November 2, 2024
কলামফিচার ২

লকডাউনে নারী নির্যাতন: চাই পুঁজিবাদ-পুরুষতন্ত্রবিরোধী গণআন্দোলন

লাবণী মণ্ডল।। নারী! দুটি অক্ষর। এই অক্ষর দুটি নিয়ে রয়েছে হাজারও কৌতুক, রসালো বক্তব্য। কিন্তু ‘নারী’ যে কী শক্তি তা একমাত্র পৃথিবীর ‘মানুষ’ চরিত্রের মানুষগুলোই আঁচ করতে পারেন। নারী নির্যাতন-নিপীড়নের চিত্র যুগের পর যুগ ধরেই চলে আসছে। সময়ের প্রয়োজনে রূপ বদলেছে। ধরন পাল্টেছে। কখনও অদৃশ্য রয়েছে। কখনও ভয়ংকর থেকে ভয়ংকর রূপ ধারণ করেছে। আবার ঘুরে দাঁড়িয়েছে। যুদ্ধ করেছে। জীবন দিয়েছে। জীবন নিয়েছে। যা আজঅব্দি অব্যাহত রয়েছে।

বিশ্বব্যাপী চলছে করোনাভাইরাসের মহামারি। এর থেকে শীঘ্রই মুক্তি মিলছে না। লকডাউনে নারী-পুরুষ উভয়কেই ঘরে থাকতে বাধ্য করা হচ্ছে। আর এটাই ‘নারী সমাজের’ জন্য কাল হয়ে এসেছে। নারী নির্যাতনের হার বেড়েছে আশঙ্কাজনকভাবে। পৃথিবীর বিভিন্ন রাষ্ট্রেই নারী নির্যাতনের চিত্র সামনে চলে আসছে।

অতীত ইতিহাস থেকে আমরা জানতে পারি, যে কোনো প্রাকৃতিক দুর্যোগেই নারী নির্যাতন-শিশু নির্যাতন বেড়ে যায়। এই মহামারিতে তারই রূপ দেখতে পাচ্ছি। নারী হলো নির্যাতিতের মধ্যে নির্যাতিত। যখন আমরা শ্রমিকশ্রেণির মুক্তির কথা বলি, তখন একইসাথে এটাও বলি, নারীমুক্তিটা জরুরি।

নারীর ওপর চাপ বেড়েছে। সবচেয়ে নিরাপদ জায়গা ঘর। সেই ঘরে নিরাপদে দিনাতিপাত করতে পারছেন না নারী। পুরুষ সবসময় ঘরে থাকলে নারীর প্রতি সহিংসতা বাড়ে বলে একটা কথা গ্রাম্য প্রবাদে শুনেছিলাম। যার বাস্তব রূপ দেখতে পারছি। আর সমাজের সার্বিক চিত্র অবলোকন করছি।

শ্রমিকশ্রেণির মধ্যে এর রূপ আরও ভয়ংকর আকার ধারণ করেছে। আমাদের মতো দেশের শ্রমিক পরিবারগুলোর মধ্যে নারীরাই বেশি শ্রম দেয়। ঘরে বাইরে সমানতালে। লকডাউনে নারী যখন ঘর থেকে বের হতে পারছেন না তখন তাদের নির্যাতনের মাত্রা বেড়েছে কয়েকগুণ।

বিভিন্ন এনজিও ও মানবাধিকার সংস্থার পাশাপাশি জাতিসংঘের পক্ষ থেকেও এই সময়ে বিশ্বব্যাপী নারী নির্যাতন উল্লেখযোগ্যহারে বৃদ্ধির দাবি করা হচ্ছে। বিশেষজ্ঞরা জানান, ‘পরিবারবেষ্টিত থাকায় নারীদের পক্ষে তাদের ওপর হওয়া সহিংসতার ঘটনা অন্যদের জানানো বা আইনি পদক্ষেপ নেওয়া সম্ভব হচ্ছে না। পর্যবেক্ষণে দেখা যায়, নারী নির্যাতনের মধ্যে উল্লেখযোগ্য সংখ্যকই ধর্ষণ ও পারিবারিক সহিংসতার ঘটনা।’

জাতিসংঘের মহাসচিব বলেন, ‘গত কয়েক সপ্তাহে অর্থনৈতিক ও সামাজিক চাপ বেড়েছে। মানুষের মধ্যে আতঙ্ক বেড়েছে। সেই সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বেড়েছে পারিবারিক সহিংসতার ঘটনা। সরকারগুলো করোনাভাইরাস মোকাবেলায় জাতীয় যে পরিকল্পনা নিচ্ছে, তাতে নারীর প্রতি পারিবারিক সহিংসতা রোধের বিষয়টিও যেন থাকে।’

বিশ্বের অন্যান্য রাষ্ট্রগুলোও এ ব্যাপারে জোর দিয়েছে। তাদের অনেকের দাবি এ মুহূর্তে করোনাভাইরাস নিয়ে ব্যস্ত থাকার ফলে নারী নির্যাতনের অনেক খবরই মিডিয়ায় আসছে না। যে বিষয়টাকে গুরুত্ব দেওয়া জরুরি বলে মনে করছে।

করোনার এই ভয়াবহতার মধ্যেও গত ১৭ এপ্রিল লক্ষ্মীপুরের রামগতি উপজেলায় ১৬ বছরের এক কিশোরী ধর্ষণের শিকার হয়েছে। এর আগে ১৫ এপ্রিল ফেনীতে ফেসবুক লাইভে এসে স্ত্রীকে কুপিয়ে হত্যা করে টুটুল ভূঁইয়া। এছাড়াও এপ্রিলের প্রথম সপ্তাহে মাদারীপুর পুলিশের নারী সদস্য অনিমা বাড়ৈ (২৭) ধারালো অস্ত্রের আঘাতে জখম হন। এপ্রিলের প্রথম সপ্তাহে কেরানীগঞ্জে ত্রাণ নিতে গেলে ওখানকার স্থানীয় পাণ্ডারা ঘরে আটকে রেখে ১০ বছরের শিশুকে ধর্ষণ করে। এছাড়া মার্চের শেষে জামালপুরে করোনাভাইরাসে আক্রান্ত রোগীকে তল্লাশির কথা বলে পুলিশ পরিচয়ে ঘরে প্রবেশ করে এক কিশোরীকে তুলে নিয়ে ধর্ষণ করেছে পাঁচ হিংস্র পুরুষ। সবই সম্ভব- চরম ভোগতান্ত্রিক-পুঁজিতান্ত্রিক-পুরুষতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থায়।

ঢাকার সিএমএম আদালতের তথ্যমতে, মার্চের শেষ ১০ দিনে শুধু ঢাকা মহানগরীতে ধর্ষণ, যৌতুকের দাবিতে নির্যাতন, যৌন নিপীড়ন ও অপহরণের ২৮টি মামলা হয়েছে। এর মধ্যে ৯টি ধর্ষণের মামলা। আর যৌতুকের জন্য নির্যাতনের ঘটনায় মামলা হয়েছে ৮টি। এর বাইরে যৌন নিপীড়নের অপরাধে মামলা হয়েছে ৬টি। অপহরণের মামলা ৫টি। এসব মামলায় গ্রেপ্তার হয়েছেন ৩৭ জন। মানবাধিকার সংগঠনগুলোর তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, শুধু মার্চেই বগুড়া, জামালপুর ও কক্সবাজার জেলায় ৩৬টি ধর্ষণ ঘটেছে। এ ছাড়া একই সময়ে এ তিন জেলায় ৩ শতাধিক পারিবারিক নির্যাতন ঘটে। মানুষের জন্য ফাউন্ডেশনের প্রাপ্ত তথ্যে, চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে মার্চ পর্যন্ত মোট ২৫৭ জন নারী ও শিশু ধর্ষণের শিকার হন। এর মধ্যে মৃত্যু হয় ১২ জনের। ধর্ষণ শেষে ৪ জন আত্মহত্যা করেন। যৌন হয়রানির শিকার হন ৪৬ জন। এজন্য আত্মহত্যা করেন ৫ জন। এই সময়ে ৪২ নারীর মৃত্যু হয় স্বামীর নির্যাতনে। যৌতুকের কারণে ২০ জন নারীকে শারীরিকভাবে নির্যাতন করা হয়। নির্যাতনে মৃত্যু হয় ১২ জনের। এই সময়ে চারজন নারীর ওপর অ্যাসিড নিক্ষেপ হয়।

এগুলো সবই বুর্জোয়া মিডিয়ার খবর। এর বাইরে চিত্রটা যে আরও কত ভয়ংকর তা সচেতন মানুষ মাত্রই উপলব্ধি করতে পারে। কত খবর ফাইলের নিচে চাপা পড়ে রয়েছে। কত নারী মুখ বন্ধ করে সয়ে যাচ্ছেন! কত নারী ভেবেছে নিজেকে শেষ করে দেওয়ার কথা। তা তো আমরা বুঝতেই পারি।

যার চিত্র হওয়ার কথা ছিল বিপরীত। এত সময়, এত নিকটে আর কখনও হতে পারেনি, আগামী যতদিন বেঁচে থাকবেন ততদিনেও হতে পারবেন না। এখনই সময় ছিল নিজেদের মধ্যে বোঝাপড়া বাড়ানো, শ্রদ্ধাবোধ বাড়ানো, কাজের ক্ষেত্র ভাগ করে নেওয়ার। সন্তানদের প্রতি দায়িত্ববোধ বাড়ানোর। কিন্তু চিত্র পুরো উল্টো। ব্যক্তির উপর এর দায় বর্তিয়ে মুক্তি মিলবে কি?

ডোমেস্টিক অ্যাবিউজের পক্ষ থেকে জানানো হয়, ‘লকডাউনের সময় নির্যাতনের শিকার নারীরা ঘর থেকে বের হতে পারছেন না। বাধ্য হয়ে তাদের ঘরেই থাকতে হচ্ছে। তবে কেউ কেউ নির্যাতন সহ্য করতে না পেরে লকডাউনের মধ্যেই ঘর ছাড়ছেন।’

কতটা ভয়ংকর খবর! ভীতিকর! ভাবতেই কেমন গা শিউরে ওঠে। ক্ষণিকের জন্য হলেও, পুরো পুরুষজাতির প্রতি ঘৃণাবোধ জন্ম নেয়। চিন্তার সম্বিত ফিরে পেলে, আবার ভাবিও এটাই চরম পুরুষতান্ত্রিক ব্যবস্থাপনার চিত্র।

নির্যাতনের শিকার হয়ে ঘর ছেড়ে পালানো এক নারী বিবিসিকে বলেন, ছয় মাস ধরে তার স্বামী তাকে মানসিক ও শারীরিকভাবে নির্যাতন করে আসছে। তবে কয়েকদিন আগে লকডাউন শুরু হওয়ার পর থেকেই সেই নির্যাতন বেড়ে গেল বহুগুণ। বাধ্য হয়ে এই দুর্যোগের মুহূর্তে ঘর ছাড়তে বাধ্য হন।

পারিবারিক সহিংসতা নিয়ে কাজ করার প্রেক্ষিতে স্যান্ড্রা হোরলে জানান, গত বছর শুধু ইংল্যান্ড ও ওয়েলসে ১৬ লাখ নারী পারিবারিক সহিংসতার শিকার হয়েছিলেন। এ বছর এ সংখ্যা বেড়ে যাওয়ার আশঙ্কায় রয়েছেন।

সদ্য গাজীপুর শ্রীপুর উপজেলার ঘটে যাওয়ার ঘটনার কথাই যদি বলি, একজন ১৭ বছর বয়সী মাদকাসক্ত কিশোর কীভাবে চার চারটি মানুষকে কুপিয়ে হত্যা করল। এরপর আবার ধর্ষণও করল। মৃত্যু নিশ্চিত করার জন্য গলা কেটে স্বর্ণালঙ্কার নিয়ে পালিয়ে গেল! অবাক হওয়ার মতো ঘটনা কি? এই প্রথমই এরকম ঘটনা ঘটেছে? নাহ! এরকম ঘটনা অহরহ এই সমাজব্যবস্থায় ঘটে থাকে।

পুরো বিষয়টা বাংলাদেশের রাষ্ট্র ব্যবস্থার একটি ক্ষুদ্র রূপ মাত্র। সার্বিকভাবে ভাবলে এই ভঙ্গুর রাষ্ট্রের চিত্র আরও ভয়ংকর। যে কারণে আমরা বলি, সংস্কার করে এ রাষ্ট্রকে বাঁচানো যাবে না। ভেঙ্গেচুরে নতুন করে নির্মাণ করতে হবে। তা না হলে এর রূপ আরও ভয়ংকর দিকে ধাবিত হবে। এখনই সময়। লড়তে লড়তে বেঁচে যাওয়ার। অবিরত লড়াইয়েই একমাত্র মুক্তি সম্ভব।

সাম্রাজ্যবাদ-সম্প্রসারণবাদ-আমলা মুৎসুদ্দি পুঁজিবাদ-সামন্তবাদ-পুরুষতন্ত্র বিরোধী গণআন্দোলনের মধ্য দিয়েই একমাত্র নারীর উপর নির্যাতন-নিপীড়ন থেকে মুক্তি পাওয়া সম্ভব। তা না হলে নারীমুক্তি সম্ভব নয়। তাই বর্তমান পরিস্থিতিতে নারীসমাজ সংগঠিত হওয়ার জন্য আরও একধাপ এগিয়ে যাবে বলে প্রত্যয় ব্যক্ত করছি।

 

লাবণী মণ্ডল: সহ-আহ্বায়ক : বিপ্লবী শ্রমিক আন্দোলন, সংগঠক : বিপ্লবী নারী মুক্তি

[ফেমিনিস্ট ফ্যাক্টরে প্রকাশিত কলাম লেখকের নিজস্ব বক্তব্য]