December 23, 2024
অনুবাদসাহিত্যবই নিয়ে আলাপ

পর্ব-১২: পেশল বাস্তবতা আর পূর্বকল্পিত জেন্ডার বিষয়ক মতামত

শিল্প সমালোচক, লেখক শার্লট মালিন্সের A Little Feminist History of Art বইটি বাংলায় অনুবাদ করছেন বিশিষ্ট অনুবাদক, শিক্ষক জি এইচ হাবীব। বইটির অনুবাদ ধারাবাহিকভাবে প্রকাশ হচ্ছে ফেমিনিস্ট ফ্যাক্টরে।

আজ পড়ুন এর  দ্বাদশ পর্ব। সব পাঠকের সুবিধার জন্য প্রতি পর্বের শুরুতে বইটির এবং লেখক শার্লট মালিন্সের সংক্ষিপ্ত পরিচিতি দেয়া থাকবে।।

[নারীবাদী শিল্প আন্দোলনের শুরু ১৯৬০-এর দশকের শেষের দিকে। পুরুষ প্রাধান্যবিশিষ্ট রঙ্গমঞ্চে প্রতিযোগিতায় অবতীর্ণ হওয়ার জন্যে সে সময় নারী শিল্পীরা তাঁদের কাজগুলোর জেন্ডারচ্যুতি ঘটাবার সংগ্রামে নামেন। এরপর থেকে সেই আন্দোলন শিল্প জগতে গোটা বিশ্বজুড়ে অন্যতম প্রধান ভূমিকা পালন ক’রে আসছে। ‘নন্দনতাত্ত্বিক ফরমালিযম’ ব’লে অভিহিত যুগের পর সামাজিকভাবে প্রাসঙ্গিক নানান ইস্যুতে কথা বলার জন্য ‘নারীদৃষ্টি’-র সাহায্যে নারী শিল্পীরা বিভিন্ন মাধ্যমে কাজ ক’রে জেন্ডার, পরিচয় এবং ফর্মের দিকে সবার দৃষ্টি আকর্ষণ করতে চেয়েছেন, সমালোচনা করেছেন সাংস্কৃতিক প্রত্যাশাগুলোকে এবং নারীকে সনাতনী দৈনন্দিন ধারণায় আটকে ফেলার ব্যাপারটিকে। সমাজের দৃষ্টি ঘোরাতে চেয়েছেন সাম্যের জন্যে নারীর সংগ্রাম এবং নারীদেহকে পণ্য হিসেবে দেখবার মানসিকতা ও ক্রিয়াকর্মের দিকে। “অল্প কথায় নারীবাদী শিল্প-ইতিহাস” (A Little Feminist History of Art) নামের ছোট্ট বইটিকে এই আন্দোলনের ফসল হিসেবে জাত অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ কিছু শিল্পকর্মের সংক্ষিপ্ত কিন্তু সারগর্ভ ভূমিকা বলা যেতে পারে। ১৯৬০-এর দশক থেকে বর্তমান কাল অব্দি পঞ্চাশটি অসামান্য কাজ নারীর জীবন ও অভিজ্ঞতাকে তুলে ধরেছে। সেই সঙ্গে, ভিয্যুয়াল সংস্কৃতির ওপর নারীবাদী আদর্শ ও রাজনীতি যে প্রভাব ফেলেছে সেটাও এই কাজগুলো মেলে ধরেছে। “অল্প কথায় নারীবাদী শিল্প-ইতিহাস” নামের এই গ্রন্থটি জেন্ডার বৈষম্য, যৌনতা, গার্হস্থ্য জীবন, ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা আর নারী দেহের মতো বিষয়গুলো খতিয়ে দেখা বিংশ শতকের সবচাইতে উচ্চাকাঙ্ক্ষী, প্রভাবশালী ও টেকসই শৈল্পিক আন্দোলনগুলোর একটির আনন্দ উদযাপন। 

শার্লট মালিন্স একজন শিল্প সমালোচক, লেখক এবং সম্প্রচারক। তিনি রেচল হোয়াইরিড, সেসিলি ব্রাউন, র‌্যাচেল লামসডেন,  জেনি স্যাভিল, ক্যাথে ডে মনসাউক্স, স্যু অ্যারোস্মিদ, সুজ্যান কুন, স্যুযি হ্যামিলটন এবং পলা রেগোসহ বিভিন্ন নারী শিল্পীকে নিয়ে লেখালেখি করেছেন। তাঁর রচিত ও প্রকাশিত বিভিন্ন গ্রন্থের মধ্যে রয়েছে “লাইভ্স অভ দ্য গ্রেট আর্টিস্টস” (২০০৮) এবং “র‌্যাচেল হোয়াইহেড” (২০০৭)। তিনি বিবিসি রেডিও ফোর-এর “ফ্রন্ট রো” এবং “স্যাটারডে রিভিউ’’-র নিয়মিত প্রদায়ক]

 

কিকি স্মিথ (Kiki Smith)

(জন্ম ১৯৫৪)

একটা গ্যালারিতে এক নারীর প্রমাণ আকারের একটা ভাস্কর্য দাঁড়িয়ে। তার কোনো চুল নেই, চোখ নেই, ত্বক  নেই, এবং তাঁর পেট জুড়ে আর বুকের ওপরে পেশীগুলো টানটান হয়ে আছে। সে একজন একোশে (écorché)- একসময় অঙ্গসংস্থানবিদ্যা শেখাবার জন্যে মোমের যে মডেল ব্যবহার করা হতো, যেখানে কেবল একটি দেহের ত্বকহীন পেশীগুলো দেখানো থাকতো, তাই।

কিকি স্মিথ এই ভাস্কর্যটির নাম দিয়েছেন Virgin Mary এবং এটার মাধ্যমে ম্যানিকিনটি একটি গূঢ় এবং সাংকেতিক ইতিহাসের মুখোমুখি হয়। স্মিথ একজন ক্যাথলিক হিসেবেই বড় হয়েছেন, কিন্তু ধর্মের সঙ্গে তাঁর সম্পর্কটি বিশ্বাসের নয়, অনুসন্ধানের। শেষ অব্দি তিনি নানান গল্পগাঁথায় আস্থা রাখতে পারেন না; চরিত্রগুলো তাঁর কাছে শেষ অব্দি নেহাত কিছু মানুষ ছাড়া আর কিছুই নয়।

স্মিথের নার‌ীবাদ সুপ্ত, একটা উপ-টেক্সট যা তাঁর কাজের ওপর দিয়ে খেলে বা বয়ে যায়। তাঁর ভাস্কর্য, প্রিন্ট, আর ড্রইংগুলো ফিগারের সমস্ত আন্তরযন্ত্রীয় (visceral) দীপ্তি নিয়ে কেন্দ্রীভূত। এই কাজটিতে (যে কাজটি ওফিলি-র দ্য হোলি ভার্জিন মেরি ১৯৯৬-এর চার বছর আগে তৈরি) তিনি তাঁদের বাস্তবতা দেখিয়েছেন যাঁদেরকে আমরা শ্রদ্ধার চোখে দেখি: পেশী আর হাড়ের একটি মাংসল মিশ্রণ। অন্যসব কাজে তিনি মানুষের চুল ব্যবহার করেন, বা কাচ দিয়ে স্পাইনাল কলাম ছাঁচে ঢালাই করেন, যাতে ক’রে দেহ বা শরীরের ভঙ্গুরতার অনুভূতির উদ্রেক করা যায়। দেহ যেমন সেটাকে তিনি সেভাবেই প্রকাশ করেন; যেসব সমাজ-অর্থনীতিক এবং ধর্মীয় এজেন্ডা সেটাকে গঠন করে বা রূপ দেয় বা তৈরি সেটার বাইরে নিয়ে গিয়ে।

 

শিল্পকর্ম পরিচিতি:

Virgin Mary ১৯১৯২

মোম, চীযক্লথ এবং কাঠ, ইস্পাতের ভিত্তিসহ

১৭১.৫ X ৬৬ X ৩৬.৮ সে.মি.

 

ট্রেসি মোফাট (Tracy Moffatt)

(জন্ম ১৯60)

শর্টস আর চপ্পল পরা একটি মেয়ে একটি গাড়ির সামনে গুঁড়ি মেরে বসে আছে। ছবির বাইরের কারো বা কোনো কিছুর দিকে তাকিয়ে সে একটা গাড়ির হেড ল্যাম্প মুছছে। তার মুখটা গম্ভীর, বলা চলে উদ্বিগ্ন। ছবিটা আমাদেরকে সময়ের পথ ধরে পেছনে নিয়ে যায়, আমাদের স্মৃতির রাজ্যে; অথবা অতীতের কোনো স্মৃতিকাতরতাপূর্ণ কল্পনায় মগ্ন করে, যে-অতীতের দেখা মেলে পুরানো পারিবারিক আলোকচিত্রগুলোয়। সে যা-ই হোক, ছবির শিরোনামটা একটা বিষণ্ণ ভাব এনে দেয় : Useless, ১৯৭৪; আর ক্যাপশনটা যেন প্রতিচ্ছবিটায় ভীতির বীজ বুনে দেয়: “তার বাবার কাছে তার নাম ছিল ‘Useless’ ( ফাল্তু) ।”

মোফাট Scarred for life সিরিযের জন্য মোট নয়টি লিথোগ্রাফ তৈরি করেছিলেন। এবং লিথোগ্রাফগুলো অ্যাভোকেডো রঙের বাথরুম সেট, মোটরগাড়ির ক্রোমিয়াম রঙের বহিরাবরণ, এবং পারিবারিক নানান গুপ্তরহস্যের জমানায় ঐতিহাসিক পরম্পরা অনুযায়ী সাজানো হয়েছিল : দুজনের উপযোগী একটি বিছানায় একজন নগ্ন পুরুষ একটি কমবয়েসী মেয়েকে ভয় দেখাচ্ছে; দুই বালক পুতুল নিয়ে খেলতে গিয়ে ধরা পড়েছে; পারিবারিক ঝগড়া-বিবাদের সময় টিনেজার এক বালিকা তার আসল বাবার নাম জেনে ফেলেছে। মোফাট বলেন,  “ব্যাপারটা একটু আতংকজনক হলে সে-সম্পর্কে আমার আগ্রহ জন্মে।” ক্যাপশনগুলো এই প্রতিচ্ছবিগুলোতে একটা ডকুমেন্টারির  ছোঁয়া এনে দেয়, তবে কুশীলবদের ব্যবহার করা থেকে শুরু ক’রে মোফাট যেভাবে প্রতিটি দৃশ্য নির্মাণ করেন তার মধ্যে একটা কিছু সাজিয়ে তোলার ব্যাপার রয়েছে। তিনি একজন নির্দেশক বা পরিচালকের মতো কাজ করেন, এবং সতর্কতার সঙ্গে ফ্রেমবন্দি-করা এই কাজগুলো সেই সব মানুষের নানান প্রশ্ন আমাদের সামনে তুলে ধরে যারা গোটা জীবনকে তৈরি করেছে তাদের চিন্তাশূন্য মন্তব্য দিয়ে অথবা গ্রহণযোগ্য আচার-ব্যবহার সম্পর্কে পূর্বকল্পিত জেন্ডার বিষয়ক মতামতের মাধ্যমে।

 

 

 

শিল্পকর্ম পরিচিতি:

Useless, ১৯৭৪; Scarred for Life  ১৯৯৪ সিরিয থেকে

কাগজে রঙিন লিথোগ্রাফ

৮০ X ৬০ সে. মি.

 

(চলবে)

পর্ব-১: শিরীন নিশাত ও যারিনা হাশমি- দ্রোহ আর স্মৃতিকাতরতা

পর্ব-২: মহাজাগতিক সৃজনকারী শক্তি ও নারীর স্বরূপে ফেরা

পর্ব-৩: শিল্পের নতুন বিষয় ও শিল্পীর শরীর

পর্ব-৪: শ্রম বৈষম্য এবং সন্তান পালনের দলিল

পর্ব-৫: নারীর প্রতীকী ইতিহাস এবং শিল্পকর্ম হিসেবে দেহ

পর্ব-৬: দেহ ভাস্কর্য ও চিরন্তন মাতৃসত্তার বিরুদ্ধচিত্র

পর্ব-৭: গার্হস্থ্য জীবন আর অন-স্ক্রীন নারীত্বের স্বরূপ উন্মোচন

পর্ব-৮: দেহাস্ত্র এবং অনিরপেক্ষ প্রতিচ্ছবি

পর্ব-৯: বোধ স্বতন্ত্র এবং ফিউশন অস্বস্তিকর

পর্ব-১০ নির্যাতন নিরন্তর ও পিতৃতান্ত্রিক বিশ্বে নারী হওয়ার জটিলতা

পর্ব-১১: ব্যক্তিগত ক্ষমতায়ন এবং কৃষ্ণাঙ্গ নারী সমকামীর অভিজ্ঞতা