November 1, 2024
নারীবাদ আলোচনাফিচার ৩

শুলামিথ ফায়ারস্টোন: শিশুজন্মের বাধ্যতা থেকে নারীর মুক্তি চেয়েছেন যিনি

কারিন আশরাফ ।। 

সাক্ষাৎকার নেওয়া হচ্ছে বুদ্ধিদীপ্ত চেহারার এক তরুণীর। তিনি বলে চলেছেন পৃথিবী নিয়ে তার নতুন আইডিয়ার কথা। তাঁর মতে, শিশুর জন্মদান এক প্রকারের শেকল, গর্ভধারণের বিলুপ্তি চান তিনি। আঁতকে উঠছেন? আরো অবাক হবেন জানলে তাঁর এই সাক্ষাৎকারটি নেওয়া হয়েছিল সেই ১৯৬৯ সালে। কী তাকে প্ররোচিত করেছিল বাক্সের বাইরে চিন্তা করতে?

১৯৪৫ সালে কানাডায় জন্মগ্রহণ করা শুলামিথ ফায়ারস্টোন ছোটবেলা থেকেই পরিবারের সহজাত লিঙ্গবাদের বিরুদ্ধে অবস্থান নিতেন। তিনি পরবর্তীতে দ্বিতীয় তরঙ্গ নারীবাদ আন্দোলনের গুরুত্বপূর্ণ একজন সদস্য হয়ে ওঠেন। লেখালেখি আর আন্দোলনে তিনি ছিলেন সক্রিয়।

ফায়ারস্টোনের কর্মময় জীবন নিয়ে কথা বলার আগে র‍্যাডিকাল এবং দ্বিতীয় তরঙ্গ নারীবাদ সম্পর্কে কিছু কথা বলে নেওয়া শ্রেয়। র‍্যাডিকাল ফেমিনিজম হল সেই মতাদর্শ যেখানে সামাজিক ও অর্থনৈতিক সকল প্রেক্ষাপটে পুরুষের আধিপত্য নির্মূল চেয়ে করা হয়। আর দ্বিতীয় তরঙ্গ নারীবাদ ছিল ১৯৬০ থেকে দুই দশকব্যাপী নারীবাদী আন্দোলন যা মূলত নারী ও পুরুষের সমান অধিকার নিয়ে, এর ব্যাপ্তি ছিল বিশাল।

শিকাগো থেকে আর্ট ডিগ্রি নেওয়ার পরে তিনি তাঁর প্রথম নারীমুক্তি সংঘ, ‘ওয়েস্টসাইড’ প্রতিষ্ঠা করেন। পরবর্তীতে নিউইয়র্কে সহযোদ্ধাদের নিয়ে প্রতিষ্ঠা করেন ‘নিউইয়র্ক র‍্যাডিকাল উইমেন’। এই সংঘটি ইতিহাসকে পুরুষতান্ত্রিক লেন্সের বাইরে গিয়ে দেখার চেষ্টা করত। তাঁদের মতে, ইতিহাসে নারী সবসময়ই নির্যাতিত। সংঘের কার্যক্রমের মধ্যে ছিল একটি মনস্তাত্ত্বিক প্রোগ্রাম। এই প্রোগ্রামে মহিলাদের স্বাধীনচেতা আর স্বনির্ভর হতে উৎসাহ দেওয়া হত। সামাজিকভাবে নারীর মধ্যে যে হীনম্মন্যতা তৈরি হয়ে যায় তা দূর করাই ছিল এই প্রোগ্রামটির লক্ষ্য। তিনি রেডস্টকিংস গ্রুপেরও একজন গুরুত্বপূর্ণ সদস্য ছিলেন।

ফায়ারস্টোনের অ্যাক্টিভিজমের অন্যতম একটি উপাদান হল নারীর প্রজননগত অধিকার ও যৌন পরিতৃপ্তি নিয়ে আলোচনা। গর্ভপাতের অধিকার দাবিতে প্রথম মানববন্ধন কর্মসূচির আয়োজন করেছিলেন তিনি। এই মানববন্ধনে বারোজন নারী গর্ভপাত নিয়ে তাদের ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা শেয়ার করেন। জীবদ্দশায় বহুবার তিনি গর্ভপাত আইনের বিরুদ্ধে আন্দোলন করেছেন, জমায়েত করেছেন এমন জায়গায় যেখানে পুরুষ সঙ্গী ছাড়া নারীদের প্রবেশ নিষিদ্ধ।

সক্রিয় আন্দোলনের পাশাপাশি তিনি লেখালেখি করতেন। তাঁর প্রকাশিত বই ‘দ্য ডায়ালেক্টিক অফ সেক্স’ দ্বিতীয় তরঙ্গ নারীবাদের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ রচনার মধ্যে রয়েছে। এই বইতে তিনি আলোচনা করেছেন কীভাবে নারীর কাছ থেকে তার প্রজননগত অধিকার ছিনিয়ে নেওয়ার মাধ্যমে পুরুষতন্ত্র আধিপত্য করেছে।

জন্মনিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থাগুলো দুর্লভ হওয়ার কারণে নারীরা ধারাবাহিকভাবে শিশু জন্মদানে ও পরে শিশুপালনে ব্যস্ত হয়ে পড়তেন। এতে তারা বাধ্য হতেন পরিবারের পুরুষের মুখাপেক্ষী হয়ে থাকতে। ফায়ারস্টোন এমন একটি পৃথিবী কল্পনা করেছিলেন যেখানে কৃত্রিম উপায়ে শিশু জন্মগ্রহণ করবে ও বেড়ে উঠবে।

আধুনিক যুগে যেখানে নারী-পুরুষের জীবতত্ত্ব দিয়ে অনেক সময় বৈষম্যকে জাস্টিফাই করা হয়, শুলামিথ সেখানে এসব জৈবতাত্ত্বিক পার্থক্যকে শুধু পুরুষতান্ত্রিকতার একটি কারণ হিসেবে দেখতেন। ঋতুস্রাব, গর্ভধারণ, মা ও শিশুর পারস্পরিক নির্ভরতাকে তিনি জৈবিক ফ্যাক্ট হিসেবে এবং এগুলোর কারণে সৃষ্ট শ্রমবিভাজনকে স্বীকার করতেন। কিন্তু তাঁর মতে, “প্রকৃতিতে কোন কিছুই পরম নয়।” মানবসমাজের বৈচিত্র‍্য ও স্থিতিস্থাপকতায় তাঁর আস্থা ছিল অগাধ। তিনি চাইতেন ‘নিউক্লিয়ার ফ্যামিলি’ কাঠামো থেকে সমাজ বের হয়ে আসুক, এমন একটি সমাজের সৃষ্টি হোক যেখানে সাংস্কৃতিকভাবে জৈবিক লিঙ্গ কোনো ফারাক ফেলবে না।

ফায়ারস্টোনের মতে, জৈবিকতার দাস হয়ে থাকার কোন যৌক্তিক কারণ মানুষের নেই। প্রযুক্তির মাধ্যমে প্রকৃতির আদি নিয়মের বাইরে যাওয়ার চেষ্টা মানুষ করতে পারে। প্রযুক্তি নিয়ে শুলামিথের অভিমত ছিল স্পষ্ট। তাঁর মতে, প্রযুক্তির সাহায্যেই লিঙ্গ-শ্রেণিবিভেদ উৎপাটন সম্ভব। পরিবারকাঠামো এবং শিশু জন্মদান প্রক্রিয়ার বিলুপ্তি ঘটিয়ে কৃত্রিম প্রক্রিয়ায় এগুলো পরিচালিত করার মাধ্যমে তিনি চেয়েছেন সমাজে নারী ও শিশুদের অন্তর্নিহিত ক্ষমতাহীনতা দূর করতে। তাঁর মতে, ট্র‍্যাডিশনাল জেন্ডার রোলগুলো থেকে বের হয়ে এগিয়ে যাওয়া তখনই সম্ভব যখন নারীদের নিজ শরীরের ওপর পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ আর সার্বভৌমত্ব প্রতিষ্ঠিত হবে। এর অর্থ এই নয় তিনি মাতৃত্বের বিরুদ্ধে ছিলেন, বরং তার অবস্থান ছিল নারীর বেছে নেওয়ার অধিকারের পক্ষে। তিনি বলতেন, শুধু প্রযুক্তি দিয়ে লিঙ্গভিত্তিক শ্রেণিবিভেদ দূর করা সম্ভব নয়, যদি না প্রযুক্তি নারীর নিয়ন্ত্রণের বাইরে থাকে ও তার চয়েস করার অধিকার ক্ষুণ্ণ করে।

শুলামিথ ফায়ারস্টোনের দৃষ্টিভঙ্গি বর্তমানের দাড়িপাল্লায়ও র‍্যাডিকাল বা চরমপন্থার মনে হতে পারে। তবে এক্ষেত্রে শুলামিথের একটি উক্তি উল্লেখ করা যেতে পারে –

“যখন নারীবাদ সত্যিকার অর্থে এর উদ্দেশ্য পূরণে সফল হবে, তখন সমাজের সবচেয়ে মৌলিক কাঠামোগুলোতেও ফাটল ধরবে।”

কেননা তার মতে, নারীবাদীদের কাজ হল সবধরনের কাঠামোকে প্রশ্ন করা।

বর্তমান যুগে শুলামিথ ফায়ারস্টোনের দর্শন কীভাবে প্রাসঙ্গিক তা নিয়ে আলাপ হতে পারে। যে লড়াই অর্ধশতক আগে ফায়ারস্টোন করেছিলেন, সেই গর্ভপাত এবং জন্মনিরোধক ব্যবস্থার লভ্যতার লড়াই আমাদের আজো করতে হচ্ছে। বর্তমানের পৃথিবী আগের যেকোনো সময় অপেক্ষা প্রযুক্তিতে এগিয়ে। যদিও নারীরা আগের তুলনায় অর্জন করেছে অনেক, ইন্টারনেটের এই যুগে নারীদের সামনে এসেছে নতুন এক চ্যালেঞ্জ। পুরুষশাসিত সমাজে ইন্টারনেটে নিজের অধিকার পোক্ত করা, সাইবারস্পেসে প্রবেশাধিকার আদায় করে নেওয়া, বিভিন্ন প্রযুক্তির ওপরে নারীদের নিয়ন্ত্রণ, আর সর্বোপরি সমতা অর্জনের যে সংগ্রাম, তা কিন্তু সত্তর বছর আগের সেকেন্ড ওয়েভ ফেমিনিজমের প্যারালাল। তাই নতুন করে এখন প্রয়োজন শুলামিথের আইডিয়াগুলোকে আলোচনা ও ব্যাখ্যা করা।

নিজ সময়ের তুলনায় অনেক অগ্রসর এই চিন্তাবিদের মতাদর্শ অনেক প্রশংসা ও সমালোচনা কুড়িয়েছে। বর্ণাঢ্য কর্মমুখর জীবন হলেও ব্যক্তিগত জীবনে মানসিক ও শারীরিক আঘাতের শিকার হয়েছিলেন তিনি। মৃত্যুর আগ পর্যন্ত ভুগেছিলেন সিজোফ্রেনিয়া রোগে। ২০১২ সালে নিজ অ্যাপার্টমেন্টে মারা যান। বিতর্কিত বিভিন্ন প্রস্তাবনা করে থাকলেও একজন নারীবাদী,  অ্যাক্টিভিস্ট ও লেখক হিসেবে তাঁর অবদান নারীমুক্তির ইতিহাসে অনস্বীকার্য।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *