September 20, 2024
ফিচার ৩মুক্তমত

আপত্তি জানাতে শিখুন, ‘সঠিক’ বলতে কিছু নেই

সামিয়াতুল খান।। আমার কাছে মনে হয় অন্যান্য সব শিক্ষনীয় জিনিসের মত কোনো কিছুতে আপত্তি করতে জানাটাও একটা শিক্ষণীয় বিষয়। এই আপত্তি করতে পারার ব্যাপারটাও আপনাকে আলাদা করে শিখতে হবে। কিন্তু মজার ব্যাপার হল এই আপত্তি করতে পারার শিক্ষাটা অন্যান্য সব শিক্ষার মত ঠিক অ্যাক্টিভ শিক্ষা না, এটা অনেকটা প্যাসিভ শিক্ষা। তবে অ্যাক্টিভ হোক আর প্যাসিভ, এটা আপনাকে শিখতে হবে, শিখতে না পারলে এটার অ্যাপ্লিকেশন আপনি পারবেন না।

বলতে দ্বিধা নেই, এই আপত্তি করতে শেখার শিক্ষাটাই হওয়া উচিত আমাদের সবচাইতে বড় শিক্ষা। সোশ্যাল স্ট্রাকচার অনুযায়ী, বাংলাদেশে এমন একটা নীতি চালু আছে যে ‘প্যারেন্টসরা যেটা বলেন সেটাই ঠিক’। কথাটা যে সত্যি নয় সেটা বুঝতে কষ্ট হবার কথা নয়। কষ্ট  হলে অবশ্য এই লেখাটা আপনার জন্যে নয়। যা হোক, এই যে একটা নির্দিষ্ট গোষ্ঠীকে পরিবারতন্ত্রে সুপ্রিম পাওয়ার দিয়ে তাদের ভুলত্রুটির উর্ধ্বে বসানো, এটার ক্ষতিকর প্রভাব আপনি ততক্ষণ অব্দি বুঝবেন না যতক্ষণ না আপনি আপত্তি করতে শিখবেন। আর যদি আপনি আপত্তি করতে না শেখেন তাহলে আপনি ‘ডিপেন্ডেন্সি ডিসঅর্ডার’-এ পড়ে যাবেন। আস্তে আস্তে আপনার সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতা হারিয়ে যাবে। আপনি হয়তো আপনার পরিবারে আদরের প্রিন্স/প্রিন্সেস সেজে বসে থাকবেন, তবে সেটা হবে দুর্বল অকার্যকর কোনো প্রিন্স।

শুধু এই পরিবারতন্ত্রে না, আপনার উচিত আপনার জীবনের যে কোনো বিষয়ে আপত্তি করতে শেখা। কোনো একটা বিষয় হয়তো আপনার পছন্দ হচ্ছে না। আপনার হয়তো আপত্তি করা উচিত, কিন্তু আপনি কী করলেন? আপনি মেনে নিলেন। এই মেনে নেওয়া আর মানিয়ে নেওয়া শিখতে শিখতে আপনি ভুলে যাবেন, আপত্তি করার মত একটা গুণও আমাদের শেখা দরকার ছিল।

এমনটা মোটেও না যে আপত্তি করতে জানলেই আর আপত্তি করে ফেললেই আপনি ঠিকটাকেই বেছে নেবেন। কিন্তু এমনটা তো অবশ্যই যে আপত্তি করতে জানলে আপনি নিজের সিদ্ধান্ত নিজে নিতে পারবেন। সেই সিদ্ধান্ত যদি আপনার জন্যে ব্যাকফায়ারও করে, সেটার দায় থাকবে শুধুই আপনার। অন্তত কারো সিদ্ধান্তে ব্যাকফায়ারড হওয়ার চেয়ে নিজের সিদ্ধান্তে অটল হওয়া যে অনেক ভাল, এই ধ্রুব সত্যিটা আশা করি আমি কিংবা আপনি সবাই জানি।

মহেন্দ্র সিং ধোনির বাবা চাইতেন তিনি একটা সরকারি চাকরি করে খেয়ে পরে দিন কাটিয়ে দেবেন, শচীন টেন্ডুলকারের বাবা চাইতেন তিনি হবেন মিউজিশিয়ান। শচীন কিংবা ধোনিরা আপত্তি জানিয়েছিলেন, সেই আপত্তির ফল আপনারা দেখতেই পাচ্ছেন। শুধু তাই না, ১৯৭০ সালের ২৬ আগস্ট আমেরিকার ‘ন্যাশনাল অর্গানাইজেশন ফর ওমেন’ অনুভব করেছিল, আমেরিকার তখনকার যে সোশ্যাল স্ট্রাকচার তাতে করে নারীরা যোগ্য সমঅধিকার পাচ্ছে না। তখন তারা আপত্তি তুলল, ৫০ হাজার নারী সেদিন নিউইয়র্কের রাস্তায় বেরিয়ে এসেছিল সমঅধিকারের দাবিতে। এই ঘটনা আমেরিকা মনে রেখেছে ‘ওমেন্স স্ট্রাইক ফর ইকুয়ালিটি’ নামে।

১৯১৫ সালে ইংল্যান্ড ছিল প্রচন্ড রকমের রক্ষণশীল। সে সময়ে ইংল্যান্ডের মানুষ যৌনতাকে পরিমাপও করত রক্ষণশীল কায়দায়। সে সময় ইংল্যান্ডের এই যৌনচিন্তাকে প্রশ্ন তুলে আপত্তি জানিয়েছিলেন হ্যাভলক এলিস। তিনি একটি বইও প্রকাশ করেছিলেন, নাম ছিল ‘সাইকোলজি অফ সেক্স’। বলাই বাহুল্য, এলিসের এই আপত্তিকে ইংল্যান্ডের মানুষ ঠিকভাবে নেয়নি। এলিসের বই প্রকাশের পর সবগুলো কপিই পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছিল, প্রকাশককে অব্দি কঠিন শাস্তি পোহাতে হয়েছিল। পরে এলিসের সব বই প্রকাশিত হয় আমেরিকা থেকে। তবে এলিসের এই আপত্তির ফল কিন্তু পরে ঠিকই বাস্তবায়িত হয়।

চিকিৎসা-বিজ্ঞানের ‘মানি-ডায়মন্ড কন্ট্রোভার্সি’ বলে একটা বিতর্কিত ঘটনা আছে। আমেরিকার জন-হপকিন্স বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক জন মানি মনে করতেন কোনো উভলিঙ্গ মানবশিশুকে শিশুবয়সে সেক্স-চেঞ্জ অপারেশনের মাধ্যমে বদলে ফেলা যায়। সে সময়ে জন মানির তত্ত্ব ছিল, “মানুষের জেন্ডার নির্ধারণে প্রকৃতির কোন প্রভাব নেই, প্রভাব পুরোটুকুই পরিবেশ সঞ্জাত”। জন মানি তার এই তত্ত্বের জন্যে প্রচুর পুরষ্কারেও ভূষিত হয়েছিলেন। তবে জন মানির এই তত্ত্বে প্রথম আপত্তি তোলেন মিল্টন ডায়মন্ড। মিল্টন ডায়মন্ড বলেন, মানুষের যৌনতা নির্ধারিত হয় হরমোন কর্তৃক, পরিবেশ দ্বারা নয়। তবে জন মানি মিল্টনের এই কথাকে একেবারেই গুরুত্ব দিচ্ছিলেন না। তিনি বরং তার পেপার-এর প্রচারণাতেই বুঁদ হয়ে ছিলেন। আর ঠিক সেসময়ে বিবিসি ঠিক করে এর ওপর তারা একটি ডকুমেন্টারি করবে, তবে ডকুমেন্টারি বানানোর শুরুতে বিবিসির চিন্তা ছিল একটু ভিন্ন। বিবিসির মূল লক্ষ্য ছিল, জন মানির কাজকে তুলে ধরা আর মিল্টনের কথাবার্তাকে হালকাভাবে দেখানো। তবে ডকুমেন্টারি বানাতে গিয়ে বিবিসি দেখল, জন মানি তার গবেষণার উদাহরণ হিসেবে ‘ডেভিড রেইমার’ নামক যে ব্যাক্তির উদাহরণ দিয়েছেন, সেটা আসলে পুরোপুরি ‘সফল’ নয়। যেহেতু আমার এই লেখার মূল উদ্দেশ্য মিল্টনের আপত্তি তোলাটুকু, তাই আমি ডেভিড রেইমারের সাথে কি ঘটেছিল সেটা এখানে লিখলাম না। কেউ আগ্রহী হলে গুগলে সার্চ করতে পারেন। চিকিৎসা-বিজ্ঞানে এই ঘটনা বিখ্যাত হয়ে আছে ‘মানি-ডায়মন্ড কন্ট্রোভার্সি’ নামে।

যা হোক, মিল্টন ডায়মন্ডের এই আপত্তি তোলার ফলে যৌনতার সূচক হিসেবে আমেরিকার মানুষের সে সময়ের চিন্তাভাবনা বদলে গেছিল। উভলিঙ্গের মানবশিশুকে ছোটবেলায় সেক্স-রিঅ্যাসাইনমেন্ট অপারেশনের মাধ্যমে বদলে ফেলার মত আকর্ষনীয় সমাধান তাদের কাছে পরে প্রশ্নবিদ্ধ হয়েছিল। তারা জানতে পেরেছিল, সেক্স-রিঅ্যাসাইনমেন্ট অপারেশন পরবর্তী জীবনে কী বিরূপ প্রভাব ফেলে।

এমন আপত্তি তোলার ঘটনা যুগে যুগে ঘটেছে বহুবার। ‘হাংরিয়ালিস্ট মুভমেন্ট’ এর আন্দোলন ঘটেছিল স্রেফ কয়জন কবি আপত্তি তুলেছিলেন বলে। আর সেই ঘটনার পরই বাংলা, উর্দু, তামিলসহ এই উপমহাদেশের বেশ কয়েকটি সাহিত্যের ধারাই পাল্টে গেছিল। কলোনিয়াল মানসিকতা বদলে নতুন করে পুনর্জন্ম ঘটেছিল এই সাহিত্যগুলির।

আমাদের তাই আপত্তি করতে জানতে হবে, আপত্তি করা শিখতে হবে। বুঝতে হবে, অ্যাবসল্যুট ধারা হিসেবে ‘সঠিক’ বলতে কিছু নেই। আমরা যত বেশি আপত্তি করতে জানব, ততটুকু বেশি আমরা নবপ্রভাতের দিকে এগিয়ে যাব। অন্যান্য সব শিক্ষার মত আপত্তি করতে পারার শিক্ষাটাও যে একটি পরম শিক্ষা, এতে কি আর কারো সন্দেহ আছে?

 

[ফেমিনিস্ট ফ্যাক্টরে প্রকাশিত মুক্তমত লেখকের নিজস্ব বক্তব্য]

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *