পাবার পরে দেখলাম এই বইমেলাতে তার শিশুদের জন্য বই বের হয়েছে আর নামকরা ব্যক্তিবর্গ তার বইয়ের রিভিউ দিচ্ছে বেশ ঘটা করে। অথচ ঘটনাকাল বছরও পেরিয়ে যায়নি। অপরাধ মূলত লালন করা এক বিষয়। এখানে প্রত্যেক অপরাধী প্রত্যেককে লালন করে আর অ্যাবিউজ এর সাথে জড়িত থাকে। ক্ষমতার বিভিন্ন স্তরে থাকায় খুব সহজেই তারা তাদের এই অনৈতিক কাজগুলো বজায় রাখতে পারে। ফলে হাজারও মুনিয়া তাদের জালে একের পর এক আটকাতে থাকে আর হারাতে থাকে তাদের স্বপ্ন দেখা জীবন।
দোষারোপের আরেকটি বিষয়, মুনিয়া প্রেম করেছে বিবাহিত একজনের সাথে। এক্ষেত্রে সেও ভিকটিম করছে অপর কোন নারীকে। অবশ্যই তা ক্ষমার অযোগ্য এক অপরাধ। কিন্তু আনভিরের মতো ধনকুবেরদের মাঝে প্রায় শতভাগই বিবাহ বহির্ভূত নানা কর্মকাণ্ডে জড়িত। আর কিছুক্ষণ আগে যে বললাম, এ এক চক্র। এখানে প্রত্যেকেই অ্যাবিউজ করে ও প্রত্যেকে প্রত্যেককে নিরাপত্তা দেয়। তাদের অর্থের একটা অংশ বরাদ্দ থাকে এ ধরনের অ্যামিউজমেন্টের জন্য। সেই চক্রে কোনো মেয়ে পড়ে গেলে কেবল তারই দোষ? তার পরিবারেরই দোষ? একটা রাষ্ট্রের, রাষ্ট্রের আইন কানুনের কোন ভূমিকা কি নেই? হ্যাঁ, গডফাদার উপন্যাসটি পড়েছি, মাফিয়ার হাত দীর্ঘ থাকে সেও জানি। কিন্তু আজ সভ্য একটা যুগে অসভ্যতাকে দমনের কোন পথই কি আমাদের খোলা নাই? আইনের প্রয়োগ যদি একটাবারও একটা কালো হাতকে গুড়িয়ে দিতো, অন্তত দশটা কালো হাতকে ইতস্তত করে দিতে পারতো। এর সূত্রপাত হয়, অন্যায় অর্থ সমাগমের পথ ধরে, একে একে দুর্নীতির জালে তখন সকলে জড়াতে থাকে আর এভাবে গড়ে ওঠে শক্তিশালী এক চক্র। এখন এই চক্রের অংশ হিসেবে স্বাভাবিকভাবেই মুনিয়াকে অপরাধী বানানো সহজ হয়, কারণ সে জালে আটকা পড়া শক্তিহীন এক মাছ মাত্র।
মুনিয়া অপরাধী আরেক শ্রেণির কাছেও, যারা এই ধনকুবেরের বউ। একজন ধনকুবেরের বউ হবার কারণে তার সুবিধার জায়গাটি হচ্ছে, ক্ষমতায়ন। একজন এসএসসি পাশ করা মেয়েও স্বামীর অফিসের মাস্টার্স ডিগ্রীধারীকে ধমক দেবার, আদেশ দেবার ক্ষমতা রাখেন। আর এই ক্ষমতার লোভ থেকে সরে আসার হেডম সবার থাকে না। এর পাশাপাশি থাকে বিপুল অর্থবৈভব। তার বেকার জীবন বা স্বামীর অফিসে বসবার ফলে তার যে মাসিক মাসোহারা তা হারাতে হবে যদি স্বামী নামক মানুষটির অস্তিত্ব তার জীবন থেকে নাই হয়ে যায়। একে আমি মন্দ চোখে দেখছি না, কিন্তু স্বামীর বিবাহ বহির্ভূত জীবন নিয়ে তার তীব্র মানসিক যন্ত্রণা থাকলেও স্বামীকে চ্যালেঞ্জ করার কথা ভাবতেও পারে না তাদের স্ত্রী। কিন্তু ওই যে সবল রাগ ঝাড়ে দুর্বলের উপর। ফলে স্বামীর প্রেমিকাটি হয়ে যায় তার অন্যতম শিকার। আর সমাজে একটা মেয়েকে অপদস্থ করা সবচেয়ে সহজ কাজ। এবারও তা দেখলাম, আনভিরের মায়ের প্রতি বা তার স্ত্রীর প্রতি কারও ক্ষোভ নাই; কোন শিক্ষায় সন্তান এমন হল, স্বামীর অপকর্মের বিরুদ্ধে তার স্ত্রী কোন ভূমিকায় এলো! সবাই কিন্তু একচেটিয়া দোষারোপ করছে মুনিয়া আর তার পরিবারের উপরে, কেন আনভিরের কাছে গেল। বলি, কেন যাবে না? একজনের ভালোবাসার চোখকে, মধ্যবিত্তের জীবনে দামী গিফটকে কার কাছে আকর্ষনীয় মনে হয় না? আমাদের সমাজের সন্তান কি ভিনগ্রহের মানসিকতার হবে?
স্বামীর প্রতারণায় ক্ষুব্ধ হয়ে বউটি আরেক মেয়ের উপরে যত দায় চাপায়, তার এক ভাগও চাপায় না স্বামীর উপরে। অথচ দোষ যদি স্ত্রীর সাথে করে থাকে, তা করেছে স্বামীটিই বেশি। আরেকটি মেয়ে কেন, কী কারণে, কোন কথা শুনে, কোন মোহজালে পড়ে এই সম্পর্কে জড়িয়েছে তা কিন্তু একবারও খুজঁতে যায় না। আর মেয়েটি যদি অর্থনৈতিকভাবে হয় আকাশ পাতাল ব্যবধানের, তাহলে তো মেয়েটিকে উপড়ে ফেলাই শুধু নয়, তার চরিত্র নিয়ে নাজেহাল করা আরও সহজ হয়। বউটি মেয়েটিকে প্রতিদ্বন্দ্বী হিসেবে নির্মূল করতে যত আগ্রহী থাকে, স্বামীকে অপরাধী ভাবতে তার আগ্রহ তেমন থাকেনা। কারণ অধিকাংশ ক্ষেত্রেই দেখা যায়, স্বামীকে চ্যালেঞ্জ তো করেই না, বরং স্বামীপ্রবরের সাথেই ঘর করতে তার আগ্রহ বেশি থাকে। একে কী লোভ মনে হয় না? মুনিয়া লোভী হলে সে কী? আমাদের পুরুষতান্ত্রিকতার শক্তি এভাবেই প্রতি মেয়েকে প্রতিদ্বন্দ্বী করে। লোভী হিসেবে চিহ্নিত করে। আমি মনে করি না, ধনকুবেরের স্ত্রীটি শুধুমাত্র লোভের কারণে সংসারটিতে টিকে থাকে, এর পেছনে সন্তান, একটা পরিবারে দীর্ঘদিন থাকার অভ্যস্ততা, ক্ষমতায়নের অভ্যস্ততা, স্বাচ্ছন্দ্য অনেক কিছুই জড়িত থাকে। ঠিক তেমনই আমি মনে করি না যে, মুনিয়ার মতো মেয়েরা অপরাধী। তাদের সরলতার সুযোগে, স্বপ্ন দেখার সূযোগটুকু নিয়ে তাদের এই জীবনে টেনে আনা হয়। এরপর ধূলিকণার মতো উড়িয়ে দেয়া হয়। আরেক মুনিয়া সেখানে আসে, আবারও ধূলিকণা হয়ে মিশে যায়।
মুনিয়াকে নিয়ে লিখে কিছুই হবে না জানি। ভয়ংকর মানসিক কষ্টে আছি, লিখলাম তবু। হয়তো এর সমাধান নাই। প্রকৃতির উপর ছেড়ে দিয়ে কেবল ভাবছি, চক্রাকারে নারীর উপর সকল নির্যাতনকারীর মুখগুলো উন্মোচিত হোক। বাবা মা আর সমাজের কাছে হাতজোড় করে অনুরোধ করছি, মেয়ে আর ছেলেটির মাঝে সংবেদনশীল মনটি গড়ে তুলুন, যেন তারা ভালোবাসা দিয়ে নিজেকে গড়ে তুলতে পারে, সহানুভূতি নিয়ে পাশের জনের হাত ধরতে পারে। এর বেশি কিছুই করার শক্তি আমার নাই। ক্ষমা কর মুনিয়া আমাকে ..!
[ফেমিনিস্ট ফ্যাক্টরের কলামে প্রকাশিত লেখা লেখকের নিজস্ব মতামত]