September 20, 2024
ফিচার ২মুক্তমত

ধর্ষণ এবং কাঠগড়ায় নারীর চরিত্র যাচাই

সানজিদা খানম।। ধর্ষণ! ধর্ষণ শুধু শারীরিক আক্রমণ বা আহত হওয়ার মধ্যেই সীমাবদ্ধ কোন ব্যাপার নয়। ধর্ষণের সাথে সব চেয়ে বেশি জড়িত মানসিক আঘাত এবং অসম্মানের পীড়া; কিন্তু ধর্ষণের সাথে একজন নারীর সম্মানের বিষয়টি জড়িত নয় বরং নারীর সম্মানের বিষয়টি জুড়ে দেওয়া হয়। ধর্ষণের মাধ্যমে নারীর আত্মসম্মান কোনভাবেই হরণ হয় না বরং একজন ধর্ষকের মানসম্মানই নষ্ট হবার কথা। কিন্তু সমাজে ঘটে এর উল্টোটা। ধর্ষণের মতো এমন দুর্ঘটনার দায়ভার এসে পরে ভিক্টিমের ওপর, তার চরিত্রের ওপর, যাকে আমরা বলি “ভিক্টিম ব্লেমিং”। মানসিক যন্ত্রণাকে শতগুণে বাড়ানোর পেছেনে এই ভিক্টিম ব্লেমিং কাজ করে, যা পরবর্তীতে নারীর আত্নবিশ্বাসকে আঘাত করে পাশাপাশি স্বাভাবিক জীবনযাত্রায় বাধা হেয়ে দাঁড়ায়, মানসিক ভারসাম্যহীনতাও দেখা যায় এমনকি আত্মহত্যা করতেও বাধ্য হয় অনেকে।

ধর্ষণের ব্যাপারে “ভিক্টিম ব্লেমিং” এর মতো মারাত্মক একটা ব্যাপার আমাদের সমাজের অতি পরিচিত একটি চিত্র। একই সাথে আমাদের আদালতও আইনে লিখিতভাবে এমন একটি ভিক্টিম ব্লেমিং এর ফাঁক-ফোকর রেখেছেন, যা প্রয়োগ করা হয় কোর্টে ধর্ষণ মামলা চলাকালীন সময়ে। কীভাবে? একটি দেড়শ বছরের পুরনো সাক্ষ্য আইন ১৫৫(৪) ধারার মাধ্যমে। এ আইনটি ব্রিটিশ পিরিয়ডে তৈরি, যেখানে বলা আছে ধর্ষণ মামলায় ভিক্টিমের চরিত্রকে যদি দুশ্চরিত্র অথবা হালকা সম্ভ্রান্ত বলে প্রমাণ করা যায় তবে সেই ভিক্টিমের সাক্ষ্য গ্রহণযোগ্য হবে না, আরো শক্ত প্রমাণ দাঁড় করাতে হবে। এ আইন কোর্টে দাঁড়িয়ে একজন ভুক্তভুগী নারীর শুধু চরিত্র বিশ্লষেণর অনুমতিই দেন না, বরং ধর্ষণের মামলার ন্যায্য বিচারেও প্রধান বাধা, যার ফাঁক গলে অপরাধী বের হয়ে যেতে পারে।

ধর্ষণের মামলায় “চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যকে” আসামী পক্ষ হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করছে কি না তা তলিয়ে দেখতে বাংলাদেশ লিগ্যাল এইড অ্যান্ড সার্ভিসেস ট্রাস্ট ( ব্লাস্ট) একটি গবেষণা করেছে ২০০০ সাল থেকে ২০১০ সালের প্রাপ্ত সকল ডাটার ওপর ভিত্তি করে। এবার দেখা যাক সে গবেষণা থেকে কী উঠে এসেছে।

আব্দুল মজিদ বনাম রাষ্ট্র [১৩ বিএলসি২০০৮] নামের এক মামলায় দেখা যায় একজন নারী তার শিশুসহ নিজগৃহে ঘুমন্ত অবস্থায় যৌন আক্রমণের শিকার হন। পরে আসামী পালানোর সময় গ্রামবাসীর হাতে ধরা পড়ে। কিন্তু এ মামলাতে সে মহিলা তালাকপ্রাপ্ত, তার পূর্বের বৈবাহিক অবস্থা এবং তিনি যৌন সম্পর্কে জড়িত কি না তা বিবেচ্য বস্তু হয়ে ওঠে এবং এরই ধারাবাহিকতায় তাকে ‘….ধর্ষিতা একজন হালকা নৈতিক চরিত্রের অধিকারিণী এবং তিনি অসামাজিক ও অনৈতিক কার্যক্রমে জড়িত রয়েছেন…’ বলে “চারিত্রিক বৈশিষ্টের” বিশ্লেষণ করা হয়।

রাষ্ট্র বনাম শাহীন এবং অন্যান্য [২৮ বি এলডি (হাইকোর্ট ডিভিশন)] নামের আরেকটি মামলায় দেখা যায় একজন নারীকে তার নানীর কাছ থেকে ছিনিয়ে এনে হোটেল রুমে গণধর্ষণ করা হয়। এ মামলার রায়ের ক্ষেত্রে আদালতে বলা হয়, ‘এটি এমন একজন নারীর ধর্ষণের মামলা, যার আগে দুবার বিয়ে হয়েছিল…’ এবং এটাও বলা হয় যে উল্লেখিত কারণে বাদীর একার সাক্ষ্য গ্রহণযোগ্য নয়। এখানে আমাদের লক্ষ্য রাখা উচিত ধর্ষণের মতোন মামলায় আক্রান্ত নারীই সব থেকে বড় সাক্ষী কিন্তু এখানে তার সাক্ষ্যই যদি গণ্য করা না হয় তবে ন্যায্য বিচারকাজে তা অনেক বড় একটি বাধা।

আবার আরেকটি মামলায় দেখা যায় নারীর চরিত্র বিশ্লষণ করা হচ্ছে গাছে ওঠা দেখে। এ মামলায় যৌন আক্রমনের শিকার হন একজন অল্পবয়সী গৃহপরিচালিকা। তিনি সদর দরজা বন্ধ থাকায় পেঁপে গাছ বেয়ে ওঠেন বলে তাকে ‘হালকা সম্ভ্রমের নারী’ বলে উল্লেখ করা হয় আদালতের রায়ে।

তবে চারিত্রিক বিশ্লেষণে যিনি সম্ভ্রম চরিত্রের অধিকারী তিনি এ ধারার মাধ্যমে উপকৃত হয়ে থাকেন। এখানে প্রশ্ন আসে একজন যৌন আক্রমণে আক্রান্ত ব্যক্তির ‘চরিত্র’ বিশ্লষেণ কতটুকু জরুরি? ধরুন একজন যৌনকর্মী যদি ধর্ষণের মামলা করে থাকেন তবে সাক্ষ্য আইন তার জন্য স্পষ্টতই প্রধাণ বাধা। তবে কি একজন যৌনকর্মী তার ওপর হওয়া অন্যায় অত্যাচারের বিচার চাইতে পারেন না? অবশ্য আমাদের দেশের প্রেক্ষিতে তা ধর্ষণ হিসেবেই গণ্য করতে অনেকেই অপরাগ থাকবেন কিন্তু আইনের কাছেও কি তাই? গবেষণা থেকেই আমরা দেখতে পাচ্ছি কীভাবে নারীর চরিত্র বিশ্লেষণের ক্ষেত্রে তার বৈবাহিক সম্পর্ক কি, কয়টি বৈবাহিক সম্পর্কে ছিল বা যৌন সম্পর্কের ইতিহাস কী এসব জরুরি বিষয়। এমনকি একজন অল্পবয়সী মেয়ে পেঁপে গাছ বেয়ে উঠলেও তার চরিত্রের সম্ভ্রম কমে যায়!

ধর্ষণ কী? কখন আমরা বলে থাকি উক্ত ব্যক্তি ধর্ষণের শিকার? যখন কারো অনুমতি ছাড়া যৌনসঙ্গম অথবা যৌন অনুপ্রবেশ ঘটানো হয় তখনই সেটাকে ধর্ষণ বলে বিবেচনা করা হয়। এ জায়গায় তার আগে কয়টি বিয়ে হয়েছে, সে আগে কার কার সাথে সঙ্গম করেছে, সে কী পরে, কীভাবে চলে বা সে গাছে ওঠে কি না তা খতিয়ে দেখা কতটুকু প্রাসঙ্গিক? বিষয়টা ধান ভানতে শিবের গীতের মতন হয়ে গেল না! এই ধারা যতদিন অব্যাহত থাকবে ততদিন কাঠগড়ায় দাঁড়িয়ে আক্রান্ত নারীই অপমানের শিকার হবে কারণ আসামীপক্ষ এ ধারাকে হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করতে গিয়ে তার চরিত্র বিশ্লেষণের নামে ভরা মজলিশে তাকে হেনস্তা করবে যাকে “সেকেন্ড রেপ” হিসেবেও গণ্য করা যায়।

যখন ধর্ষণ বা ধর্ষণের চেষ্টা সংক্রান্ত কোনো ঘটনা আমরা পাই, সোশ্যাল মিডিয়ার কমেন্ট সেকশনই বলে দেয় সমাজ কীভাবে আক্রান্ত নারীরই চরিত্রকে দোষারোপ করা শুরু করে। এটা আমরা তনু থেকে শুরু করে মুনিয়া, পরীমনিসহ সকল ক্ষেত্রে দেখতে পাই। তবে আশার বিষয় হচ্ছে ভিক্টিম ব্লেমিং নিয়ে আমরা এখন পাল্টা কথা বলা শুরু করেছি, প্রতিবাদ জানাচ্ছি কিন্তু স্বয়ং আদালতেই যদি এমন ভিক্টিম ব্লেমিং এর সুযোগ থাকে তবে যে কোনো নারীর সুষ্ঠ বিচার পেতে যেমন বাধা আসবে, তেমনি অনেকেই কোর্ট অব্দি যেতে ভয় পাবে, মামলার পরিমাণ কমে যাবে এমনকি মামলার পরেও এমন হেনস্তার রেশ তাকে আজীবন বয়ে বেড়াতে হবে। আমাদের কি উচিত না সাক্ষ্য আইনের ১৫৫(৪) ধারার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানানো?

সাক্ষ্য আইনের আরেকটি বিশেষ দিক পুরুষতান্ত্রিকতার পৃষ্ঠপোষকতা। এখানে নারীর চরিত্র মাপার যে মাপকাঠি তা পুরোটাই পুরুষতান্ত্রিক। যেখানে ধর্ষণের সঙ্গানুযায়ী স্পষ্টই সঙ্গমের ক্ষেত্রে সম্মতির বাইরের বা বিনা অনুমতিতে যৌন অনুপ্রবেশকে ধর্ষণ বলে বিবেচনা করা হচ্ছে সেখানে সাক্ষ্য আইন নারীর চরিত্রের ওপর ভিত্তি করে সম্মতিকে অনেকটা ঠুনকো হিসেবে দেখাচ্ছে। এটা স্পষ্টভাবে উচ্চারণ না করলেও পরোক্ষভাবে সম্মতির জায়গাটা ঠুনকো হচ্ছে। যেমন একজন নারী তালাকপ্রাপ্ত কি না, আগে দুটি বৈবাহিক সম্পর্ক ছিল কি না, বা আগের যৌন সম্পর্কের ইতিহাস আছে কি না বা যৌন কার্যকলাপে জড়িত কি না বা পেঁপে গাছে ওঠে কি না এসব যখন বিবেচনায় নেওয়া হয়, তখন সেই নারীর সম্মতির জায়গাটি ফ্যাকাসে হয়ে আসে। সমাজের চোখে এমন একটা দৃষ্টিভঙ্গিও দাঁড় হয়ে যায়, যে আগে থেকে যৌন সম্পর্কে জড়িত বা যার ‘চরিত্র’ ‘সম্ভ্রম’ নাই, তার সম্মতির দরকারও নাই। দায়ের করা ধর্ষণ মামলাটি সত্য কি না তা প্রমাণ করার আরো উপায় আছে সেই নারীর এ ধরণের চরিত্র বিশ্লেষণ ছাড়াও, যেখানে চরিত্রের সংজ্ঞাটাই গোলমেলে। একজন গাছে উঠলে কিংবা আগে বিয়ে করে থাকলে বা আগে যৌনসম্পর্ক থাকলে চরিত্র নষ্ট হবার কোনো কারণ দেখতে পাই না। এ ধারা অব্যাহত থাকলে নারী-চরিত্রকেও যখন তখন আক্রমণ করার সহজ সুযোগ থাকে, যেন নারী-চরিত্র হাতের মোয়া! পান থেকে চুন খসলেই ঘাড়ে চেপে বসা যাবে।

ভারত এবং পাকিস্তান দেড়শ বছর আগের এ আইন বাতিল করে দিয়েছে, কিন্তু আমরা এখনও তা আঁকড়ে ধরে আছি কেন? তবে আমরা কি এখনও দেড়শ বছর আগেই পড়ে আছি? সাক্ষ্য আইনের ১৫৫(৪) ধারা নারী স্বাধীনতার জন্যও বাধা যেখানে নারীর চরিত্র বিশ্লেষণে পুরুষতান্ত্রিক মাপকাঠি ব্যবহার করা হয়। একই সাথে এ আইন থাকলে বহু নারী কাঠগড়ায় হেনস্তার শিকার হবে এবং সুষ্ঠু বিচার পাবে না। তাই অনতিবিলম্বে এই ধারা বাতিলে দাবি তুলে ধরা আমাদের সবার কর্তব্য।

 

[ফেমিনিস্ট ফ্যাক্টরে প্রকাশিত মুক্তমত লেখকের নিজস্ব বক্তব্য]