পর্ব-২৩: নারী অধিকারের মানে এবং ‘দ্য আদার সাইড’
শিল্প সমালোচক, লেখক শার্লট মালিন্সের A Little Feminist History of Art বইটি বাংলায় অনুবাদ করছেন বিশিষ্ট অনুবাদক, শিক্ষক জি এইচ হাবীব। বইটির অনুবাদ ধারাবাহিকভাবে প্রকাশ হচ্ছে ফেমিনিস্ট ফ্যাক্টরে। আজ পড়ুন এর তেইশতম পর্ব। সব পাঠকের সুবিধার জন্য প্রতি পর্বের শুরুতে বইটির এবং লেখক শার্লট মালিন্সের সংক্ষিপ্ত পরিচিতি দেয়া থাকবে।।
[নারীবাদী শিল্প আন্দোলনের শুরু ১৯৬০-এর দশকের শেষের দিকে। পুরুষ প্রাধান্যবিশিষ্ট রঙ্গমঞ্চে প্রতিযোগিতায় অবতীর্ণ হওয়ার জন্যে সে সময় নারী শিল্পীরা তাঁদের কাজগুলোর জেন্ডারচ্যুতি ঘটাবার সংগ্রামে নামেন। এরপর থেকে সেই আন্দোলন শিল্প জগতে গোটা বিশ্বজুড়ে অন্যতম প্রধান ভূমিকা পালন ক’রে আসছে। ‘নন্দনতাত্ত্বিক ফরমালিযম’ ব’লে অভিহিত যুগের পর সামাজিকভাবে প্রাসঙ্গিক নানান ইস্যুতে কথা বলার জন্য ‘নারীদৃষ্টি’-র সাহায্যে নারী শিল্পীরা বিভিন্ন মাধ্যমে কাজ ক’রে জেন্ডার, পরিচয় এবং ফর্মের দিকে সবার দৃষ্টি আকর্ষণ করতে চেয়েছেন, সমালোচনা করেছেন সাংস্কৃতিক প্রত্যাশাগুলোকে এবং নারীকে সনাতনী দৈনন্দিন ধারণায় আটকে ফেলার ব্যাপারটিকে। সমাজের দৃষ্টি ঘোরাতে চেয়েছেন সাম্যের জন্যে নারীর সংগ্রাম এবং নারীদেহকে পণ্য হিসেবে দেখবার মানসিকতা ও ক্রিয়াকর্মের দিকে। “অল্প কথায় নারীবাদী শিল্প-ইতিহাস” (A Little Feminist History of Art) নামের ছোট্ট বইটিকে এই আন্দোলনের ফসল হিসেবে জাত অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ কিছু শিল্পকর্মের সংক্ষিপ্ত কিন্তু সারগর্ভ ভূমিকা বলা যেতে পারে। ১৯৬০-এর দশক থেকে বর্তমান কাল অব্দি পঞ্চাশটি অসামান্য কাজ নারীর জীবন ও অভিজ্ঞতাকে তুলে ধরেছে। সেই সঙ্গে, ভিয্যুয়াল সংস্কৃতির ওপর নারীবাদী আদর্শ ও রাজনীতি যে প্রভাব ফেলেছে সেটাও এই কাজগুলো মেলে ধরেছে। “অল্প কথায় নারীবাদী শিল্প-ইতিহাস” নামের এই গ্রন্থটি জেন্ডার বৈষম্য, যৌনতা, গার্হস্থ্য জীবন, ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা আর নারী দেহের মতো বিষয়গুলো খতিয়ে দেখা বিংশ শতকের সবচাইতে উচ্চাকাঙ্ক্ষী, প্রভাবশালী ও টেকসই শৈল্পিক আন্দোলনগুলোর একটির আনন্দ উদযাপন।
শার্লট মালিন্স একজন শিল্প সমালোচক, লেখক এবং সম্প্রচারক। তিনি রেচল হোয়াইরিড, সেসিলি ব্রাউন, র্যাচেল লামসডেন, জেনি স্যাভিল, ক্যাথে ডে মনসাউক্স, স্যু অ্যারোস্মিদ, সুজ্যান কুন, স্যুযি হ্যামিলটন এবং পলা রেগোসহ বিভিন্ন নারী শিল্পীকে নিয়ে লেখালেখি করেছেন। তাঁর রচিত ও প্রকাশিত বিভিন্ন গ্রন্থের মধ্যে রয়েছে “লাইভ্স অভ দ্য গ্রেট আর্টিস্টস” (২০০৮) এবং “র্যাচেল হোয়াইহেড” (২০০৭)। তিনি বিবিসি রেডিও ফোর-এর “ফ্রন্ট রো” এবং “স্যাটারডে রিভিউ’’-র নিয়মিত প্রদায়ক]
জিয়াও লু (Xiao Lu)
(জন্ম ১৯৬২)
বেইজিং-এ ১৯৮৯ সালে China/Avant-Garde নামে যে প্রদর্শনীর আয়োজন করা হয় সেখানে জিয়াও লু-র ডায়ালগ–ও ছিল। প্রদর্শনীর উদ্বোধনীর দিন স্বতঃস্ফূর্তভাবেই তিনি সিদ্ধান্ত নেন সেটায় একটা পারফরমেন্স যোগ করবেন। এক বন্ধুকে বলেন তাঁর ক্রিয়া-কর্ম রেকর্ড করতে। গ্যালারির কর্মচারীদেরকে বুঝতে না দিয়ে তিনি হঠাৎ দুই ফোনবক্সের মধ্যেখানের আয়না বরাবর দুটো গুলি চালিয়ে সেটায় চিড় ধরিয়ে দেন। চীনে সমসাময়িক নারী শিল্পীদের অস্তিত্ব জানান দিয়ে পারফরমেন্সটি কিংবদন্তীর মর্যাদা লাভ করে।
গোড়াতে জিয়াও লু ডায়ালগ-কে একটি নারীবাদী কাজ হিসেবে চিন্তা করেননি, সেটা যে-চিন্তা থেকে উৎসারিত তার কারণে সেটাকে সেরকম ভাবা যেতে পারতো।কাজটাকে তিনি তাঁর নিজের অতীত নিয়ে তাঁর ছেলেবন্ধুর সঙ্গে খোলামেলাভাবে আলাপ করতে না পারার ব্যর্থতা বিষয়ক ব’লে গণ্য করেছেন, যে-অতীতে যৌন নির্যাতনের ব্যাপার জড়িত ছিল। পরে তিনি তাঁর পেশাগত জীবনে নারীবাদী তত্ত্বে নিজেকে নিমগ্ন করেছেন এবং অন্যান্য নারীর অভিজ্ঞতা খতিয়ে দেখবার জন্য নিজের চর্চার পরিসর বৃদ্ধি করেছেন। তিনি বলেন, “আমার মনে হয় ‘নারী অধিকার’ কথাটির বিভিন্ন স্তরের অর্থ রয়েছে। প্রথমত, একজন নারীকে অবশ্যই তাঁর মূল্য খুঁজে পেতে হবে, এবং তাঁর স্বাধীনতা বজায় রাখতে হবে… [এবং] নারীকে অবশ্যই ক্ষমতায়িত হতে হবে। চীনে সমালোচকরা একচেটিয়াভাবে পুরুষ, এবং কথা বলার এক্তিয়ার কেবল তাঁদেরই। ফলে, কোনো নারী যখন কোনো সমস্যার সম্মুখীন হন তখন তাঁর যাওয়ার কোনো জায়গা থাকে না। কেউ তাঁর কথা শুনবে না।
শিল্পকর্ম পরিচিতি:
Dialogue ১৯৮৯; পুনর্নির্মাণ ২০১৫
ইন্সটলেশন ও পারফরমেন্স
ন্যান গোল্ডিন (Nan Goldin)
(জন্ম ১৯৫৩)
ন্যান গোল্ডিন-এর Misty and Jimi Paulette in a Taxi, NYC ছবিটি ১৯৯১ সালে তোলা হয়েছিল, যখন তাঁর দুই বন্ধু নিউ ইয়র্কের প্রাইড প্যারেডে ঘুরে ফিরে বেড়াচ্ছিলেন। দুই ড্র্যাগ কুইন* (drag queen) পরচুলা ও প্যাড লাগানো ব্রা প’রে এবং কড়া মেকাপ নিয়ে খুবই ফ্যাশনদুরস্তভাবে সেজেগুজে ছিলেন, কিন্তু তারপরেও তাঁদের গম্ভীর, প্রায় বিষন্ন অভিব্যক্তি এই ছবিটিকে একটি সম্মোহক বৈশিষ্ট্য দান করেছে। কিছু স্বাভাবিক অনুপুঙ্খ আমাদের নজরে পড়ে: ফিশনেট-এর চূড়ায় বড় বড় ছিদ্র, ট্যাক্সির নোংরা রিয়ার উইন্ডো, আর সেই সঙ্গে মাত্রাতিরিক্ততা, গ্লামার ও মেকি অক্ষিপক্ষের সমান্তরাল জগতে পলায়নের বাসনা।
ড্র্যাগ জগতের প্রতি গোল্ডিনের বিমুগ্ধতার শুরু সেই তখন থেকে যখন তিনি ১৯৭০-এর দশকে বোস্টন স্কুল অভ্ আর্ট-এর শিক্ষার্থী। ১৯৭৮ সালে তিনি যখন নিউ ইয়র্কে থাকার জন্যে আসেন তখন তিনি তাঁর চারপাশের যাঁদেরকে দেখেছেন তাঁদের ছবি তুলতে থাকেন। সৃষ্টি হতে থাকে সম্পর্কের চলমান প্রতিচ্ছবি, যৌনতার ও মাদক সেবনের স্বতঃস্ফূর্ত দৃশ্য, এইডসে মৃত্যুপথযাত্রী বন্ধুদের দুঃসহ কঠিন প্রতিকৃতি, সবচাইতে উল্লেখযোগ্যভাবে The Ballad of Sexual Dependency (১৯৭৯-৮৬) –তে।
১৯৯০-এর দশকে তাঁর কাজ প্রায়শই নারীবাদের ব্যাপকতর সংজ্ঞার আলোকে দেখা হতে থাকে, যখন তিনি নারী-পুরুষের সনাতন বাইনারি বিভাজনের বাইরে নতুন এলাকা খতিয়ে দেখতে শুরু করেন। ১৯৯৩ সালে তিনি ড্র্যাগ কুইনদেরকে আরো অনিশ্চিত জেন্ডার ক্যাটাগরির অংশ হিসেবে বর্ণনা করেন: তৃতীয় লিঙ্গ। ড্র্যাগ জগতের আলোকচিত্রগুলোর প্রতি উৎসর্গীকৃত তাঁর প্রভাববিস্তারী গ্রন্থ দ্য আদার সাইড- তিনি লিখেছেন “আমি কখনোই তাঁদেরকে নারীর সাজে সজ্জিত পুরুষ হিসেবে দেখিনি, বরং একেবারেই ভিন্ন কিছু হিসেবে দেখেছি- দেখেছি একটি তৃতীয় জেন্ডার হিসেবে, যা অন্য দুটো জেন্ডারের যে কোনেটির চাইতে বেশি অর্থ বহন করে।
*(ড্র্যাগ কুইন এমন একজন ব্যক্তি যিনি সাধারণত পুরুষ, এবং তিনি ভিন্ন লিঙ্গের বা জেন্ডারের পোশাক প’রে ও মেকআপ ক’রে লোকজনকে বিনোদিত করার জন্য সাধারণত বাড়াবাড়ি রকমের ফিমেল জেন্ডারবাচক আচার-আচরণ ইত্যাদির অবতারণা করেন। ঐতিহাসিকভাবে, বেশিরভাগ ড্রাগন কুইনই পুরুষ ছিলেন যাঁরা নারীর পোশাক পরিধান করতেন। কিন্তু আধুনিক সময়ে ড্রাগন কুইনরা সমকামী পুরুষ এবং সমকামী সংস্কৃতির সাথে সম্পর্কিত। তবে তাঁরা যে-কোনো লিঙ্গ এবং যৌন পরিচয়বাহী হতে পারেন।)
শিল্পকর্ম পরিচিতি:
Misty and Jimi Paulette in a Taxi, NYC ১৯৯১
আলোকচিত্র; কাগজে ডাই ডেস্ট্রাকশন বা ডাই ব্লিচের মাধ্যমে প্রিন্ট নিয়ে বোর্ডের ওপর বসানো
৬৯.৫ X ১০১.৫
(চলবে)
পর্ব-১: শিরীন নিশাত ও যারিনা হাশমি- দ্রোহ আর স্মৃতিকাতরতা
পর্ব-২: মহাজাগতিক সৃজনকারী শক্তি ও নারীর স্বরূপে ফেরা
পর্ব-৩: শিল্পের নতুন বিষয় ও শিল্পীর শরীর
পর্ব-৪: শ্রম বৈষম্য এবং সন্তান পালনের দলিল
পর্ব-৫: নারীর প্রতীকী ইতিহাস এবং শিল্পকর্ম হিসেবে দেহ
পর্ব-৬: দেহ ভাস্কর্য ও চিরন্তন মাতৃসত্তার বিরুদ্ধচিত্র
পর্ব-৭: গার্হস্থ্য জীবন আর অন-স্ক্রীন নারীত্বের স্বরূপ উন্মোচন
পর্ব-৮: দেহাস্ত্র এবং অনিরপেক্ষ প্রতিচ্ছবি
পর্ব-৯: বোধ স্বতন্ত্র এবং ফিউশন অস্বস্তিকর
পর্ব-১০ নির্যাতন নিরন্তর ও পিতৃতান্ত্রিক বিশ্বে নারী হওয়ার জটিলতা
পর্ব-১১: ব্যক্তিগত ক্ষমতায়ন এবং কৃষ্ণাঙ্গ নারী সমকামীর অভিজ্ঞতা
পর্ব-১২: পেশল বাস্তবতা আর পূর্বকল্পিত জেন্ডার বিষয়ক মতামত
পর্ব-১৩: সঙ্গীতের মহাফেজখানা আর ঐতিহাসিক পেইন্টিং-এর ভিন্ন বয়ান
পর্ব-১৪: সাদা কার্ড বাদামি কার্ড আর নারীর চোখে নারী
পর্ব-১৫: দৈনন্দিনের একঘেয়েমি আর শিল্পে গেরিলাযুদ্ধ
পর্ব-১৬: আশ্রয়স্থল কিংবা কারাগার আর ফিমেল আর্টের অনুসন্ধান
পর্ব-১৭: নারীর দেহভাষা আর পুরুষের প্রত্যাশার বিরুদ্ধাচারণ
পর্ব-১৮: পরিচয় পুনরুদ্ধার এবং ইতিহাসে স্থান পুনর্দখল
পর্ব-১৯: সহজাত প্রবৃত্তিভিত্তিক শিল্প আর শিশু ও মাতার ভিন্ন যাত্রা
পর্ব-২০: দানবীয়তায় ঝোঁক আর মিথ্যে দিয়ে নিজেকে পুনরাবিষ্কার
পর্ব-২১: জেন্ডার ভিন্নতা ও নারীবাদের মূল্য পরীক্ষা
পর্ব-২২: প্রকল্প সমবায়ী এবং শারীরিক অনুভূতির শিল্পরূপ