শিক্ষিত উপার্জনক্ষম নারীকে পরানো নতুন বেড়ির গল্প
ভগবতী রায়।। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইসলামিক স্টডিজ বিভাগের এক ছাত্রী সম্প্রতি শ্বশুর শাশুড়ি স্বামীর নির্মম নির্যাতনে মৃত্যুবরণ করেছেন বলে মেয়েটির মা অভিযোগ করেছেন। এই বিষয়টি নিয়ে ইতোমধ্যেই অনেক পত্রিকায় লেখালেখি হয়েছে। অনেকে এরকম মন্তব্যও করেছেন যে, ছাত্রীর বাপের বাড়ির পরিবার তো জানতো যে, তাদের মেয়েটা প্রতিনিয়ত শ্বশুরবাড়িতে নির্যাতনের শিকার হচ্ছিল। তাহলে কেন তার পরিবারের লোকজন এর কোন প্রতিকার করেনি বা মেয়েটাকে স্বামীর বাড়ি থেকে নিয়ে আসেনি বা আইনি কোন প্রতিকার প্রার্থণা করেনি? এরকম হাজারো প্রশ্ন এখন লোকমনে। মেয়েটির চাচাতো ভাই বলছে, ‘আমার আপুকে মেরে ফেলা হয়েছে।আমি এর বিচার চাই।’ অনেকে এমন মন্তব্যও করেছেন যে, মেয়েটি যে রূঢ় বাস্তবতার শিকার হল এসব ক্ষেত্রে মেয়েটির নিজের পরিবারের দায়ও কিন্তু অস্বীকার করার মত না।
উপরে উল্লিখিত বিষয়ে আমার কিছু মতামত আছে। মেয়েটির পরিবার যে মেয়েটিকে পর্যাপ্ত সাপোর্ট দিতে পারেনি, এজন্য কিন্তু সমাজেরও দায়বদ্ধতা আছে। যদিও কেউ না খেয়ে থাকলেও এই সমাজের কারও কিছু আসে যায় না। তারপরও আমরা কিন্তু সমাজকে উপেক্ষা করতে পারছি না। ধরে নেয়া হল মেয়েটির পরিবার মেয়েটিকে ডিভোর্স করায়ে এনে তার স্বপ্নপূরনের পথে সহায়ক ভূমিকা পালন করছে। কিন্তু আশেপাশে মেয়েটিকে নিয়ে যে নানা কুৎসা রটনা করা হবে, বলা হবে মেয়েটির চরিত্র ভাল না তাই স্বামীর ঘর টেকেনি, আবার এমনও হতে পারে মেয়েটি বদমেজাজী ছিল, শ্বশুর শাশুড়ি স্বামীকে সম্মান করত না, তাই তার সংসার টেকেনি। ঠিক কাঁটা ঘায়ে নুনের ছিটা পড়লে যেমন হয় এরকম সুতীক্ষ্ম বাক্যবাণ আশেপাশের লোকজন ছুঁড়তে থাকবে। কিছু পরিবার হয়ত এত কিছুরও পরও তাদের মেয়েদের পাশে দাঁড়াতে পারে, আর কিছু পরিবার হয়ত পারে না। কিছু পরিবার যে পারে না তার মধ্যে হয়ত এই পরিবারটিও থাকতে পারে। কারণ পত্রিকা পড়ে যতটুকু মনে হল যে মেয়েটির বাবা নাকি বিয়ের পরও মেয়ের পড়াশোনার সমস্ত খরচ চালাতেন। সম্প্রতি মেয়ের বাবা মারা যান। তাই মেয়েটিকে সাপোর্ট দেয়ার মত হয়ত তেমন কেউ ছিল না। তাই তাকে হয়ত এমন নিদারুন পরিণতির শিকার হতে হল।
সাধারনত যখন মেয়েরা ডিভোর্সপ্রাপ্ত হয় তখন সবার আঙ্গুল কিন্তু সেই মেয়েটার দিকেই ওঠে,পুরুষটার দিকে নয়। বিষয়টা এরকম যেন সংসার ভাঙ্গার পুরো দায় মেয়ের, ছেলের এখানে কোন দায় নাই। বেগম রোকেয়া মেয়েদের শিক্ষিত করে কর্মক্ষেত্রে ছেড়ে দিতে বলেছিলেন যেন তারা নিজেরা নিজেদের ভাতকাপড়ের দায়িত্ব নেয়া শিখতে পারে। এই একবিংশ শতাব্দীতে এসে আজ অনেক মেয়ে হয়ত নিজেরা নিজেদের দায়িত্ব নেয়া শিখে গেছে। কিন্তু যখনই তারা সংসার নামক বেড়াজালে পড়ছে তখন কিন্তু আবার তাদের পায়ে শিকল পড়ানো হচ্ছে। এ রকম হাজারো নজির আছে যে, মেয়ে উপার্জন করে ঠিকই, বেতনের চেকে সইও করে ঠিকই, কিন্তু তার মাসিক বেতন আর তার দু’চোখে দেখা হয় না। সেই মাসিক বেতন তোলে তার স্বামী। যদি মেয়েটা কখনও এর প্রতিবাদ করে তাহলে তার সংসারে অশান্তি শুরু হবে এবং যদি সে তার হক দাবি করে তাহলে তার কপালে জুটবে ডিভোর্সের তকমা। মনে করেন মেয়েটার ডিভোর্স হয়ে গেল, তারপরও যে সে নিজের মত করে একটু বাঁচবে সেটাও তার জন্য অনেক কষ্টকর হয়ে পড়ে। ছোট্ট একটা উদাহরণ দেই, যদি কোন বাড়িওয়ালা এটা শোনে যে, মেয়েটা ডিভোর্সি এবং সে বাসা ভাড়া নিয়ে একাই থাকতে চায় তাহলে সেই ডিভোর্সি মেয়ের পক্ষে হয়ত ভাড়া বাসা পাওয়ায় কঠিন হয়ে পড়বে। এ তো গেল ছোট্ট একটা নমুনা। এরপরও যে আরও কত ঝক্কি ঝামেলা আছে সেটার ব্যাপারে হয়ত আর একদিন আলোচনা করা যাবে। আসলে মেয়েরা শিক্ষিত হচ্ছে, উপার্জন করছে কিন্তু সেই উপার্জনের পয়সা তারা স্বাধীনভাবে কাজে লাগাতে পারছেনা।
তাই একবিংশ শতাব্দীতে এসেও এই সুশিক্ষিত, উপার্জনক্ষম মেয়েদের পায়ে আর এক অদৃশ্য বেড়ি পড়ানো হয়ে গেছে। বেগম রোকেয়া হয়ত তৎকালীন সময়ে ভেবেছিলেন যে, মেয়েরা যদি নিজের পায়ে দাঁড়ায় তাহলে হয়ত তাদের দুঃখ দুর্দশা অনেকাংশে লাঘব হবে। কিন্তু উপার্জনক্ষম হওয়ার পরেও যে মেয়েরা উপার্জনহীন হয়ে পড়ে থাকবে এটা হয়ত বেগম রোকেয়ারন কল্পনাতেও ছিল না।
[ফেমিনিস্ট ফ্যাক্টরে প্রকাশিত মুক্তমত লেখকের নিজস্ব বক্তব্য]