সিলভিয়া প্লাথের টিউলিপ
সিলভিয়া প্লাথের (১৯৩২-১৯৬৩) টিউলিপ কবিতার অনুবাদ করেছেন মেহেরুন নূর রহমান। বলা হয়, ১৯৬১ এ সিলভিয়া প্লাথ যখন হাসপাতালে অ্যাপেনডেক্টমি (অ্যাপেনডিক্স অপারেশন) থেকে সুস্থ হচ্ছিলেন তখন তাকে উপহার দেয়া একতোড়া টিউলিপ দেখে এই কবিতাটি লিখেছিলেন ।।
টিউলিপ
টিউলিপগুলি দারুন উত্তেজক, এখন এখানে শীতকাল
দেখো সবকিছু কেমন সাদা, কত শান্ত, কেমন তুষারময়
আমি শান্তিকে অনুভব করতে শিখছি, চুপচাপ শুয়ে আছি
আলো এসে পড়ছে আমার হাতে, সাদা দেয়ালে, বিছানায়
আমি কেউ না, বিস্ফোরণের সাথে আমার কোনো সম্পর্ক নেই
আমি আমার নাম এবং রোজকার জামাকাপড় দিয়ে দিয়েছি নার্সদের
অ্যানেস্থেটিস্টদের দান করেছি আমার ইতিহাস এবং সার্জনদের আমার দেহ
তারা বালিশ এবং চাদরের ভাঁজে আমার মাথা রেখেছে
যেন দুটি সাদা ঢাকনার মধ্যে একটি চোখ, বন্ধ করা যাবে না
মূর্খ চোখের তারা, ওকে সবকিছু নিজের ভেতরে ধারণ করতে হবে
নার্সরা চারপাশে আসে যায়, তাদের নিয়ে কোনো সমস্যা নেই
তারা সাদা টুপি পরে এদিক ওদিক ঘুরে বেড়ায়
হাত দিয়ে কাজ করে যায়, একই রকম, একটি অন্যটির মতোই
এরা কতজন, গুনে বলা সম্ভব না
আমার শরীর তাদের কাছে একটি নুড়ি পাথর, তারা এটিকে পরিচর্যা করে
যত্ন করে পানি ঢালে, আলতো করে মসৃণ করে
এরা সুচালু সূঁচের আঘাতে আমাকে অসাড় করে, আমাকে ঘুম পাড়িয়ে দেয়
এখন আমি আমাকে হারিয়ে ফেলেছি, আমি অসুস্থ
আমার পুরোনো চামড়ার বাকসো কালো ওষুধ-বক্সে পরিণত হয়েছে
আমার স্বামী এবং সন্তানরা পারিবারিক ছবিতে হাসছে
তাদের হাসি আমার শরীরকে জড়িয়ে ধরে ঝুলতে থাকে
আমি সবকিছু চলে যেতে দিচ্ছি, একটি ত্রিশ বছরের মালটানা নৌকা
যার গায়ে একগুঁয়েভাবে আমার নাম এবং ঠিকানা ঝুলছে
তারা আমাকে প্রেমময় সম্পর্কগুলো থেকে দূরে সরিয়ে দিয়েছে
সবুজ প্লাস্টিকের বালিশওয়ালা ট্রলিতে ভীত এবং অনাবৃত আমি
আমি দেখি, আমার চা বানানোর সরঞ্জাম, আমার কাপড়ের স্তুপ, আমার বই
দৃষ্টির বাইরে সব ডুবে যায় এবং জল গড়িয়ে যায় আমার মাথার উপর দিয়ে
আমি যেন এখন একজন সন্ন্যাসী, এতটা শুদ্ধ আমি কখনোই ছিলাম না
আমি কোনো ফুল চাইনি, শুধু চেয়েছিলাম
হাত ছড়িয়ে শুয়ে থাকতে এবং একেবারে শূন্য, নিরুত্তাপ হতে
এটা যে কত মুক্তি, তুমি জানো না কতটা পরিত্রাণ
এই শান্তিময়তা এতো বড় যে এটি তোমাকে হতবুদ্ধি করে দেবে
এবং এটি কিছুই প্রত্যাশা করে না, শুধু একটি নাম, কিছু ক্ষুদ্র অলংকার
এটা শেষ পর্যন্ত মৃতদের কাছাকাছি নিয়ে আসে, আমি তাদের কল্পনা করি
তাদের মুখ বন্ধ করে দেই যেন কোনো ধর্মীয় দীক্ষার নিয়ম মত
প্রথমত টিউলিপগুলো খুব বেশি লাল, এই উজ্জ্বলতা আমাকে আঘাত করে
এমনকি উপহারের মোড়ানো কাগজের ভেতর দিয়ে আমি তাদের নিঃশ্বাসের শব্দ শুনতে পাই
হালকাভাবে, সাদা বাধা ফিতের ভেতর থেকে, যেন একটি বিরক্তিকর শিশু
তাদের রক্তিমতা আমার ক্ষতের সাথে কথা বলে, যোগাযোগ করে
তারা সূক্ষ্ম, মনে হয় ভাসমান, যদিও তারা আমাকে পরিমাপ করে
তারা তাদের রঙ এবং আকস্মিক জিহ্বা দিয়ে আমাকে বিপর্যস্ত করে তোলে
যেন আমার ঘাড়ের চারপাশে এক ডজন জালের লাল ভারি সিসার পাথর
আমাকে আগে কেউ লক্ষ করতো না, এখন করে
টিউলিপগুলি আমার দিকে মুখ ঘুরিয়ে থাকে এবং আমার পিছনে জানালা
যেখানে দিনে একবার আলো ধীরে ধীরে প্রসারিত এবং সংকুচিত হয়
এবং আমি নিজেকে দেখি, নিরস, হাস্যকর, কাটা কাগজের মত ছায়া
সূর্য এবং টিউলিপের চোখ, এই দুইয়ের মধ্যে
এবং আমার কোন মুখ নেই, আমি নিজেকে মুছে ফেলতে চেয়েছি
প্রাণবন্ত টিউলিপ আমার অক্সিজেন শুষে নেয়
তারা আসার আগে বাতাস ছিল শান্ত
আসা-যাওয়া, শ্বাস-প্রশ্বাস, কোনোরকম ঝামেলা ছাড়া
তারপর টিউলিপগুলো ভরিয়ে দিলো চারপাশ প্রবল কোলাহল দিয়ে
এখন থমথমে বাতাস তাদের চারপাশ ঘিরে থাকে নদীর মত
যেন ঘিরে আছে একটি ডুবে যাওয়া মরিচা-লাল ইঞ্জিনের চারপাশে
তারা আমার মনোযোগ কেন্দ্রীভূত করে, যা সুখকর
কোনোরকম প্রতিশ্রুতি ছাড়া খেলে এবং বিশ্রাম করে
এছাড়া, দেয়ালগুলোকেও মনে হয় নিজেদের উষ্ণ করছে
টিউলিপগুলিকে বিপজ্জনক অপরাধীদের মতো কারাগারের পিছনে রাখা উচিত
তারা তাদের মুখ খুলে হা করে থাকে ভয়াবহ আফ্রিকান বিড়ালের মতো
এবং আমার হৃদয় জানে তারা তাদের মুখ খোলে এবং বন্ধ করে
আমার প্রতি প্রচণ্ড ভালোবাসায় প্রস্ফুটিত লাল ফুল ভর্তি পাত্র
আমি যে জলের স্বাদ পাই তা সমুদ্রের মতো উষ্ণ এবং লবনাক্ত
আর তা আসে সুদূর দেশ থেকে সুস্বাস্থ্যের নামে