‘গেরিলা গার্লস’ কারা?
কাজী নাজীফা লামিনূর ।।
আজকের সভ্যতার যে বিকাশ তা বহু ভাঙা গড়ার ফসল। কত আন্দোলন, বিদ্রোহ, বিপ্লব, দর্শন, আদর্শ মানুষের চিন্তা-চেতনা ও দৃষ্টিভঙ্গিকে প্রভাবিত করেছে। ইতিহাস ঘাটলে দেখা যায়, যুগে যুগে বিভিন্ন আন্দোলনের প্রকাশ ও বৈশিষ্ট্যে ছিল নানা বৈচিত্র্যময়তা। তেমনই নারীবাদ আন্দোলনকে বৈচিত্র্যময় করে তুলেছে ‘গেরিলা গার্লস’ নামের নারীবাদী দল। বেনামী এই দলে ভিন্ন উপস্থাপনায় আধুনিক নারীবাদীরা লড়াই করছেন লিঙ্গ বৈষম্য, বর্ণবাদ ও পুরুষতান্ত্রিক শিল্প সংস্কৃতির বিরুদ্ধে। তারা মুখোশ ব্যবহার করেন এবং আড়ালে রাখেন নিজেদের নাম ও পরিচয়। যদিও এর পেছনে রয়েছে সুনির্দিষ্ট উদ্দেশ্য। ‘গেরিলা গার্লস’ এর সদস্যরা মনে করেন এই প্রক্রিয়া ব্যক্তিগত পরিচয় ছাপিয়ে তাদের কাজ ও আদর্শকে মানুষের কাছে মূখ্য করে তুলবে। তারা নাম-পরিচয় লুকানোর জন্য গরিলা মুখোশ পরেন এবং ছদ্মনাম হিসেবে মৃত নারী চিত্রকরদের নাম ব্যবহার করেন। যেমন ফ্রিদা কাহলো, ক্যাথে কোলভিটজ এবং অ্যালিস নীলসহ প্রমুখ ব্যক্তিদের নাম। সমাজে ঘটে যাওয়া বৈষম্য ও দুর্নীতিকে প্রকাশ করার জন্য পোস্টার, বই, বিলবোর্ডের মাধ্যমে তথ্য প্রচার করে গেরিলা নারীরা। আবার জনসাধারণের সামনে মঞ্চায়ন করে সচেতনতামূলক ও চমকপ্রদ প্রদর্শনী। তারা চেষ্টা করে কথাগুলোকে যতটা সম্ভব আকর্ষণীয় ও হাস্যরসাত্মক ভাবে উপস্থাপন করার; যাতে মানুষ সেগুলো বিনোদনের ছলে গ্রহণ করে। তাছাড়া নারীবাদ যে কোনো রসহীন, কাটখোট্টা বিষয় নয়, সেটি মানুষকে জানান দেয় এই নারীরা।
বিশ শতকের দিকে যখন শিল্প আন্দোলন এগিয়ে যেতে শুরু করে, তখন গ্যালারি (শিল্পচর্চা ও প্রদর্শনীর জায়গা)-তে নারী শিল্পী এবং প্রতিনিধির অভাব ছিল। এই গ্যালারিগুলি সাধারণত অভিজাত শ্রেণি, প্রধানত শ্বেতাঙ্গ পুরুষদের দ্বারা পরিচালিত হত, যার ফলে এগুলো শিল্পচর্চা নয় বরং শক্তি কাঠামোতে রূপ নেয়। ১৯৬০ সালে নিউইয়র্কের ‘মেট্রোপলিটন মিউজিয়াম অফ আর্ট’-এর পরিচালক বোর্ড ছিল পুরুষদের নিয়ন্ত্রণে। তখন শিল্প প্রদর্শনের একটি বড় অংশ ছিল নারীকেন্দ্রিক। শিল্পে নারীকে যৌনবস্তু হিসেবে উপস্থাপন করে মানুষকে আকর্ষণ করার চেষ্টা করা হতো। এরপর ১৯৮৫ সালে, শিল্প জগতে যৌনতাবাদ ও বৈষম্যের বিরুদ্ধে সচেতনতা গড়ে তোলার লক্ষ্যে যাত্রা শুরু করে একদল নারী। প্রথম অবস্থায় মাত্র সাতজন নারী সদস্য নিয়ে ‘গেরিলা গার্লস’ শুরু করে ‘মিউজিয়াম অফ মডার্ন আর্ট’-র প্রদর্শনী। নাম দেয়া হয় ‘অ্যান ইন্টারন্যাশনাল সার্ভে অফ রিসেন্ট পেইন্টিং অ্যান্ড স্কাল্পচার’; সেখানে ১৬৫ জন শিল্পীর তালিকায় শুধুমাত্র ১৩ জন নারী অন্তর্ভুক্ত ছিল। সেসময় শিল্প জগতের বিভিন্ন সমস্যা নিয়ে প্রায়শই আন্দোলনে নামতো ‘গেরিলা গার্লস’। বিক্ষোভে সাড়া পাওয়ার পর তারা ম্যানহাটনের ডাউনটাউন জুড়ে পোস্টার লাগিয়ে দেয়। এরপরই শিল্প জগতে বর্ণবাদ রুখতে তারা কাজ শুরু করে। বর্তমানে তারা নিউইয়র্কের বাইরেও প্রকল্প গ্রহণ করেছে, যা তাদেরকে জাতীয় ও আন্তর্জাতিকভাবে যৌনতা এবং বর্ণবাদ মোকাবেলা করতে সক্ষম করে তুলছে। শুধু তাই নয়, কাজের পরিসর বড় করার জন্যে চলচ্চিত্র, জনপ্রিয় সংস্কৃতি এবং রাজনীতিতে যৌনতা এবং বর্ণবাদের চর্চা রোধ করতে কাজ করছে ‘গেরিলা গার্লস’।
এই নারীবাদী দলটি সম্পর্কে যারা কিছুটা জানেন, তাদের অনেকেই প্রশ্ন করেন ; গেরিলা গার্লস কেন গরিলার মুখোশ পরে? উত্তরে তারা বলেন, যখন তারা নিজেদের ছদ্মবেশ নিয়ে ভাবছিলেন তখন দলের একজন সদস্য গেরিলা বানান ভুল করে গরিলা লিখে ফেলে। সেই মুহূর্তেই তাদের মাথায় আসে বানর বৈশিষ্ট্যের শক্তিশালী প্রাণী গরিলার কথা। তারা সিদ্ধান্ত নেয় শক্তির প্রতীক হিসেবে গরিলার ছদ্মবেশ ধারণ করবে। অদ্ভুত এই নারীবাদী দলটির প্রতিবাদের হাতিয়ার তাদের সৃজনশীলতা। নানা আঙ্গিকে পোস্টার ও বিলবোর্ড তৈরি করে তারা বৈষম্য ও বর্ণবাদের বিরুদ্ধে জনমনে সচেতনতা ছড়িয়ে দিতে চায়। তারাই প্রথম জনসাধারণের মনে প্রশ্ন জাগিয়েছে যে, শিল্পের উপাদান হওয়ার জন্য কেন নারীকে সবসময় বিবসনা হতে হবে? পুরুষের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে জাদুঘরে কেন নারীকে যৌনবস্তু হিসেবে প্রদর্শন করা হয়? নারীরা কি কামের প্রতীক ছাড়া আর কিছুই নয়?
এমন সাহসী প্রতিবাদের জন্য গেরিলা নারীরা বেশ মনোযোগ পেতে শুরু করে। মজাদার, হাস্যরসে পূর্ণ পোস্টারের মাধ্যমে অসংখ্য সামাজিক বিষয় সম্পর্কে সচেতনতা গড়ে তোলা এবং সমতার আদর্শ প্রচার করা গেরিলা গার্লস প্রজেক্টের সবচেয়ে বড় অংশ। প্রথম দিকের পোস্টারগুলোতে নারীদের যৌনতা, নারী ও পুরুষ শিল্পীদের বেতনের অসমতা তুলে ধরা হয়। তাদের পোস্টারগুলো প্রকাশ করে যে শিল্প জগতটি অন্যান্য ক্ষেত্রের তুলনায় কতটা যৌনতাবাদী ছিল। ১৯৮৯ সালে প্রকাশিত তাদের আইকনিক পোস্টার যা স্পষ্টভাবে চিহ্নিত করেছে যে ‘মেট্রোপলিটান মিউজিয়াম অব আর্ট’-এর আধুনিক শাখার ৫% এরও কম শিল্পী ছিলেন নারী কিন্তু সেখানকার শিল্পকর্মে শতকরা ৮৫ ভাগই নগ্ন নারী৷ সেই যুগান্তকারী পোস্টারটি গেরিলা গার্লসকে “শিল্প জগতের বিবেক” হিসাবে চিহ্নিত করেছে এবং তারা তখন থেকেই এইভাবে কাজ করে আসছে। তারা এমন শিল্পের চর্চা চায় যা সবসময় সত্য-চালিত। সম্প্রতি শিল্প জগতে লিঙ্গ ও জাতিগত সমতার জন্য ক্রমবর্ধমানভাবে গেরিলা গার্লস সফলতা অর্জন করছে। তাদের অর্জনের ঝুলিতে আছে ‘হুইটনি মিউজিয়াম অফ আমেরিকান আর্ট’ স্বীকৃত ৮৮টি পোস্টার এবং পোর্টফোলিও; গ্যালারি এবং প্রতিষ্ঠানগুলোতে প্রতিনিধিত্বকারী নারী নিয়োগ এবং সংখ্যালঘুদের জন্য অনুকূল পরিবেশ অর্জন।
মিনিয়াপলিসের ‘ওয়াকার আর্ট সেন্টার’ গেরিলা গার্লসের পোস্টারগুলো সংগ্রহে রেখেছে; এছাড়া নগরীর বিভিন্ন দেয়াল, ফোনবুথ এবং গ্যালারিতে প্রদর্শিত হয় পোস্টারগুলো। আর মানুষকে বারবার মনে করিয়ে দেয় শিল্প জগতে অসম প্রতিনিধিত্ব এবং মজুরি বৈষম্যের কথা। কাজের মাধ্যমে গেরিলা নারীরা বহু গুণীজনের প্রশংসা কুড়িয়েছে। মার্কিন নারীবাদী ও রাজনীতিবিদ গ্লোরিয়া স্টেইনেম ‘গেরিলা গার্লস’ এর দীর্ঘদিনের ভক্ত। তিনি বলেন “আমি মনে করি তারা নিখুঁত প্রতিবাদী দল, এবং তারা একঘেয়ে নয়, তাদের ভিতর হাস্যরস আছে।”
গত ৩৬ বছর তারা কাটিয়েছে শিল্প জগতের শক্তির বিরুদ্ধে লড়াই করে, যাদুঘর, গ্যালারি, বৃহত্তর সাংস্কৃতিক ইতিহাসে লিঙ্গবাদ এবং বর্ণবাদ চিহ্নিত করার জন্য পাবলিক আর্ট প্রচারণা তৈরি করেছে। এই মুখোশধারী, বেনামী সমষ্ঠি মার্কিন সংস্কৃতির গতিপথ পরিবর্তন করতে অসামান্য ভূমিকা রেখেছে। তারা এই আদর্শই প্রচার করতে চেয়েছে যে শিল্প ও সংস্কৃতির মান অর্থ দিয়ে অর্জন করা যায়না। চলচ্চিত্র ও সাহিত্যকে যদি শুধুমাত্র ব্লকবাস্টার বা বেস্টসেলার তালিকা দিয়ে পরিমাপ করা হয়, তবে তা সংস্কৃতির দুর্ভাগ্য। শিল্প জগৎ তার প্রকৃত জায়গা থেকে অনেক দূরে চলে গেছে। চার দশক ধরে বিপ্লবের সূচনা এবং ক্রমবর্ধমান পরিবর্তন অর্জনের পর, ‘গেরিলা গার্লস’ এখন আশাবাদী যে তারা হয়তো তাদের আদর্শকে সুপ্রতিষ্ঠিত করতে পারবে।