দুর্যোগে নারী: অবহেলা ও অধিকারহীনতার না দেখা ছবি
তৌকির ইসলাম।। বাংলাদেশের প্রায় এক তৃতীয়াংশ জেলা আজ বন্যায় ভাসছে। কিছুদিন আগে আম্ফানও হানা দিয়ে গেছে। দুর্যোগ ব্যবস্থাপনার একজন শিক্ষার্থী হিসেবে বিভিন্ন প্রজেক্ট এবং থিসিসের সুবাদে দুর্যোগপ্রবণ বেশ কিছু জেলা ঘুরে দেখার সৌভাগ্য আমার হয়েছে। আর সেই ক্ষুদ্র অভিজ্ঞতাকে কাজে লাগিয়ে আজকের এই লিখতে বসা।
একটি দুর্যোগ যখন আঘাত হানে তা প্রকৃতি আর পরিবেশে যতটা না ক্ষতি করে তার অনেক বেশি ক্ষতি সাধন করে আর্থসামাজিক প্রেক্ষাপটে। আর এই প্রেক্ষাপটে সবচেয়ে বেশি ক্ষতির সম্মুখীন হয়ে থাকেন নারীরা এবং তা শারীরিক ও মানসিক উভয় ভাবেই। পুরুষের যে ক্ষতি সাধিত হয় না তা আমি বলছি না। কিন্তু নারীর ক্ষতি হয় বেশি এবং সবচেয়ে বেশি তা উপেক্ষিত হয়।
একটি দুর্যোগ যখন হানা দেয় তখন নারীকেই সর্ব প্রথম তার পরিবারের রক্ষার্থে ভাবতে হয়। সন্তানের সুরক্ষা থেকে শুরু করে গবাদি পশুর নিরাপত্তা ভাবতে গিয়ে নারী নিজেই পড়ে যান বিপদে। কিন্তু সেই সুরক্ষা শতভাগ নিশ্চিত করা হয়তো সম্ভব হয়ে ওঠে না নারীর জন্য। পুরুষও পারেন না শতভাগ নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে। কিন্তু সেই সুরক্ষা নিশ্চিত করতে গিয়ে যখন কোন বিপত্তি ঘটেই যায় তখন প্রথমেই আঙ্গুল ওঠে নারীর দিকে।
একটু উদাহরণ দিয়ে বলি। ধরুন দুর্যোগের সময় একজন নারী তার সন্তান, নগদ অর্থ, ঘরের জিনিসপত্রের সুরক্ষা ঠিকই নিশ্চিত করতে পেরেছেন কিন্তু বানের পানিতে ভেসে গেছে বাড়ির বাছুরটি। বাড়ির বাছুরটি ভেসে যাওয়া নিয়ে নারীকে যতটা পারিবারিক নিন্দা শুনতে হয় বাকি সব কিছু রক্ষার জন্য সে কি সেভাবে প্রশংসিত হয়? মোটেও না।
দুর্যোগে একজন পুরুষের জীবিকা নির্বাহের পথ বন্ধ হয়ে যায়। কিন্তু একজন নারীকে করতে হয় বিশাল যুদ্ধ। দুর্যোগে পানি আনা, রান্না করা, সন্তানের লালন পালন, সকলের সুরক্ষা নিশ্চিত করা- সব কিছুর দায় এসে পড়ে নারীর উপর। এসব কাজে পরিবারের পুরুষ সদস্যকে সহায়ক হিসেবে পাওয়া মুশকিল। পাছে সমাজে তার পুরুষ আইডেন্টিটি খর্ব হয়! একবার এক বন্যা দুর্গত অঞ্চলে গিয়েছিলাম। সেখানে অনেক নারী অভিযোগ করেছিলেন যে বন্যার সময় পুরুষরা সব সময় বাড়িতে থাকেন ফলশ্রুতিতে ঝগড়া হয় অনেক বেশি। অনেকে বলতে পারেন পুরুষের আয় থাকে না আর তাই সে মানসিকভাবে কিছুটা বিক্ষিপ্ত হয়ে এমন আচরণ করেন। কথাটি আংশিকভাবে আমি মানি কিন্তু পরিবারের নারী সদস্য যিনি বিনা পারিশ্রমিকে ননস্টপ সার্ভিস দিয়ে যাচ্ছেন তার কি তাহলে মানসিকভাবে বিক্ষিপ্ত হওয়া স্বাভাবিক নয়! এমনকি দুর্যোগ মুহূর্তেও পরিবারের পুরুষ সদস্যরা কোন কিছুতেই দৃশ্যত কম্প্রমাইজ করতে রাজি নন।
দুর্যোগের সময় নারীর নিরাপত্তা, খাদ্য, স্বাস্থ্য, বাসস্থান ইত্যাদি সকল ধরনের অধিকার অবহেলিত হয়। একটি দুর্যোগের সময় নারীর প্রতি সহিংসতা অনেকাংশে বৃদ্ধি পায়। নারী পাচার, যৌন নির্যাতন, বাল্যবিবাহ ইত্যাদি ব্যাপকহারে বৃদ্ধি পায়। নারীর স্বাস্থ্য ও খাদ্যের বিষয়টি আরও বেশি উপেক্ষিত হয়। নারী মাত্রই কম আহার যথেষ্ট- এখনো সমাজে এই কুসংস্কার প্রচলিত। দুর্যোগের সময় নারী ন্যূনতম খাদ্যটুকু পান না। পুষ্টির ঘাটতিও বেশি পরিলক্ষিত হয় নারী ও মেয়ে শিশুদের মধ্যে। ফলশ্রুতিতে দুর্যোগে একজন নারীর শারীরিক ক্ষতি একজন পুরুষের তুলনায় অনেক বেশি হয়। নারীর প্রজনন স্বাস্থ্য ব্যাহত হয় চরমভাবে।
নারীর ব্যক্তিগত হাইজিনের বিষয়টি মাথায় নিয়ে আমাদের দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা পদ্ধতি আশানুরূপভাবে গড়ে ওঠে নি। আশ্রয়কেন্দ্রগুলোতে নারীর জন্য আলাদা বাথরুমের ব্যবস্থা নেই বললেই চলে। কিশোরী মেয়ে থেকে শুরু করে মধ্যবয়সী নারী- কারো পিরিয়ডকালীন হাইজিন দুর্যোগের সময় নিশ্চিত হয় না। আমাদের কোন আশ্রয়কেন্দ্র একজন প্রসূতি মায়ের জন্য উপযুক্ত কিনা তা নিয়ে রয়েছে সন্দেহ। কোন একটি শেলটারে গর্ভকালীন সেবা পাওয়া দুষ্কর। দুর্যোগ এলে যে নারীর খাবার, নিরাপত্তা, পুষ্টি, প্রজনন স্বাস্থ্য সকল কিছু অবহেলিত হয়, সেই নারীকেই পুরুষের চেয়ে বেশি অবদান রাখতে হয় দুর্যোগ সামলাতে।
সামাজিকভাবে নারীকে দুর্যোগের সময় হেয় করাও হয়ে থাকে বেশি। ভাবছেন কীভাবে! আমি একটু মনে করিয়ে দেই। বিগত কয়েক বছরের মধ্যে একটি ভূমিকম্পের কারণ হিসেবে বহির্বিশ্বের একজন ধর্মীয় নেতা কয়েকজন নারীর পোশাকের কথা উল্লেখ করেছিলেন। সব সমাজেই এমন হয়ে থাকে তা বলছি না। কিন্তু পরোক্ষভাবে চিত্রটা এমনই। ত্রাণ প্রদানের সময়ও নারীর প্রয়োজন মাথায় রাখা হয় না। আপনি কি পারবেন দুর্যোগের সময় ত্রাণ হিসেবে বাংলাদেশের সমাজ ব্যবস্থায় স্যানিটারি প্যাড, ভ্যাজাইনাল ইনফেকশন ক্রিম, প্রয়োজনীয় ইনার গার্মেন্টস (বিশেষত পেনটি), পিল ইত্যাদি বিতরণ করতে! যতটা প্রয়োজন. ততটা পারবেন না। এর জন্য আপনাকে গোপনীয়তা রক্ষা করতে হবে। এখন কিছু কিছু দাতব্য প্রতিষ্ঠান সাহস করে কিছুটা বিতরণ করছে। কিন্তু সমাজের ব্যাকবাইটিং বেশি শুনবেন। দুর্যোগেও কেন নারীর পিরিয়ড, প্রজনন স্বাস্থ্য, ইনার গার্মেন্টস ইত্যাদি সুরক্ষা নিয়ে আদিখ্যেতা করতে হবে সমাজ এটাই চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখাতে চাইবে বারবার।সমাজের চোখে, পরিবারের চোখে দুর্যোগের সময় নারীর অধিকার, নারীর অবদান দৃশ্যমান হবে না।
দুর্যোগে নারীর অবদান আর অধিকার তখনই রক্ষিত হবে যখন সমাজ আর পরিবার বুঝতে পারবে যে দুর্যোগে সকল মানুষের সকল ধরনের ক্ষতি হয়, শুধু পুরুষের আর্থসামাজিক ক্ষতি নয়। দুর্যোগে যেমন ছেলে সন্তানের দুধের বোতলের প্রয়োজন, তেমনি মেয়ের হাইজিনের জন্য প্যাড প্রয়োজন। দুর্যোগের সময়ে পুরুষ হিসেবে আপনার যেমন খাওয়া প্রয়োজন, ঠিক তেমনই আপনার নারী সঙ্গীর খাওয়া এবং বিশ্রাম প্রয়োজন। নারীর অবদানের মূল্যায়ন হউক সমানভাবে। নারীর অধিকার নিশ্চিত হউক যে কোন পরিস্থিতিতে।
[ফেমিনিস্ট ফ্যাক্টরে প্রকাশিত মুক্তমত লেখকের নিজস্ব বক্তব্য]