পুত্র সন্তানকে বড় করতে গিয়ে যে ৮টি ভুল কখনোই করবেন না
হাসিব হক ।। গুডমেন প্রজেক্ট ডটকম নামের একটা সাইটে প্রকাশিত এক আর্টিকেল থেকে জানলাম – ছেলে শিশুকে বড় করার ক্ষেত্রে কোনোভাবেই আটটি ভুল করা যাবে না। পড়ে অনেক কিছু জানলাম, বেশ চিন্তা করার খোরাক রয়েছে। আমি যা পড়লাম সেটা শেয়ার করলে সম্ভবত সবার কাজে আসবে, তাই নিজের মতো করে গুছিয়ে লেখার চেষ্টা করলাম। দিনশেষে আমরা চাই আমাদের বাচ্চারা “মানুষ” হোক; ট্যালেন্টেড, সফল আর ধনী হবার চেষ্টায় শেষ অব্দি পুরুষতান্ত্রিক হয়ে না উঠুক।
আপনি হয়তো ভাবছেন আপনি প্যারেন্টিং ভাল জানেন। কিন্তু সত্য হলো সবচেয়ে বুদ্ধিমান বাবা মাও সন্তান বড় করতে গিয়ে অনেক রকম ভুল করে। বিশেষ করে সন্তানটি যদি পুত্র সন্তান হয়। বিশেষ করে সমাজে প্রচলিত স্টেরিওটাইপগুলো ভাঙাটা খুব কঠিন, তাই ছেলেকে বড় করতে গিয়ে তাকে তথাকথিত পৌরুষের শিক্ষায় দীক্ষিত করে ফেলেন বেশিরভাগ বাবা মা। এটি এড়ানো বেশ কঠিন। ছেলে সন্তানকে পুরুষ নয়, একজন মানবিক বোধ সম্পন্ন মানুষ হিসেবে বড় করতে চাইলে যে ভুলগুলো এড়ানো জরুরি, নিচে তেমন আটটি ভুলের কথা বলা হলো।
১. ছেলেরা মানসিকভাবে শক্ত হবে এমনটা আশা করা:
আমাদের সমাজে, এমনকি সারা পৃথিবীতেই একটা ধারণা কম-বেশি প্রচলিত আছে যে “পুরুষের কাঁদতে নেই!” এটা একটা মারাত্মক ভুল। আবেগকে চেপে রাখা কাজের কিছু নয়, বরং তা মানসিক চাপ তৈরি করে যার ফলাফল খারাপ চেহারায় বের হয় অন্য কোনোভাবে। বাচ্চাদের কখনোই তাদের আবেগকে গিলে ফেলার পরামর্শ দেয়া উচিত নয়। বরং দুঃখ, হতাশা, লজ্জা, গর্ব, ভয়, বিব্রতকর অবস্থা, প্রেম, কামনা, সাহস, নিরাপত্তাহীনতা এ জাতীয় বোধগুলোর সাথে তাদের পরিচিত করা উচিত। প্রয়োজনবোধে নিজের অনুভূতির প্রকাশেও এই শব্দগুলো ব্যবহার করে তাদেরকে বোঝাতে হবে কোনটা আসলে কী।
মনে রাখতে হবে, আনন্দ উচ্ছ্বাসের মতো করে ঋণাত্মক অনুভূতিগুলোও যেন বাবা-মায়ের কাছে তারা নির্দ্বিধায় প্রকাশ করতে পারে সে ক্ষেত্র বাবা-মাকেই প্রস্তুত করতে হবে।
২. ছেলেরা কখনও অনাকাঙ্ক্ষিত পরিস্থিতির শিকার হবে না এমনটা মনে করা:
আমরা আমাদের মেয়ে সন্তানদের আগলে রেখে রক্ষা করতে চাই, সেটা গুরুত্বপূর্ণও। কিন্তু ছেলেরাও কিন্তু অনাকাঙ্ক্ষিত পরিস্থিতির শিকার হতে পারে! প্রতি ৬ জনের ১ জন ছেলে শিশু আঠারো বছর বয়স হবার আগেই অনাকাঙ্ক্ষিত যৌন আচরণের শিকার হয়ে থাকে।
ছেলেদেরকে তাদের শরীরের অঙ্গপ্রত্যঙ্গের সঠিক নাম শেখানোটা গুরুত্বপূর্ণ। সে সাথে ছোটবেলা থেকেই তাদের সাথে বারবার আলোচনা করে বোঝাতে হবে শারীরিক সীমা এবং অনুমতির বিষয়গুলো, যেন তারা বুঝতে পারে যেকোনো সময় নিজেদের শরীরের বিষয়ে ‘না’ বলার অধিকার তাদের আছে। সঙ্গে সঙ্গে ছেলেদের এটাও জানাতে হবে যে তারা যেকোনো বিষয় নিয়ে আপনার সাথে কথা বলতে পারে, এবং তাদের যেকোনো কথা শোনার জন্য আপনি প্রস্তুত আছেন এবং তারা যেন এ ভরসাটুকু পায় যে আপনার কাছে সত্য বলার জন্য তারা বিপদে পড়বে না।
মনে রাখতে হবে, বাবা-মা হিসেবে সন্তানদের সাথে এই বিষয়গুলো নিয়ে কথা না বললে অন্য কেউ বলবে, সম্ভবত তারা সেসব ব্যক্তি নয় যাদের আপনি আশা করেন আপনার সন্তানকে শারীরিক সীমা এবং অনুমতির বিষয়গুলো নিয়ে শেখাতে আসবে।
৩. খেলাধুলায় ভালো হওয়ার জন্য চাপ দেয়া:
খেলাধুলা চমৎকার বিষয়, তবে সবার জন্যে নয়। অবশ্যই বাচ্চাদের ছোটবেলায় সবার সাথে খেলাধুলা করাটা শেখা উচিত, তবে ছেলেকে খেলাধুলায় ভালো হতেই হবে এমনটি নয়। তারা ফুটবলে গোল করলে, বা ক্রিকেট মাঠে ছক্কা পেটালে কিংবা উইকেট নিলে আমরা অবশ্যই খুশি হই, গর্ববোধ করি; তবে তারা যখন খেলাধুলা ছাড়া অন্য কোনো কিছু নিয়ে খেটেখুটে, কাজ করে কিছু অর্জন করে, যা ঠিক কিছু জিতে নেয়ার সাথে সম্পর্কিত নয় – তখনও একই রকম খুশি হওয়া বা গর্ববোধ করা জরুরি।
এবং হ্যাঁ, বাচ্চাদের শারীরিকভাবে সক্রিয় থাকা খুব দরকারি বটে, তবে সেটা সবসময় খেলাধুলার মাধ্যমেই হতে হবে তা নয়। মনে রাখা দরকার – আপনার ছেলে খেলাধুলা করলেও “খাঁটি মানুষ” হওয়ার চেয়ে বেশি জরুরি কিছু কিন্তু নয়! কাজেই কোনো ছেলে বাচ্চা যদি খেলাধুলায় তেমন আগ্রহী না-ই হয়, তাহলে তাকে জোর করার কিছু নেই।
৪. ছেলে সন্তানরা মেয়েদের সাথেই ডেট করার জন্য বড় হবে এমনটি ভেবে নেয়া:
প্রেম, বিয়ে এসব বিষয় নিয়ে কথা বলার সময় লিঙ্গ-নিরপেক্ষ শব্দ ব্যবহার করাটা শুধু সমকামী বা উভকামী নয়, সকল শিশুর জন্যেই উপকারী। এক্ষেত্রে “বিয়ের সময় তখন তুমি আর তোমার স্ত্রী একসাথে সিদ্ধান্ত নেবে” এরকমভাবে না বলে বরং “যখন বড় হবে, তখন তুমি এবং যাকে তুমি বিয়ে করবে, সে আর তুমি একসাথে সিদ্ধান্ত নেবে” বলাটা ভালো।
কেন?
তাতে করে উপকারটা হচ্ছে এই যে – আপনার ছেলে সন্তান যদি সমকামী বা উভকামী হয়, তাহলে সে এটা ভাববে না যে আপনি তাকে স্ট্রেইট হয়ে যাবার জন্য চাপ দিচ্ছেন। আর যদি সে স্ট্রেইটই হয়, তাহলে সম্পর্ক যে শুধু একটা ছেলে আর একটা মেয়ের মধ্যেই হতে পারে এমন বদ্ধমূল ধারণা পোষণ করবে না, সকল প্রকার সম্পর্কের প্রতিই সে সহনশীল এবং সহানুভূতিশীল হবার শিক্ষা পাবে।
৫. ছেলেরা ভয় পায় না এমনটা ধরে নিয়ে কথা বলা:
ছেলেরাও ভয় পায়। তাদের সাথে “ভয় পাওয়ার কিছু নেই” না বলে বরং কী নিয়ে নার্ভাস লাগছে বা ভয় পাচ্ছে সেটা খোলাসা করে প্রকাশ করতে বলুন। তাদেরকে বুঝিয়ে বলুন যে সাহসী হওয়া মানে ভয় না পাওয়া নয়, সাহসীরাও ভয় পায়, কিন্তু তারা যে কোনোভাবেই চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করার ব্যাপারে সিদ্ধান্তটা নিতে পারে।
৬. তারা কখনও কারও ক্ষতি করবে না এমনটি ভেবে নেয়া:
আমরা সবাই সন্তানদের মধ্যে সবকিছু বেস্ট দেখতে চাই। তবে মেয়ে শিশুদের যেমন মমতাবান, সহানুভূতিশীল হতে শেখানো হয়, ঠিক একইরকম ভাবে ছেলে শিশুদেরও সহানুভূতিশীল, মমতাময়, অনুভূতিপ্রবণ হতে শেখানো অত্যন্ত জরুরি, যেন তারা খুব ছোটবেলা থেকেই বুঝতে পারে যে তাদের কোনো কাজের জন্য অন্য কারো কেমন লাগতে পারে।
অনুমতি নেয়ার ব্যাপারটা (consent) ছেলে শিশুদের খুব ভালোভাবে শেখাতে হবে, স্পর্শ বা যেকোনো যৌন আচরণ বা যৌনতার ক্ষেত্রে “হ্যাঁ” ছাড়া অন্য যেকোনো কিছুই যে আসলে “না” – এ ব্যাপারটি তাদের শেখানো জরুরি। তাদেরকে পরিষ্কার করে বোঝাতে হবে যে তার আচরণে যেন কেউ আহত না হয় বা কষ্ট না পায় – এ ব্যাপারে দায়িত্বশীল হতে হবে।
৭. ছেলে শিশুদের সামনে “পেনিস জোকস” বলা:
পেশীবহুল শরীর এবং পুরুষাঙ্গের আকার নিয়ে পুরুষদের উপর সমাজ একটা প্রচণ্ড চাপ তৈরি করে রেখেছে। নিজেদের ছেলে শিশুদের এ ধরনের বডিশেমিং থেকে রক্ষার প্রাথমিক দায়িত্ব বাবা-মায়ের। এই ধরনের বডিশেমিং যেন মনে কখনও স্থান করে নিতে না পারে সেজন্য বাচ্চাদের সামনে কখনওই স্বাস্থ্য, পেনিস সাইজ এসব নিয়ে ন্যূনতম ঠাট্টা-মশকরা বা কৌতুক করা যাবে না। তাছাড়া, অন্যের যৌনাঙ্গ নিয়ে কৌতুক করা এক প্রকার জঘন্য আচরণ, আপনার সন্তান যেন আপনাকে এরকম জঘন্য এবং নিষ্ঠুর আচরণ করতে কখনও না দেখে, এমনকি যদি সেটা কোনো সেলিব্রিটি বা টেলিভিশনের কাউকে নিয়েও হয়, কেননা তারা আপনাকে দেখেই শিখবে এবং নিজেদের আচরণের মধ্যে তা মিশিয়ে ফেলবে।
৮. ছেলেরা বড় হয়ে গেলে তাদের জড়িয়ে ধরা বা আদর করা বন্ধ করে দেয়া:
অনেক সমাজেই ছেলেরা বড় হয়ে গেলে বা বয়ঃসন্ধিতে পৌঁছে গেলে বাবা-মা তাদের স্পর্শ করা, জড়িয়ে ধরা বা আদর করা বন্ধ করে দেন! অবশ্যই বাচ্চারা বিশেষ করে ছেলেরা বড় হয়ে গেলে চেহারায় আর শরীরে শিশুসুলভ আদুরে ব্যাপারটা আর থাকে না, কিন্তু বেশিরভাগ মানুষের জন্যই মানুষের স্পর্শ একটা মৌলিক চাহিদার মতন।
টিনেজ বাচ্চাদের ধরতে গেলে হয়তো তারা বিরক্ত হয়ে সরিয়ে দিতেই পারে, কিন্তু যখন তার ভালোবাসা প্রয়োজন, তখন যে তার জন্য আপনি আছেন, এটুকু তার জানা থাকা প্রয়োজন। ছেলে এবং মেয়ে শিশুরা বড় হয়ে গেলেও তাই hugs and snuggles খুব দরকারি জিনিস।