না-ঘুমের রাজ্য
তানিয়া কামরুন নাহার।।
দেশ বিদেশ ঘুরে বেড়ানোর বাতিক আছে আমার। বাতিকই বলবো। অন্যদের বেলায় এটা শখ বা হবি হলেও আমারটা বাতিক। বাতিক বলবোই না কেন? কিছুদিন ঘরে বসে থাকলেই মাথা ঘোরানো, পেট ব্যথা, হাত পা চাবানো ইত্যাদি নানা সব উপসর্গ দেখা দেয়। তখনই আমি বুঝি, বেরিয়ে পড়া দরকার। তারপর বেরিয়ে পড়ি। মুসাফিরের মতো, সাথে থাকে শুধু ছোট্ট একটা ব্যাগ, ব্যাস! কেউ আমার আসল পরিচয় জানে না। সাধারণ মানুষের ভীড়ে মিশে মিশে আমি ঘুরতে থাকি, যেভাবে নদীর জল বয়ে যায়, সেভাবেই। নির্দিষ্ট কোন লক্ষ্য নিয়ে ঘুরি না। আমার পরিচিত অনেকেই সেই সব দূর্দান্ত অভিজ্ঞতার কথা জানতে চায়। আলসেমি করে বলা হয় না। তবে আজ একটা ভ্রমণ কাহিনী শোনাবো আপনাদের। এক ঘুমহীন রাজ্যের গল্প।
বেশ কয়েক বছর আগে ঘুরতে ঘুরতে চলে গিয়েছিলাম এক আজব রাজ্যে। সে রাজ্যের কেউ কখনো ঘুমায় না। দিন রাত সবাই হাসছে, চলছে, কাজ করছে। চারিদিকে জাগ্রত মানুষ আর যন্ত্রের কাজের ঘড় ঘড়ে শব্দে কান পাতা দায়। অটোয়া, অস্ট্রিয়া, প্যারিস, শিকাগো এমনি সব জায়গায় ঘুরতে ঘুরতে বেশ ক্লান্ত হয়ে গিয়েছিলাম। এরপর পরই ঐ আশ্চর্য না ঘুমের রাজ্যে এসে আমি পৌঁছাই। ভাবলাম, এখানে একটু ঘুমিয়ে নিয়ে চাঙ্গা হয়ে নেবো। তাই একটা পাঁচ তারা হোটেলে গিয়ে উঠলাম। হোটেলের লাক্সারিয়াস রুমের ধবধবে খাটে গা এলিয়ে দিলাম ঘুমোবো বলে। আশ্চর্য ব্যাপার, বালিশে মাথা রাখতেই ঘুম গেলো পালিয়ে। তবুও চেষ্টা করছিলাম, চোখ বন্ধ করে ঘুমটাকে আনার। কিন্তু কাজ হচ্ছিলো না। এই করতে করতে রুম সার্ভিসের লোক এলো। জিজ্ঞেস করলাম, এ ঘরে কি কোন সমস্যা আছে? আমার ঘুম আসছে না কেন? সে লোক প্রফেশনাল মাপা হাসি হেসে জানালো, ‘‘এ রাজ্যে কেউ ঘুমায় না। কারো ঘুম আসে না। এমন কি অন্য দেশের কেউ এ রাজ্যে চলে এলে তারও ঘুম আসবে না।’’ ভারি আশ্চর্য ব্যাপার! কত দেশ ঘুরলাম, এমন দেশের কথা তো জীবনেও শুনি নি। এ কোন না-ঘুমের দেশ !
ঘুম যখন আর আসছেই না, অগত্যা বেরিয়ে পড়লাম । রাজ্যটা ঘুরে দেখতে। সত্যিই কেউ ঘুমাচ্ছে না। ঘড়ির হিসাবে গভীর রাত। কিন্তু আলো ঝলমলে এক শহর। এত আলোতে তারার আলো সব হারিয়ে যাচ্ছে। একেই হয়ত আলো দূষণ বলে। দোকানপাট, শপিং মল, অফিস আদালত সবই খোলা। থাকবেই না কেন? লোকের তো ঘুম পায় না। তাই রাত দিন সবই সমান তাদের। ঘুরতে ঘুরতে চলে গেলাম এক নাইট ক্লাবে। এখানে সবার মনে খুব আনন্দ। সবাই নাচছে, গাইছে। আমি তো এখানে ফূর্তি করতে আসি নি। আমি হলাম পর্যটক। আমার কাজ শুধু দেখা। তাই চুপচাপ এক কোণায় বসে বসে সবাইকে দেখতে লাগলাম। এক পেগ বরফ মেশানো হুইস্কি দিয়ে গেলো ওয়েটার। ওটা নিয়েই বসে আসি। এমন সময় আমার পাশে এসে বসলো এক যুগল। লাল গাউনে মেয়েটি ঝলমল করছে। সাথের জনও বেশ সুপুরুষ। হেসে কুটি কুটি হচ্ছে দুজন। ওদের টুকটাক কথাগুলো ভেসে আসছে আমার কানে। মেয়েটি বলছে, ‘‘তোমার বউ কি এখানে?’’ পুরুষটি বললো, ‘‘না, ও এখনো জানেই না আমি তোমার সাথে। বাসায় আমার জন্য অপেক্ষা করছে।’’
মেয়েটি বললো, ‘‘ভাগ্যিস, এখানে ঘুমের বালাই নেই, তারপর চেয়ে অপেক্ষাই ভালো।’’
‘‘হ্যাঁ, এজন্যই দেখো না, ২৪ ঘণ্টার মধ্যেও আরো বাড়তি কিছু সময় আমাদের হাতে রয়ে যাচ্ছে। এজন্যই তোমাকে সময় দিতে পারছি। অন্য দেশে কিন্তু এমন সুবিধা পাওয়া যায় না।’’ বলে পুরুষটি ইঙ্গিতপূর্ণভাবে চোখ টিপলো।
সামান্য এ কৌতুকে মেয়েটি হেসে গলে গলে পড়লো পুরুষটির গায়ে। বললো, ‘‘সত্যিই তাই, আমার হাবিরও ঘুম আসে না। এত বড় শিল্পপতি সে, বিশাল তার কাজকারবার। ঘুম কিভাবে আসে ওর? ভাড়াটে জিএফদের এজন্যই বাড়তি সময় দিতে পারছে ও। মজার ব্যাপার কি জানো, ঐ মেয়েদেরকে সময়ে দেয়া শেষে খুন করে ফেলাটা ওর একটা শখ। অথচ কেউ তার টিকির নাগালও পায় না। তার রাতও আনন্দময় হোক।’’ এই বলে উচ্চস্বরে হাসতে শুরু করে দিলো মেয়েটি। ডিস্কো সং এর এতো আওয়াজের ভেতরেও কেউ কেউ হাসির শব্দে তার দিকে চমকে তাকালো। মেয়েটি হাসছে তো হাসছেই। গ্লাসের পানীয়ের প্রভাব কি না, কে জানে। তবে আমার মনে হলো, মেয়েটির হাসি কেমন যেন একটু কান্নার মতো। এখান থেকে বেরিয়ে পড়লাম বাইরে।
বাইরে বেরিয়ে দেখি, রাস্তা উপরে রাস্তা। তারপর উপরে আরেক রাস্তা। এ এক এলাহি কারবার। না দেখলে বোঝানো সম্ভব না। শ্রমিকেরা এত রাতেও কাজ করছে। ঘুম নেই তাদেরও। একটানা কাজ করে যাচ্ছে। রাস্তা ছেড়ে আমি গলিপথ ধরি। একটু একটু করে এগিয়ে যাই। কোথা থেকে যেন হিন্দি গানের চটুল সুর ভেসে আসছে। সামনে যতই এগোচ্ছি, শব্দ জোরালো হচ্ছে। কাছে যেতেই দেখি, কারো গায়ে হলুদের অনুষ্ঠান তাই এমন আয়োজন। অনুষ্ঠান ছেড়ে সামনে এগোতে থাকি। হিন্দি গানের আওয়াজ কমে আসছে, কিন্তু আরেক ধরনের আওয়াজ বিকটভাবে কানে লাগছে। যেন হুমকি দিচ্ছে কেউ, ‘‘আপনারা বলেন, ঠিক কিনা? কথা বলেন? বলেন, আল্লাহু আকবর।’’ সমস্বরে অনেক লোকের কণ্ঠস্বর ভেসে এলো, ‘‘আল্লাহু আকবর।’’ শুনতে পাই, বক্তার কণ্ঠ, বেশ দূর থেকেও শুনতে পাই, ‘‘এভাবে সারারাত জেগে জেগে আপনারা জিকির করবেন। আল্লাহর আরশ পর্যন্ত আপনাদের জিকির পৌঁছে যাবে। আরো জোরে বলেন, আল্লাহু আকবর!’’ লোকেরা আরো জোরে চিৎকার করে উঠলো, ‘‘আল্লাহু আকবর!’’ মনে মনে আমিও বলি, ‘‘হে আল্লাহ, আমি যে তোমাকে ডাকছি, শুনতে পাচ্ছো তো?’’ পাশেই তাকিয়ে দেখি একটা হাসপাতাল। আমি দ্রুত সেখানে চলে যাই। রোগীরা যন্ত্রণায় কাতরাচ্ছে। তাদের মুখেও আল্লাহর নাম। ঘুম নেই তাদের চোখেও। এ হাসপাতালেও মাইকের শব্দ এসে পৌঁছেছে, চারিদিকে শুধু ‘‘আল্লাহু আকবর, আল্লাহু আকবর’’ ধবনি। আল্লাহ সবাইকে রহম করুক, মনে মনে এ প্রার্থনা করে আমি বেরিয়ে পড়ি। আমার আর ভালো লাগছে না। আমি দৌঁড় দিই একটা। এক ছুটে চলে আসি আরেক গলিপথে।
নতুন এই গলিপথে দেখি এক লোক পাগলের মতো বিড়বিড় করতে করতে যাচ্ছে, ‘‘আগামীকাল থেকে রাতে আর কিছু খাবো না। তাহলে কিছু টাকা সেভ হবে। ঘর ভাড়া, ইলেক্ট্রিক বিল, বাচ্চার জন্য দুধ কেনার টাকা কোথা থেকে যোগাড় করবো, এখনো জানি না। এবার ঈদেও মালিক বেতন বোনাস কিছু দেয় নি।’’ লোকটার কথা আমার কানে চলে আসে। এগুলো নিয়ে আমি আর মাথা ঘামাতে চাই না। এমনিতেই আমার আর ভালো লাগছে না। আমি আরো জোরে দৌড়াতে থাকি। দৌড়াতে দৌড়াতে একটা জায়গায় এসে থামি। দেখে মনে হচ্ছে, এটা আবাসিক এলাকা। জানালার গ্রিল ধরে একটা ছ/সাত বছরের ছেলে দাঁড়িয়ে আছে। ওকে দেখে একটু ভালো লাগলো। শিশুদের আমি ভালোবাসি। ওকে দেখে হাত নেড়ে বললাম, ‘‘হাই!’’ ছেলেটিও হাত নাড়লো।
বললাম, ‘‘কী বাবু, ঘুম নেই?’’ বলেই মনে হলো, এটা তো অনিদ্রার রাজ্য! কেন আর এ অবান্তর প্রশ্ন করা?
ছেলেটি ফিসফিসিয়ে বললো, ‘‘বাবা প্যান্টের বেল্ট খুলে মাকে মারছে!’’
ছেলেটার কথা শুনে পাশের আরেক জানালা থেকে কথা বলে উঠলো আরেকটা ছেলে। ওরই বয়সী, বললো, ‘‘আমার মাকে ভাড়াটে খুনি দিয়ে খুন করিয়েছে বাবা! আমি নিজে দেখেছি!’’ ওদের কথা শুনে আমি আর স্থির থাকতে পারি না। আবার দৌঁড় দিই। আমি থামি না। দৌঁড়ুতে থাকি, দৌঁড়ুতে থাকি। এক দৌঁড়ে চলে আসি রাজ্যের শেষ সীমান্তে। দেখি একটা কুকুর নিশ্চিন্ত মনে ঘুমাচ্ছে। কুকুরটার ঘুম দেখে শান্তি লাগে। সিদ্ধান্ত নিই, এ রাজ্য আর এক মুহূর্তও থাকা চলবে না।