November 2, 2024
অনুবাদফিচার ১সাহিত্যফিচার ৩বই নিয়ে আলাপ

পর্ব-২৫ (অন্তিম): সমকামী নারীর জীবন এবং গর্ভপাতের বৈধতা-অবৈধতা

শিল্প সমালোচক, লেখক শার্লট মালিন্সের A Little Feminist History of Art বইটি বাংলায় অনুবাদ করছেন বিশিষ্ট অনুবাদক, শিক্ষক জি এইচ হাবীব। বইটির অনুবাদ ধারাবাহিকভাবে প্রকাশ হচ্ছে ফেমিনিস্ট ফ্যাক্টরে। আজ পড়ুন এর ২৫তম ও অন্তিম পর্ব। সব পাঠকের সুবিধার জন্য প্রতি পর্বের শুরুতে বইটির এবং লেখক শার্লট মালিন্সের সংক্ষিপ্ত পরিচিতি রয়েছে।।

[নারীবাদী শিল্প আন্দোলনের শুরু ১৯৬০-এর দশকের শেষের দিকে। পুরুষ প্রাধান্যবিশিষ্ট রঙ্গমঞ্চে প্রতিযোগিতায় অবতীর্ণ হওয়ার জন্যে সে সময় নারী শিল্পীরা তাঁদের কাজগুলোর জেন্ডারচ্যুতি ঘটাবার সংগ্রামে নামেন। এরপর থেকে সেই আন্দোলন শিল্প জগতে গোটা বিশ্বজুড়ে অন্যতম প্রধান ভূমিকা পালন ক’রে আসছে। ‘নন্দনতাত্ত্বিক ফরমালিযম’ ব’লে অভিহিত যুগের পর সামাজিকভাবে প্রাসঙ্গিক নানান ইস্যুতে কথা বলার জন্য ‘নারীদৃষ্টি’-র সাহায্যে নারী শিল্পীরা বিভিন্ন মাধ্যমে কাজ ক’রে জেন্ডার, পরিচয় এবং ফর্মের দিকে সবার দৃষ্টি আকর্ষণ করতে চেয়েছেন, সমালোচনা করেছেন সাংস্কৃতিক প্রত্যাশাগুলোকে এবং নারীকে সনাতনী দৈনন্দিন ধারণায় আটকে ফেলার ব্যাপারটিকে। সমাজের দৃষ্টি ঘোরাতে চেয়েছেন সাম্যের জন্যে নারীর সংগ্রাম এবং নারীদেহকে পণ্য হিসেবে দেখবার মানসিকতা ও ক্রিয়াকর্মের দিকে। “অল্প কথায় নারীবাদী শিল্প-ইতিহাস” (A Little Feminist History of Art) নামের ছোট্ট বইটিকে এই আন্দোলনের ফসল হিসেবে জাত অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ কিছু শিল্পকর্মের সংক্ষিপ্ত কিন্তু সারগর্ভ ভূমিকা বলা যেতে পারে। ১৯৬০-এর দশক থেকে বর্তমান কাল অব্দি পঞ্চাশটি অসামান্য কাজ নারীর জীবন ও অভিজ্ঞতাকে তুলে ধরেছে। সেই সঙ্গে, ভিয্যুয়াল সংস্কৃতির ওপর নারীবাদী আদর্শ ও রাজনীতি যে প্রভাব ফেলেছে সেটাও এই কাজগুলো মেলে ধরেছে। “অল্প কথায় নারীবাদী শিল্প-ইতিহাস” নামের এই গ্রন্থটি জেন্ডার বৈষম্য, যৌনতা, গার্হস্থ্য জীবন, ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা আর নারী দেহের মতো বিষয়গুলো খতিয়ে দেখা বিংশ শতকের সবচাইতে উচ্চাকাঙ্ক্ষী, প্রভাবশালী ও টেকসই শৈল্পিক আন্দোলনগুলোর একটির আনন্দ উদযাপন। 

শার্লট মালিন্স একজন শিল্প সমালোচক, লেখক এবং সম্প্রচারক। তিনি রেচল হোয়াইরিড, সেসিলি ব্রাউন, র‌্যাচেল লামসডেন,  জেনি স্যাভিল, ক্যাথে ডে মনসাউক্স, স্যু অ্যারোস্মিদ, সুজ্যান কুন, স্যুযি হ্যামিলটন এবং পলা রেগোসহ বিভিন্ন নারী শিল্পীকে নিয়ে লেখালেখি করেছেন। তাঁর রচিত ও প্রকাশিত বিভিন্ন গ্রন্থের মধ্যে রয়েছে “লাইভ্স অভ দ্য গ্রেট আর্টিস্টস” (২০০৮) এবং “র‌্যাচেল হোয়াইহেড” (২০০৭)। তিনি বিবিসি রেডিও ফোর-এর “ফ্রন্ট রো” এবং “স্যাটারডে রিভিউ’’-র নিয়মিত প্রদায়ক]

শার্লট প্রজার (Charlotte Prodger)

(জন্ম ১৯৭৪)

সোফার ওপর একজোড়া পা রাখা, এই দৃশ্য দিয়ে একটি অন্ধকার ঘরে একটি চলচ্চিত্র শুরু হয়। পা দুটো শার্লট প্রজার-এর। পা দুটোর ফ্রেম-বন্দি অবস্থা ধীরে ধীরে ওপরে নীচে যায় এবং সেটাকে তিনি তাঁর আইফোনে ধারণ করতে থাকেন। এই দৃষ্টিকোণ থেকে আমরা যেন তাঁর ভেতরে অবস্থান করছি, এবং তাঁর দুই চোখ ও শ্বাস-প্রশ্বাস আমাদের স্থিরদৃষ্টিকে নিয়ন্ত্রণ করছে। তাঁর ভাষায়, “দেহের  পরিচালনা পদ্ধতিগুলো ক্যামেরার সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে গেছে। এটা এক ধরনের অনোন্যজীবিতা- পারস্পরিক নির্ভরতার মধ্যে দিয়ে দুটি সত্তার জীবনযাপন, বা এক ধরনের আঁকড়ে ধরা। ব্যাপারটা আমার ভাল লাগে।”

প্রজারের এই ৩২ মিনিটের চলচ্চিত্র BRIDGIT-এর  পুরোটাই আইফোনে তোলা, এবং এটি তাঁকে ২০১৮ সালে টার্নার প্রাইজ এনে দেয়। ফুটেজগুলো গ্লাসগোতে তাঁর ফ্ল্যাট, বাত্যাতাড়িত স্কটিশ সমুদ্র, এবং উচ্চভূমির (Highlands)। চলচ্চিত্রটির নাম রাখা হয়েছে নব্যপ্রস্তর যুগের এক দেবীর নামে। স্থান এবং কালভেদে তাঁর পরিচয় বদলে গেছে বার বার। একজন সমকামী নারী হিসেবে জীবনকে নিজে খতিয়ে দেখার ক্ষেত্রে এই নামটি বা এই দেবী প্রজারের জন্যে একটি লেইটমোটিফ।

BRIDGIT একান্তভাবেই একটি ব্যক্তিগত চলচ্চিত্র; অদ্ভুত, উদ্ভট ইতিহাসের সঙ্গে সত্তা বিষয়ে প্রজারের নিজের বোধটির সম্পৃক্ততা ভালো ক’রে দেখতে চেয়েছে এই ছবিটি। এটার বর্ণনাভঙ্গিটি ছাড়া ছাড়া; প্রজারের অনুভূতিগুলো সম্পর্কে তা অসংখ্য অন্তদৃষ্টি তুলে ধরে। তাঁর কথায় এটি “প্রভাব বা অগ্রসরমানতার সরল ইতিহাসের খতিয়ান ততটা নয়, যতটা এগুলোকে একটির পাশে আরেকটিকে ধরে রাখা।”

 

 

শিল্পকর্ম পরিচিতি:

BRIDGIT ২০১৬

সিঙ্গেল-চ্যানেল এইচডি ভিডিও

৩২ মিনিট

 

পলা রেগো (Paula Rego)

(জন্ম ১৯৩৫)

ধাতব একটা বিছানায় ডোরাকাটা পোশাক-পরা এক নারী একদিকে কাত হয়ে কুঁকড়ে মুকড়ে শুয়ে আছেন। তাঁর চোখ খোলা, হাত মুষ্টিবদ্ধ। তিনি অন্য দুজনকে দেখতে পারছেন না যাঁরা একই ধরনের পরিসর অধিকার ক’রে আছেন : চোস্ত পোশাক-আশাক পরিহিত একজন একটি বিছানায় শুয়ে আছেন, তাঁর পা দুটো ছড়ানো, দুই বাহু টান টান ক’রে পা দুটো ধরে আছে, বা, এক স্কুল ছাত্রী একটা বালতির ওপর পা ছড়িয়ে ব’সে আছে। এই তিনে মিলেই তৈরি হয়েছে  Triptych- গর্ভপাত বৈধ করা হবে কিনা তা নিয়ে পর্তুগালে ১৯৯৮ সালে যে-গণভোটের আয়োজন করা হয় সেই ঘটনার প্রতিক্রিয়াস্বরূপ পলা রেগো যে-সমস্ত  শিল্পকর্ম সৃষ্টি করেছিলেন তার একটি অংশ। বেশি লোক ভোট দিতে আসেনি, এবং গর্ভপাত (২০১৭ সাল অব্দি) অবৈধ-ই রয়ে যায় ।

পর্তুগালেই বেড়ে-ওঠা রেগো ক্রোধে জ্বলে ওঠেন। তাৎক্ষণিকভাবে তিনি একটি সিরিয তৈরি করতে লেগে পড়েন, যে-সিরিযে বিকল্পটিকে একেবারে সরাসরিভাবে উপস্থাপন করা হয়, আর তা হচ্ছে:  অবৈধ গর্ভপাত। পলা রেগো ১৯৭৬ সাল থেকে লন্ডনে বাস করছেন, কিন্তু জন্মভূমির এই ঔদাসীন্য তাঁকে ক্রুদ্ধ ক’রে তুলেছিল। তিনি বলেন, “আমার মনে হয়েছিল এটা হতে পারে না, ব্যাপারটা যে-কাউকে ভীষণ প্রচণ্ড ক্রুদ্ধ করার কথা। এ-ব্যাপারে আমি কিছু করতে চেয়েছিলাম, তাই আমি গর্ভপাতরত অবস্থার এই মেয়েদের ছবি এঁকেছিলাম।”

রেগোর নারীরা যন্ত্রণাবিদ্ধ ঠিকই, কিন্তু তাঁরা শিকার নন। দৃঢ়বদ্ধ ঠোঁট আর নিষ্পলক চোখে তাঁরা দর্শকের দিকে তাকান। তাঁরা জানেন তাঁরা কী করছেন, এবং কেন করছেন। কাজগুলো তাঁরা তাঁদের পছন্দ বা ইচ্ছা অনুযায়ীই করছেন। গর্ভবতী হতে দু’জনের দরকার হয়, কিন্তু গর্ভপাত করা হলে কেবল নারীকেই সবসময় যন্ত্রণা ভোগ করতে হয়- মানসিক এবং শারীরিক।

 

 

 

শিল্পকর্ম পরিচিতি:

Triptych ১৯৯৮

কাগজে প্যাস্টেল; অ্যালুমিনিয়ামের ওপর বসানো

(প্রতিটি) ১১০ X ১১০

সমাপ্ত

 

পর্ব-১: শিরীন নিশাত ও যারিনা হাশমি- দ্রোহ আর স্মৃতিকাতরতা

পর্ব-২: মহাজাগতিক সৃজনকারী শক্তি ও নারীর স্বরূপে ফেরা

পর্ব-৩: শিল্পের নতুন বিষয় ও শিল্পীর শরীর

পর্ব-৪: শ্রম বৈষম্য এবং সন্তান পালনের দলিল

পর্ব-৫: নারীর প্রতীকী ইতিহাস এবং শিল্পকর্ম হিসেবে দেহ

পর্ব-৬: দেহ ভাস্কর্য ও চিরন্তন মাতৃসত্তার বিরুদ্ধচিত্র

পর্ব-৭: গার্হস্থ্য জীবন আর অন-স্ক্রীন নারীত্বের স্বরূপ উন্মোচন

পর্ব-৮: দেহাস্ত্র এবং অনিরপেক্ষ প্রতিচ্ছবি

পর্ব-৯: বোধ স্বতন্ত্র এবং ফিউশন অস্বস্তিকর

পর্ব-১০ নির্যাতন নিরন্তর ও পিতৃতান্ত্রিক বিশ্বে নারী হওয়ার জটিলতা

পর্ব-১১: ব্যক্তিগত ক্ষমতায়ন এবং কৃষ্ণাঙ্গ নারী সমকামীর অভিজ্ঞতা

পর্ব-১২: পেশল বাস্তবতা আর পূর্বকল্পিত জেন্ডার বিষয়ক মতামত

পর্ব-১৩: সঙ্গীতের মহাফেজখানা আর ঐতিহাসিক পেইন্টিং-এর ভিন্ন বয়ান

পর্ব-১৪: সাদা কার্ড বাদামি কার্ড আর নারীর চোখে নারী

পর্ব-১৫: দৈনন্দিনের একঘেয়েমি আর শিল্পে গেরিলাযুদ্ধ

পর্ব-১৬: আশ্রয়স্থল কিংবা কারাগার আর ফিমেল আর্টের অনুসন্ধান

পর্ব-১৭: নারীর দেহভাষা আর পুরুষের প্রত্যাশার বিরুদ্ধাচারণ

পর্ব-১৮: পরিচয় পুনরুদ্ধার এবং ইতিহাসে স্থান পুনর্দখল

পর্ব-১৯: সহজাত প্রবৃত্তিভিত্তিক শিল্প আর শিশু ও মাতার ভিন্ন যাত্রা

পর্ব-২০: দানবীয়তায় ঝোঁক আর মিথ্যে দিয়ে নিজেকে পুনরাবিষ্কার

পর্ব-২১: জেন্ডার ভিন্নতা ও নারীবাদের মূল্য পরীক্ষা

পর্ব-২২: প্রকল্প সমবায়ী এবং শারীরিক অনুভূতির শিল্পরূপ

পর্ব-২৩: নারী অধিকারের মানে এবং ‘দ্য আদার সাইড’

পর্ব-২৪: নারী অবমাননার প্রত্যুত্তর এবং কনয্যুমার ক্যাপিটালিযমের সমালোচনা