November 2, 2024
কলামফিচার ৩

আমাকে যদি প্রশ্ন করা হয়…

স্নিগ্ধা রেজওয়ানা।। আমি কে? আমি কী? এ দুটি প্রশ্নের জবাব ভাবার সুযোগ কখনোই আমাকে দেয়া হয়নি। এ পৃথিবীতে আমার আগমন কেন ঘটেছে, সেটি কখনো আমাকে জানানো হয়নি। নিরাপত্তার বেষ্টনী ঘিরে থাকা মাতৃজঠর থেকে এই অনিশ্চিত পৃথিবীতে কেন আমার আগমন, বা আদৌ আমি জন্ম নিতে আগ্রহী কিনা, সেটিও কখনো আমাকে প্রশ্ন করা হয়নি। আমার জানা ছিল না, আমি কী বর্ণের কী লিঙ্গের বা কী নামে সকলের কাছে পরিচিত হবো। আমার পরিচয়, আমার নাম, আমার এ সকল কিছুই তোমাদের মানসপটে রচনা করা কতগুলো বর্গের বর্গীকরণের এক সমষ্ঠি।

জন্ম নেবার পর আমাকে বলা হলো আমার নাম স্নিগ্ধা। যে নামের অর্থ বোধককতা আমাকে জানান দেয় আমি একজন মেয়ে, কারন এ সমাজে পুরুষের স্নিগ্ধ হতে মানা। আমার নাম আমাকে কোমল হতে, নরম হতে শেখায়, তার সাথে এও শেখায় আমার জীবনের একমাত্র অভীষ্ট হলো নিজেকে বিলিয়ে সৌরভ ছড়িয়ে দেয়া। আমাকে বলা হল, আমাকে হতে হবে নরম, স্নিগ্ধ, কোমল। আমাকে শেখানো হলো রুঢ়তা, তেজ, অট্টহাসি আমার জন্য নয়। কারণ আমি নারী। আমাকে সেই পাঠ দেয়া হল, পাঠে পাঠে সংসারের সকল সুখ নিশ্চিত করার দায়ভার কেবলই আমার। আর আমার পরিচয় ঘটে কেবলই নারী হিসেবে।

নারীত্বকে বুঝি বা না বুঝি, আমাকে বুঝিয়ে দেয়া হলো, আমার পাখির মতো উড়তে মানা, গরম লাগলে গায়ের জামা কাপড় খুলতে মানা, জোর গলায় কথা বলতে মানা, আমার কাম থাকা মানা, আমার উচ্চাভিলাষী হওয়া মানা, আমার স্বাধীন বা স্বেচ্ছাচারী হওয়া মানা। এমনকি আমার নিজের মত করে চলা, বলা বা পোষাক পরাও মানা। আমার লজ্জা, আমার শরীর আর মুখশ্রীর সৌন্দর্যই এই সমাজে আমার একমাত্র পরিচয়। আমার গ্রহণযোগ্যতা কেবলই আটকে রইলো আমার আভরণ, শরীর, সংসার আর আব্রুর মাঝে। আমাকে শেখানো হল আমি নারী, আমার কাজ কেবলই মুগ্ধতা বিলানো, আমার কোন ভুল হতে নেই, ভুল করতে নেই, কারো প্রেমে পড়ে নিজেকে সঁপে দিতে নেই। আমাকে বোঝানো হলো আমার ভার্জিনিটি বা সতীত্ব কেবলই একজন পুরুষের যাকে আমি স্বামী হিসেবে গ্রহণ করবো, আমার শরীর কেবলই তার অধিকার। আমাকে ভোগ করবে সে। আমি ভাবার সুযোগ পাই নাই, কেন আমি পুরুষের ভোগের পাত্র, আমি এও ভাবার সুযোগ পাই নাই, কেন আমার শরীর আমার যৌনতা বা আমার নিজের উপর আমার নিজেরই কোন অধিকার নেই।

যদিও আজ অনেক নারী প্রথাগত শিক্ষায় শিক্ষিত, তবু নারী কখনো সমাদৃত হয় না তার জ্ঞান বা প্রজ্ঞায়। নারীর শিক্ষাকে বিবেচনায় নেয়া হয় না যুক্তি তর্কের কোন মঞ্চে, তাকে দেখা হয় না বিজ্ঞ বা জ্ঞানী হিসেবে। ইতিহাস থেকে তাই চোখ বন্ধ করে যদি কোন জ্ঞানী লোকের নাম বলতে বলা হয়, সেখানে এ উপমহাদেশের কোন জ্ঞানী নারীর প্রতিবিম্ব আমাদের মানসপটে ভেসে ওঠে না। তাই ইতিহাসের পাতায় সমাদরের অভাবে হারিয়ে যায় আমাদের অঞ্চলের খনা অথবা পাশ্চাত্যের হাইপেশিয়ারা, ঠিক একইভাবে আজো নারী কখনো প্রশংসিত হয় না তার মেধা, প্রজ্ঞা বা সৃষ্টিশীলতার গুনে, কখনো আলোকিত হয় না কোন মজলিসে। জ্ঞানী প্রজ্ঞাবান নারীর জীবনের দুর্ভোগ আমাকে মন করিয়ে দেয়, খনার জিহ্বা কাটা আর হাইপেশিয়াকে জীবন্ত ডাকিনী খেতাব দিয়ে পুড়িয়ে ফেলার গল্প।তাদের চলার পথকে অবদমন করার এই ইতিহাস আমাকে জানান দেয়, জ্ঞানী বা প্রজ্ঞাবান নারী হবার বাসনা ধারণ করতে মানা। আমি অনেক কিছু অর্জনের পরও আমাকে বলা হয়, তুমি তো মেয়ে, তুমি যা পেরেছো তা কয়টা মেয়ে পারে, তা নিয়েই সুখে থাকো।

যেন আমার সকল অর্জনের সফলতা, কেবলি সেখানে, মেয়ে হয়ে এতদূর পথ পাড়ি আমি কেমনে দিলাম! আমাকে বুঝিয়ে দেয়া হয়, আমার সফলতা একজন পুরুষের সফলতার কাছে যৎসামান্য।

আবার একজন নারী যতই মেধাবী বা প্রজ্ঞাবান হন না কেন তাকে পরিমাপ করা হয় ঈশ্বর প্রদত্ত রূপের আলোকে। তাইতো সুন্দরী নারীর প্রেম উপাখ্যানে সয়লাব থাকে বাজারের সস্তা সাহিত্য থেকে শুরু করে সমৃদ্ধশালী সাহিত্য ভাণ্ডার, কোথাও বিদূষী নারীর বিদ্যার প্রতি প্রেম ভক্তি বা মোহ খুঁজে পাওয়া দুষ্কর দুর্লভ ও দুষ্প্রাপ্য।

নারীকে বরাবরই পরিবেশনার কাজে ব্যবহার করা হয়েছে। নারীর মুখশ্রী যেন সেই পরিবেশনার একমাত্র বাহক। নারী গান গাইলে তা কেবলই তা মিষ্ট গলার সুমধুর গান হতে হবে, কিন্তু নারীকে কখনো ঠাঁই দেয়নি কেউ তেজালো রণ সংগীতে। আবার শরীরকলায় নৃত্য পরিবেশন তাকে ভালো মানায়- এই বোধও দেয়া হয়েছে, তবে নারীর নৃত্যকলাকে শিল্পের সম্মান না দিয়ে ভাষা দিয়ে অবজ্ঞা করে তাকে বানানো হয়েছে নটী, ব্যাকরণে নটরাজ থাকলেও, নারীর কলার সম্মানে রচিত হয়নি কোন সর্বনাম। ইতিহাস নারীর নৃত্যকলাকে জলসা ঘরে সাজিয়ে তাকে বানিয়েছে নর্তকী। আজ কিছু পুরুষের নৃত্যকলার চর্চা নারীকেও নৃত্যশিল্পী হিসেবে পরিচিত করে বটে তবে তার প্রতিভাকে খাটো করে দেবার জন্য সমাজ কেবলই নটী বা নর্তকী বলে অবমাননা করে যায় আড়ালে আবডালে, কখনো বা প্রকাশ্য।

আবার নারী পরিচয়ের সুত্র ধরেই আমি কেবলই হয়েছি অবহেলা, অবজ্ঞা আর উপেক্ষার পাত্রী। আমাকে অবমাননা করা এতটাই সহজ যে, এক পুরুষ অপর পুরুষকে যখন গালমন্দ করে, তখনও সে তার মাকে অথবা বোনকে গালি দিয়ে কথা বলে। তাই তো খুব সহজে বলে দেয়া যায় “খানকীর ছেলে”। আর আমি মেয়ে বলে, ভীষণ নির্লজ্জ পুরুষকেও বলি কেবলই কাপুরুষ, যেন তার মাঝে তার পুরুষালী মাহাত্ম্য হারিয়ে যাবার কথাটি কেবলই তাকে স্মরণ করিয়ে দেবার চেষ্টা।

নারীর বেদনা কেবলই প্রেম ভালোবাসার উপাখ্যান হয়ে ধরা পড়েছে কবিতায়, গানে, উপন্যাসের পাতায়, সাহিত্যের কাব্যকথায়। কিন্তু কেউ বলতে আসেনি নারীর জীবনের হারিয়ে যাওয়া আমিত্বের গল্প। তাই জন্মের পর থেকেই আমি যে আমার আমিত্বকে হারিয়েছি, এই তোমরা, যে আমার কাছ থেকে আমার আমিত্বকে ছিনিয়ে নিলে তার কৈফিয়ত চাওয়ার সুযোগটাও আমাকে দেয়া হয়নি।

আমি তোমাদের কাছে, বিনাশিনী সেই সৃষ্টির শুরুর আদম হাওয়ার গল্প রচনার মধ্য দিয়ে, আমার জন্ম কেবলই পুরুষের সেবার মাঝে আর মানব সভ্যতা টিকিয়ে রাখতে মনুষ্য শিশু জন্মদানের মাঝে নিহিত করা হয়েছে ধর্মগ্রন্থে, আমাকে শাসন করার, আমার গায়ে হাত তোলার অধিকার দেয়া হয়েছে পুরুষকে। যুদ্ধের সময় শত্রু পক্ষের শিবিরে আমাকে ধর্ষণ করার বৈধতাও দিয়েছে তোমাদের পবিত্র গ্রন্থ। আমাকে সীতার মত বারবার অগ্নিকুন্ডে ঝাঁপ দিতে হয়েছে সতীত্ব প্রমাণে। আমি বারবার শুধু হেয় প্রতিপন্ন হয়ে যে গৃহে আশ্রয় নিয়েছি, সেখানেও আমি কেবলই  যৌন দাসী অথবা দাসী।

আমাকে কখনো কখনো তোমাদের করুণা করতে দেখেছি, মাঝে এও বলতে শুনেছি আমাকে নাকি তোমরা পুরুষের চেয়েও বেশি সম্মান দিতে চাও! কিন্তু যে সমাজ আমাকে কখনো মানুষ হিসেবেই নিজের সাথে নিজের পরিচয় ঘটাতে দিলো না, যে সমাজ আমাকে আমার নিজের মনের উপর, নিজের শরীরের উপর কিংবা নিজের আবেগ প্রকাশের অধিকার দেয় না, সে সমাজ আবার আমাকে মূল্যায়নের বা সম্মানের অধিকার রাখে কীভাবে?

তাই আজ একলা বিকালে প্রবাসে একলা ঘরে বসে ভাবছি, আমাকে যদি প্রশ্ন করা হয়, আমি কে? আমি কী? এর উত্তর কি আমার দেয়ার সাধ্য আছে? আমি যে কে, বা আমি কী তা তো কখনো আমাকে জানার সুযোগ দেয়া হয়নি।তবে কেন আবার এই আমাকেই তোমাদের এই পুরুষতান্ত্রিক অহমিকার রোষানলে, অবজ্ঞা আর তাচ্ছিল্যভরে জানতে চাওয়া হয় আমি কে? আমি কী?

স্নিগ্ধা রেজওয়ানা: শিক্ষক, নৃবিজ্ঞান বিভাগ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়

[ফেমিনিস্ট ফ্যাক্টরে প্রকাশিত কলাম লেখকের নিজস্ব মতামত]