September 20, 2024
ফিচার ৩মুক্তমত

ভাঁড়ামোর নিচে চাপা পড়া বস্তুনিষ্ঠতা

সোনিয়া সরকার জয়া।। বাংলাদেশের সাংবাদিকেরা ঘরের খেয়ে বনের মোষ তাড়ায়। অথচ তাদের কোনো ক্ষতি হলে মিডিয়াকর্মী আর কিছু হাতেগোনা আমজনতা ছাড়া বাইরের কয়জন তাদের সাথে থাকে? তাহসান-মিথিলার ডিভোর্সে তাদের মেয়ের ভবিষ্যৎ ভেস্তে যাবে ভেবে ঘুম হারাম করে ফেলার জাতির কত অংশ গত পাঁচদিনে সাংবাদিক রোজিনার মেয়েটা কেমন আছে তার খোঁজ নিয়েছে? সাগর-রুনীর হত্যার বিচার চাইতে গিয়ে যে জাতি ঐক্যবদ্ধ হয়েছিল, তাদের মাঝেও যে বিতৃষ্ণা চলে এসেছিল, তা কি শুধু বিচারের দীর্ঘসূত্রীতার জেরে? বরং যেসব সাংবাদিক নেতার ওপর ভরসা রেখে প্রতিবাদ জিইয়ে ছিল তাদেরই হঠাৎ করে মাথা বেচে দিয়ে দ্বিচারিতার মাধ্যমে আন্দোলনকে দ্বিধাবিভক্ত করে ফেলার কারণটাও কি অনেকাংশে দায়ী নয়? নিজেদের বিকিয়ে দেয়াদের কেউ কেন ভাবেনি নৃশংস হত্যাকাণ্ডে পরিবারের দুইজন সদস্যকে হারানোর পর তাদের ওপর আস্থা রাখা পরিবারটার বাকি সদস্যদের আশার জায়গাটা তারা কীভাবে নষ্ট করে দিচ্ছে! পাঁচ বছরের শিশু মেঘের পাশে দাঁড়ানোর যে প্রতিশ্রুতি রাষ্ট্রপ্রধান দিয়েছিলেন সেটা কতটা পূরণ হয়েছে তা তো বলাই বাহুল্য। সেদিনের শিশু মেঘ আজকে কিশোর। এই ছেলেটার মনে কতটা ঘৃণার উদ্রেক হবে যখন সে জানতে পারবে তার বাবা-মা’রই কিছু বন্ধু, সহকর্মী নিজেদের উপরে ওঠার ধান্ধায় তাদের রক্তের ওপর দাঁড়িয়ে, তাদের মৃত্যুকে পুঁজি করে জঘন্য বাণিজ্য করে নিজেদের আখের গুছিয়ে নিয়ে মুখে কুলুপ এঁটে দিয়েছিল।

দুটো ঈদ আসলেই এদেশের নিউজ চ্যানেল ও সংবাদপত্রে প্রাধান্য পায় শহরের প্রতিটা শপিং মলে কত কেনাবেচা হচ্ছে, টিকেটের জন্য স্টেশনগুলোতে মানুষের লাইন কতটা দীর্ঘ, গরু-ছাগলের হাটবাজারের দরাদরি, যানবাহন/ফেরিতে কত উপচে পড়া ভিড় হচ্ছে তার আপডেট। বছরের বাকি সময় দুই দলের নেতারা কে কতটা শক্তস্বরে অপরপক্ষকে পাল্টা জবাব দিলো, কে কোথায় গিয়ে ফিতা কেটে অনুষ্ঠান উদ্বোধন করলো বা প্রতিটা বক্তা মাইক হাতে কতটা পুরান কাসুন্দি ঘাটতে পারলো তা শীর্ষ  সংবাদ মাধ্যমগুলোর হেডলাইন হয়। ব্লগার নীলয় নীলকে ঘরে ঢুকে হত্যার সংবাদও চ্যানেলে প্রচার হয়েছিলো দুটো নিতান্তই অপ্রয়োজনীয় সংবাদের পরে। চ্যানেল বা কাগজের কাটতি কমে যাওয়ার ভয়েই হয়তো খুন হয়ে যাওয়া ব্লগারদের বিচারিক কার্যক্রম নিয়ে বিস্তারিত সংবাদ প্রকাশের আগ্রহ দেখাননি বেশিরভাগ সম্পাদকই। অভিজিৎ, দীপন, ওয়াশিকুর, অনন্ত বিজয় থেকে জুলহাস হত্যা নিয়ে এত প্রতিবাদ, এত লেখালেখি কোনো পত্রিকা বা চ্যানেলে গুরুত্বের সাথে উঠে আসেনি। মামলার মত সংবাদগুলোও চাপা পড়ে গিয়েছিল পেছনের পৃষ্ঠায়, অবহেলার সাথে।

যেদেশে লেখালেখির অপরাধে ব্লগার, অ্যাক্টিভিস্ট প্রকাশ্যে খুন হয়ে রাস্তায় পড়ে থাকে, প্রতিবাদী কার্টুন আঁকার অপরাধে কিশোরেরা জেলে নির্যাতিত হয়, সেই কার্টুন ক্যাশপন লিখে শেয়ার দেয়ার দোষে মুশতাককে জেলে লাশ হয়ে যেতে হয়, পথে আন্দোলন করতে নামলে পুলিশি নির্যাতনের শিকার হতে হয়, আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন আর কয়েকবারের ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল পুরস্কার পাওয়া সাংবাদিক রোজিনাকে রোষানলে পড়ে বিনা কারণে হাজতবাস করতে হয়, ঠিক সেদেশেই পলাতক খুনি দেশে ফেরা মাত্রই জামিন পায়, সাগর-রুনীর খুনিরা লোকচক্ষুর অন্তরালে থেকে যায়, বড় বাপের সোনার পুত্ররা ধর্ষণের পর বিশিষ্ট ব্যারিস্টারের সহযোগিতায় নিঃশর্ত মুক্তি পায়, হাজার কোটি টাকা লুটপাট করে পি কে হালদারেরা নিরাপদে উন্নত দেশে পাড়ি জমায়। ক্রাইম আর অনুসন্ধানী রিপোর্ট বা পরিশ্রম করে তুলে আনা দুর্নীতি, অপরাজনীতি, অবৈধ বাণিজ্যের খবরগুলো ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের ‘দেখছি’ ‘ব্যবস্থা নিচ্ছি’ বলা পর্যন্ত থেমে থাকে। বিচার বহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের তথ্য নষ্ট করার অজুহাতে অবলীলায় মেজর সিনহাকে খুন করে ফেলা হয়। এদেশের বিচার প্রক্রিয়া কেন মিথ্যা মামলায় জেল খাটা নির্দোষদের জন্য দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর হয় কিন্তু চিহ্নিত আসামিদের ক্ষেত্রে শুধু গ্রেফতারের পর জামিন পর্যন্ত সীমাবদ্ধ থেকে যায় সে প্রশ্ন তোলার সময় কবে আসবে?

এ জাতির তীব্র আগ্রহ শোবিজের সেলেব্রিটিদের একান্তই ব্যক্তিগত খবরের প্রতি। তারা কখন খেল, কোন দেশে বেড়াতে গেল, তাদের কয়টা প্রেম আর বিচ্ছেদ হল, মডেলদের কয়টা স্ক্যান্ডাল প্রকাশ পেল, এইচডি লিংক অ্যাভেইলেবল কিনা, কেন তাদের সংসার টেকেনা এসব বিশ্লেষণ করে ফেসবুক বিচারকেরা কমেন্ট বক্সে কয়েক লাইন কুৎসিত গালিসমৃদ্ধ রায় দিয়ে দেয় নায়িকাদের ‘আউটফিট আর খারাপ চরিত্র’ই সব নষ্টের মূল। এই রায় দেয়া মানুষগুলোই আবার অবাধে ঘুষ দেয়ানেয়া করে, রাস্তাঘাটে টিজ করে, বাসে উঠে মেয়েদের বুক-পিঠ হাতড়ানোর তালে থাকে, তাদের মনমত পোশাক না পরলে মেয়েদের বাজারের মাল বানিয়ে দেয়। ব্যক্তিজীবনে মেল শভিনিজমের চর্চা করা এই মানুষগুলোই বাইরে সুখের বিজ্ঞাপন দিয়ে ঘরে বউ পেটায়, বোন-মেয়েকে তীব্র শাসনের বেড়ি পরিয়ে রাখে আর ভাই-ছেলে ধর্ষণ করে আসলে তাদের শেল্টারে পরিণত হয়ে আদর্শ গৃহকর্তার ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়। তাই হয়তো এত প্রতিবাদের পরেও প্রতিটা খুন, ধর্ষণ, ঋণখেলাপ, দুর্নীতির সংবাদকে পেছনে ফেলে ট্রল হওয়া বাতাবী লেবুর বাম্পার নিউজ আর চ্যানেলের ক্ষমতাধর প্রতিষ্ঠাতার গাওয়া বেসুরো গানের সংবাদ প্রতিবার সামনে উঠে আসে, গুরুত্বের সাথে প্রচার হয়।

যতদিন এদেশের মানুষকে নিজেদের অধিকার অর্জনের জন্য, দাবি আদায়ের জন্য, সুবিচার পাওয়ার জন্য, অন্যায়ের বিচারের জন্য, সাদাকে সাদা আর কালোকে কালো বলে প্রতিষ্ঠার জন্য প্ল্যাকার্ড হাতে পথে নামতে হবে, যতদিন প্রতিবাদ একতাবদ্ধ হওয়ার বদলে সিলেক্টিভ আর ডিভাইডেড হবে আর পক্ষপাতের দোষে দূষিত হয়ে সংগ্রাম-বিদ্রোহগুলোর ব্যবচ্ছেদ থেকে সলিল সমাধি ঘটবে, ততদিন “মুক্ত গণমাধ্যম সমাজের দর্পণ” বা “মত প্রকাশের স্বাধীনতা” কথাগুলো কাগজে কলমেই থেকে যাবে। চ্যাম্পিয়ন হতে থাকা ভাঁড়ামোর সংবাদের নিচে বারবার বস্তুনিষ্ঠ সংবাদগুলো চাপা পড়ে অতলে হারিয়ে যাবে।

 

[ফেমিনিস্ট ফ্যাক্টরে প্রকাশিত মুক্তমত লেখকের নিজস্ব বক্তব্য]