November 24, 2024
ফিচার ২মুক্তমত

প্রবাসে উপমহাদেশীয় নারীদের মন মানসিকতা কবে বদলাবে?

সাবিহা ইশরাত জাহান স্টেলা ।। দেখলে মালালা কী বলেছে দেখলে! এমনই হয়। হঠাৎ গিয়ে পড়েছে তো। রাজনীতির কলকাঠি নাড়ানাড়িতে পেয়ে গেছে দামী পুরস্কার, নামী বিশ্ববিদ্যালয়ের ডিগ্রি, আরো কতো কি! জীবনেও দেখেছে এমন। আরে তোকে নিয়ে ওরা খেলা খেলে সব দিয়ে দিলো আর তুই কিনা ভুলে গেলি তোর শেকড়, জাত, ধর্ম ইত্যাদি ইত্যাদি। কি স্পর্ধা!
মালালা ইউসুফজাই-এর দেশ থেকে বহু আগে যুক্তরাষ্ট্রে আগত দুই নারীর কথপোকথন এসব। বিষয়বস্তু, মালালা’র ‘বিয়ের কী দরকার’ মন্তব্যটি। নীরব শ্রোতা হয়েই থাকতে চাই। তবু নিজেদের জীবন নিয়ে তাদের বলা হাপিত্যেশের সূত্র ধরে বলে ফেল্লাম, আচ্ছা, আপনাদের না স্বামী নিয়ে অভিযোগের শেষ নেই। তো মালালা সেটারই সমাধান দিতে চাচ্ছিলো বোধহয়। পাল্টা উত্তর, আমাদের দেশের অনেক কিছুই তুমি জানো না, তাই কথা বাড়িয়ো না।

আচ্ছা সাবিহা, এই যে তুমি এমন একটা পোশাক পরে আসলে, কাজে আসার আগে তোমার ‘মিয়া’ কি তোমায় দেখছে?

‘মিয়া’ কে?

আহা, তোমার স্বামী। আবার কে! এই পোশাক পরতে দিলো তোমায়?

আমার প্রবাস জীবনের বয়স বেশি নয়। আমি যে চাকরিটি করছি, এই প্রশ্নটি সেখানেই কর্মরত এক ‘কর্মজীবী'(!) নারীর। মার্কিন ওই প্রতিষ্ঠানটিতে জেষ্ঠ্য কর্তাদের একজন বাদে সবাই নারী। আমারই মতো বিভিন্ন পদে কর্মরতদের বেশিরভাগই বিভিন্ন দেশের প্রবাসী নারী। স্বাভাবিকভাবেই মার্কিন নারীর সংখ্যাও উল্লেখযোগ্য।

আমার উপমহাদেশীয় সহকর্মীর সাথে আলাপের কথায় ফেরা যাক। তাদেরই একজন একদিন আমি চুল কেটে কাজে যাওয়ার পর জানতে চাইলেন, আমার নতুন চুল কাটার ঢং আমার স্বামী পছন্দ করেছেন কিনা? বললাম, জানতে চাইনি। আর তাতে কিবা আসে যায়। চুল আমার। কীভাবে কাটবো সিদ্ধান্তও আমার।

বিস্ফোরিত নেত্রে আমার দিকে চেয়ে তার প্রশ্ন- বাংলাদেশের স্বামীরা তবে এসব অ্যালাও করেন! মানে অনুমতি দেন? আমি বললাম, এই যে রোজ গাড়ি চালিয়ে কাজে আসেন, নিজে ব্যবসাও করছেন। সেখানে আপনার অধীনে কর্মরত আছেন নানা দেশি পুরুষও। এসব করছেন কি আপনার নিজ ইচ্ছায়? জানতে চাইলাম। সহকর্মী জানালেন, গ্র্যাজুয়েশন শেষ করে স্বামীর সাথে এখানে আসেন। পরে নাকি স্বামীর অনুমতিতেই তিনি গাড়ি চালানো শেখেন ও কাজে ঢোকেন। নিজের চেষ্টায় সব শিখলেও, সবই তার স্বামীর অনুমতিতেই সম্ভব হয়েছে।

তো মালালার প্রতিবেশীদের দিকে নজর দেয়া যাক। যুক্তরাষ্ট্রের তথ্য প্রযুক্তির বাজারের বিরাট অংশ এদের দখলে।উল্লেখযোগ্য সংখ্যক নারীর অবস্থানও রয়েছে। কর্মসূত্রেই পরিচয় হয়েছে এমন কয়েকজনের সাথে। আমার কর্মস্থলেই তাদের কয়েকজনের নিজেদের মধ্যকার আলাপের কথা তুলে ধরা যাক। ৭৫ বছর বয়সী কোন এক মার্কিন নারী কেন এই বয়সে এতোক্ষণ কাজ করেন তা নিয়ে আলাপ জুড়েছেন তিনে মিলে। শেষমেশ উপসংহারে পৌঁছালেন এই বলে যে, আসলে তাদের কোনো জীবন নেই। স্বামী মারা গেছেন, তাই একাই ভ্যাকেশনে যাচ্ছেন। বাড়ি ফেরার সময় রেড ওয়াইন কিনে নিয়ে ফিরছেন। এসব কোনো জীবন হলো! ফিরে গিয়ে যদি কারো জন্য রান্নাই না করতে হলো, কেউ যদি অপেক্ষাই না করলো তবে সেই জীবনের মানে কী?

নিজেরাই ব্যাখ্যা দিয়ে তৃপ্তির ঢেকুর তুলতে থাকলেন। এদিকে আমার মন যতই নীরব থাকতে চেয়ে পর্যবেক্ষণ ক্ষমতা ও অভিজ্ঞতার ঝুলি সমৃদ্ধ করতে চাক, বিরোধীতা করে বসে জিহ্বা। বলে বসি, নিজেরা যথেষ্ঠ শিক্ষিত এবং স্বাবলম্বী হলেও আপনাদের শেষ অবলম্বন সেই স্বামীই রয়ে গেল? শ্যেন দৃষ্টির আগুনে ভস্ম হওয়ার আগে ছুটে পালাই অকুস্থল থেকে। আরো একটা মজার ব্যাপার হলো, চিরশত্রু দুই দেশের ‘নিয়ন্ত্রণ রেখা’ মিলেমিশে একাকার হয়ে যেতে স্বচক্ষে দেখলাম ইমরান খানের ধর্ষণ বিষয়ক মন্তব্যকে সমর্থন করে। কথা একটাই, মেয়েদের বুঝতেই হবে, সব দেশ তো আমেরিকা-ইউরোপ না। সেখানে নিজেকে ঢেকে-ঢুকে রাখলে তবেই নিরাপদ। এদের সাথেই আমি আবার মাঝে মধ্যে মধ্যরাতে কর্মস্থল থেকে বাড়ি ফিরি। বরফ ঠেলে, দক্ষতার সাথে গাড়ি চালিয়ে ঘরে ফিরে গেলেও, সরাতে পারেন না, রন্ধ্রে রন্ধ্রে ঢুকে যাওয়া পুরুষতান্ত্রিকতার আবরণ।

কর্তার ইচ্ছেয়ই কর্ম করে যাচ্ছেন প্রবাসের একাধিক সফল নারী। যাদের বেশিরভাগই দক্ষিণ এশিয়ার বাসিন্দা। ক্রেডিট কার্ড নেবেন কিনা, হেলথ্ ইন্সুরেন্সের হালহকিকত – সব চলছে ‘কর্তা’ ‘সাহেব’ বা ‘ওনার’ নির্দেশে। অথচ, বাবা-মায়ের দেয়া শিক্ষার কারণে কিন্তু এদেশে এসে বসে থাকতে হয়নি এক মুহুর্তও। কিছুটা ব্যতিক্রম দেখতে পাই নেপালের নারীদের বেলায়। বিউটি পার্লার, যা এখানে ‘স্যালো’ বলেই বেশি পরিচিত, সেখানে কয়েকজন নেপালি নারী কাজ করেন যাদের স্বামীরা বাড়িতে থেকে বাচ্চা পালছেন। মানসিক দিক থেকেও এদেরকে বহুবারই দৃঢ় বলে মনে হয়েছে আমার।

এবারে প্রবাসের স্বদেশী বোনদের মানসিকতা আমার অভিজ্ঞতায় কেমন সেটা বলতে চাই। এটা বলে রাখা ভালো যে, আমি কথা বলছি অধিকাংশের মানসিকতা নিয়ে। সাধারণ অভিজ্ঞতা থেকে। তবে, অবশ্যই ব্যতিক্রম রয়েছেন অনেকেই। প্রায় পনেরো বছর আগের কথা। তখন আমি বৃটেনে শিক্ষার্থী। পরিচিত এক দম্পতি, স্বামী-স্ত্রী দু’জনেই প্রায় দশ ঘন্টা কাজ করেন সপ্তাহে ছয়দিন, এমন এক বাড়িতে রাতের খাওয়ার দাওয়াতে গিয়ে দেখা গেল ছয় পদের মধ্যে পাঁচটি তিনি রাঁধলেও একটি পদ তার স্বামীকে রাঁধতে হয়েছে বলে আফসোসের শেষ নেই। বারবার স্বামীর সামনে সবাইকে কৈফিয়ত দিয়েই চলেছেন। ফিরিস্তি দিচ্ছেন কোন্ দু’একটা কাজে স্বামীটি তাকে সাহায্য করে থাকেন তা নিয়ে। খানিক পরে লক্ষ্য করা গেলো, নারীকুলের সবাই একই ধরণের গল্প বলছেন বেশ গর্বের সাথেই। কর্মজীবী হলেও তাদের নেই কোনো নিজস্ব গল্প বা আলাপের বিষয়বস্তু।

নিজে দুটো কাজ করছেন। কারণ বাচ্চাদের উচ্চশিক্ষা দেবেন। যে কারণে গাড়ি চালিয়ে চলাফেরা করা। গাড়ির যাবতীয় যত্নআত্তিও নিজ হাতেই করছেন। কিন্তু কর্মক্ষেত্রে কোন ভারি কাজের বেলায় বলে বসবেন আসলে এসবই ছেলেদের কাজ। এমন দিনে তাদেরই ডাকা উচিত। এরপর, মার্কিন সহকর্মীদের মুখে ‘তুমি আসলেই একটা আজব’ – এমন কথা শুনলেও খুব একটা হেলদোল হয় না দেশি বোনটির।

নিজে দীর্ঘদিন ধরেই কাজ করছেন। কিন্তু ভালোবাসা খারাপবাসা, জন্মদিন, বিয়েবার্ষিকী এসব অনুষ্ঠানে কেন স্বামী প্রচন্ড দামি উপহার দিলেন না, এ নিয়ে তুলকালাম কাণ্ড ঘটান উপমহাদেশের এক নারী। কর্মক্ষেত্রে এসে নিজেই আবার এসবের বিস্তারিত বর্ণনা দেন। বলেন, এভাবেই ‘টাইট’ দিতে হয় ‘ওনাদের’। উদ্ভট যুক্তির তোড়ে সামনে থেকে বিদায় হয়ে মুক্তি মেলে আমার। নিচু গলায় আমাকে নিয়ে বলেন, ছোট একটা দেশ থেকে এসে দশ মাসেই প্রমোশন! বোঝাই যায়, এদের দেখে কাপড় পরা শিখেছে তো, তাই প্রমোশনটাও দ্রুত বাগিয়েছে।

কেন এদের মানসিকতা এমন? দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর দেশগুলোর নানা উন্নতির কথা চোখে পড়লেও, কেন সেখানকার নারীদের মানসিক উন্নতি হচ্ছেনা? প্রবাসের ঝাঁ চকচকে জীবন হলেও, এদের মানসিকতা যেন ফিরে যাচ্ছে প্রস্তুর যুগে। অর্থনৈতিকভাবে স্বাবলম্বী অনেক নারীও মেনে নিতে পারেনা না ‘নারীবাদ’ নামক শব্দটুকুও। এসব কথা বলতে গেলেও তেড়ে আসেন। বর্ণনা দেন নিজের তথাকথিত সংস্কৃতি বা কৃষ্টির। কেবলমাত্র ভাবনার গভীরতার অভাবেই রয়ে যাচ্ছেন অন্ধকারে। নতুন প্রজন্ম যারা এদেশে জন্মেছে সেসব মেয়েদের কারো কারো মধ্যেও কুঁকড়ে থাকা ভাব লক্ষ্য করা যায়।

তবে আশার কথা এই যে, প্রবাসে শিক্ষাসহ সব ক্ষেত্রে বেড়েছে উপমহাদেশের নারীদের অংশগ্রহণ। তাই, স্বামীকে ‘সাহেব’ আখ্যা দিয়ে অকারণেই তার পদমর্যাদা বাড়ানোর মতো দীর্ঘদিনের চাপিয়ে দেয়া পুরুষতান্ত্রিক নোংরামিগুলো থেকে একদিন নিজেরাই বের হয়ে আসতে পারবেন।

 

[ফেমিনিস্ট ফ্যাক্টরে প্রকাশিত মুক্তমত লেখকের নিজস্ব বক্তব্য]