September 20, 2024
ফিচার ৩মুক্তমত

নারীবাদের সংজ্ঞা ঠিক করে দেবার অধিকার পুরুষতন্ত্রের নেই

পদ্ম আলম  ।। সঠিক গায়ের রং কিংবা শারীরিক গঠন, বাড়ির কাজ, সফল মা, সফল বউমা ইত্যাদি পদের স্ট্যান্ডার্ড নারীদের জন্য ঠিক করে দেয়ার পরও কিছু পুরুষের আঁশ মেটেনি। আজকাল তারা নতুন স্ট্যান্ডার্ড নিয়ে মাঠে নেমেছেন। একটা মেয়ের ঠিক কেমন যোগ্যতা থাকলে সে সমঅধিকারের কথা তুলতে পারে, বই কিংবা সার্টিফিকেটের ভার তার ঘাড়ে ঠিক কীভাবে চেপে বসলে সেটাকে শুদ্ধ নারীবাদ বলা হবে সেই সীমানাও যেন ঠিক করে দিচ্ছে পুরুষতন্ত্র। যেমন ধরুন, একজন মহিলা ডিসি ধর্ষণের শিকার হলে ভিকটিম ব্লেমিং ঠিক যেমন করে হবে, একজন মেগাস্টার নারীর ক্ষেত্রে ব্লেমিং এর পরিমাণটা আরও কয়েকগুণ বেশি হবে। নিজের প্রতি হওয়া অবিচারের জন্য কার আওয়াজ তোলাটা যুক্তিসঙ্গত তা নিয়ে তুলনা টেনে প্রসঙ্গ তুললে দেখবেন, তারা দাঁত খিঁচিয়ে বলছে, ‘‘মেগাস্টার মানে রাতের রানী,আর রাতের নারীকে ধর্ষণ করা জায়েজ”।

আবার কোনো নারীকে প্রকাশ্যে ধূমপান করতে দেখলে তারা সেই নারীর ছবির সাথে তুলনা করবে বেগম রোকেয়া কিংবা অলিম্পিক মেডেল জয়ী কোনো নারীর। মানুষকে বোঝাতে চাইবে, নারীবাদ কোনটা, মানুষকে বলতে চাইবে নারী অধিকারের সীমা কতটুকু। জানাতে চাইবে নারীবাদ গড়ে উঠবে সেই অধিকারগুলো ঘিরে, যেই অধিকারের পতাকা পুরুষ তার হাতে ধরিয়ে দেবে, সে অধিকার নয় যা নারী ছিনিয়ে নেবে নিজ দমে।

ব্যক্তিগতভাবে আমি প্রকাশ্য ধূমপান অপছন্দ করি কারণ প্যাসিভ স্মোকিং একটা সমাজ কিংবা প্রজন্মের জন্য সুখকর কিছু বয়ে আনে না। তা আমার পছন্দের প্রসঙ্গ বাদ থাকুক, কারণ প্রকাশ্য ধূমপান বাংলাদেশে কোনো অস্বাভাবিক ঘটনা নয়, আর আমি যতদূর জানি পুরুষের শরীরে তামাকের সাইড ইফেক্ট থেকে বাঁচার জন্য স্রষ্টা তেমন বিশেষ ব্যাবস্থা করে রাখেননি যার থেকে নারী বঞ্চিত। আর তাই, সমাজ মুখ খিঁচায় শুধুই ধোঁয়া ফুঁকতে থাকা নারীকে দেখে, এবং সেই নারী নারীবাদের একটা ছায়া- এই বিষয়ে তাদের বড় আপত্তি। ফিরে আসি পুরনো প্রসঙ্গে। নারীবাদ মানে নারীর সাথে নারীর তুলনা নয়, নারীবাদের অর্থ শুধু নারীর উচ্চশিক্ষা কিংবা পেশা না, নারীবাদকে সংজ্ঞায়িত করার ভার কুটিল পুরুষের ওপর বর্তায়না যাতে সুকৌশলে তাদের স্বার্থরক্ষা হয়।

যেসব পুরুষেরা ভাবেন, নারী এখন বিলাত যাচ্ছে, দেশ শাসন করছে, পিএইচডি ডিগ্রি বইছে, তবে কিসের এতো চাহিদা এই গলা চড়ানো শিক্ষিত নারীবাদীদের? তাদের উদ্দেশ্যে বলি, বৈষম্য কী তা বোঝেন? সেটা শুধু সমশিক্ষা কিংবা সমপেশার পথে বাধা না।

আপনি যখন রাস্তা দিয়ে হেটে যান, আপনার টিশার্ট-জিন্স আপনার শরীরের ভাঁজ স্পষ্ট করে তুললেও সেটাকে আপনি যেকোনো মেয়ের সাথে বিছানায় শুতে পারেন সেই ট্যাগ হিসেবে ভাবা হয় না। কারণ সমাজ আপনাকে সতী পুরুষ হওয়ার কোনো স্ট্যান্ডার্ড তৈরি করে দেয়নি। আপনাকে “অবজেক্ট” থেকে বিপরীত কিংবা কখনো কখনো নিজ লিঙ্গের কাছে “মানুষ” হবার জন্য আপনার হিপ মাসল কিংবা শরীরের ভাঁজ ঢাকতে হয় না। আপনি দশদিনের ঢাকা টু বান্দরবান ট্রিপ দিলে সেটাকে তারুণ্যের জৌলুস মানা হয়, বেলাল্লাপনা না। আপনার সন্তান বখে গেলে আপনাকে শুনতে হয় না সারাদিন অফিসে আপনার ব্যস্ততাই আজ সন্তানের এই অধঃপতনের কারণ। আপনার জন্য মদ সিগারেট হেলথ হ্যাজার্ড, ক্যরেক্টারের মানদণ্ড না। আপনার মাগরিবের পর বাইরে থাকাটা ধর্ষণ হয়ে বাসায় কিংবা হাসপাতালে ফেরা না। বরং আপনারা অফার হিসেবে কোনো ধর্ষিতাকে (আপনাদের ভাষায়  ইজ্জতহারা) বিয়ে করে নিজেকে “বীর”ও ভাবতে পারেন।

কিছু পুরুষ মনে করেন নারী জীবনে এগিয়ে যাচ্ছে স্বামীর ধমক থেকে নিজের গা বাঁচাতে কারণ গৃহিণী স্ত্রীকে গলা তুলে ধমক দেয়া তারা অধিকার মনে করেন। তা মশাই,আপনি কি পড়ালেখা শিখেছেন বউয়ের থেকে সম্মান পাওয়ার জন্য? নারীকে নারীবাদী করার চেয়ে স্ত্রীবাদী করাটা তাদের আজ বড় লক্ষ্য।
যারা মনে করেন মেডেলজয়ী নারী যে অধিকার চাইতে পারে, সেই একই অধিকার পরীমণির চাওয়াটা অন্যায়। তা আপনি কি মনে করেন স্টিফেন হকিং এর চেয়ে চেইনস্মোকার শিল্পী পাবলো পিকাসো কিংবা মুভিমেকার বং জুন হো  দক্ষতায় অনেকখানি পেছানো? কিংবা এদের একজন তুলিরঙ নিয়ে ঘাঁটলে বিজ্ঞানের “ব” ব্যপারটাও তার কাছে অজানা? নাকি আপনি মনে করেন নিজেকে একজন পুরুষ হিসেবে তার অধিকার আদায় করার দাবি একজন রিকশাওয়ালার চেয়ে একজন সাইন্টিস্টের বেশি?

তাহলে একজন নারী পুলিশ, ডাক্তার, উকিল, সাংবাদিকের সাথে মেহজাবীন, সারিকার তুলনা টানা বন্ধ করেন।পোশাক স্বাধীনতাকে ছোট করে দেখা বন্ধ করেন। শুধুমাত্র আপনার সমকক্ষ হবার জন্য আপনার স্ত্রী পঁচিশ বছর পাঠ্যবইয়ের সাথে সংসার করেছে সেই ধারণা থেকে বের হয়ে আসেন, আপনার ছেলে সন্তান এবং মেয়ে সন্তানকে খাদ্য, পোশাক, শিক্ষা এসব ক্ষেত্রে সমঅধিকার দিয়ে আপনি উল্লেখ করার মতো কিছু করছেন সে ধারণা ডাস্টবিনে ছুড়ে ফেলুন, জীবনটাকে কীভাবে সাজাবে এবং ঠিক কোন বিষয়ে কতটা দক্ষ হলে অধিকার সে চাইতে পারবে এবং অধিকারটা ঠিক কেমন হওয়া উচিত সেসব স্ট্যান্ডার্ড ফিক্স করা বন্ধ করেন। সমশিক্ষা, সমপেশা নারীদের জন্য available বলে সেটা নিয়ে বড়াই করা বন্ধ করেন (উচিত ব্যপার আলাদা করে দেখা হিপোক্রেসি)। একজন নারী অধিকার চায় পুরুষের কাছে কারণ অধিকার দেয়ার ক্ষমতাটা পুরুষের- এই বোকামি ছাড়ুন। মানুষ হিসেবে সম্মান এবং অধিকারের দাবিদার একজন বেশ্যা যতটুকু, একজন নারী ডিসিও ঠিক ততটুকু।

নারীবাদের পায়ে শেকল পরানোর প্রথা থেকে সযত্নে বেরিয়ে আসার চেষ্টা বড্ড জরুরি। কোনো অধিকারের গায়ে আপনি ততক্ষণ কালি ছুড়তে পারবেন না যতক্ষণ তা দেশ ও সমাজের জন্য ক্ষতিকর, এবং কোনো অধিকারকেই আপনি মাথায় তুলতে পারেন না যখন সেটা শুধুই আপনার জন্য সুবিধাদায়ক। প্রত্যেক নারীর বিশুদ্ধ অবদান নারীবাদ, প্রত্যেক নারীর ছুটন্ত স্বপ্ন নারীবাদ, প্রত্যেক নারীর শেকলভাঙা চিৎকার নারীবাদ, প্রত্যেক নারীর তপ্ত কল্যানকর অহংকার নারীবাদ। এবং তা যেকোনো রূপে আসতে পারে। অস্কার হয়ে কিংবা গোল্ডমেডেল হয়ে, হাতকাটা ব্লাউজ হয়ে বা মাথার হিজাব হয়ে, অফিসের নিষ্ঠ কর্মী হয়ে বা মমতাময়ী মা হয়ে, ঠোঁটে জ্বলা সিগারেট হয়ে অথবা কানে গোঁজা ফুল হয়ে। এই পথ ঠিক করে দেবার অধিকার পুরুষতন্ত্রের নেই।

 

[ফেমিনিস্ট ফ্যাক্টরে প্রকাশিত মুক্তমত লেখকের নিজস্ব বক্তব্য]

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *