September 20, 2024
কলামফিচার ২

টিপ নিয়ে কথা বলা কি এলিট নারীবাদ?

উম্মে ফারহানা ।। সম্প্রতি (২ এপ্রিল ২০২২) কপালে টিপ পরিহিত কলেজ শিক্ষিক লতা সমাদ্দারকে একজন পুলিশ সদস্য অশালীন ভাষায় গালিগালাজ করেছেন এবং তার পায়ের উপর দিয়ে মোটরবাইক চালিয়ে তাকে শারীরিক আঘাত করেছেন। খবরটি সামাজিক মাধ্যমে ভাইরাল হলে অনেক নারী এমনকি অনেক পুরুষও তাদের প্রোফাইল পিকচারে টিপ পরা ছবি দিয়ে প্রতিবাদ জানিয়েছেন। এই লেখার শিরোনাম দেখেই বুঝতে পারছেন আমার আলাপ এর পরের ঘটনাপ্রবাহ নিয়ে। সামাজিক মাধ্যমে টিপ পরা প্রতিবাদকে খারিজ করার জন্য বেশ কয়েকটি যুক্তি আর প্রশ্ন উঠে এসেছে। যেমন –

১. টিপ পরার জন্য প্রতিবাদ করছেন, চয়েস বলছেন, হিজাব নিয়ে কি এমন বলেন?

২. পুরুষদের টিপ পরে প্রতিবাদ হাস্যকর

৩. দ্রব্যমূল্যের উর্ধগতি নিয়ে কথা বলেন না, পড়ে আছেন টিপ নিয়ে

৪. টিপ আন্দোলন এলিট ফেমিনিজম, এতে নারীর সার্বিক দুর্দশার কোনো উপশম হবে না। শ্রমজীবী নারীর এতে কী লাভ?

প্রথম প্রশ্নের উত্তর – হিজাব পরার জন্য কোনো নারীকে গালিগালাজ শুনতে হয়েছে এমন শুনিনি। হলে অবশ্যই তার প্রতিবাদ করতাম। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের এক উপাচার্য একবার মেয়েদের জিন্স টি শার্ট/ফতুয়া পরা নিয়ে কটুক্তি করায় শত শত মেয়ে ক্যাম্পাসের রাস্তায় নেমে প্রতিবাদ করেছিলেন। তাদের মধ্যে অনেকেই কখনো টি শার্ট বা ফতুয়া পরেন না, ট্রাডিশনাল সালোয়ার কামিজই পরেন, তবুও প্রতিবাদে তারা শামিল হয়েছিলেন। নারীবাদের এই চতুর্থ তরঙ্গে কেউ কাউকে খারিজ করেন না। অল ইনক্লুসিভিটি এ সময়ের জন্য অত্যন্ত প্রয়োজনীয় একটি বিষয়।

দুই নম্বর আলাপটি কোনো প্রশ্ন নয়, এটি একটি মত। এই মতের ব্যক্তিরা ‘প্রতীকী’ ব্যাপারটি বুঝতে পারছেন না। “কপাল আমার, টিপ আমার, কথা বলিস তুই কোন চামার?”  লিখে নিজের টিপ পরা ছবি দিয়েছেন প্রাচ্যনাটের জগন্ময় দাদা। এই স্টেটমেন্ট অত্যন্ত শক্তিশালী এবং এতে প্রকাশ পায় যে ব্যক্তির ইচ্ছা অনিচ্ছার উপর কথা বলার অধিকার কারোই থাকার কথা নয়, এটি ব্যক্তি স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ। কপালে টিপ পরা ছবিতে একটি বর্ণও না লিখে যেসব পুরুষেরা প্রতিবাদ করেছেন সেটা তাদের সংহতি প্রকাশের ভাষা, এটি প্রতীকী। ব্যক্তিগত সাজসজ্জায় তারা টিপ কখনোই পরবেন না। কিন্তু প্রতিবাদ জানাবার জন্য প্রথাবিরোধীভাবে কপালে টিপ ধারণ করার সাহস এবং সদিচ্ছাটুকুকে খারিজ করার কিছু নেই বলে আমি মনে করি।

পলিটিক্যাল কারেক্টনেস বলে একটা কথা আছে। আপনাদের মনে আছে নিশ্চয়ই, সংগীত শিল্পী সোনু নিগম একবার আজানের ধ্বনিকে বিরক্তিকর বলেছিলেন বলে মোল্লারা তার মাথা কামিয়ে পুরষ্কার দেওয়ার কথা ঘোষণা করলে উনি নিজেই নিজের মাথা শেইভ করে ফেলেন। জনাব নিগাম যা বুঝতে পারেননি তা হলো আজানের ধ্বনি অনেক মুসলিমের কাছেও বিরক্তিকর লাগতে পারে বা শেষরাতের ঘুমের ব্যঘাত ঘটাবার মতন ‘ক্যাকোফোনি’ মনে হতে পারে। কিন্তু শিবসেনাদের মুসলিমবিরোধী তাণ্ডব চলাকালীন সময়ে একজন সেলিব্রিটি হিসেবে সাম্প্রদায়িকতা উস্কে দেওয়া এমন বক্তব্য ‘পলিটিক্যালি ইনকারেক্ট’। একইভাবে সংহতি প্রকাশের ভাষা ব্যক্তিগতভাবে অপছন্দের বা হাস্যকর মনে হলেও একে খারিজ করতে চাওয়া পলিটিক্যালি ইনকারেক্ট।

তৃতীয় মতটি আমার কাছে উদ্ভট মনে হয়। কেউ পশুরক্ষা নিয়ে কথা বললে কি আপনি তাকে জিজ্ঞেস করেন ওজোন লেয়ার নিয়ে কথা বলছেন না কেন? কেউ অটিজম নিয়ে কথা বললে কি আপনি তাকে জিজ্ঞেস করেন মেন্টাল হেলথ নিয়ে উনি কেন নির্বাক? কেউ রাসায়নিক সার ব্যবহারের বিরুদ্ধে কথা বললে কি জানতে চান কেন ফসলের হাইব্রিডাইজেশন নিয়ে উনি কিছু বলেন না? একজনকে সব বিষয়ে প্রতিবাদ কেন করতে হবে? আমি নিজে ইকোনমিক্সের-ই জানিনা, বাজার নিয়ন্ত্রণের জন্য কী করা উচিৎ কোনো ধারণা আমার নাই, দ্রব্যমূল্যের উর্ধগতির জন্য মুদ্রাস্ফীতি দায়ী নাকি চাঁদাবাজি তাও আমি ভাল বলতে পারবো না। তো এসব নিয়ে কোনো সুচিন্তিত মতামত আমি কীভাবে দেব? অথচ টিপ পরার জন্য আত্মীয় বন্ধু কলিগ মহলে অনেকবারই আমাকে অনেক কটুক্তি সহ্য করতে হয়েছে। অনেকেই ধর্মীয় পরিচয় জানতে চেয়েছেন, অনেকেই ওয়াজ নসিহত করতে এসেছেন। ব্যক্তিগতভাবে যে ব্যাপারটির ভুক্তভোগী আমি, সেই ব্যাপারটি নিয়ে উচ্চকণ্ঠে প্রতিবাদ আমি করবো না তো কে করবে?

এবার চতুর্থ এবং মূল প্রশ্নে আসি। নারীবাদ নিয়ে পড়াশোনা কম বা সীমিত এমন অনেকেই বলছেন, এই টিপ আন্দোলন এলিট ফেমিনিজম, এটি সিলেক্টিভ প্রতিবাদ, এতে শ্রমজীবী নারীর কোনো লাভ নেই ইত্যাদি প্রভৃতি। আমার প্রশ্ন হলো, এলিট ফেমিনিজম বলতে উনারা কী বোঝাচ্ছেন? এর বিপরীত শব্দ কী? প্রলেতারিয়ান ফেমিনিজম? এহেন কোনো প্রকরণ কি আদৌ আছে কোথাও? নারী দিবসের ইতিহাস থেকে আমরা জানি যে শ্রমজীবী নারীরা কর্মঘণ্টা কমানোর দাবিতে নিউ ইয়র্কের রাস্তায় নেমে বিক্ষোভ প্রদর্শন করেছিলেন এবং ১৪০ জন নারী নিহত হয়েছিলেন বলে সেই দিনটিকে স্মরণ করতে ৮ মার্চ আন্তর্জাতিক নারী দিবস পালন করা হয়। নারীর অধিকার আদায়ের আন্দোলনে শুধু শ্রমজীবী নারীই যে অংশ নিয়েছেন এবং জীবন দিয়েছেন তা কিন্তু নয়। বরং মধ্যবিত্ত, উচ্চবিত্ত আর শিক্ষিত শহুরে নারীদেরও বিবিধ অবদান রয়েছে নারীর রাজনৈতিক সামাজিক আর অর্থনৈতিক অধিকার আদায়ের লড়াই সংগ্রামে। যে বেগম রোকেয়া সাখাওায়াত হোসেনকে আমরা এদেশের নারী আন্দোলনের পথিকৃৎ বলে মানি সেই তিনিও কিন্তু নারীশিক্ষার জন্য স্কুল স্থাপন করেছিলেন মধ্যবিত্ত শ্রেণির জন্যেই। তা বলে তাঁর প্রবর্তিত শিক্ষার অধিকার যে নিম্নবর্গের নারী পায়নি তা কিন্তু নয়। আপনার গৃহকর্মীর কন্যাটি যে বড় হয়ে ‘ঝিগিরি’ না করে অফিসে চাকরি করার স্বপ্ন দেখে বা দেখতে পারে তার কারণ কিন্তু এই যে রোকেয়া কখনো মধ্যবিত্ত নারীর জন্য স্কুল খুলেছিলেন।

দ্বিতীয়ত, নারীর সাজসজ্জা বা পোশাক আশাকের উপর বিধিনিষেধ বা হেনস্তা সহ্য করতে হয় মধ্যবিত্ত বা নিম্নবিত্ত নারীকেই। গার্মেন্টসে বা বাসাবাড়িতে যারা কাজ করেন সেই নারীদের মধ্যে বোরকা ব্যবহারের প্রবণতা বেশি কেননা তাদের পথেঘাটে চলতে হয়, পায়ে হেঁটে বা পাবলিক বাসে নিরাপদ বোধ করেন না বলেই তারা আপাদমস্তক আবৃত হয়ে নিজের চলাচলের স্বাধীনতা নিশ্চিত করতে চান। এলিট নারীর সেই সমস্যা নেই। বোরকা বা হিজাব পরলে তিনি পরেন ধর্মীয় কারণে বা পারিবারিক অনুশাসনে। চলাফেরার জন্য তার গাড়ি আছে, মধ্যবিত্ত নারীর তুলনায় ইভটিজিংয়ের শিকার হবার সম্ভাবনা তার একটু হলেও কম। লতা সমাদ্দার শিক্ষিত মধ্যবিত্ত হলেও তাকে রাস্তায় চলতে হয়। ব্যক্তিগত গাড়ি নিয়ে যাতায়াত করলে তার সঙ্গে এই ঘটনাটি ঘটতো না।

তৃতীয়ত, যে ব্যাপারটি কেউ তুলছেন না তা হলো, টিপ সাধারণত অমুসলিম নারীরা পরেন (মুসলিম নারীরা পরলেও আত্মীয় বা বন্ধু মহলে কটু কাটব্যের শিকার হন কিন্তু সেটা অন্য প্রসঙ্গ)। অমুসলিমরা এই দেশে সংখ্যালঘু। সংখ্যালঘু শব্দটা শুনতে আপনার যতই আপত্তিকর লাগুক, অপমানজনক মনে হোক, এটাই সত্যি যে একজন হিন্দু নারী, পাহাড়ী নারী, বিহারী নারী যতটা প্রান্তিক, একজন মুসলিম নারী তার চেয়ে কম প্রান্তিক। নারীবাদের চতুর্থ তরঙ্গ (ফোর্থ ওয়েভ) এই ইন্টারসেকশনালিটির কথাই বলে। একজন হিন্দু নারী যদি হন শারীরিকভাবে প্রতিবন্ধী কিংবা নমশূদ্র তাহলে তিনি একজন হিন্দু সুস্থ ব্রাহ্মণকন্যার চেয়ে বেশি প্রান্তিক। যে ঘটনা থেকে টিপ আন্দোলনের আরম্ভ, সেই ঘটনাটি ঘটেছে একজন সনাতন ধর্মাবলম্বী নারীর সঙ্গে। পুলিশ সদস্যটি তার সামাজিক অবস্থান কিংবা শিক্ষাদীক্ষার ব্যাপারে অনুমান করতে না পারলেও এটি নিশ্চিতভাবে বুঝতে পেরেছিল যে ভদ্রমহিলা হিন্দু। তার প্রান্তিক হওয়া নিয়ে সচেতন হয়েই সে এই সাহসটি পেয়েছে।

চতুর্থ যে ব্যাপারটি নিয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করতে চাই তা হলো, লাঞ্ছনাকারী যদি পুলিশ সদস্য না হয়ে একজন দোকানদার, একজন ফেরিওয়ালা বা একজন গুন্ডা বদমাশ গোছের কেউ হতো, তাহলে ঘটনা এমন নাও হতে পারতো। লতা সমাদ্দারের ঘুরে দাঁড়ানোর মুখে কেউ না কেউ হয়তো তার পক্ষ নিয়ে সেই লোককে দু’ঘা বসিয়ে দিতেও পারতেন। কিন্তু পুলিশের উর্দি থাকাতে কেউ এমন কিছু করার সাহস পাননি। তার মানে জনগণের সেবা করার দায়িত্ব যে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর হাতে ন্যস্ত তার সদস্যই জনগণকে নির্যাতন নিপীড়ন করছে, অর্থাৎ কিনা রক্ষকই হয়ে উঠেছে ভক্ষক। তো একটি স্বাধীন গণতান্ত্রিক দেশে বসে এই ব্যাপারটিকে যাদের কাছে আশংকাজনক মনে হচ্ছে না, এই ঘটনাটির প্রতিবাদ করা এবং শাস্তি দাবি করা যাদের কাছে যথেষ্ট গুরুত্বপূর্ণ কাজ বলে মনে হচ্ছে না, তারা কোন স্বপ্নের রাজ্যে বাস করেন তা আমার বোধের অগম্য।
নাকি অভিযুক্ত একজন পুলিশ সদস্য বলে রাষ্ট্রদ্রোহিতার মামলা খাওয়ার ভয় করেন এরা? পুলিশ না হয়ে রাম শ্যাম যদু মধু হলে এরাই অন্য সুরে কথা কইতেন? রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে কথা বলার ঝুঁকি নিতে চাননা চাকরি যাবার ভয়ে কিংবা অন্য কোনো ভয়ে? নাকি সংখ্যালঘু নারী হেনস্তা হলে তাদের কিছু এসে যায় না? নাকি কোনো নারী লাঞ্ছিত হলেই তাদের কিছু এসে যায় না? শুধু রোজার মাসে হালিমের দাম বেড়ে গেলেই টনক নড়ে?

প্রশ্ন রেখে গেলাম, যদিও উত্তরগুলো বাতাসে ভাসছে…

[ফেমিনিস্ট ফ্যাক্টরে প্রকাশিত কলাম লেখকের নিজস্ব বক্তব্য]

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *