November 23, 2024
অনুবাদসাহিত্যবই নিয়ে আলাপ

পর্ব-১৫: দৈনন্দিনের একঘেয়েমি আর শিল্পে গেরিলাযুদ্ধ

শিল্প সমালোচক, লেখক শার্লট মালিন্সের A Little Feminist History of Art বইটি বাংলায় অনুবাদ করছেন বিশিষ্ট অনুবাদক, শিক্ষক জি এইচ হাবীব। বইটির অনুবাদ ধারাবাহিকভাবে প্রকাশ হচ্ছে ফেমিনিস্ট ফ্যাক্টরে। আজ পড়ুন এর  পঞ্চদশ পর্ব। সব পাঠকের সুবিধার জন্য প্রতি পর্বের শুরুতে বইটির এবং লেখক শার্লট মালিন্সের সংক্ষিপ্ত পরিচিতি দেয়া থাকবে।।

[নারীবাদী শিল্প আন্দোলনের শুরু ১৯৬০-এর দশকের শেষের দিকে। পুরুষ প্রাধান্যবিশিষ্ট রঙ্গমঞ্চে প্রতিযোগিতায় অবতীর্ণ হওয়ার জন্যে সে সময় নারী শিল্পীরা তাঁদের কাজগুলোর জেন্ডারচ্যুতি ঘটাবার সংগ্রামে নামেন। এরপর থেকে সেই আন্দোলন শিল্প জগতে গোটা বিশ্বজুড়ে অন্যতম প্রধান ভূমিকা পালন ক’রে আসছে। ‘নন্দনতাত্ত্বিক ফরমালিযম’ ব’লে অভিহিত যুগের পর সামাজিকভাবে প্রাসঙ্গিক নানান ইস্যুতে কথা বলার জন্য ‘নারীদৃষ্টি’-র সাহায্যে নারী শিল্পীরা বিভিন্ন মাধ্যমে কাজ ক’রে জেন্ডার, পরিচয় এবং ফর্মের দিকে সবার দৃষ্টি আকর্ষণ করতে চেয়েছেন, সমালোচনা করেছেন সাংস্কৃতিক প্রত্যাশাগুলোকে এবং নারীকে সনাতনী দৈনন্দিন ধারণায় আটকে ফেলার ব্যাপারটিকে। সমাজের দৃষ্টি ঘোরাতে চেয়েছেন সাম্যের জন্যে নারীর সংগ্রাম এবং নারীদেহকে পণ্য হিসেবে দেখবার মানসিকতা ও ক্রিয়াকর্মের দিকে। “অল্প কথায় নারীবাদী শিল্প-ইতিহাস” (A Little Feminist History of Art) নামের ছোট্ট বইটিকে এই আন্দোলনের ফসল হিসেবে জাত অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ কিছু শিল্পকর্মের সংক্ষিপ্ত কিন্তু সারগর্ভ ভূমিকা বলা যেতে পারে। ১৯৬০-এর দশক থেকে বর্তমান কাল অব্দি পঞ্চাশটি অসামান্য কাজ নারীর জীবন ও অভিজ্ঞতাকে তুলে ধরেছে। সেই সঙ্গে, ভিয্যুয়াল সংস্কৃতির ওপর নারীবাদী আদর্শ ও রাজনীতি যে প্রভাব ফেলেছে সেটাও এই কাজগুলো মেলে ধরেছে। “অল্প কথায় নারীবাদী শিল্প-ইতিহাস” নামের এই গ্রন্থটি জেন্ডার বৈষম্য, যৌনতা, গার্হস্থ্য জীবন, ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা আর নারী দেহের মতো বিষয়গুলো খতিয়ে দেখা বিংশ শতকের সবচাইতে উচ্চাকাঙ্ক্ষী, প্রভাবশালী ও টেকসই শৈল্পিক আন্দোলনগুলোর একটির আনন্দ উদযাপন। 

শার্লট মালিন্স একজন শিল্প সমালোচক, লেখক এবং সম্প্রচারক। তিনি রেচল হোয়াইরিড, সেসিলি ব্রাউন, র‌্যাচেল লামসডেন,  জেনি স্যাভিল, ক্যাথে ডে মনসাউক্স, স্যু অ্যারোস্মিদ, সুজ্যান কুন, স্যুযি হ্যামিলটন এবং পলা রেগোসহ বিভিন্ন নারী শিল্পীকে নিয়ে লেখালেখি করেছেন। তাঁর রচিত ও প্রকাশিত বিভিন্ন গ্রন্থের মধ্যে রয়েছে “লাইভ্স অভ দ্য গ্রেট আর্টিস্টস” (২০০৮) এবং “র‌্যাচেল হোয়াইহেড” (২০০৭)। তিনি বিবিসি রেডিও ফোর-এর “ফ্রন্ট রো” এবং “স্যাটারডে রিভিউ’’-র নিয়মিত প্রদায়ক]

 

লরি সিমন্স (Laurie Simmons)

(জন্ম ১৯৪৯)

লরি সিমন্স Early Colour Interiors শিরোনামের সিরিযটি নিউ ইয়র্কে অবস্থিত তাঁর অ্যাপার্টমেন্টে ব’সে শুরু করেছিলেন; তখন তিনি নানান ধরনের খুচরো কাজ ক’রে জীবনধারণ করছেন আর সেই সঙ্গে শিল্পচর্চা চালিয়ে যাচ্ছেন- স্টুডিওতে কাজ করার চাইতে তিনি ঘরে ব’সে কাজ করাই বেশি পছন্দ করতেন। তো, এর কয়েক বছর আগে তিনি বন্ধ হবো হবো করছে এমন একটা খেলনার দোকান থেকে একটা ‘পুতুলের সংসার’ (ডলস হাউস) কিনেছিলেন। ১৯৭৬ সাল থেকে তিনি সেটার ছবি তুলতে শুরু করেন, ১৯৭৮ সালে রঙীন ছবির দিকে চলে যান, এবং পুতুলের সংসারে নানান আনুপাতিক মাপের পুতুল যোগ করেন।

Blonde / Red Dress / Kitchen / Milk  ১৯৫০-এর দশকের এক গৃহবধূর প্রতিচ্ছবি; তাঁর পরনে ফুলেল পোশাক। একটা রান্নাঘরে দাঁড়ানো। ছবিটি দর্শকের মনে একটা আবদ্ধতার ভীতির জন্ম দেয়। ৬টা বাজে, কিন্তু টেবিলে কোনো চা নেই; বরং মুদির দোকান থেকে কেনা নানান জিনিসের একটা সসেমিরা দশা সেখানে; ওদিকে সিংকে রয়েছে নানান থালা-বাসন-গামলা, আর চুলার ওপর প্যান। যেন তিনি সব জিনিস-পত্তর থেকে মন সরিয়ে একটু দম নিচ্ছেন, ভাবছেন তিনি কী করছেন। কড়া আলোতে ছবিটা ওপর থেকে তোলা হয়েছে, এবং তাতে তাঁকে মনে হচ্ছে যেন তিনি কোনো দ্বীপে পরিত্যাক্ত, নিঃসঙ্গ অবস্থায় আছেন; তাঁর দৃষ্টি অবনত। বাম দিকে একটা অশুভ ছায়া যেন ওঁত পেতে আছে, আর তাতে ক’রে অস্বস্তির গা শিরশিরে অনুভূতিটা বেড়ে গেছে।

রঙের ব্যবহার এই প্রতিচ্ছবিগুলোকে কমার্শিয়াল ফটোগ্রাফির সঙ্গে এক ক’রে দিয়েছে। সিমন্স গৃহে নারীর ভূমিকার ব্যাপারে প্রশ্ন তুলেছেন, এবং বিজ্ঞাপিত গার্হস্থ্য পরম সুখের প্রত্যাশিত  নিখুঁতত্বের সঙ্গে অসংখ্য নারী যে-অভিজ্ঞতার ভেতর দিয়ে যান সেটার বৈপরীত্য তুলে ধরেছেন, এবং সে-অভিজ্ঞতা দৈনন্দিন সাধারণত্ব, একঘেয়েমি আর নিঃসঙ্গতা বা বিচ্ছিন্নতার ।

 

 

শিল্পকর্ম পরিচিতি:

Blonde / Red Dress / Kitchen / Milk  ১৯৭৯

আলোকচিত্র; কাগজে রঙীন সিবাক্রোম প্রিন্ট

৮.৯  X ১২.৭

 

গেরিলা গার্লস (Guerrilla Girls)

(১৯৮৫ সালে প্রতিষ্ঠিত)

আজ থেকে পঁয়ত্রিশ বছর আগে ১৯৮৫ সালে নিউ ইয়র্কের শিল্প পরিমণ্ডলে গেরিলা গার্লস-এর আবির্ভাব রীতিমত সাড়া ফেলে দিয়েছিল। সক্রিয় নারী শিল্পীদের এই দলটির উদ্দেশ্য ছিল নারীবাদকে আবার জাগিয়ে তোলা। তাঁরা (পুরুষদের) বিজ্ঞাপনী ভাষা আত্মসাৎ ক’রে নিজেদের বার্তা রাস্তায় রাস্তায় ছড়িয়ে দিয়েছিলেন, এবং বিভিন্ন স্থানে নানান সারগর্ভ টেক্সট সম্বলিত পোস্টার সেঁটে জাদুঘরগুলোর উদ্দেশে চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে দিয়েছিলেন, যাতে সেগুলো আরো বেশি ক’রে নারী এবং অ-শ্বেতাঙ্গ শিল্পীদের কাজের প্রদর্শনীর ব্যবস্থা করে। তাছাড়া, গেরিলা গার্লস বাণিজ্যিক গ্যালারিগুলোকে সেগুলোর জাতিগত এবং  লৈঙ্গিক বৈষম্যের কারণেও সমালোচনা করেছিলেন।

Do women have to be naked to go into the Met. Museum?  (মেট্রোপলিটন জাদুঘরে প্রদর্শিত হওয়ার জন্যে নারীদেরকে কি নগ্ন হতেই হবে?) ছিল মূলত নিউ ইয়র্ক পাবলিক আর্ট ফান্ডের একটি বিলবোর্ড প্রকল্প। গেরিলা গার্লস-এর পোস্টারের প্রমাণ সাইজের নমুনাটি প্রত্যাখ্যাত হলে পরে তাঁরা নিজেরাই প্রকল্পটির জন্য পয়সা জোগাড় করেন এবং Jean Auguste Dominique Ingres-এর La Grande Odalisque ১৮১৪ চিত্রটি গরিলার মুখোশ শোভিত হয়ে নিউ ইয়র্কের নানান বাসের গায়ে চড়ে সারা শহর পাক খেয়ে বেড়াতে থাকে। গেরিলা গার্লস পরে এই কাজটিকে তাঁদের Guerrilla Girls Talk Back (গেরিলা গার্লস-এর প্রত্যুত্তর) নামের প্রিন্ট পোর্টফোলিও-র অংশ হিসেবে অবমুক্ত করে।

গেরিলা গার্লস এমনকি ওয়ার্কশপ এবং বক্তৃতা পরিচালনা করার সময়-ও পুরো পাবলিক ইভেন্টজুড়ে গরিলার মুখোশ প’রে এবং ফ্রিদা কাহলো বা কেতে কোলভিৎস-এর মতো মৃত নারী শিল্পীদের নাম ধারণ ক’রে নিজেদের আড়ালে রাখেন। এই পরিচয়হীনতার ফলে দলটির ধ্যান-ধারণার প্রতি-ই জনগণের আসল নজর পড়ে, স্বতন্ত্র কোনো সদস্যের ওপর নয়। দলটিতে কে বেশি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন কে কম, এই শ্রেণী বা স্তরবিন্যাসের বিষয়টি নিয়ে দর্শক ভাবিত হওয়ার সুযোগ পান না।  এই যূথবদ্ধ স্তরবিন্যাসহীনতার বিষয়টি আজো দলের ভেতর রক্ষা করা হয়।

 

 

শিল্পকর্ম পরিচিতি:

Do women have to be naked to go into the Met. Museum?  ১৯৮৯

কাগজে স্ক্রিনপ্রিন্ট

২৮ X ৭১

 

 

শিল্পকর্ম পরিচিতি:
Grande Odalisque (Une Odalisque বা La Grande Odalisque) ১৮১৪
তৈলচিত্র
৮৮.৯ X ১৬২.৫৬ সে.মি.
অবস্থান : লুভ্, প্যারিস

 

(চলবে)

পর্ব-১: শিরীন নিশাত ও যারিনা হাশমি- দ্রোহ আর স্মৃতিকাতরতা

পর্ব-২: মহাজাগতিক সৃজনকারী শক্তি ও নারীর স্বরূপে ফেরা

পর্ব-৩: শিল্পের নতুন বিষয় ও শিল্পীর শরীর

পর্ব-৪: শ্রম বৈষম্য এবং সন্তান পালনের দলিল

পর্ব-৫: নারীর প্রতীকী ইতিহাস এবং শিল্পকর্ম হিসেবে দেহ

পর্ব-৬: দেহ ভাস্কর্য ও চিরন্তন মাতৃসত্তার বিরুদ্ধচিত্র

পর্ব-৭: গার্হস্থ্য জীবন আর অন-স্ক্রীন নারীত্বের স্বরূপ উন্মোচন

পর্ব-৮: দেহাস্ত্র এবং অনিরপেক্ষ প্রতিচ্ছবি

পর্ব-৯: বোধ স্বতন্ত্র এবং ফিউশন অস্বস্তিকর

পর্ব-১০ নির্যাতন নিরন্তর ও পিতৃতান্ত্রিক বিশ্বে নারী হওয়ার জটিলতা

পর্ব-১১: ব্যক্তিগত ক্ষমতায়ন এবং কৃষ্ণাঙ্গ নারী সমকামীর অভিজ্ঞতা

পর্ব-১২: পেশল বাস্তবতা আর পূর্বকল্পিত জেন্ডার বিষয়ক মতামত

পর্ব-১৩: সঙ্গীতের মহাফেজখানা আর ঐতিহাসিক পেইন্টিং-এর ভিন্ন বয়ান

পর্ব-১৪: সাদা কার্ড বাদামি কার্ড আর নারীর চোখে নারী