September 20, 2024
জীবনের গল্পফিচার ৩

নীনা গুপ্তা: স্ট্রং, ফিয়ারসাম, ইন্ডিপেন্ডেন্ট, স্ট্রং

রেহমান মুস্তাফিজ।। ১৯৯৩ সালে ভারতে মুক্তি পায় সঞ্জয় দত্ত এবং মাধুরী দীক্ষিত অভিনীত ব্লকব্লাস্টার সিনেমা ‘খলনায়ক’। সিনেমা মুক্তির আগেই অবৈধ অস্ত্র রাখার অপরাধে সঞ্জয় দত্তকে জেলে যেতে হয়। আর ঐ রকম এক সময়ে সঞ্জয় দত্তের জন্য একটা লাইফ লাইন ছিল এই খলনায়ক মুভি। সঞ্জয় দত্তের ব্যাডঅ্যাস অবতার- টক অফ দ্য টাউন ছিলই। কিন্তু এই মুভির একটা গান ছিল তার চেয়েও বেশি আলোচনায়। মাধুরীর ‘ঠুমকা’ পপ কালচারে নতুন পালক যোগ করলেও অশ্লীলতার অভিযোগ ছিল এই গানটার বিরুদ্ধে। কিন্তু সব কিছু ছাপিয়েও সে বছরের অন্যতম জনপ্রিয় অ্যালবাম ছিল ‘খলনায়ক’। এক বছরে ১০ লাখের বেশি কপি বিক্রি হয় তা। জনপ্রিয়তায় একমাত্র ‘বাজিগর’ মুভির মিউজিককেই পিছনে ফেলতে পারেনি সে বছর। আর এই সাফল্যের ৯০% ক্রেডিট যায় এই ‘চোলি কে পিছে কেয়া হে’ গানটির।

না এই লেখাটা ‘চোলি কে পিছে কেয়া হে’ নিয়ে না, সঞ্জয় দত্ত বা মাধুরী দীক্ষিত কতটা ভাল ছিল মুভিতে সেটা নিয়েও না। লেখাটা সম্পূর্নই ‘নীনা গুপ্তা’কে নিয়ে। নীনা গুপ্তাকে চেনেননি? এই যে চোলি কে পিছে কেয়া হে গানটির ‘চোলি কে পিছে কেয়া হে?’ বা ‘চুনরি কে নিচে কেয়া হে?’ এই প্রশ্নটা যিনি করছিলেন তিনিই নীনা গুপ্তা।

স্ট্রং, ফিয়ারসাম, ইন্ডিপেন্ডেন্ট, স্ট্রং পার্সোনালিটিসমৃদ্ধ নারী- এই বিশেষণগুলো নীনা গুপ্তা দারুনভাবে ধারণ করেন। জীবনে যতবারই কঠিন পরিস্থিতির মুখোমুখি হয়েছেন, প্রতিবারই শক্ত হাতে দক্ষতার সঙ্গে সামলেছেন। ইংরেজিতে একটা কথা আছে না ‘হোয়েন দ্য গোইং গেটস টাফ, দ্য টাফ গেটস গোইং’, ঠিক তেমনটাই।

নীনা গুপ্তার জন্ম ৪ জুলাই ১৯৫৯ দিল্লীতে। মেধাবী এই মানুষটি দিল্লী ইউনিভার্সিটি থেকে সংস্কৃতে মাস্টার্স ও পরবর্তীতে এম ফিল করেন। ছিলেন এন.এস.ডি (ন্যাশনাল স্কুল অফ ড্রামা গ্রাজুয়েট। এই এন.এস.ডি এন্ট্রি কতটা টাফ সেটা বলি। বর্তমানে ইন্ডিয়ার অন্যতম সেরা অভিনেতা বলা হয় মনোজ বাজপায়িকে। তিনিও এন.এস.ডি তে ভর্তির আবেদন করে রিজেক্টেড হয়েছেন। জনপ্রিয় কমেডিয়ান কপিল শার্মা টানা তিন বছর রিজেক্টেড হয়েছিলেন। ইন্ডিয়ান অভিনেতা/অভিনেত্রী তৈরির আঁতুরঘর বলে এন.এস.ডিকে। বর্তমানে জনপ্রিয় ইরফান খান, নাওয়াজউদ্দীন সিদ্দিকী, নাসিরুদ্দীন শাহ, অনুপম খের, পঙ্কজ ত্রিপাঠী, পঙ্কজ কাপুর, রাজকুমার রাওদের মত জাত অভিনেতাদের সবাই এখান থেকেই এসেছেন। তারা সবাই হীরের মত দ্যুতি ছড়াচ্ছেন।

কিন্তু এতসব নামের ভিড়েও নীনা গুপ্তা নামটাকে কেমন জানি পরিচিত মনে হয় না? অথচ তার ফিল্ম ক্যারিয়ার শুরুই হয়েছিল ১৯৮৩ সালের একাডেমি অ্যাওয়ার্ড (অস্কার) সেরা মুভি জিতে নেয়া ‘গান্ধী’র মাধ্যমে। শুরুর দিকে করেছিলেন ‘জানে ভি দো ইয়ারো’ চলচ্চিত্রটি। যে মুভিটাকে বলা হয় অ্যাহেড অফ ইটস টাইম বা সময়ের চেয়ে এগিয়ে থাকা চলচ্চিত্র। বলিউডের অন্যতম সেরা চলচ্চিত্র এটি। যার শুরুটাই এরকম মুভি দিয়ে, তবুও সে তেমন এগোতে পারেনি! আপনার আমার খটকা লাগতে পারে। আর তাই জবাবটা নীনা নিজের মুখেই দিয়েছিলেন। ‘আমার কোন সেক্রেটারি ছিল না, আমি কোন পরিচালককে ব্যক্তিগতভাবে ফোনও দেই নি কখনো। কখনো বড় বড় লোকদের সাথে দেখা করে কোন চরিত্রও চাই নি। যার কারনে আমার নামে ‘স্ট্রং উওম্যান’ পার্সেপশান তৈরি হয়। আর আমাদের সমাজে স্ট্রং উওম্যানদের নেগেটিভলিই নেয়া হয়। আর তাই আমি পেয়েছি সব নেগেটিভ, ভ্যাম্প বা ছোটখাট চরিত্র। আমি কখনোই প্লেইন, সিম্পল, ড্রামার চরিত্র পাই নি।’

এসব নেতিবাচক পরিস্থিতি পেছনে ফেলে তবুও সামনে এগিয়ে যাচ্ছিলেন তিনি। চলচ্চিত্রের পাশাপাশি টেলিভিশনেও অভিনয় করেছেন। অভিনেত্রীর পাশাপাশি ক্যারিয়ারে যোগ হয়েছিল প্রযোজক ও পরিচালক তাকমাও। যে সময়টা পার করছিলেন গ্রেট না বলা না গেলেও নিজের মর্জিতে উড়ছিলেন বলে খারাপও বলা যায় না। আর ক্যারিয়ারের সেই সময়ই পরিচয় হয় ওয়েস্ট ইন্ডিজ ক্রিকেট লিজেন্ড স্যার ভিভিয়ান রিচার্ডসের সঙ্গে। পরিচয় থেকে পরিণয়ে খুব একটা সময়ই লাগে নি। ভিভ তখন বিবাহিত এবং দুই বাচ্চার বাবা। যদিও ভিভ তখন তার প্রথম ওয়াইফ থেকে আলাদা থাকছিলেন এবং ডিভোর্স হবে তাদের, এমনই কথা হচ্ছিলো। এরকম সময়েই একবার কলকাতার এক নাইট ক্লাবে ভিভ ও তাকে সঠিক জুতা না থাকার ফলে ঢুকতে না দিলে মিডিয়ায় তার এবং ভিভের প্রেম চর্চা শুরু হয়। ভিভের সাথে লিভ ইনও শুরু করেন। হ্যাপি কাপল বলতে যা বোঝায় এরকমটা মনে হওয়া অস্বাভাবিকও না। কিন্তু তাকে জীবনের বুড়ো আঙ্গুল দেখানো তখনও বাকি।

সময়টা ১৯৮৮-৮৯। নীনা গুপ্তা গর্ভবতী হয়ে পড়েন। কিংবদন্তী ভিভ প্রথম স্ত্রীর কথা বলে নীনার সাথে সম্পর্কটা চুকিয়ে দেন। নীনা তার বাবা মাকে তখন বলেছিলেন, ‘আমি অন্তঃসত্ত্বা। কিন্তু আমি বিয়ে করছি না এবং এই বাচ্চাটাকেও আমি আমার কাছে রেখে দেব, আমার মতই বড় করব এবং এর বাবা কে সেটাও জানতে চেও না কখনো।’

রক্ষণশীল পরিবারে এটা মেনে নেয়ার কোন প্রশ্নই আসে না। ১৯৯০ সালে ভিভ একেবারে ইন্ডিয়া ছেড়ে চলে গেলেন উইন্ডিজ। আর নীনা তার মেয়েকে একাই লালন পালন করতে লাগলেন। নীনার অনেক কাছের বন্ধুই তাকে সে সময় বিয়ে করতে চেয়েছিলেন। কিন্তু তিনি ফিরিয়ে দেন তাদের সবাইকে। নীনার বক্তব্য ছিল কারো করুণার পাত্রী হয়ে বেঁচে থাকা তার পক্ষে সম্ভব না। ছোট মাসাবার বয়স যখন ৪ বছর তখনই নীনার বাবা তার এই সিদ্ধান্ত মেনে নেন। নীনার মতে বাবা যখন আমাকে এবং আমার মেয়েকে মেনে নেন, তখন থেকেই মাসাবার সব কিছুই বাবাই দেখাশোনা করে। আর আমার জীবনও কিছুটা সহজ হয়ে ওঠে।

এবার পালা ক্যারিয়ারে মন দেয়ার। ব্যাক উইদ ব্যাং একটা কথা আছে না এরকমই বলা যায় নীনার ফিরে আসাকে। ‘woh chokri’ মুভিতে তার চরিত্রটি জিতে নেয় জাতীয় পুরষ্কার। ছোট ছোট পদক্ষেপ ফেলে আগাচ্ছিল কেরিয়ার। ছোট মাসাবার স্কুলে যাবার বয়সও হয়েছে। আর সে সময় এক সাংবাদিকের হাতে মাসাবার বার্থ সার্টিফিকেটের অরিজিনাল কপিটা এসে যায়। সাংবাদিকরা বার বার নীনাকে প্রেশার দিতে থাকে মাসাবা ভিভের মেয়ে স্বীকার করে নিতে। একটা সময় ব্ল্যাকমেইলও করতে শুরু করে যদি স্বীকার না করে তাহলে পত্রিকায় বার্থ সার্টিফিকেটটা ছড়িয়ে দেওয়ার। তখন কোন উপায় অন্ত না দেখে নীনা এবং ভিভ দুনিয়ার সামনে স্বীকার করে নেন তাদের অতীত সম্পর্ক এবং মাসাবা তাদের দুজনের সন্তান।

কিছুদিন টক অফ দ্যা টাউন ছিলেন। কিন্তু হারিয়ে যাচ্ছিলেন ধীরে ধীরে। কাজের অফার আর আগের মত পাচ্ছিলেন না। অনেক বড় কিছু হতে পারতেন কিন্তু হতাশার গল্প হয়ে থাকলেন। অন্তত এমনটাই মনে হচ্ছিল তখন। ২০০৮ সালে আড়ালেই দিল্লীর এক চার্টার অ্যাকাউন্টেন্টকে ভালবেসে বিয়ে করে সংসারীও হলেন। কিন্তু অভিনয়টা যে রক্তে মিশে আছে। একেই বা ছেড়ে দেন কীভাবে? কিন্তু অভিনয় করতে হলে তো সুযোগ পেতে হবে। নীনা গুপ্তা যে হারিয়ে যাওয়া একজন। তাকে কে কাজ দেবে? এরকম হতাশার মধ্যে থেকেই ২০১৭ সালে নিজের টুইটার অ্যাকাউন্টে একটা টুইট করেন। যেখানে লেখা ছিল ‘আমি মুম্বাই থাকি এবং কাজ করি। আমি মোটামুটি ভাল অভিনয় করতে পারি। যদি কোন কাজ থাকে আমাকে বলো।’

এই সামান্য এক টুইটে বি-টাউন যেন আবারো গরম হয়ে ওঠে। অনেকেই বলাবলি শুরু করলো কীভাবে এরকম কথা সে টুইটারে বলতে পারল? ব্যক্তিগতভাবে কি কাজ চাওয়া যেত না? নীনার ভাষায় ‘আমি এই একটা কাজ পারি তাই এই কাজটা চাইতে আমার কোন লজ্জা নেই। যেহেতু আমি বেকার বসে আছি। কিন্তু তবুও আমি ব্যাক্তিগতভাবে কারু কাছে কাজ চাইবো না। আমি জানিয়ে দিয়েছি কাজ করার মত এভেইলেবল আমি। এখন কোন পরিচালক যদি মনে করে তার গল্পে আমাকে প্রয়োজন তবে সে নিজেই আসবে।’

আর এই এক টুইটেই তার কাছে আসে ‘বাধাই হো’। মনে আছে নীনা বলেছিলেন ড্রামা ক্যারেক্টার তিনি তেমন একটা পাননি তার কেরিয়ারে? তাই এবার যখন পান, সেটাকে ব্যবহারও করলেন তেমনভাবেই। ‘বাধাই হো’ দেখে আপনি বলতেই পারেন এটা আয়ুষ্মান খুরানার মুভি। কিন্তু না, এটা নীনা গুপ্তার মুভি ছিল। আর এবারের কামব্যাকে প্রথমবারের মত ফিল্মফেয়ার অ্যাওয়ার্ড নিজের ঝুলিতে। এবার যেন নীনা গুপ্তার সত্যিকারের সেকেন্ড ইনিংস শুরু হয়েছে। কাজও পাওয়া শুরু করেছেন। কিছুদিন আগেই মুক্তি পেল ‘সুভ মাঙ্গাল যিয়াদা সাবধান’। প্রশংসা করা হচ্ছে সেটার পারফর্মেন্সেরও। আর তার সেই ছোট মাসাবা আজ বড় হয়েছে। হয়েছেন একজন সফল ফ্যাশন ডিজাইনারও।

প্রিয় নীনা গুপ্তা আপনাকে আটকানোর সাধ্য কার?