পিতৃতন্ত্রের চাপে পিষ্ট মীনাকুমারীর জীবন ও কবিতা
মেহেদী হাসান ।। ত্রৈলোক্যনাথের ‘কঙ্কাবতী’ উপন্যাসে কঙ্কা একবার জ্বরের ঘোরে মশাদের রাজ্যে হারিয়ে যায়। সে রাজ্য বলতে পারি রোকেয়ার ‘সুলতানার স্বপ্নে’র মতো। নারী মশারাই রাজ্য চালায়। মেয়েদের কাঙ্ক্ষিত জীবনতো আসলে স্বপ্নে বসবাস। বাস্তবের সঙ্গে এর দুস্তর ব্যবধান। মশাদের রানি কঙ্কাকে জিজ্ঞেস করে, ‘তুমি কে?’ সে বলে, ‘মনুষ্য সমাজে মেয়েরা বিয়ের আগে পিতার সম্পত্তি। বিয়ের পর স্বামীর। এক্ষণে আমার বিয়ে হয়েছে। আমি আমার স্বামী খেতুর সম্পত্তি।’
কবি ও অভিনেত্রী মীনাকুমারীর (১৯৩৩-৭২) মালিকানা নিয়ে ছিল এমনি দ্বন্দ্বের এক বিপর্যয়কর বাস্তবতা। তিনি পিতা ও স্বামী নামের দুই দেয়ালের মাঝের সরু গলিটায় পড়ে গিয়েছিলেন। দেয়াল ভাঙার ক্ষমতা তাঁর ছিল না, বরং পথটা সংকীর্ণ হয়ে পড়ছিল দিনকে দিন। আলোকোজ্জ্বল নাকি আলো ঝলমল বলতে পারি না, তবে এক বর্ণাঢ্য বিলাসিতার ভেতরে টিকে থাকা দস্তয়েভস্কি’র নাস্তাসিয়া ফিলিপোভনা সে, যার মুখের আস্তরণ খসে পড়লে বেরিয়ে আসবে বিষন্ন-ধূসর এক নারী জীবন। পুরো চেহারায় তার রূপ প্রকটিত। সে বিষন্ন জীবনটাই লিখেছেন মীনাকুমারী তাঁর কবিতায়। কি আকুতি প্রকাশ করছেন তিনি দুটো পংক্তিতে : ‘শতাব্দী কেটেছে পড়েনি শীতল এই চোখের পাতা/ উত্তপ্ত কপালে খানিক তোমার গরম তালু রাখো’। এক জীবনে তিনি ‘গরম তালু’ পাননি। না পিতার কাছ থেকে, না প্রেমিক-স্বামীর কাছ থেকে। না, তাঁকে ঘিরে থাকা রংয়ের জগত থেকে।
একবার ফিরাক গোরখপুরী মুশায়রায় মীনাকুমারীকে দেখে কবিতা পড়তে অস্বীকার করেন। বলেন, ‘মুশায়রা কেবল কবিদের জন্য।’ অর্থাৎ মীনা কুমারী কবি নন, হয়তো হিন্দি পপুলার কালচারের প্রদর্শনীর রমণী ভেবেছিলেন তিনি। তাহলে মীনাকুমারী কে? তিনি অভিনেত্রী, হিন্দি ছবির জনপ্রিয় নায়িকা। গান গাইতেন, নাচতেন। আর এসব গুণপনা নিয়ে সেকালে হয়ে উঠেছিলেন হিন্দি ছবির অপরিহার্য নারী চরিত্র। পপুলার কালচারের মোহময় জগতের বর্ণাঢ্য নারীকুল যে কত নিঃসঙ্গ অসহায়, মীনাকুমারীর জীবন আর কবিতা না পড়লে বোঝা যায় না : ‘জীবন চোখ থেকে বেরিয়ে আসা বর্ণহীন ফোঁটা/ তোমার আঁচলের আশ্রয় পেলে অশ্রু হয়ে যেত’। সারাজীবন এ-আঁচলের আশ্রয় খুঁজে বেড়িয়েছেন তিনি। ‘সাহেব বিবি অউর গোলাম’ ছবির সে গানটা, “না যাও ছাইয়াঁ, চুরাকে বাইয়াঁ, কসম তোমহারি, মে রো পড়ুঙ্গি, রো পড়ুঙ্গি” – যেখানে মীনাকুমারীকে আমরা দেখছি প্রবল আকুতি আর অনুনয়ে কাতর হয়ে পড়তে। গানের মাঝে মীনাকুমারীর চেহারার অভিব্যক্তি আর দেহের ভঙ্গি তাঁকে অনন্য এক উচ্চতায় পৌঁছে দেয়। হয়তো নিজের জীবনের সঙ্গে মিল থাকায় এতোটা প্রাণবন্ত হয়ে উঠেছিলেন তিনি। একটা গজলে বলছেন, “খোদার কসম, বেদনাকে ভুলিয়ো না/ একে থাকতে দাও, আমার, এই তো শুধু আমার”।
একান্ত বেদনায় নীল হয়ে ওঠা সময়গুলোতে কবিতা লিখতেন। গোরখপুরী তাঁকে কবি মনে না করলেও গুলজার তাঁর ব্যক্তিগত বেদনা বহন করে চলা কবিতাগুলো মৃত্যর পর একটি গ্রন্থে সংকলিত করেন। সম্প্রতি সফিকুন্নবী সামাদী মীনাকুমারীর কবিতার (২০২২) বইটার মূল উর্দু থেকে বাংলা ভাষ্য প্রকাশ করেছেন। সে বইয়ের কবিতাগুলো দিয়ে আমরা তাঁর জীবনটাকে দেখবো।
মীনাকুমারী বিষন্ন বেদনার এক নারী, পুরুষতান্ত্রিক সমাজের গড়নে নারীর মালিকানার যে প্রসঙ্গ তুলেছিলাম তিনি সে স্বত্বের নির্মম শিকার। মাত্র চার বছর বয়সে শুরু করতে হয় অভিনয়। জীবনের প্রথম ২৫ টাকা পারিশ্রমিক পেয়ে সে টাকায় পরিবারের জন্য খাবার কেনা হয়। সফিকুন্নবী সামাদী জানাচ্ছেন, দরিদ্র পরিবারের জন্য তিনি ছিলেন ‘সোনার ডিম পাড়া হাঁস’। পরিবারকে বাঁচাতে এরপর এটা হয়ে যায় তাঁর পেশা। অথচ তিনি চাইতেন অন্য বাচ্চাদের মতো পড়ালেখা করতে। বলেছিলেন, ‘আমি স্কুলে যেতে চাই।’ জীবনের শুরু থেকে তাঁকে করতে হয়েছে যুদ্ধ। একটা কবিতায় বলছেন, ‘সকাল থেকে সন্ধ্যা / অন্যের জন্য কিছু করে যেতে হবে / যার মধ্যে নিজের লেশ মাত্র নেই/ সেই সাকার চিত্রে রং লাগাতে হবে/ জীবন কী, উদাসী ধোঁয়া, দুঃখের মেঘ/ থেকে থেকে প্রশ্ন আসে মনে/ এ যদি জীবন হয় তবে মৃত্যু কাকে বলে?’ তিনি যখন কবিতা লেখা শুরু করেন তখন তিনি ছিলেন নিঃসঙ্গ, পিতা ও স্বামী দুজনেরই আশ্রয় ছাড়া। একাকী একটা জীবন তাঁর। চারপাশ ঘিরে বিলাসীমহলের বাসিন্দারাও তখন খুব একটা ছায়া মাড়ায় না। কবিতায় বলছেন: ”পথ দেখতে থাকবে শতাব্দী ধরে/ ছেড়ে যাব এই দুনিয়া একা”। একা তিনি ছিলেন না, দরিদ্র মা-বাবার তৃতীয় কন্যা-সন্তান হয়ে জন্মেই পেয়েছিলেন অনাকাঙ্ক্ষিত আগমনের স্বাদ। দরিদ্র পিতা তাঁকে এতিমখানায় দিয়ে দেন। কিন্তু মায়ের কান্নায় অনিচ্ছুক পিতা ফিরিয়ে আনেন শিশুটিকে।
প্রেমে পড়ার পর প্রথমে লুকিয়ে রাখলেন পিতার কাছ থেকে সে সংবাদ। ১৮ বছর বয়সে যখন বিয়ে করলেন প্রেমিক কামাল আমরোহিকে তখন প্রেমিকের বয়স ৩৪। বিবাহিত প্রেমিকের তিন সন্তান। কেমন ছিল তাঁর প্রেমের অনুভূতি? আজ আর জানার উপায় নেই। আমরা বরং তাঁর কবিতায় শরণ নেই। বিষন্ন-বেদনার দিনগুলোতে ছড়াচ্ছেন প্রেমের ঔজ্জ্বল্য : “সে আর আমি/ যখন চুপ হয়ে যাই/ আমাদের না-বলা, না-শোনা কথায়/ তখন দেখতে পাই থেকে থেকে জোনাকির চমক/ আমাদের আলাপের ভাষা তাই/ যে ভাষা/ বৃক্ষদের, ফুলেদের, তারাদের, ঝরনাদের/ এই ঘন বন/ এবং আঁধার রাতের আলাপ যা দিন হলে পরে/ পশ্চাতে ফেলে যায় আলো আর শিশিরের অশ্রু, প্রিয়তম/ আহ্/ প্রেম!”
চেয়েছিলেন বিয়ের সংবাদ গোপন থাকবে। পিতাকে ২ লক্ষ টাকা আয় করে দিয়ে পিতার মালিকানা কিনে আবার সঁপে দেবেন প্রেমিক স্বামীর কাছে। তা আর হয় নি, পিতা জেনে গেলেন সব, জানারই কথা, পিতা তো তাঁর মালিক শুধু নন, প্রধান এজেন্টও। পিতার নির্দেশে তালাক দিতে রাজি হলেন না। স্বামীর ছবিতে অভিনয় করার ইচ্ছে ছিল। পিতা বললেন, “মেহবুব খানের ‘অমর’ ছবির শিডিউল নেওয়া হয়ে গেছে। অন্য কোনো ছবি করা যাবে না”। রাজি হলেন। কিন্তু সে ছবি শেষ করার আগেই পরিচালকের সঙ্গে বনিবনা না-হওয়ায় স্বামীর ছবি করতে হাজির হলেন। স্বামীর ছবি করতে গিয়ে পিতার বাড়ির দরজা চিরতরে বন্ধ হয়ে গেলো তাঁর জন্যে। পিতার সংসারে ছিলেন পিতার নজরদারিতে। আর স্বামী বিখ্যাত আমরোহির সংসারে? স্ত্রীকে নজরদারিতে রাখতে নিয়োগ দিলেন পাহারাদারের। মেকআপ রুমেও পাহারাদার থাকতো, যাতে অন্য কোনো পুরুষ প্রবেশ করতে না পারে। একবার সেটের মেকআপরুমে গুলজারকে প্রবেশ করতে দেখে আমরোহির সচিব বাকার আলী মীনাকে থাপ্পড় মেরে বসেন। স্বামীর হাতে মার খেয়েছেন অনেকবার, কিন্তু এবারের অসম্মান আর ভুলতে পারেন নি। ছোটবোনের বাড়িতে আশ্রয় নেন। আর কোনোদিন ফিরে যান নি স্বামীর সংসারে। একটি গজলে বলছেন, ‘হৃদয় ভাঙার শব্দ শীতল মেঝেতে/ ঝন করে নিশ্বাসের বেড়ি ভেঙেছে।’ আরেকটি গজলে বলছেন, ‘এমন করে ঘুরে দেখো না তুমি আমায়/ তড়পাই, ছেড়ে দাও ঘায়েল মনে করে।’ আর প্রেমকে বুঝে নিতে চাইছেন এভাবে, ” প্রতিটি মোড়ে কেবল দুটো নাম যায় পাওয়া/ মৃত্যু বলো – যদি প্রেম বলতে না পারো”। প্রেম না পেয়ে এ-কবিতার মতো মৃত্যুকে তিনি আলিঙ্গন করেছিলেন। ৩৯ বছরের জীবনটাতে তাই মানুষকে চিনতে পেরেছিলেন। চিনতে পারছিলেন সম্পর্কের রূপ : ‘আমার হৃদয়ের রহস্য জানো তুমি! / আমার জ্বলন্ত উদাস অস্তিত্বের অংশীদার/ তোমার দীর্ঘশ্বাস, তোমার জখম, তোমার সমস্ত বেদনা/ তার সাথে সম্পর্ক আমার, আজ এর সবই আমার’।
মীনাকুমারীর প্রিয় কবি ছিলেন মীর তকি মীর আর ফয়েজ আহমদ ফয়েজ। দু’জন দু’ঘরাণার উর্দু কবি। একজন যদি প্রথাগত উর্দু কবিতার প্রেমের কবি হয়ে থাকেন আরেকজন রাজনীতির। মীনাকুমারীর কবিতার পড়লে তাঁকে মীরের কবিতার নিকট আত্মীয় মনে হবে। তবে তিনি কখনোই উর্দু কবিতার রূপ-রূপকের গভীর জটিল অলংকৃত কবি নন। তিনি বরং নিজের যাপিত-বাস্তবতার সরল প্রকাশ ঘটিয়েছেন কবিতায়। এ কারণে তাঁর কবিতায় তাঁর বেদনাবিধুর জীবনকে যেভাবে পাওয়া যায়, সাধারণ জীবনের গভীর অতল দার্শনিকতা তার থেকে অনেক দূরে। অর্তেগা ই গাসেত যে যাপিত-বাস্তবতা দেখতে চান কবিতায়, কবিতাকে মানবিক করে তোলার জন্যে, মীনাকুমারীর কবিতা সে বাস্তবতার উপস্থাপন। এক সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, ‘নিজেকে সারাজীবন একাই মনে হয়েছে।’ আর একটা গজলে বলেছেন: ”আর সফরসঙ্গী যদি মেলেও কোথাও/ চলছে এখানে দুজনে একা”। এভাবে একা চলতে চলতে পৌঁছে গেলেন মৃত্যুর দুয়ারে : ‘ না আছে প্রেম না প্রয়োজন / মরণ কি এতটাই সুন্দর / মৃত্যুর কোল পাই যদি তবে/ জেগে থাকবার কী প্রয়োজন ‘। চার দশকের কম সময়ের জীবনে পুরুষ ছিল তার একান্ত নির্ভরতা, তবুও তিলতিল করে মৃত্যুর দিকে এগিয়ে যাওয়ার সময় সঙ্গী ছিল কেবল মদ আর দারিদ্র্য। যে পিতৃতন্ত্রের দীর্ঘ ছায়ার নিচে তিনি আশ্রয় নিতে চেয়েছিলেন, সে পিতৃতন্ত্র আসলে নির্মম রোদ, তাতে জ্বলে পুড়ে ছাই হয়ে নিঃশেষিত হন হিন্দি চলচ্চিত্রের এ মহত্তম প্রতিভা। তিনি গাইতে পারতেন, নাচতে পারতেন অভিনয় তো জানতেন আমরা জানিই। স্কুলে না-গেলেও গৃহশিক্ষকের সহায়তায় একাধিক ভাষা শিখেছিলেন, লিখতেন অনিন্দ্য সুন্দর, সরল সব কবিতা, যাতে মূর্ত হয়ে আছে এক নারীজীবনের বিষন্নতার বেদনা। অথচ কোথাও অনুযোগ নেই, নেই কোনো অভিযোগ, নেই কোনো চাপানো দায়বোধ। নিজের ভেতরে নিজেই পুড়েছেন, হয়ে উঠেছেন অক্ষয় পাথর: ‘তোমরা তো মেঘ/ এসেছ হাওয়ার সাথে/ কিছুক্ষণ আকাশে ছেয়ে ছিলে/ ঢেলেছ বৃষ্টি / তারপর দূরে কোথাও গেছ চলে/ আমরা পাথর,/ স্থির নিজের স্থানে / আমরা জানি যে/ যে যায় আসে না সে কখনো ফিরে ‘।