November 21, 2024
সাহিত্যফিচার ৩প্রবন্ধ

বাংলা সাহিত্যে নারীবাদ

সৌমেন সরকার ।। ‘নারীবাদ’ বা, ‘ফেমিনিজম’ শব্দটি ফরাসী দার্শনিক চার্লস ফুরিয়ে সর্বপ্রথম ১৮৩৭ খ্রীষ্টাব্দে ফ্রান্সে ব্যবহার করেন। ‘ফেমিনিজম’ শব্দটি ফরাসি ‘ফেমিনিন’ থেকে এসেছে যার অর্থ নারী এবং এই শব্দের সাথে ‘ইজম’ বা, ‘বাদ’ প্রত্যয় যুক্ত হয়ে ‘ফেমিনিজম’ এ পরিণত হয়। নারীবাদী বলতে যে, শুধু নারীদেরকেই বুঝানো হয় এই ধারণা ভুল। যে কোনো লিঙ্গের মানুষ নারীবাদের প্রচার ও প্রসারে কাজ করে থাকলে তাকেও নারীবাদী হিসেবে অভিহিত করা হয়।

অধিকাংশ নারীবাদী বিশ্বাস করেন, যে সমস্ত আন্দোলন নারীর অধিকার রক্ষা ও তাদের অবস্থান পরিবর্তনের লক্ষ্যে কাজ করেছে, তাদের প্রতিটিকেই নারীবাদীদের আন্দোলন রূপে গণ্য করা উচিত। জুডিথ অ্যাস্টেলারা নারীবাদ সম্পর্কে তাঁর Feminism and Democratic Transition In Spain বইতে বলেছেন, “নারীবাদ হচ্ছে সামাজিক পরিবর্তন ও আন্দোলনের লক্ষ্যে একটি পরিকল্পনা, যা নারী নিপীড়ন বন্ধ করার নিমিত্তে চেষ্টা করে থাকে”। সেই সূত্র ধরে, বাঙালি যত কবি-সাহিত্যিক তাঁদের নিজ নিজ লেখনী শিল্পগুণে নারীদের উপর চলতে থাকা শোষণ, বঞ্চনা আর অবহেলিত হওয়ার কথা সমাজের সামনে তুলে ধরে যেভাবে পরিবর্তনের আভাস দিয়ে গেছেন, তাতে করে তাঁরাও নারীবাদী। সাহিত্য যেহেতু সমাজের দর্পণ স্বরূপ সেহেতু এতে সমাজের নারীদের বাস্তব চিত্র ফুটিয়ে তোলা হবে এটাই ছিল স্বাভাবিক। কিন্তু একই সাথে সমাজের মোড়লদের রক্তচক্ষু উপেক্ষা করে, নিজেদের উপন্যাসের মধ্য দিয়ে কালজয়ী ঔপন্যাসিকরা অত্যন্ত দায়িত্ববোধের সাথে স্বীয় সৃজনশৈলীতায় চপেটাঘাত করেছেন দাম্ভিক পুরুষ-শাসিত সমাজব্যবস্থাকে এবং একই সাথে সামাজিক প্রেক্ষাপটে এঁকেছেন নারীর নতুন চরিত্র, যা কিনা  নারীর চিরাচরিত অবলা, অসহায়, কন্যা , স্ত্রী কিংবা মায়ের রূপে নারীদের উপর চাপিয়ে দেওয়া সাংসারিক কাজের চেয়ে ভিন্নতর।

বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের “দুর্গেশ নন্দিনী” উপন্যাসে আয়েশা, পরিবারের চাপানো বাগদান অস্বীকার করে, সেবা করতে গিয়ে ভালোবেসে ফেলে বিধর্মী জগৎসিংহকে। সেই সময়ের বাস্তবতায় এই চরিত্রের নিজের জীবনসঙ্গী নির্বাচনের সিদ্ধান্ত ছিল এক অনন্য দৃষ্টান্ত। “বিষবৃক্ষ” উপন্যাসে অনাথ ও বিধবা কুন্দনন্দিনী, তৎকালীন হিন্দু সমাজের চাপানো বঞ্চনা আর কঠোরভাবাপন্নতা না মেনে হয়েছে বিদ্রোহী এবং পেতে চেয়েছে সেই সব কিছু যার থেকে সেই সময়কালে বঞ্চিত থাকতো অন্যান্য সকল বিধবারা। “কৃষ্ণকান্তের উইল” উপন্যাসে বিধবা রোহিণী, নিজের ভালোবাসার মানুষ বিবাহিত গোবিন্দ লালকে পাওয়ার জন্য যে তৎপরতার ছবি ফুটে উঠেছে তা সেই সময়ের প্রেক্ষাপটে ছিলো দুর্লভ। “দেবী চৌধুরাণী” উপন্যাসের রূপবতী ও গুণী প্রফুল্ল, এক সাধারণ দরিদ্র পরিবারের মেয়ে বলে বারবার শ্বশুড়বাড়িতে লাঞ্চিত হয়, তবু তার সংগ্রাম থেমে থাকে নি। ডাকাত সর্দার ভবানি পাঠকের আশ্রয়ে হয়ে উঠেন দুর্ধর্ষ ডাকাত দেবী চৌধুরাণী এবং তাকে সংগ্রাম করতে দেখা যায় ইংরেজ শাসনের বিরুদ্ধে, যা ঐ সময়ে নারীর চরম শক্তিমত্তা ও সাহসিকতার পরিচয় দেয়।

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তাঁর ছোটগল্প “হৈমন্তী”তে যেভাবে হৈম’র করুণ পরিণতির কথা তুলে ধরেছেন ঠিক তেমনি অপর ছোটগল্প ‘দেনা পাওনা’ তে নিরূপমা চরিত্রটির মধ্য দিয়ে তৎকালীন সমাজের সবচেয়ে ভীতিকর ব্যাধি পণ প্রথার বিরুদ্ধে অবস্থান নিখুঁত কল্পে ফুটিয়ে তুলেছেন। “নষ্টনীড়” গল্পে চারূলতাকে সুখী হওয়ার বাসনায় সামাজিকভাবে অস্বীকৃত সম্পর্কের বাঁধনে জড়াতে দেখা গেছে যা ছিল নিজের ইচ্ছার বাস্তবায়নে এক আদর্শিক দ্বন্দ্ব। “চোখের বালি” উপন্যাসে বিনোদিনী, ভোগে-ভালোবাসায় কোমলে কঠিনে চিরাচরিত অবলা নারীর চরিত্রকে অস্বীকার করেছে অবলীলায়। “স্ত্রী’র পত্রে” মৃণাল একজন সন্তানহীন, বুদ্ধিদীপ্ত, চরম ব্যাক্তিত্বসম্পন্ন এক চরিত্র।  মৃণালের আশ্রিত দরিদ্র মেয়ে বিন্দুর প্রতি মৃণালের স্বামী ও শ্বশুড়বাড়ির লোকজন ক্রুদ্ধ আচরণ করায় সে সংসার ত্যাগ করতেও পিছপা হয় না। উল্লেখযোগ্য বিষয় হচ্ছে সমকামীতার ইঙ্গিতও রবীন্দ্রনাথ এখানে দিয়েছেন। এছাড়াও কবিগুরুর “শেষের কবিতা” র লাবণ্য কিংবা “গোরা” র সুচরিতা চরিত্রের মধ্য দিয়ে আধুনিকা নারী চরিত্রের জন্ম দিয়েছেন সুনিপুণভাবে।

মীর মশাররফ হোসেন এর “বিষাদ-সিন্ধু” উপন্যাসে প্রণয়াকাঙ্খী এজিদের বাহুবলের প্রদর্শনের পাশাপাশি জায়েদার নিজের অধিকারের দাবি আদায়ের পরাক্রম ছিলো দৃষ্টিনন্দিত। লেখকের আত্মজীবনীমূলক উপন্যাস “উদাসীন পথিকের মনের কথা”য় সাহসী নারী জমিদার প্যারীসুন্দরীর কথা বর্ণিত হয়েছে, যার উদ্ধারকর্তা হিসেবে আবির্ভাব,ফসলের জমিতে নীলচাষের অত্যাচারে জর্জরিত প্রজার দুঃখে কাতরতা, অসীম সাহসিকতা এবং বুদ্ধিদীপ্ত পদক্ষেপ নারীর শক্তিকেই প্রতিষ্ঠিত করেছে। শরৎচন্দ্রের “দেনা-পাওনা” উপন্যাসে ষোড়শীর, ঋজু চরিত্রের ভারে উদ্দেশ্যহীন ব্যভিচারী জমিদার জীবনানন্দকে অনেকবার পর্যুদস্ত হতে দেখা যায়। এছাড়াও লেখকের “চরিত্রহীন” এর কিরণময়ী কিংবা “পথনির্দেশ” এর হেমনলিনী চরিত্রের মধ্য দিয়ে ফুটে উঠেছে নারীদের অপার বুদ্ধিমত্তা ও পরনির্ভরতাকে অস্বীকার করার প্রবণতা।

বেগম রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেন রচিত উপন্যাস “সুলতানা’স ড্রিম” আজ ইংরেজী সাহিত্যে প্রথম ফেমিনিস্ট ইউটোপিয়ান উপন্যাস হিসেবে সমাদৃত যেখানে তিনি নারী পুরুষের কর্ম আর ধর্ম পাল্টাপাল্টি করে চলতি সমাজ ব্যবস্থা ভেঙ্গে গড়েছেন, কারও সহানুভূতির আশায় বসে থাকেন নি। নারীর পূর্ণ মুক্তির জন্য যে এক নতুন জগতের প্রয়োজন তা বেগম রোকেয়া এক কল্পরাজ্য সৃষ্টি করে দেখিয়েছেন।

আশাপূর্ণা দেবীর “প্রথম প্রতিশ্রুতি” উপন্যাসে সত্যবতীর মাধ্যমে সমাজ ব্যবস্থার মূল কাঠামো, বিবাহ প্রথা ও নারী পুরুষের সম্পর্ক অবলীলায় অস্বীকার করেছেন। “সুবর্ণ” উপন্যাসে সুবর্ণের মধ্য দিয়ে লেখিকা দেখিয়েছেন সমাজ কাঠামো পরিবর্তনের পথ কতটা জটিল হতে পারে, পিতৃতান্ত্রিক সমাজ যেভাবে নারীকে আষ্ঠেপৃষ্ঠে জড়িয়ে রেখেছে তা থেকে মুক্ত হতে হলে সাহস ও কৌশল দুইই চায়। মহাশ্বেতা দেবীর “দ্রৌপদী” গল্পে দ্রৌপদী মেঝেন, “স্তন্যদায়িনী” গল্পে যশোদা চরিত্রের জীবনের মধ্য দিয়ে নারীর অধিকার বিচ্যুতির মাত্রা যে কখনোই একই রকম হতে পারে না তা ফুটে উঠেছে।

সত্তর দশকের পরে তসলিমা নাসরিনের নানা গল্প ও লেখা যেমন আমার মেয়েবেলা, শাড়ী ও ব্লাউজ, লজ্জা , উতল হাওয়া ইত্যাদিতে নারীদের স্বাধীনচেতা দৃষ্টিভঙ্গি, নারীবাদী রাজনৈতিক দৃষ্টিকোণ তুলে ধরার পাশাপাশি তীব্র স্বরে সমাজে নারী অবহেলার কৈফিয়ত চেয়েছেন এবং নারীবাদের জয়গান গেয়েছেন। এছাড়া বেগম সুফিয়া কামাল, রাবেয়া খাতুন, দেবারতি মিত্র, মল্লিকা সেনগুপ্ত, জয়া মিত্র এমন অনেকেই নিজেদের লেখার নারীবাদের স্বকীয় চর্চা অব্যাহত রেখেছে। যেমন মল্লিকা সেনগুপ্ত তাঁর “সীতায়নে” মহাকাব্য রামায়ণকে নতুন আলোকে উপস্থিত করেছেন, যেখানে মুখ্য চরিত্র রাম নয় বরং  সীতা। এক মাতৃতান্ত্রিক সাম্য সমাজকে আগ্রাসী আর্য রাষ্ট্রতন্ত্র কেমন করে পুরুষ শাসনের কব্জায় নিয়ে এলো তারই গল্প “সীতায়ন”।

চিন্তাধারা হিসেবে নারীবাদ ধ্রুব কিংবা সার্বজনীন ব্যাপারটা এমন না। বরং দেশ,কাল,পাত্র ভেদের ভিত্তিতে বিভিন্ন গোষ্ঠির সমাজ ব্যবস্থা, রাজনৈতিক ইতিহাস এবং ঐতিহাসিক কাল এ সবই নারীবাদের সংজ্ঞা রচনা করতে সহায়তা করে। খোদ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে শ্বেতাঙ্গ মেয়েদের নারীবাদের দর্শন কৃষ্ণাঙ্গদের দর্শন থেকে ভিন্ন এবং যথেষ্ট রকম পৃথক। ঠিক সেই রকম তৃতীয় বিশ্বের নারীবাদী দর্শন প্রথম বিশ্বের নারীদের চিন্তাধারা থেকে বেশ কিছুটা দূরে সরে থাকবে বলাই বাহুল্য। এই তফাৎ মেনে নিয়ে নারীবাদের মুখ্য উদ্দেশ্য যা নিজেদের অবস্থার উন্নতি তথা নারী পুরুষ সম অধিকারের দিক নির্দেশক, অর্জনের লক্ষ্যে বাংলা সাহিত্যে সাহিত্যিকদের অবদান অনস্বীকার্য।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *