রাষ্ট্র কি আদৌ বৈষম্যহীন?
সাদিয়া মেহজাবিন।। ষষ্ঠ শ্রেণিতে থাকতে গড় গড় করে মুখস্ত করেছিলাম রাষ্ট্রের ৪টি স্তম্ভ। স্বাধীনতা, সার্বভৌমত্ব, সরকার ও জনগণ। আমার বোকা মন ভেবে নিয়েছিল, রাষ্ট্র সত্যি এসব মেনে চলে। সময় গড়িয়ে আমি বুঝতে পারি স্বাধীন রাষ্ট্রে আমি বাস করলেও আমরা স্বাধীন না।
একটু বড় হয়ে সংবিধান শব্দটি বুঝতে শিখলাম। কিন্তু পদে পদে আমি বুঝতে পারি আমরা মূলত সংবিধান নয় ক্ষমতার লড়ায়ে টিকে থাকার এক যুদ্ধে আছি। আচ্ছা রাষ্ট্র কি কোনো বস্তু কিংবা প্রাণী? নাকি ঈশ্বর? রাষ্ট্রের আমাদের উপর অন্যায় করার কোনো সুযোগ নেই, তাহলে কেন আমরা বৈষম্যের শিকার হচ্ছি? মূলত দেখা যায় রাষ্ট্র পরিচালনায় যারা আসীন হয় তারাই আমাদের উপর অন্যায় অবিচার করে।
সংবিধানের ২৮(১) অনুচ্ছেদে বলা আছে, “কেবল ধর্ম, গোষ্ঠী, বর্ণ, নারী-পুরুষভেদ বা জন্মস্থানের কারণে কোনো নাগরিকের প্রতি রাষ্ট্র বৈষম্য প্রদর্শন করিবেন না।” ২৮(২) অনুচ্ছেদে বলা আছে রাষ্ট্র ও গণজীবনের সর্বস্তরের নারী পুরুষ সমান অধিকার লাভ করিবেন”।
এত স্বচ্ছ সংবিধান দেখে-পড়ে আমি বেশ খুশি হই; কিন্তু কাচের মত টুকরো হয়ে যায় সমাজ। কখন জানেন? যখন দেখি মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক সংসদ কমিটি জানাজায় কিংবা গার্ড অব অনারে নারী ইউএনও রাখতে চান না। বিষয়টা মর্মান্তিক হতো যদি আমার দেশ নিরপেক্ষ হতো, আমার দেশ বৈষম্যহীন হতো। ব্যাপারটা এখন হাস্যকর কেননা রাষ্ট্রের কোনো ধর্ম থাকার কথা নয়, সেখানে আমার রাষ্ট্রের প্রধান ধর্ম ইসলাম। ইসলামিক শরিয়া মতে জানাযায় নারী উপস্থিতি অসম্ভব ব্যাপার। কেবল তা নয়, সাথে কবর জেয়ারত গুনাহ। যেখানে আপনারা ইসলামিক রাষ্ট্র চাইতে ব্যস্ত, কেউ ধর্ম নিরপেক্ষ রাষ্ট্র চাইলে তাকে গুম খুন হত্যা করেন সেখানে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী হিসেবে এখনো একজন নারী আছে দেখে আমার হাসি কান্না দুটোই পায়। রাষ্ট্র কেন এই বৈষম্য করে? ইসলামিক রাষ্ট্র ব্যবস্থা কায়েম করার চেষ্টাকেই প্রধান অন্তরায় ধরে নিলে, তবে দোষের কিছু দেখছি না।
যাই হোক এখনো কোনো রাষ্ট্রের কর্মচারী প্রধানমন্ত্রী থেকে আমলা কামলা কাউকে প্রতিবাদ করতে দেখলাম না। আমি দুঃখিত কারণ আমরা এখনো ততটুকু প্রতিবাদী নই, যতটুকু হলে এই বৈষম্য ভেঙ্গে চুরমার করে দেওয়া যায়।
তবে রাষ্ট্র বৈষম্যহীন প্রশ্নে আরেকটি বিষয়, এই যে সেলিব্রেটিদের উপর হওয়া যেকোনো অন্যায়, অবিচার, নির্যাতনে আমরা সাধারণ জনগণ যেভাবে ঝাপিয়ে পড়ি সেভাবে কি তারাও সাধারণ জনগণের উপর হওয়া অন্যায়ের প্রতিবাদে ফেটে পড়ে? আজকাল শিল্পী গোষ্ঠীকে খুব কম দেখা যায় প্রতিবাদী হতে। প্রতিবাদী শিল্প তৎপরতা নেই বললেই চলে। কেন এরকম, কেন তারা সমাজ নিয়ে নিজের দায়টুকুও স্বীকার করেন না?
সেলিব্রেটিরা চাইলেই প্রধানমন্ত্রীর দ্বারস্থ হয়ে অন্যায়ের বিচার চাইতে পারে, অনেকে সুষ্ঠ বিচারও পেয়েছেন। অন্যদিকে কিন্তু যারা সাধারণ জনগণ তারা এই সুযোগ পায় না।
মুনিয়া হত্যা মামলায় রাষ্ট্রের কোনো ভূমিকা ছিল না। কেবল মুনিয়ার চরিত্র নিয়ে মহাভারত রচনা করাই যেন হাতিয়ার ছিল। মুনিয়া একজন মুক্তিযোদ্ধার সন্তান কিন্তু সেও রাষ্ট্রের থেকে এই সুবিচার পেলো না। অন্যায় কার? নিশ্চিত আমাদের সংবিধানের অপরিপক্কতার দোহাই দেওয়া অন্যায় কেননা সংবিধানে বলা আছে রাষ্ট্র বৈষম্য করে না।
পরিমণির উপর হওয়া অন্যায়ের প্রতিবাদ করা যেমন জরুরি সাথে এই নিখুঁত প্রশ্নগুলো টুকে রাখা ভালো। আর যেসব কোটি সংখ্যক মানুষ বাজে কমেন্টের বন্যা বয়ে দিচ্ছে তাদেরকে আমি তিরস্কার করি না। তিরস্কার করি সুশীল সমাজের মুখোশের অন্তরালে কুৎসিত মনমানসিকতার মানুষদের। যারা নিজেরটা ভালো বুঝে, নিজের তলা গুছিয়ে রেখে চুপিসারে কেটে পড়ছেন। মনে রাখুন এই বীজ সুদূরপ্রসারী কোনো ফলন দেবে না। শিল্পীদের প্রতিবাদী হওয়া এখন তাদের নিজেদের সুফল বয়ে আনবে। অন্তত আপনারা এবার বাদাম খান আর বুদ্ধির বিকাশ করুন। যদি সময় হয় ৫৬০টি মসজিদের পাশে ১টি হলেও লাইব্রেরিও করুন। আমাদের এই বিকৃত মনের অবসান এখন কেবল ভালো মানের শিক্ষা ব্যবস্থা, রুচিশীল শিল্প- সাহিত্যে নিহিত আছে।
[ফেমিনিস্ট ফ্যাক্টরে প্রকাশিত মুক্তমত লেখকের নিজস্ব বক্তব্য]