নারীবিদ্বেষ: পিতৃতন্ত্রের অনিবার্য অনুষঙ্গ
ইমতিয়াজ মাহমুদ ।। নারীবিদ্বেষ একটি অতি প্রাচীন সমস্যা। পিতৃতন্ত্র যখন থেকে উদ্ভব হয়েছে সেই থেকেই এই সমস্যা আছে এবং সমাজে যতদিন কোনো না কোনো প্রকারে শোষণ বিদ্যমান থাকবে ততদিনই নারীর প্রতি বৈষম্য থাকবে এবং ততদিনই নারীবিদ্বেষ বিদ্যমান থাকবে। তবে এর মধ্যেই গণতান্ত্রিক দেশগুলিতে চেষ্টা হয় যতটা সম্ভব নারীবিদ্বেষকে নিয়ন্ত্রণ করার, কেননা গণতন্ত্রে শোষণেরও একটা শোভন রূপ থাকতে হয়; ফলে শোষণের বহিঃপ্রকাশগুলিও যেন শোভন প্রকারের হয় সেই চেষ্টাও গণতান্ত্রিক সংস্কৃতির একটা অংশ হয়।
এই সব চেষ্টার পরেও নারীবিদ্বেষ বিরাজ করে, দূর করা যায় না, এমনকি এর কোনো শোভন রূপও দেওয়া যায় না। শরীরের অভ্যন্তরের সমস্যা যেমন ফোঁড়ার আকারে প্রকাশিত হয়, পিতৃতান্ত্রিক শোষণও সেই রকম নারীবিদ্বেষ আকারে প্রকাশিত হয়। আমাদের দেশে নারীবিদ্বেষ যে অন্য অনেক দেশের চেয়ে অনেকটাই তীব্র সে কথা তো আমরা সকলেই জানি। বেশিরভাগ সময়ই আমরা এটাকে মানুষের ব্যক্তিগত আচরণ, জ্ঞান, বুদ্ধি এইসবের উপর চাপিয়ে দিয়ে দায় সারার চেষ্টা করি। কিন্তু আসলে তো এটা কোনো মানুষের ব্যক্তিগত আচরণ বা রুচি বোধের ব্যাপার নয় – নারীবিদ্বেষ একটি রাজনৈতিক আচরণ, এই আচরণের পেছনের দর্শন হচ্ছে পিতৃতন্ত্র।
সম্প্রতি আমাদের দেশে মানুষের নারীবিদ্বেষী আচরণের প্রসঙ্গটা আবার সামনে এসেছে পরীমণি এবং অন্য কয়েকজন নারীকে যে সম্প্রতি ফলাও করে গ্রেফতার করা হলো, রিমান্ডে নেওয়া হলো, সেই সূত্রে। আমরা দেখেছি যে পরীমণিকে যখন নাটকীয়ভাবে গ্রেফতার করা হয় তখন বাংলাদেশের মানুষদের একটা বড় অংশ কীভাবে প্রতিক্রিয়া দেখিয়েছে। বিশেষ করে অনলাইনে যারা নানা মাধ্যমে মতামত প্রকাশ করেন, ফেসবুকে টুইটারে, খবরের কাগজের অনলাইন সংস্করণে খবরের নিচের মন্তব্যে, ইউটিউবে। আইন শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কর্মকর্তাদের কথা বলার ভঙ্গি ও তারা কী সব শব্দ ব্যবহার করেন, সেইসবও দেখেছি। পরীমণির বিরুদ্ধে অভিযোগ হচ্ছে যে ওর ঘরে বেআইনিভাবে রাখা মদ পাওয়া গেছে। মামলাও হয়েছে মাদক দ্রব্য নিয়ন্ত্রণ আইনে। ঠিক আছে, একজন মানুষ যদি বেআইনিভাবে মদ রাখে ওর ঘরে, মামলা করেছেন, মামলার তদন্ত হবে, বিচার হবে, বিচারে দোষী হলে তিনি সাজা পাবেন। ঠিক আছে, কেউ যদি মদ রাখা বা মদ পান করা খারাপ মনে করেন তাইলে সেটা নিয়ে সমালোচনাও করতে পারেন। কিন্তু আইন শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কর্মকর্তারা, সাংবাদিকরা এবং অন্যান্য নাগরিকরা কী চর্চায় মেতে উঠলেন?
যেসব আলোচনা হয়েছে সম্প্রতি, সেইসব আলোচনার কন্টেন্ট এবং ফর্ম দুইটাই যদি দেখেন, দেখবেন যে তীব্র নারীবিদ্বেষ, নারীর বিরুদ্ধে এক প্রকার অসহনীয় ঘৃণা যেন লোকেদের কথা থেকে ঠিকরে বের হচ্ছে। এক বন্ধু আমাকে একটা ফেসবুক পোস্ট দেখালেন, পোস্টটা লিখেছেন আমাদের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের একজন বড় কর্মকর্তা। তিনি আলোচনাটা শুরু করেছেন হেঁয়ালির মত করে – দুধ, দুধের মাছি, তার দুধ পছন্দ ইত্যাদি দিয়ে এবং শেষ করেছেন এই বলে যে ‘হেলেনা, পিয়াসা, মৌ পরীমণি আজ হয়তো এরা বুঝতে পেরেছে, দুধ খাইয়ে কালসাপ পোষা যায়, ভক্ত না।’ আর এই পোষ্টের নিচে মন্তব্যের ঘরে নারীকে কাঁঠালের কোয়া ইত্যাদির সাথে তুলনা। ইঙ্গিতগুলি তো খুব দুর্বোধ্য নয়। উদাহরণ আপনি অনেক পাবেন।
এইসব কথা যারা লিখছেন, কেউ একটু স্থূল ভাষায় কেউ সূক্ষ্মভাবে, এরা কিন্তু সকলেই শিক্ষাবঞ্চিত গুণ্ডা প্রকৃতির লোক নয়। সকলেই এরা মৌলবাদী রাজনৈতিক পথের অনুসারীও নয়। শিক্ষিত লোকজন আছেন, দায়িত্বশীল পেশাজীবী আছেন, রাজনীতিবিদ আছেন, শিল্পী সাহিত্যিক আছেন, নারী আছেন, পুরুষ আছেন। এতোগুলি লোক যখন একসাথে একই সুরে বিভিন্ন ফর্মে নারীবিদ্বেষী কথা বলতে থাকেন তার অর্থ কী হয়? তার অর্থ হয় যে নারীবিদ্বেষ বা মিসোজিনি হচ্ছে আমাদের সংস্কৃতির অবিচ্ছেদ্য অংশ, আমাদের সংস্কৃতির নিয়ামক অংশ। অল্প কিছু লোক ব্যতিক্রম আছে, নারীবাদীরা এবং সমাজ পরিবর্তন যারা চায় ওরা। এরা তো ব্যতিক্রম এবং এরা তো বলছেনই যে আমরা সমাজের এইসব বিধান মানি না, বদলাতে চাই। অর্থাৎ মিসোজিনিই হচ্ছে আমাদের সংস্কৃতি, আমাদের সামাজিক মূল্যবোধ, আমাদের সমাজের বৈধ বিধান। যারা বলেন যে মিসোজিনি হচ্ছে সামাজিক অবক্ষয়ের ফল বা নারীর প্রতি অসম্মানজন কথা বলা মানে হচ্ছে সামাজিক অবক্ষয়, ওরা ভুল বলেন। এইটাই সামাজিক বিধান, নারীকে গালি দেওয়াই সামাজিক বিধান, অবক্ষয় নয়।
মিসোজিনিই যে সামাজিক বিধান এইটা বুঝতে পারবেন অরগানিক ইন্টেলেকচুয়ালদের কথা শুনলে। অরগানিক ইন্টেলেকচুয়াল কে? এই কথাটা এন্টোনিও গ্রামসি বলেছিলেন। গ্রামসির কথা হচ্ছে যে সমাজের প্রতিটা মানুষই ইন্টেলেকচুয়াল কারণ সকলেরই কোনো না কোনোভাবে সামাজিক চিন্তার ক্ষমতা আছে। কিন্তু সকলেই ইন্টেলেকচুয়াল হিসাবে সামাজিক দায়িত্ব পালন করতে পারে না। অরগানিক ইন্টেলেকচুয়ালরা সমাজের একটা হেজিমনি তৈরিতে ভূমিকা রাখে আর সেইজন্যে ওরা ব্যবহার করে ঐসব সামাজিক যন্ত্র, যেমন শিক্ষা, সাহিত্য, গণমাধ্যম ইত্যাদি। কারা এই অরগানিক ইন্টেলেকচুয়ালরা? এরা হচ্ছে শিক্ষিত অভিজ্ঞ লোকজন যার নিজের নিজের পেশায় অভিজ্ঞতা দিয়ে সমাজে একটা গ্রহণযোগ্য অবস্থান তৈরি করেছে, যেমন – ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার, বুড়ো আমলা, উকিল, সিনেমার পরিচালক এইরকম লোকজন। এরা অভিজ্ঞতার কারণে সমাজের চিন্তার সূত্রটা জানে এবং সেইটাকে নিজেদের সমর্থন দিয়ে বৈধতা প্রদান করে। এই বৈধতা দেওয়ার কাজটা ওরা করে নিজেরা সমাজের প্রচলিত বিধিবিধান নিজেদের জীবনে মেনে এবং সেইগুলির পক্ষে কথা বলে। অন্যভাবে বললে, এরা হেজিমনিটা তৈরিও করে এবং সেটা বজায় রাখার কাজটাও করে।
আমাদের অরগানিক ইন্টেলেকচুয়ালদের কথা তো আমরা শুনেছি এই সময়ে। ওরাও তো নারীদেরকে গালি দেওয়া, সুযোগ পেলেই স্লাট শেইমিং করা সেগুলির কোনোটা থেকেই বিরত থাকেন না। কেউ মিসোজিনিটা করেন একটু সূক্ষ্মভাবে সরেস কায়দায়, আর কেউ সেইটা পারেন না বলে রুঢ় বহিঃপ্রকাশ ঘটান। কিন্তু নারীকে স্লাট শেইমিং প্রায় সকলেই করেন। কেন করবেন না? ওরা তো সমাজের বিদ্যমান কাঠামোটা ধরে রাখতে চান এবং সেই কাঠামো ধরে রাখতে চাইলে নারীর অবস্থান যে পুরুষের অধস্তন, সেইটাও তো বজায় রাখতে হবে। এইজন্যেই এই হেজিমনি আর এই হেজিমনি বজায় রাখার প্রক্রিয়াটা শুরু হয়ে যায় একদম শুরু থেকেই – একটি শিশুর বুদ্ধি হওয়ার সাথে সাথেই তাকে শেখানো শুরু হয় নারী কী আর পুরুষ কী, আর কে কর্তা আর কে তার অধীন।
একটা শিশু যখন স্কুলে যায়, তখন থেকেই তাকে শেখানো শুরু হয় জেন্ডার রোল- নারী রান্না করবে, নারী সন্তান জন্ম দেবে, সন্তান লালন পালন করবে, পুরুষ বাইরে কাজ করবে, পুরুষ যুদ্ধ করবে ইত্যাদি। ছবি দিয়ে, গল্প দিয়ে, কবিতা দিয়ে, ধর্মীয় বানী দিয়ে, নৈতিক শিক্ষার নামে, সামাজিক শিক্ষার নামে এইগুলিই শেখানো হয় আমাদের শিশুকে- নারী আর পুরুষ এক নয়, নারী অধম পুরুষ উত্তম। নারীকে থাকতে হবে পর্দার মধ্যে, নারীকে থাকতে হবে অনুগত, নারীকে থাতে হবে ঢাকনির নিচে – এইরকম সব কথা। এইসব কথার অবিচ্ছেদ্য অনুষঙ্গ কী? যে, নারী যদি এইসব বিধান না মানে, কোন নারী যদি ভাজা পুঁটিমাছের মত ঢাকনির নিচে শুয়ে থাকতে অস্বীকার করে তাইলে সে হয় যায় সমাজচ্যুত। যে নারী এইসব বিধান অনুসরণ করবে না সে তো তাইলে আর আমাদের সমাজের কেউ না, পবিত্র কেউ না, মায়ের জাত না, বোনের জাত না। তাইলে সে কে? তাকে ডাকতে হবে বেশ্যা বলে। বেশ্যা বলে ডাকতে হবে কারণ দুইটা। প্রথমত নারীর জন্যে যে স্থান পিতৃতন্ত্র নির্ধারণ করে দিয়েছে সেটা যদি সে না মানে তাইলে তাকে তার অবস্থানটা বুঝিয়ে দেওয়া, আর দ্বিতীয় কারণ হচ্ছে তাকে বাচনিক শাস্তি দেওয়া বা তাকে নিগৃহীত করা।
এটাই অনিবার্য। নারীকে এই বিদ্বেষ মেনে নিয়েই জীবন যাপন করতে হয়। না, কিছু পুরুষ যে নারীর প্রতি সহানুভূতিসম্পন্ন থাকেন না, তা নয়। অনেকেই থাকেন যারা নারীর প্রতি সহানুভূতিসম্পন্ন হয় বটে। কিন্তু এই সহানুভূতিওয়ালারাও দেখবেন যে পিতৃতান্ত্রিক বিধান মেনেই সহানুভূতি দেখায়। হয়তো আন্তরিকভাবেই সহানুভূতি দেখায়, কিন্তু পিতৃতান্ত্রিক বিধান মেনেই। পরীমনি প্রসঙ্গেও এইরকম সহানুভুতিওয়ালা ভদ্রলোকেরা বিধান মেনেই দেখবেন মন্তব্য করছেন, নারী মায়ের জাত। ও ভাই, মর্যাদা পাওয়ার জন্যে নারীকে মা হতে হবে কেন? যে নারীটি মা হতে চায় না তার কি মানুষের মর্যাদা পাওয়ার অধিকার নেই? কেউ কেউ দেখবেন যে বলবে, মেয়েটা নষ্ট কিন্তু কে তাকে নষ্ট করেছে ওদেরকে ধরেন। মানে কী? আপনি একজন নারীকে নষ্ট বলছেন এই কথাটার মানে কী? নারী কি গাছের আম? হাঁড়ির রসগোল্লা যে নারী নষ্ট হবে বা পচে যাবে?
সার কথা হচ্ছে ঐটাই, যেটা প্রথমে বলেছি, পিতৃতন্ত্র যতদিন থাকবে ততদিন নারীবিদ্বেষ থাকবে। কোনো কোনো দেশে এর প্রকাশ একটু শোভনভাবে হয়, কোনো কোনো দেশে অশোভন, রূঢ়ভাবে হয়। কিন্তু নারীবিদ্বেষ বা মিসোজিনি থেকে নারীর মুক্তি নাই। অন্তত ততদিন পর্যন্ত নয়, যতদিন না পিতৃতান্ত্রিক সমাজ পাল্টে ফেলতে পারবেন।
[ফেমিনিস্ট ফ্যাক্টরে প্রকাশিত কলাম লেখকের নিজস্ব বক্তব্য]