জিন জিয়ান আজাদি – নারী জীবন ও স্বাধীনতা
ইমতিয়াজ মাহমুদ ।। ইরানে নারীদের একটা বিদ্রোহ শুরু হয়েছে এবং এই পর্যন্ত আমরা যেসব খবর পেয়েছি তাতে মনে হচ্ছে বিদ্রোহের আগুন প্রজ্বলিত হয়েছে ইরানের সর্বত্র। তেহরানে বিক্ষোভ তো হচ্ছেই, তেহরানের বাইরেও অধিকাংশ বড় শহরে এবং অনেক ছোট শহরে ও শহরতলিতে বিক্ষোভ করছে নারীরা। নারীদের সাথে যোগ দিয়েছে ইরানের গণতন্ত্র ও স্বাধীনতাকামী তরুণ যুবাসহ সর্বস্তরের মানুষ। কী হচ্ছে এইসব বিক্ষোভে? নারী পুরুষ সকলে শহরের সড়কে জমায়েত হচ্ছে, মিছিল করছে, শ্লোগান দিচ্ছে, নারীরা খুলে ফেলছে ওদের হিজাব বোরকা আর নিক্ষেপ করছে সেগুলি আগুনে। নারীদের অনেকেই মাথার চুল কেটে বিসর্জন দিচ্ছে, কোথাও কোথাও দেখা গেছে নারীদের কেটে ফেলা লম্বা চুল পতাকার মতো করে ফ্ল্যাগস্ট্যান্ডে ঝুলিয়ে দিয়েছে কেউ কেউ। কোথাও কোথাও সড়কের মাঝখানে আগুন জ্বালিয়ে সেটাকে ঘিরে বিক্ষোভ করছে নারী পুরুষ সকলে মিলে। সুর করে গাইছে, শ্লোগান দিচ্ছে ‘জিন, জিয়ান, আজাদি’; ফারসি এই শ্লোগানটির বাংলা করলে যেটা দাঁড়ায় ‘নারী, জীবন স্বাধীনতা’।
বলাই বাহুল্য যে এই বিক্ষোভ শুরু হয়েছে মাআশা আমিনির মৃত্যু থেকে। বাইশ বছরে ফুটফুটে মেয়ে মাআশা আমিনি অনেক দূরের একটা ছোট শহর থেকে বেড়াতে এসেছিল তেহরানে। ওর সাথে ছিল ওর ছোট ভাই। তেহরানে মোরাল পুলিশ ওকে ধরেছে। কেন? ওর মাথার হিজাব নাকি যথাযথ ছিল না। ধরে ওরা মাআশাকে ওদের ডিটেনশন সেন্টারে নিয়ে যায়। সেখানে মাআশা অসুস্থ হয়ে পরলে ওকে হাসপাতালে নিয়ে যায় পুলিশ। মাআশার পরিবারের অভিযোগ হচ্ছে যে ডিটেনশন সেন্টারে মাআশাকে মারধোর করা হয়েছে। মৃত্যু হয়েছে মেয়েটার। বিবিসির সাথে কথা বলতে গিয়ে মেয়েটার বাবা কাঁদছিল, ওর মেয়েটা ভাল ছাত্রী ছিল, আধুনিক ছিল, সে মাইক্রোবায়োলজি পড়তে চেয়েছিল – ইরানের নারীর স্বাধীনতাবিরোধী আইন আর মোরাল পুলিশ মিলে এই মেয়েটাকে বাঁচতেই দিল না। এরপর থেকেই ইরানের নারীরা বিক্ষোভ শুরু করে। এখন তার সাথে যুক্ত হয়েছে স্বৈরাচার পতনের দাবি।
ইরানে নারীদের উপর এই বিশেষ ড্রেস কোড বাধ্যতামূলক করা হয়েছে ওদের ইসলামি বিপ্লবের পর। শুধু নারীদের পোশাক নয়, নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয়েছে নারীদের সাজসজ্জার উপর এবং চলাফেরার উপরও। এছাড়া ইরানের নানারকম ঐতিহ্যবাহী সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের উপরও। এমনকি ওরা ইরানের হাজার বছর ধরে চলে আসা নওরোজ উৎসবের উপরও বিধিনিষেধ আরোপ করার চেষ্টা করেছিল, কিন্তু মানুষের বাধার মুখে সেটা আর করতে পারেনি। কিন্তু নারীদের উপর নানারকম নিষেধাজ্ঞা ঠিকই চাপিয়ে দিয়েছে। ইরানের মেয়েরা সবসময়ই মধ্যপ্রাচ্যের অন্যান্য এলাকার মেয়েদের চেয়ে অপেক্ষাকৃত আধুনিক ছিল, ফলে মেয়েরা এইসব বিধিনিষেধ খুব সহজে মানতে চায়নি কখনোই। এই কারণেই মেয়েদেরকে বাধ্য করার জন্যে ইরানের ইসলামী সরকার তৈরি করেছে মোরাল পুলিশ যাদের কাজ হচ্ছে রাস্তাঘাটে মেয়েদেরকে চোখে চোখে রাখা, ওরা আইনে নির্ধারিত ড্রেস কোড ইত্যাদি মেনে পোশাক পরেছে কিনা। ইরানের বড় শহরের মেয়েরা যেটা করে, ওরা পশ্চিমা পোশাক আশাক পরে ঠিকই, কেবল বাইরে বেরুবার সময় উপরে একটা বড় ওভারকোটের মতো পরে আর মাথায় স্কার্ফ দিয়ে ঢেকে রাখে। ঘরে গিয়ে ঐ কোটটা খুলে ফেললেই আবার জিনস বা স্কার্ট বা ঐসব পোশাক বেরিয়ে আসে।
তেহরানে কিছুদিন বাস করেছেন এরকম এক বন্ধুর সাথে কথা হচ্ছিল ইরানের এইসব বিচিত্র বিধিনিষেধ নিয়ে। তিনি জানালেন কিছু মজার কথা। যেমন, ইরানে মেয়েদের নেইল পলিশ পরা নিষেধ, কারো হাতে নেইল পলিশ পাওয়া গেলে জরিমানা আদায় করা হয়। মেয়েরা ঠিকই নেইল পলিশ পরে বের হয়। বের হওয়ার সময় পকেটে করে টাকা নিয়ে যায়। রাস্তায় বের হয়েই ওরা নিজেরাই গিয়ে পুলিশকে হাত দেখায়, এই দেখো আমি নেইল পলিশ পরেছি, বল কত টাকা জরিমানা দিতে হবে? এইরকম চলতে চলতে একসময় পুলিশরাও ক্লান্ত হয়ে গিয়ে মেয়েদেরকে আর চট করে নেইল পলিশের জন্যে বিরক্ত করে না।
এই যে জোর করে নারীদের উপর ড্রেস কোড চাপিয়ে দেওয়া, সাজসজ্জার উপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা এইটা তো অন্যায়। এটা হচ্ছে মানুষের স্বাধীনতার উপর হস্তক্ষেপ করা, নারীদের স্বাধীনতা সীমিত করার চেষ্টা করা। নারীরা সেটা মানবে কেন? ইরানের নারীরা প্রথম থেকেই এইসব নিবর্তনমূলক বিধিবিধান মানতে চায়নি। পুলিশ দিয়ে, মিলিটারি দিয়ে জোর করে ওদেরকে এইসব বিধান মানতে বাধ্য করা হয়েছে ঠিকই, কিন্তু বিচ্ছিন্নভাবে হলেও ইরানের নারীরা এইসব নিয়ম ভেঙেছে, প্রতিবাদ করেছে সবসময়ই। প্রতিবাদ করতে গিয়ে অনেক নারী অধিকার কর্মীকে প্রাণ দিতে হয়েছে, ইরান ছাড়তে হয়েছে, নির্যাতনের শিকার হতে হয়েছে, কারাগারে আছে এখনো অনেকে – কিন্তু বিদ্রোহ চলমান আছে ঠিকই। আয়াতুল্লাহ খোমেনির ইসলামী বিপ্লবের ঠিক পরপরই ১৯৭৯ সনের মার্চের শুরুতে নারী দিবস পালন করার জন্যে তেহরানে যান কেট মিলেট। কেট মিলেটকে আপনারা জানেন, তাঁর Sexual Politics বিশ্বব্যাপী নারীবাদের দ্বিতীয় তরঙ্গের সূচনায় গুরুত্বপূর্ণ একটি গ্রন্থ ছিল এবং তিনি নিজে আমেরিকার নারীবাদী আন্দোলনের গুরুত্বপূর্ণ নেতা ছিলেন। সে বছর ৮ই মার্চে তেহরানের রাস্তায় ইরানের নারীরা কেট মিলেটকে সাথে নিয়ে নারী দিবসের শোভাযাত্রা করে আর দাবি করে যে ইরানে নারীদের অধিকারের উপর যেন হস্তক্ষেপ করা না হয়। আয়াতুল্লাহ খোমেনি এবং ইরানের সরকার নারীদের এই দাবি মানেনি, নারীদেরকে ইরানের সমাজ রাজনীতি ও অর্থনীতিতে কোণঠাসা করা হয়, ওদের অধিকার খর্ব করা হয় এবং ইরানের নারীদেরকে ঠেলে দেওয়া হয় অবরোধের আড়ালে।
নারীদের বিদ্রোহ ইরানের ইসলামী বিধানাবলিকে হঠাতে পারেনি, আন্দোলনের ব্যাপকতাও সবসময়ই খুব বেশি হয়তো ছিল না, কিন্তু বিদ্রোহ সবসময়ই ছিল। ইরানে মেয়েদের উপর নিষেধাজ্ঞা ছিল ওরা স্টেডিয়ামে যেতে পারবে না খেলা দেখতে, আন্দোলন করেই ওরা সেই নিষেধাজ্ঞা সরিয়েছে। ২০১৯ সনে নানা দাবি-দাওয়ায় ইরানে ব্যাপক বিদ্রোহ হয়েছে। ইরানের সরকার শক্ত হাতে নৃশংসভাবে সেই বিদ্রোহ দমন করেছে। রয়টারের হিসাবে সেই আন্দোলনে ১৫০০ মানুষ নিহত হয়েছে। এবারের আন্দোলনটাও বেশ ব্যাপকতা লাভ করেছে এবং অনেক জায়গায় পুলিশে ও অন্যান্য সরকারি বাহিনীর সাথে আন্দোলনকারীদের সংঘর্ষ হয়েছে। এ পর্যন্ত আটজনের মৃত্যুর সংবাদ পাওয়া গেছে, মৃতদের মধ্যে পুলিশও আছে। সরকার ইতিমধ্যে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলি বন্ধ করে দিয়েছে এবং অনেক জায়গায় ইন্টারনেট সংযোগও বন্ধ করে দিয়েছে। ধারনা করা হচ্ছে যে আজ বা আগামীকাল থেকে মিলিটারিও মোতায়েন করা হবে। ভাষ্যকাররা বেশিরভাগই বলছেন যে সরকার এবারও শক্ত হাতে জোর করে এই আন্দোলন দমন করবে। কিন্তু এই আন্দোলন আরেকবার প্রকাশ করে দিল যে মানুষের স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ করলে মানুষ সেটা মেনে নেয় না, মানুষ তার অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্যে বারবার লড়াই করতে নামে।
ইরানের এই বিক্ষোভ থেকে আমাদের শেখার বিষয়টা খুবই স্পষ্ট। নারীরা হিজাব পরবে কি পরবে না সেটা প্রশ্ন সেটা নয়। নারীরা পর্দা করবে কি করবে না সেটাও প্রসঙ্গ নয়। মূল কথাটা হচ্ছে যে জোর করা যাবে না। কেউ যদি হিজাব বোরকা এইসব পরতে চায় সে পরবে আর যদি কেউ এগুলি পড়তে না চায় সে পরবে না। আপনি জোর করে হিজাব পরাতে পারেন না আবার জোর করে হিজাব খুলতেও পারেন না- দুইটাই অন্যায়, জোর করা যাবে না। নারী কি পোশাক পরবে সেটা নারীর নিজের সিদ্ধান্ত। নারীর শরীরের মালিক নারী নিজে, নারী কি পোশাক পরবে সেই সিদ্ধান্তও নারীর নিজের। মুল বিষয়টা হচ্ছে স্বাধীনতা- স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ করাটা অন্যায়। কোন গোষ্ঠীর যদি মনে হয় যে না, নারীর জন্যে পর্দা করাটা উত্তম, ওরা সেইটা নিয়ে প্রচার করতে পারে, আলাপ করতে পারে, মতামত দিতে পারে। কিন্তু কেউ হিজাব পরেনি বলে আপনি কাউকে হেনস্তা করবেন, সেটা তো অপরাধ, শাস্তিযোগ্য অপরাধ।
ইরানের নারীরা ইরান জুড়ে আগুন জ্বালিয়ে দিয়েছে, বিদ্রোহের আগুন। ভাববেন না যে কেবল মাথার হিজাব সরিয়ে ফেলার দাবিতে এই আগুন জ্বলছে বা কেবল মাআশা আমিনির মৃত্যুর প্রতিবাদেই এই আন্দোলন সীমিত থাকবে। এটা হচ্ছে স্বাধীনতার আন্দোলন এবং মানুষ হিসাবে নারীর মর্যাদার আন্দোলন। ওদের শ্লোগানটা লক্ষ্য করুন – জিন জিয়ান আজাদি বা নারী জীবন ও স্বাধীনতা। এই তিনটা শব্দতেই বোধগম্য হয় নারীর এই আন্দোলনের গভীরতা। তিন শব্দের এই শ্লোগান তো পৃথিবীব্যাপী সকল নারীর মুক্তি সংগ্রামের একটা সাধারণ সঙ্গীতেরই অংশ আরকি। এই শ্লোগান কি আমাদের দেশের নারীদেরও শ্লোগান নয়?