November 1, 2024
নারীবাদ আলোচনাফিচার ৩

ভিগান ফেমিনিজম: সবার উপরে কেন মানুষ সত্য!

ইকোফেমিনিজমের একটি বড় আলোচ্য বিষয় হলো ভিগান ফেমিনিজম থিওরি, যা  সব ধরনের নিপীড়নের কথা তুলে ধরে। ভিগান ফেমিনিজম শুধু নারীর উপর অত্যাচার নয়, বরং প্রকৃতিতে বিরাজমান সব প্রাণীর উপর নিপীড়ন অবসান ঘটানোর কথা বলে। ভিগান ফেমিনিজম নিয়ে  লিখেছেন ফাতেমা তুজ জোহরা ।।

ভিগান ফেমিনিজম নিয়ে কথা বলার আগে আমরা দুটো জিনিস সম্পর্কে সংক্ষেপে জানবো। এক ভিগানিজম কী, দুই ফেমিনিজম কী, এবং এই দুইয়ের মধ্যে কী সংযোগ রয়েছে।

ভিগানিজম কী?

আমাদের সমাজের পরিপ্রেক্ষিতে আপনি ভিগান বা ভেজিটেরিয়ান এটা শোনার সাথে সাথেই সবার আগে আপনার ধর্মীয় পরিচয় নিয়ে প্রশ্ন তোলা হয়। ভিগান হতে আপনাকে কোনো ধর্মীয় পরিচয় বহন করতে না হলেও নানারকম প্রশ্নের সম্মুখীন ঠিকই হতে হয়। কিন্তু এর সাথে ধর্মের সংযোগ নাও থাকতে পারে। বরং ভিগান হবার পেছনে নানা কারণ থাকে। হতে পারে সেটা স্বাস্থ্য সচেতনতা, হতে পারে পরিবেশ সচেতনতা বা নৈতিকতার দায়; এসব কারণ থেকেও বিশ্ব জুড়ে এখন অনেকেই ভিগান লাইফ বেছে নিচ্ছেন।

যারা শুধুমাত্র ফলমূল, সবজি বা শস্যদানা খেয়ে জীবনধারণ করেন মূলত তারাই ভিগান। প্রাণী হত্যা করে জীবিকা নির্বাহ করা হয় মূলত প্রাণীদেহের পুষ্টিগুণের কারণে। ধর্মীয় কারণ বাদে যারা ভিগানিজম পালন করেন তারা আসলে প্রাণী হত্যা করে বা প্রাণীকে ব্যথা দিয়ে কোনো ধরণের খাবার গ্রহণ করতে চান না। তাই তাদের খাদ্যাভ্যাসে দুধ-ডিম-মাছ-মাংস-মধু এসব কিছুই থাকে না। তার মানে কি তাদের শরীরে প্রয়োজনীয় পুষ্টির অভাব রয়েছে? একদম নয়। উদ্ভিজ্জ বিভিন্ন উৎস থেকে শরীরের প্রয়োজনীয় সব পুষ্টি উপাদানই পাওয়া সম্ভব। তাই ভিগান হলে দ্রুত মারা যাবে, অপুষ্টিতে ভুগবে এগুলো একেবারেই ভ্রান্ত ধারণা।

সহজ ভাষায় ধর্মীয় পরিচয়ের বাইরে যারা ভিগান তাদের মূল উদ্দেশ্য কোনো প্রাণীকে ক্ষতিগ্রস্ত না করা। এখন খুব ছোট পরিসরে নারীবাদ কী ও ভিগানিজমের সাথে এর সম্পর্কের দিকটি তুলে ধরবো।

নারীবাদ কী?

খুব সহজ ভাষায় নারীবাদ বলতে আমরা নারী পুরুষ ও সব লিঙ্গের সমান অধিকার বুঝি। অর্থাৎ, নারীবাদ লিঙ্গ সমতার কথা বলে। নারীবাদ মানে কিন্তু পুরুষ বিরোধিতা নয়। নারীবাদ পুরুষতন্ত্রের সেইসব অন্যায়ের কথা বলে যা আবহমান কাল ধরে নারীর সাথে ঘটে আসছে। নারীবাদের লক্ষ্য সমতা আদায় করা। নারীবাদ সকল নিপীড়িতের পক্ষে কথা বলে, সকলের অধিকারের সমতা চায়। বিশ্বের বিভিন্ন স্থানে নারীবাদীরা নারীদের অধিকার আদায়ের লক্ষ্যে বিভিন্ন ধরনের কাজ করে চলেছেন।

নারীবাদী আন্দোলন মূলত চারটি ধাপে বিভক্ত। প্রথম ধাপের ঢেউ আসে উনিশ শতকের শুরুর দিকে। এ সময় নারীবাদীদের মূল লক্ষ্য ছিলো নারীর ভোটাধিকার ও অর্থনৈতিক অধিকার। এরপর বিশ শতকের মধ্যভাগে নারীবাদ আন্দোলনের দ্বিতীয় ঢেউয়ে ভোটাধিকারের পাশাপাশি জেন্ডার অসমতা দূরীকরণে কাজ করা হয়। ১৯৯০ এর শুরুর দিকে নারীবাদের তৃতীয় ঢেউ শুরু হয় যেখানে আন্দোলনের মূল আলোচ্য বিষয় ছিলো বর্ণবাদ। এরপর ২০১২ সালে আসে চতুর্থ ঢেউ, যা যৌন হয়রানি, নিপীড়ন, ধর্ষণের সংস্কৃতি এবং বডি শেমিং ইত্যাদি বিষয়গুলোতে ফোকাস করে।

ভিগানিজম ও নারীবাদের মধ্যে সংযোগ:

যৌনতা, বর্ণবাদ, শ্রেণিবাদসহ সকল ধরনের নিপীড়নের সাথেই আসলে নারীবাদ যুক্ত। ভিগান ফেমিনিজমের শুরুও এখান থেকেই। মানুষ যেভাবে প্রকৃতি এবং প্রকৃতির অন্যান্য সৃষ্টির উপর আধিপত্য বিস্তার করেছে, ভিগান ফেমিনিজম সেই আধিপত্যের অবসান চায়। নারীর উপর পুরুষতন্ত্রের যে আধিপত্য ও প্রকৃতির উপর মানুষের আধিপত্য, দুটোই কিন্তু এক ধরনের নিপীড়ন, নির্যাতন। সেটা বুঝতে পারলেই ভিগান ফেমিনিজমের মূল প্রতিপাদ্য সহজেই বোঝা যায়।

মানবতাবাদে প্রতিনিয়ত মানুষকে ভালোবাসার কথা বলা হয়। কিন্তু কখনো ভেবে দেখেছেন কি, মানবতাবাদে অন্য প্রাণীদের জায়গা কোথায়? তাদের অধিকারের কথা কোথায় বলা হয়? তাহলে কি অন্য প্রাণীর অবস্থান শ্রেণিবিভাজন অনুযায়ী মানুষের নিচে? মানবতাবাদে মানুষের যতোটা অধিকার, অন্য প্রাণীর কি ততোটা অধিকার রয়েছে? যদি অন্য প্রাণীর মানুষের সমান অধিকার থাকে তবে তারা কেন মানুষের খাবার হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে? কারণ, মানুষ শুধুই অন্য প্রাণীর মতো প্রাণী, আর কিছুই নয়, তাহলে?

আমাদের সমাজে শ্রেণিবিন্যাস তৈরি করেছে মানুষ। সে কারণেই বলা হয় “সবার উপরে মানুষ সত্য, তাহার উপরে নাই”। উপরে, নিচে, ডানে, বামে শ্রেণিবিন্যাসই সমাজে এক একটা স্তর তৈরি করে। আপনি মানুষ হিসেবে যখনই নিজেকে সর্বশ্রেষ্ঠ ভাববেন, তখনই অন্য প্রাণীরা আপনার চেয়ে নিচু স্তরে চলে যাবে। আর এই উঁচু-নিচু স্তরের কারণে অবধারিতভাবে ধরে নেয়া হয় মানুষের চেয়ে অন্য প্রাণীর প্রাণের মূল্য কম, কাজেই তাদের অধিকারবোধও কম।

কোনো প্রাণীকেই মূলত হত্যা করার অধিকার আমাদের নেই, ভিগান ফেমিনিজম এই কথাটিকেই স্বীকৃতি দেয়। আপনি যখন প্রাণী হত্যা করবেন, খাওয়ার জন্য ফার্মিং করবেন, তখন মানুষে মানুষে স্তরভেদে অত্যাচার করার জাস্টিফিকেশনও খুঁজবেন।

প্রাণী হিসেবে মানুষ এবং অন্যান্য প্রাণীর সাথে সুদৃঢ় একটা বন্ধন রয়েছে। এ কারণেই আমরা কুকুর-বিড়াল পুষতে ভালোবাসি, তাদের খেতে কিন্তু ভালোবাসি না। আপনি মানুষ হিসেবে যে মুহুর্তে নিজেকে শ্রেষ্ঠ দাবি করবেন সেই মুহুর্তেই অন্যান্য জীবের সাথে আপনার প্রাকৃতিক যে বন্ধন, সেটি ভেঙে যাবে। এবং এখান থেকেই মূলত প্রাণীহত্যার জাস্টিফিকেশন শুরু।

কুকুর-বিড়াল পোষার কথা বলছিলাম। মানুষের মধ্যে অদ্ভুত কিছু সাইকোলজি কাজ করে। খেয়াল করে দেখবেন, কিছু কিছু প্রাণীর ব্যাপারে মানুষের দারুণ এম্প্যাথি কাজ করে। যেমন, কুকুর, বিড়াল, ডলফিন বা খাঁচায় পোষা লাভ বার্ড। তাহলে সেই একই এম্প্যাথি কী গরু, মুরগি, শূকরের প্রতি কাজ করার কথা ছিল না?

আপনি যদি নির্যাতনের বিরুদ্ধেই কথা বলেন, আপনি যদি নারী অধিকার নিয়েই কথা বলেন, তাহলে আপনার সব ধরণের নির্যাতন বন্ধ করার বিরুদ্ধেই কথা বলতে হবে। ভিগান ফেমিনিজমে কোনো ধরণের প্রাণী শ্রেণীবিন্যাস নেই। এখানে সবাই সমান। তাই কেউ কাউকে অযাচিতভাবে ক্ষতি করার অধিকার রাখে না। যতদিন অর্যন্ত মানুষ অন্যান্য প্রাণীদের হত্যা করবে, নির্যাতন করবে, সেটা যে কারণেই হোক, ততদিন অন্যান্য সব অন্যায়-অবিচারও সমান তালে চলতে থাকবে।

প্রাণী অধিকার খর্ব করা এবং নারী নির্যাতন, এই দুইয়ের খুব কাছাকাছি কিছু মিল রয়েছে। ভিগান ফেমিনিস্ট থিওরি অনুযায়ী মাংস খাওয়াও এক ধরনের পিতৃতান্ত্রিক আধিপত্য। যে আধিপত্য পুরুষকে সহিংস হতে শেখায়। আপনি নারীর প্রতি সহিংস হন, শিশুর প্রতি হন বা অন্য কোনো প্রাণীর প্রতি, ব্যথার ধরণ কিন্তু একই, কাটলে একই রঙের রক্ত বের হয়। কাজেই, যে কোনো সহিংসতার মূলে যে অ্যারোগেন্স আর ভায়োলেন্স রয়েছে তা নির্মূল না করলে নারী অধিকার বা প্রাণী অধিকার কোনোটিই প্রতিষ্ঠিত হবে না।

ক্যারল জে. অ্যাডামস তার বিখ্যাত বই “দ্য সেক্সুয়াল পলিটিক্স অফ মিট: আ ফেমিনিস্ট-ভেজিটেরিয়ান ক্রিটিকাল থিওরি” বইটিতে ভিগানিজম এবং ফেমিনিজমের মধ্যকার সম্পর্কটিকে চমৎকারভাবে উপস্থাপন করেছেন। তার মতে পুরুষতান্ত্রিক সমাজে মাংস খাওয়াও এক ধরনের পৌরুষত্ব জাহির করা। জেন্ডারভিত্তিক সমাজে পুরুষ মাংস খাবে এটাই স্বাভাবিক, নারী সবজি দিয়েও জীবন চালাতে পারে বলে ভাবা হয়! পিতৃতান্ত্রিক সমাজে নারীকে যেমন সেকেন্ড জেন্ডার হিসেবে দেখা হয়, অন্যান্য প্রাণীকেও মানুষের তুলনায় নিচু স্তরের ভাবা হয়। তাই, নারীর প্রতি যৌন সহিংসতা এবং প্রাণী হত্যা করে খাওয়া, এই দুইয়ের মাঝে একটা পিতৃতান্ত্রিক অত্যাচারের আভাস সহজেই পাওয়া যায়।

পিতৃতান্ত্রিক সমাজে সবার উপরে পুরুষ সত্য- ভিগান ফেমিনিজম থিওরি এই চিন্তা ও নিয়মকে অস্বীকৃতি জানায়। এই সমাজে ভিগান ফেমিনিজিম প্র্যাক্টিস করার অর্থ “আমি পিতৃতন্ত্রের শ্রেণীবিভাজন অস্বীকার করি”।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *