“মহিলা মানুষকে কেন উঠালেন?”
হালিমা আক্তার বৃষ্টি ।। নারীরা এখন পিছিয়ে নেই কোনো ক্ষেত্রেই। তবে কেন সমাজ আমাকে “মহিলা” বলে গালি দেয়?
কারণ এখনো সমাজে পুরুষতান্ত্রিক মনোভাব নারীদেরকে বিকলাঙ্গ ভাবে। আমাদের উন্নতি তখনই হবে যখন নিজেদেরকে একজন স্বাধীন মানুষ হিসেবে ভাবতে পারবো। পুরুষতান্ত্রিক চেতনাকে দুমড়ে মুচড়ে সমাজে সমতা বিধান করতে আমরাই পারবো। কিন্তু একজন বাঙালি নারী হয়ে আমি তার নিশ্চয়তা কোথায় পাবো?
সাধারণ লোকাল বাসে একজন নারী হলে যাত্রী হিসেবে আপনাকে দেখতে চায়না কেউ। সেই বাসে দাঁড়িয়ে কিংবা বসে থাকা সকলেরই একই অবস্থা। চালক এবং হেল্পারকে তো বাদই দিলাম। বাসে উঠতে বাধা দেয় প্রতিটা মূহুর্তেই। মাঝ রাস্তায় এক কথায় বিপদে ফেলেই পাড়ি জমায়। এ অধিকার তাদের কে দিয়েছে?
যখন ধস্তাধস্তি করে বাসে উঠি তখন আমাকে উদ্দেশ্য করে বলা হয় “ড্রাইভার সাহেব, মহিলা মানুষকে কেন উঠালেন?”
কিন্তু আমি তো মহিলা বলে তাদেরকেই চিনি যারা মহলে থাকেন। নিজেদের কোনো স্বাধীনতা ছিল না তাদের। যারা চার দেয়াল বন্দি।
আমি তো মহলে থাকি না, আমি মহিলা নই। আমি মানুষ এবং আমি নারী। আমাকে গালমন্দ করে, নিচু করে, আত্মবিশ্বাস হারিয়ে দমিয়ে রাখতে পুরুষতান্ত্রিক সমাজ এই ২০২৩ সালে এসেও পিছিয়ে নেই। তাদের শিরায় মিশে আছে আমাকে নিয়ন্ত্রণ করার একচ্ছত্র অধিকারের ইচ্ছে।
তাদের ধারণা একজন নারীকে বাসে তুললে তাদের রোজগার কমে যাবে। কিন্তু তারা বার বার ভুলে যাচ্ছে ইতিহাসে প্রতিটি ক্ষেত্রে নারীদের অবদান। তারা ভুলে যাচ্ছে তাদের জন্মের পেছনে একজন মায়ের অবদান। যিনি একজন নারী। তার সাথে বৈবাহিক বন্ধনে আছে একজন নারী। হয়তো তার সন্তানও একজন নারী এবং তার ঘরে রয়েছে বোন, একজন নারী।
এই কড়া সময়ে এসেও শুচি-অশুচি’তে নারীর অবস্থান ভয়ংকর। নারী হিসেবে তারা আমায় অশুচি বলেই গণ্য করছে। কেননা আমি নারী। পুরুষজাতির সামনা সামনি দাঁড়ালে হয় সে অপবিত্র হয়, না হয় তার জাত যায় এবং সম্মানহানি হয় এমনি ভাব করে গনপরিবহনের সুশীল পুরুষজাতি।
যখন এই প্রশ্ন তাদের করা হয়, “কেন বাসে আমাকে উঠতে বাধা দেয়া হচ্ছে?”
তখন তাদের উত্তরে থাকে –
– বাসে জায়গা নেই
– শরীরে শরীরে ধাক্কা লাগলে আপনারাই তো চিল্লিয়ে প্রতিবাদ করবেন
– আপা আপনাদের তো কষ্ট হবে তাই তো বারণ করলাম
– পরের বাসে আসুন ঐটায় জায়গা আছে
– আপনাদের “মহিলা” এবং প্রতিবন্ধী সিট ফিলআপ
– আপনি পুরুষ ভর্তি বাসে নিরাপদ নন।
তাহলে আমি নিরাপদ কোথায়?
এর উত্তরে বলা হয় –
– আমার পা আছে, আমি দাঁড়াতে পারবো।
– আমি বুঝতে পারি কোন ধাক্কাটা ব্যাড টাচ এবং কোনটা গুড টাচ। সেটা আমি বুঝে সময়মতো প্রতিবাদ করবো। আপনার চরিত্র ভালো থাকলে আপনি এতে চিন্তা করবেন না।
– সন্তান জন্মদানের কষ্টের চাইতে তো এটি বড় নয়।
– বাস কি আপনার ব্যক্তিগত? এটায় উঠবার অধিকার এবং ইচ্ছে আমারও আছে।
– আপনার ধারণা ভুল। সংরক্ষিত সিট বিশেষ প্রয়োজনে দেয়া হয় এবং এ বাসে ৪০ সিটেই আমার অধিকার সমান। তাছাড়া তাকিয়ে দেখুন আমাদেরকে সেখানেও বসতে দিচ্ছেন না আপনারাই এবং বাসে উঠতেও দিচ্ছেন না।
– বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে রাস্তার চাইতে বাসে যথেষ্ট নিরাপদ আমি।
২০২২ সালে জনশুমারি প্রতিবেদনে বলা হয়, বিভাগ হিসেবে ঢাকায় সর্বাধিক ৪ কোটি ৪২ লাখ ১৫ হাজার ১০৭ জন মানুষের বসবাস। এর মধ্যে পুরুষ ২ কোটি ২৪ লাখ ৫৯ হাজার ৮২২ জন এবং নারী ২ কোটি ১৭ লাখ ২১ হাজার ৫৫৬ জন। বিভিন্ন প্রতিবেদন মোতাবেক, দেশে বাসই রয়েছে ৪৯,৮৩৯টি বাস এবং ঢাকার উত্তর সিটি করপোরেশনে আছে ৯ হাজার সাতাশটি পরিবহন।
ঢাকা শহরের হিসাব করলে আনুমানিক প্রায় ২০ হাজারের মতো বাস থাকলেও সে বাসে ভ্রমণ করার অধিকার শুধু নরদেরই আছে।
এই গণপরিবহন অর্থাৎ লোকাল বাসে নারীদের জন্য শুধু ঐ সংরক্ষিত ৯ আসন। যার হিসাব দাঁড়ায় মোট ১,৮০,০০০ টি সিট। যেখানে তথাকথিত ভদ্রলোকরা নাক চুলকাতে চুলকাতে বসে থাকছেন বেশিরভাগ সময়তেই।
উঠতে বললে তখন সম অধিকার স্লোগান দেয় এবং বলে এখন এসব মানে না তারা। সমঅধিকার বিধান করছে বর্তমানে।
তাহলে গোটা জাতির কাছে প্রশ্ন, গণপরিবহনে যাতায়াতে আমার অধিকারটা কোথায়? কোথায় গেলে পাবো আমার অধিকার?
[ফেমিনিস্ট ফ্যাক্টরে প্রকাশিত মুক্তমত লেখকের নিজস্ব বক্তব্য]