November 2, 2024
ফিচার ২মুক্তমত

নারী দিবস ততদিন জরুরি, যতদিন…..

মার্জিয়া নাঈম।। Man অর্থ মানুষ অথচ Woman অর্থ নারী। ম্যানকাইন্ড বলে মানবজাত বোঝানো হলেও এর মাঝে উওম্যানদের অস্বীকার করা হয়েছে। সভ্যতা সূচনা থেকেই এতটা পুরুষতান্ত্রিক। ধর্ম থেকে শুরু করে রাজনীতি কোথাও কখনো নারীবান্ধব নিয়মকানুনের প্রবর্তন হয়নি। পুঁজিবাদী সমাজ নারীকে আর্থিকভাবে কর্মক্ষম হবার সুযোগ করে দিলেও সেটা স্বাধীনতা অর্জনের কোন ধাপ নয়। বরং কিছু ক্ষেত্রে কিছু সুবিধাভোগী নারীই পুরুষতান্ত্রিক এজেন্ট হিসেবে কাজ করে প্রচার করে বেড়ায় যে, মেয়েরা এগুচ্ছে। অথচ সমতার প্রশ্নে নারী এবং অন্যান্য লিঙ্গ যোজন যোজন দূর এখনো।

নারী দিবসের উদ্ভব হয়েছিলো সকল লিঙ্গের মধ্যে সমতা বিধানের উদ্দেশ্যে। এমন একটি সমাজ বিনির্মানের প্রয়াস ছিল যেখানে পুরুষ দম্ভ করে বলবেনা ‘আমি নারীকে স্বাধীনতা দিয়েছি’। কারণ পুরুষ প্রভু নয়, মানুষ। সে কাউকে স্বাধীনতা দেবার ক্ষমতাই রাখেনা। সে বড়জোর স্বাধীনতা অর্জনের পথে বাঁধা সৃষ্টি থেকে বিরত থাকতে পারে। সে অবদান রাখতে পারে সমতার পথে মেয়েদের এই চেষ্টায় বন্ধুর মতোন পাশে থেকে। ব্যস এটুকুই। তার বিরোধিতা বা তার অহংপূর্ণ করুণা কোনটিই মেয়েদের কাম্য নয়।

নারী পুরুষ এবং অন্যান্য সকল লিঙ্গকে আজও বিভিন্ন ছকে ফেলা হয়। পুরুষকে হতে হয় বলবান, হতে হয় আবেগহীন, থাকতে হয় গোঁফ দাড়ি, স্বর হতে হয় ভরাট। অন্যদিকে নারীকে হতে হয় কোমল, নমনীয়। যেকোন পরিস্থিতিতে মানিয়ে চলার ক্ষমতা থাকতে হয়। ঘরের কাজ আর রান্না জানতে হয়। পুরুষকে বাঘ সিংহ আর নারীকে জল বা ফুল ইত্যাদি বিশেষণে ভূষিত করা হয়। পরিবার সমাজ এবং নারী নিজে যতো ধরণের নিপীড়ন সহ্য করে তার পেছনে ঢাল হয়ে দাঁড়িয়ে যায় ফ্যাশন, মিডিয়া, কসমেটিকসসহ বিভিন্ন ইন্ড্রাস্ট্রি। তারা শেখায় ফর্সা হলে সকলে ভালবাসবে, রান্না ভালো করতে অমুক তেল প্রয়োজন যাতে ঘরের লোকেরা খুশি থাকবে। মেয়ের চুল লম্বা না হলে ভালো বিয়ে হবেনা, আবার ছেলে টাক হলে সুন্দরী মেয়ে পাওয়া যাবেনা ইত্যাদি রকমের জঘন্য বডি শেমিং। পুরুষেরা বুঝতেই পারে না, পুরুষতন্ত্রের ধারক, বাহক ও প্রচারক হতে গিয়ে কত সুচতুরভাবে তারাও এই সিস্টেমের ভিক্টিম হয়ে গেছে।

পুরুষালী নারীদের ক্ষেত্রেও একই কথা বলা যায়। পুরুষতান্ত্রিক সমাজে ভালো এবং আদর্শ মেয়ে হিসেবে মর্যাদা পেতে এরা অন্যান্য মেয়েদের প্রতি বিদ্বেষমূলক আচরণ পোষণ করেন। অনেক ক্ষেত্রে পুরুষের চেয়েও তাদের নিপীড়ন করবার মাত্রা বেশি থাকে। তাই শাশুড়ি তার অপূর্ণতা পূরণ করতে চান ছেলের বৌকে দিয়ে, মা তার সম্মান অক্ষুণ্ণ রাখতে চান তার মেয়েকে দিয়ে। অন্যান্যরা তাদের ভালোত্ব টিকিয়ে রাখতে প্রতিযোগিতামূলক আচরণ করেন পরস্পরের সাথে। অথচ এরা নিজেরাই নিগৃহীত। মা তার মেয়ের সকল কর্মকাণ্ডের জন্য দায়ী হন বলে সর্বোচ্চ রক্ষণশীল আচরণ করেন। শাশুড়িরা ছেলের ঘাড়ে বোঝা হতে চাননা বলে ইনসিকিউরিটি থেকে ‘আমার ছেলেকে নিয়ে গেলো’ রকমের মানসিকতা প্রদর্শন করেন। বোন কিংবা ননদ পরিবারে তার দাম আরেকটু কমে যাওয়ার ভয়ে আক্রমণাত্মক ব্যবহার করে। সমাজের অন্যান্যরাও নিজেদের ছোট গণ্ডিতে অপাংক্তেয় হয়ে যাবার ভয়ে অন্যের প্রতি বিদ্বেষ প্রয়োগকেই সহজ উপায় মনে করে টিকে থাকার জন্য। এদিকে পুরুষতান্ত্রিক সমাজ রটিয়ে বেড়ায় ‘মেয়েরাই মেয়েদের শত্রু’। মূলত সুপ্রাচীন এই চক্রান্ত খালি চোখে দেখার মতন নয়।

যেহেতু সমতা এখনো অনেক দূরের পথ, তাই নারী দিবস এখনো পৃথিবীব্যপী একটি অপরিহার্য উদযাপন। এই দিনে নারীকে শপথ নিতে হবে সব বাঁধা ভেঙ্গে এগিয়ে যাওয়ার। এই দিনে অন্যান্য লিঙ্গদের শপথ নিতে হবে নিজেদের অধিকার আদায়ে সর্বোচ্চ চেষ্টা করবার। এই দিনে পুরুষকে শপথ নিতে হবে নিজেকে প্রভু থেকে মানুষের কাতারে নিয়ে আসার চেষ্টা করার।

এবারের নারী দিবসের প্রতিপাদ্যও তাই। Lets all be each for equal. সবাইকেই বুঝতে হবে নারী মানুষ ভিন্ন অন্য কোন প্রজাতি নয়। তাই তার জন্য আলাদা করে কিছু করতে হবে এমন নয়, বরং সকলের জন্য যা করা হয় বা করতে দেয়া হয় যেভাবে, সেটুকুই তারও প্রাপ্য। যতদিন ৫০% ক্ষমতায় নারী আসীন হতে পারবেনা, ততদিন নারী দিবস পালন করতে হবে যথাযথ মর্যাদায়।

নারী দিবস ততদিন জরুরি যতদিন নারীকে সংসার সামলাবার আর পুরুষকে ঘরের কর্তা বলার প্রচলন থাকবে। ততদিন জরুরি যতদিন মা হওয়াকে মেয়েদের মহান দায়িত্ব হিসেবে বিবেচনা করা হবে। ততদিন জরুরি যতদিন ধর্ষণে নারীর সম্মানহানি হয়েছে বলে তাকে ভিকটিম ব্লেইম করা হবে। ততদিন জরুরি যতদিন সম্পত্তির সমান অধিকার নিশ্চিত হবেনা। ততদিন জরুরি যতদিন বিয়ে না হওয়া বা বিয়ে না করা একরকমের সামাজিক অপরাধ বলে বিবেচিত হবে। ততদিন জরুরি যতদিন ‘সব কিছুর পরেও সংসার টিকিয়ে রাখতে হবে’, ‘তালাক হলে লোকে কি বলবে’  নামক আবর্জনামূলক চিন্তা খোদ নারীদের মাথা থেকে দূর না হবে। ততদিন জরুরি যতদিন নারীর শরীর তার দুর্বলতা বা যোগ্যতা হিসেবে বিবেচিত হবে। ততদিন জরুরি যতদিন গোলাপি নারীর রঙ ভেবে পুরুষেরা তা পরতে লজ্জা পাবে। ততদিন জরুরি যতদিন মেয়েদের পরের ঘরে যাবার জন্য বাবা মা বড় করবে। ততদিন জরুরি যতদিন “সংরক্ষিত মহিলা আসন লাগবে কেন” বা “নারী দিবসের প্রয়োজনীয়তা কি” ইত্যাদি প্রশ্ন করার মতোন মূর্খতা সমাজের মানুষের মধ্যে বিদ্যমান থাকবে।

মার্জিয়া নাঈম: এক্সিকিউটিভ সেক্রেটারি, দীপ্ত টেলিভিশন।

[ফেমিনিস্ট ফ্যাক্টরে প্রকাশিত মুক্তমত লেখকের নিজস্ব মতামত]