December 18, 2024
ফিচার ২মুক্তমত

জীবন যেখানে অনিশ্চিত, বাল্যবিবাহ সেখানে প্রকট

সাহারা ইসলাম ।। সাম্প্রতিককালে কোভিড-১৯ এর কারণে বাল্যবিবাহ মহামারির রূপ ধারণ করেছে। বাল্যবিবাহ বলতে এমন বিবাহ বোঝায় যেখানে কোনো এক পক্ষ কিংবা উভয় পক্ষই অপ্রাপ্তবয়স্ক। বিবাহের ক্ষেত্রে ১৮ বছর পূর্ণ হয়নি এমন কোনো নারী এবং ২১ বছর পূর্ণ হয়নি এমন কোনো পুরুষ অপ্রাপ্তবয়স্ক হিসেবে গণ্য। বাল্যবিবাহে মেয়ে এবং ছেলে উভয়ের ওপরই প্রভাব পড়ে। তবে মেয়েরাই বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে থাকে। বেশিরভাগ মাতৃমৃত্যুর প্রধান কারণ বাল্যবিবাহ। ১৫-১৯ বছর বয়সী গর্ভবতী নারীদের মৃত্যুর সম্ভাবনা ২০ বছর বয়সী গর্ভবতী নারীদের তুলনায় দ্বিগুণ। আর ১৫ বছরের কম বয়সী গর্ভবতী নারীদের ক্ষেত্রে মৃত্যুর সম্ভাবনা ৫-৭ গুণ বেশি। তাছাড়াও ১৮ বছরের নিচে মেয়েদের অপরিণত সন্তানদানের সম্ভাবনা ৩৫-৫৫%। যখন মায়ের বয়স ১৮ বছরের নিচে তখন শিশু মৃত্যুর হার ৬০%।সেই সাথে অসুস্থ, রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কম থাকা, অপুষ্টিতে ভোগা শিশুর সংখ্যা অনেক বেশি। জনসংখ্যার হার বেড়ে যাওয়ার অন্যতম প্রধান কারণ বাল্যবিবাহের প্রাদুর্ভাব।

এখন আসি বাল্যবিবাহের ইতিহাসে।

ঐতিহাসিকভাবে, বিশ্বব্যাপী বাল্যবিবাহ একটি প্রচলিত প্রথা। প্রাচীন গ্রীসে মেয়েদের কম বয়সে বিয়ে এবং মাতৃত্বে উৎসাহিত করা হতো। সেই সাথে ছেলেদেরও কৈশোরেই বিয়ের জন্য উৎসাহ দেয়া হতো। বাল্যবিবাহ ও কৈশোরে গর্ভধারণ খুবই সাধারণ ঘটনা ছিলো সেসময়। প্রাচীন রোমে মেয়েদের বিয়ের বয়স ছিলো ১২ বছর এবং ছেলেদের ১৪ বছর। মধ্যযুগে ব্রিটিশ আইন অনুসারে ১৬ বছরের পূর্বে বিয়ে সর্বজনস্বীকৃত ছিলো। প্রাচীন ও মধ্যযুগীয় সমাজে মেয়েদের সাধারণত বয়ঃসন্ধির আগেই বিয়ে দেয়া হতো। শিল্প বিপ্লবের আগে ভারত, চীন এবং পূর্ব ইউরোপসহ বিশ্বের অনেক অংশে মেয়েদের বয়ঃসন্ধিতে পৌঁছানোর পরপরই বিয়ে করার প্রবণতা ছিল, যে সমাজে জনসংখ্যার অধিকাংশই ক্ষুদ্র কৃষি সম্প্রদায়ে বাস করতো। সমাজে পুরুষদের দেরিতে বিয়ে করার প্রবণতা থাকলেও মেয়েদের কিশোরী বয়সেই বিয়ে দেওয়া হতো।

UNFPA’র তথ্য মোতাবেক, যেসব কারণ বাল্যবিবাহের জন্য দায়ী তার মধ্যে রয়েছে দারিদ্র্য, অর্থনৈতিক অস্থিতিশীলতা, লিঙ্গ বৈষম্য, প্রচলিত প্রথা বা চর্চা, নিরক্ষরতা, মেয়েদের উপার্জনে অক্ষম ভাবা এবং নিরাপত্তাহীনতা, বিশেষত যুদ্ধ, দুর্ভিক্ষ বা মহামারির সময়। বাল্যবিবাহ হওয়ার নানাবিধ কারণের মধ্যে অন্যতম দরিদ্রতা। দরিদ্র পরিবার মেয়েদের ভরণপোষণের দায়িত্ব পালন করতে না পেরে বিয়েকেই তাদের আর্থিক সুরক্ষার একমাত্র উপায় বলে মনে করে। অথচ প্রতিটি মানব শিশু জন্মানোর পর অন্ন, বস্ত্র, বাসস্থান, শিক্ষা, এবং চিকিৎসা পাওয়া তার জন্মগত অধিকার। আর এসব অধিকার এবং শিশুর চাহিদা পূরণ করার মতো মানসিক এবং অর্থনৈতিকভাবে সক্ষম না হয়েও শিশু জন্মদান এবং তাকে বঞ্চিত করা রীতিমতো সাংঘাতিক অপরাধ এবং শিশুটির প্রতি অন্যায়।

আর এই অন্যায় সংস্কৃতি গড়ে উঠছে দিনকে দিন। অন্যায়কে অন্যায় মানতে নারাজ এসব মানুষের কাছে বংশবৃদ্ধিই শেষ কথা, অক্ষমতা সত্ত্বেও শিশুর জন্ম দিয়ে তাকে বঞ্চিত করা এবং পরবর্তীতে শিশুর জীবন অনিশ্চয়তায় ধাবিত করে, তারা নিশ্চিন্ত হয় উত্তরসূরী রেখে যাওয়ার প্রথা মানতে পেরে। বাল্যবিবাহের আরও একটি বড় কারণ নিরাপত্তাহীনতা। অভিভাবকের ধারণা বিয়ে দেয়া মানেই মেয়ের নিরাপত্তা সুনিশ্চিত করা। যেখানে প্রতিটি নাগরিকের নিরাপত্তা প্রদান করা রাষ্ট্রের দায়িত্ব।

সেই সাথে সমাজে নারীদের প্রতি নেতিবাচক মনোভাব বিলুপ্তিকরণ এবং নারীদের প্রতি হওয়া অন্যায়, যৌন হেনস্থাসহ সকল নির্যাতনের যথাযথ শাস্তির ব্যবস্থা আইনের প্রয়োগই সমাধান।

২০২০ সালের অক্টোবরে UNICEF প্রকাশিত Ending Child Marriage : A profile of progress in Bangladesh শীর্ষক প্রতিবেদন অনুযায়ী বাল্যবিবাহে শীর্ষ ১০ দেশ –

১. নাইজার ২. মধ্য আফ্রিকান প্রজাতন্ত্র ৩. শাদ  ৪. মালি ৫. মোজাম্বিক ৬. বারকিনা ফাসো ৭. দক্ষিণ সুদান ৮. বাংলাদেশ ৯. গিনি ১০. সোমালিয়া।

UNICEF এর হিসেব মতে, সাম্প্রতিক বছরগুলোতে সারাবিশ্বে উল্লেখযোগ্য হারে বাল্যবিবাহ বৃদ্ধি পায়। বর্তমানে বাল্যবিবাহে বিশ্বের শীর্ষ ১০ দেশের মধ্যে ৮ম বাংলাদেশ। বাল্যবিবাহের এই পরিস্থিতি আরও জটিল করে তুলেছে কোভিড-১৯। করোনা মহামারির কারণে স্কুল কলেজ বন্ধ থাকা, অর্থনৈতিক চাপ, ভবিষ্যৎ সম্পর্কে অনিশ্চয়তা এবং বাবা মায়ের মৃত্যুজনিত ঘটনা সবচেয়ে ঝুঁকির মুখে থাকা মেয়েদের বাল্যবিবাহের দিকে ঠেলে দেয়। যদিও কোভিড মহামারির সময়ের পূর্বেও বাংলাদেশে প্রচুর বাল্যবিবাহ সংঘটিত হয়েছে। দেশের প্রায় ৫১ শতাংশ কন্যাসন্তান বাল্যবিবাহের শিকার।

বেসরকারি বিভিন্ন উন্নয়ন সংস্থা ও সামাজিক সংগঠন জনসাধারণ বিশেষ করে প্রান্তিক জনগোষ্ঠীকে সম্পৃক্ত করে সচেতনতামূলক কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছে। ফলে দেশের মানুষের মাঝে বাল্যবিবাহের কুফল সম্পর্কে অনেকটা সচেতনতা গড়ে উঠলেও বাল্যবিবাহের পরিমাণ আশাতীত হ্রাস করা সম্ভব হয়নি। মূলত, বাংলাদেশ এর প্রায় প্রতিটি পরিবার বাল্যবিবাহের কুফল সম্পর্কে সম্যক জ্ঞান রাখলেও এ জ্ঞানের বহিঃপ্রকাশ ঘটায় বা মূল্যায়ন করে এমন পরিবারের সংখ্যা এখনো আশাপ্রদ নয়।

 

[ফেমিনিস্ট ফ্যাক্টরে প্রকাশিত মুক্তমত লেখকের নিজস্ব বক্তব্য]

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *