সমাজে যে মেয়ের পরিচয় ‘সুন্দরী’, তার বিপদ তত বেশি!
তারেক আজিজ বাপ্পী ।। আমাদের বিদ্যমান পুরুষতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থার বেধে দেয়া মাপকাঠিতে দৈহিক সৌন্দর্যে যে মেয়েটি ‘আকর্ষণীয়’ তার জন্য সমাজের পথে পথে প্রতিবন্ধকতাও তত বেশি। এই প্রতিবন্ধকতা তার মানসিক, বুদ্ধিবৃত্তিক বা কেরিয়ারের বিকাশে, এমনকি তার শারীরিক বিকাশের ক্ষেত্রেও সমস্যা তৈরি করে। কীভাবে, তা ব্যাখ্যা করা যাক।
ধরা যাক ঢাকার একটি বিশ্ববিদ্যালয় ৪র্থ বর্ষে পড়ুয়া শারমিন (ছদ্মনাম)। সে দেখতে সুন্দর ও আকর্ষণীয়। করোনাকালীন সময়ে শিক্ষা কার্যক্রমে ব্যাঘাত না ঘটলে সে এতদিনে অনার্স গ্রাজুয়েট হয়ে যেত। এই সমস্যা শারমিনসহ ছেলে-মেয়ে নির্বিশেষে দেশের এই স্তরের সব শিক্ষার্থীই ফেস করছে। তো তার ক্ষেত্রে ব্যতিক্রম যা ঘটেছে তা হল বিগত দেড় বছরে সে তার নিজ পরিবারের সদস্য, আত্মীয়-স্বজন-পরিচিতজন মারফত এ পর্যন্ত প্রায় অর্ধশত বিয়ের প্রস্তাব পেয়েছে। তার মধ্যে আছে তার বাবার বন্ধুর ছেলে, অফিসের সহকর্মীর ছেলে থেকে শুরু করে মায়ের পক্ষের অমূক-তমূক দূর-দূরান্তের আত্নীয়-পরিচিতজন পর্যন্ত। সব ‘লোভনীয়’ চাকুরীজীবী ছেলে। এত এত জলোচ্ছ্বাসের মত ধেয়ে আসা বিয়ের প্রস্তাব মোকাবেলা করতে করতে সে এখন ক্লান্ত, মানসিকভাবে বিপর্যস্ত। এই অত্যাচার থেকে মুক্তি পেতে এই সময়কালে মাঝে মাঝেই সে ঢাকায় এসে অন্য মেয়েদের সাথে কখনো ভাড়া বাসায়, কখনও বা গার্লস মেস/ হোস্টেলে (হল-ক্যাম্পাস বন্ধ থাকায়) থেকেছে। সে জীবনে বড় হতে চায়। কেরিয়ারে প্রতিষ্ঠিত হতে চায়। একজন স্বতন্ত্র-স্বাধীন মানুষ হিসেবে নিজের একটা পরিচয় চায়। তার আগে বিয়েশাদির কোনো পরিকল্পনা তার ছিলনা। এভাবেই কাটছে তার দিন। এখন পর্যন্ত সে এই লড়াইয়ে টিকে আছে, কিন্তু এই স্যাডিস্ট সমাজকে মোকাবেলা করে কতদিন টিকতে পারবে তা সে নিজেও জানেনা।
এই চিত্র পুরো বাংলাদেশের। রূপকার্থে শারমিনরা হল গোটা সমাজের প্রতিচ্ছবি। গ্রামগঞ্জের অবস্থা তো ভয়াবহ। এখানে মেয়েশিশুর চেহারা ‘সুন্দর’ হলেই যেন সে হয়ে ওঠে গোটা পাড়ার মানুষের মাথাব্যাথার কারণ। একটু বেড়ে উঠতেই তার বিয়ের দরকষাকষি নিয়ে মা-বাবা থেকে শুরু করে প্রতিবেশী, চিন্তায় কারো ঘুম হয়না। অনেক অভিভাবক আবার দেখা যায় তাদের কন্যাশিশুর বয়স বাড়তেই গুপ্তধনের মত তাকে লুকিয়ে রাখতে তৎপর হয়ে ওঠেন। বেড়ে যায় তার প্রতি বাড়ির বাইরে না যাবার হুকুম; গেলেও অতিরিক্ত কাপড়ে নিজেকে মুড়ে তারপর যাওয়ার শর্তে। খেলাধুলা সব হয় তার জন্য নিষিদ্ধ। কোনো সুস্থ ও সচেতন ব্যক্তির অনেক ক্ষেত্রে মনে হতে পারে যে গ্রামের বেশিরভাগ কন্যা সন্তানের অভিভাবকেরা ঠিক ততদিন তাদের মেয়ে সন্তানের বিয়ে স্থগিত রাখেন যতদিন মেয়েটির জননাঙ্গ একটি পুরুষাঙ্গকে ধারণে সক্ষম হয়। বাস্তবতা হলো, অনেকক্ষেত্রে তারও আগেই বিয়ে হয়ে যায়। এর ফলস্বরূপ ঘটতে থাকে দাম্পত্য কলহ (পুতুল খেলার বয়সে দাম্পত্যের কী বোঝে ওই মেয়ে), শারীরিক-মানসিক নির্যাতন, বৈবাহিক ধর্ষণ, অকাল গর্ভধারণ ও গর্ভপাত, এমনকি সন্তান জন্ম দিতে গিয়ে মৃত্যু পর্যন্ত। এখানে কন্যাশিশুর চেহারা একটু ‘কম সুন্দর’ হলে বা শারীরিক কোনো গুরুতর প্রতিবন্ধকতা থাকলেই বরং কেবল সেই একটু বেশি শিক্ষাদীক্ষার সুযোগ পায়। তাও কিন্তু সেই বিয়ের জন্য যোগ্য হয়ে উঠতেই। এতসব বাঁধার পাহাড় অতিক্রম করে এই সমাজ থেকে কোনো মেয়ের উঠে এসে আত্মপরিচয় প্রতিষ্ঠা করে পূর্ণাঙ্গ মানুষ হয়ে ওঠার ঘটনা স্বাভাবিকভাবেই অতি বিরল।
এ তো গেল প্রত্যক্ষ সামাজিক বিপদের বিবরণ। এবার দেখা যাক এই সামাজিক সেটআপ বা ফাঁদে কীভাবে একটি মেয়ে নিজেই নিজের বিপদ ডেকে আনে। এই সিস্টেম নামক ফাঁদের প্রথম কাজ হল কীভাবে একটি মেয়েকে মেধাশূণ্য বা ব্রেইনলেস করা যায় তার চেষ্টা করা। সেটা কীভাবে হয়?
ব্যাপারটা হল সমাজের মানুষ মেয়েটার সৌন্দর্যের প্রশংসায় মেতে থাকে। এটা এক পর্যায়ে তোষামোদে পরিণত হয়। আর এখান থেকে তার মধ্যে তৈরি হতে থাকে নারসিসিজম বা আত্মপ্রেম; প্রশংসা পেলে যা মানুষের স্বাভাবিক প্রবৃত্তি। কিন্তু আত্মপ্রেম যখন অনিয়ন্ত্রিত পর্যায়ে পৌঁছায় তখন তা পরিণত হতে পারে একধরনের মানসিক বিকারে। ঠিক এই জায়গা থেকেই তার পুরুষতান্ত্রিক সমাজের ফাঁদে পা দিয়ে বিপদ ডেকে আনা শুরু হয়। সে যদি গোঁটা ব্যাপারটা কী হচ্ছে তা ধরতে না পারে তো দেখা যাবে মানুষ যত তার শারীরিক সৌন্দর্যের প্রশংসা করবে, দ্বিগুণ গতিতে তার মধ্যে বাড়বে নারসিসিজম। ফলস্বরূপ ঐ মেয়ের চিন্তাজগত একটা সংকীর্ণ গণ্ডিতে আবদ্ধ হয়ে পড়বে। নিজেকে আরও আরও সুন্দরভাবে উপস্থাপন করে মানুষের মনোরঞ্জন কীভাবে করা যায় তার নিত্যনতুন উপায় খোঁজা, নিজে প্রকৃতপক্ষে যা বা যা হতে চেয়েছিল তার ট্র্যাক হারিয়ে ফেলা ব্যাপারগুলো তার সাথে ঘটতে থাকে। কিন্তু সে সময় থাকতে এর কিছুই বুঝে উঠতে পারেনা। একজন নারসিসিস্ট এর মস্তিষ্ক চলতে থাকে অন্যের কমান্ডে। অন্যভাবে বলা যায় সমাজের লোকজন তার মস্তিষ্ক দখলে নিয়ে সেখানে কলোনি স্থাপন করে ফেলে। এই অনিয়ন্ত্রিত নারসিসিজম ব্যাপারটার সাথে সম্পর্কিত আরেকটা ব্যাপার তখন স্বাভাবিকভাবেই চলে আসে তা হল পপুলিজম বা জনতুস্টিবাদ। রাজনীতিবিজ্ঞানের টার্ম হলেও পপুলিজম ব্যাপারটা যে কোনো নারসিসিস্ট ব্যক্তির আচরণের সাথেও কিছুটা সম্পর্কিত। দেখা যেতে পারে সে জনগণকে তুষ্ট করতে বা তার ফ্যান-ফলোয়ারদের তুষ্ট করতে নিজের ইচ্ছাকে প্রাধান্য না দিয়ে লোকে কী বলবে, সমাজ কী ভাববে এসব চিন্তায় ব্যস্ত থাকে ফলে সমাজের সনাতন চিন্তাধারার বাইরে তার আর যাওয়া হয়না। জনতুস্টির আশায় তার মূল ফোকাস হয়ে উঠতে পারে তার শরীর। চেহারার প্রশংসা পাওয়ার জন্য হয়ে যেতে পারে সে সাজুগুজু নিয়ে ব্যতিব্যস্ত অথবা ফ্যাশন ম্যানিয়াক রোবট টাইপ মানুষ। যা শেষ পর্যন্ত গিয়ে দাঁড়াতে পারে এক্সিবিশনিজম নামক বিকৃতি অথবা তার নিজ শরীরকে পণ্যকরণ পর্যন্ত। এই পর্যায়ে পড়াশোনা-জ্ঞানার্জন থেকে সে পুরোপুরি বিচ্ছিন্ন হতে থাকে। প্রসঙ্গত একটি জনপ্রিয় আফ্রিকান প্রবাদ এখানে স্মরণ করা যেতে পারে— “Unlike the brain, the stomach alerts you when it’s empty” অর্থাৎ “পেট খালি হলে সঙ্কেত দেয়, কিন্তু মাথা খালি হয়ে গেলে কোন সঙ্কেত দেয়না”।
সুতরাং এটা এমন একটা সমাজ যেখানে প্রতি পদে পদে নারীর অগ্রযাত্রাকে থামানোর জন্য তৈরি করে রাখা হয়েছে ফাঁদ। নারী সেসব ফাঁদে পা দিচ্ছে বুঝে এবং না বুঝে। এখানে আছে পুরুষতন্ত্রে অভ্যস্ত এক বিশাল ব্রেইনলেস নারীগোষ্ঠী যারা নিজেরা নারী হলেও তাদের অবস্থান নারীর বিকাশের সম্পূর্ণ বিপরীতে। তাদের ব্যাপারে বিশেষ সতর্কতা জরুরি। এই সিস্টেমে একটি মেয়ে যত ‘সুন্দরী’ হুটহাট যার তার সাথে বিয়ে হয়ে যাওয়ার আশঙ্কাও তার তত বেশি। তাই সমাজস্রোতের বিপরীতে টিকে থাকার স্বার্থে তাদের সমতাবাদী বা নারীবাদী হওয়াটা একটু বেশিই জরুরি। এজন্য পড়াশোনাটা খুব দরকার; পৃথিবী-সমাজ–রাষ্ট্রের সিস্টেম সমূহ বোঝাটা খুব জরুরি। তখনই কেবল সম্ভব নারীবাদ নিয়ে বাজারে ছড়ানো প্রোপাগান্ডা ও ভ্রান্তির জবাব দিতে পারা ও জনসচেতনতা সৃষ্টি করতে পারা। নারীবাদের দর্শন তাদের দেবে আশার আলো (প্রতিকূল পরিবেশে লড়াই করার জন্য দরকারি শক্তি, সাহস, প্রেরনা)। ও হ্যাঁ সমাজ কিন্তু বলবে “তাদের বিয়ে হবেনা”! কথা কিন্তু সত্য! আসলেই তাদের ‘বিয়ে হবে’ না, কারণ তারা তো ‘বিয়ে করবে’; যখন তাদের ইচ্ছা, তখন; তার ভালোলাগার-ভালোবাসার মানুষকে; যখন তার ক্যারিয়ার সুনিশ্চিত, ঠিক তখন।
[ফেমিনিস্ট ফ্যাক্টরে প্রকাশিত মুক্তমত লেখকের নিজস্ব বক্তব্য]